“সিন্ধুর সাত সতী গিয়েছিলো হারিয়ে,
জেগে রইলো শুধু নিঃশব্দ প্রাচীন ইট— একটি স্থানীয় কবিতার অনুবাদ।”
নারীরা সমাজের ক্ষমতায় থাকবে এমন দৃশ্য এখনো অকল্পনীয় লাগলেও এটা জেনে আপনি অবাক হবেন যে, ধারনা করা হয় মহেঞ্জোদারোর সাতজন ক্ষমতাশীল নারী ছিলেন যারা সে সময়ে সমাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন এবং তাদের বলা হয় মহেঞ্জোদারো ‘সাত সতী’।
মহেঞ্জোদারো, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর, যা আজও একটি রহস্যময় স্থান হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে আছে। বিশেষত,”সাত সতী” নামে পরিচিত নারীদের কাহিনি মহেঞ্জোদারোর প্রাচীন ইতিহাসে এক অমোঘ আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে।
এই নারীরা কি শুধুই একটি কিংবদন্তি, নাকি তাঁদের জীবনও সত্যিই রহস্যে আবৃত ছিল?
মহেঞ্জোদারো সাত সতী আসলে কারা?
মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া একটি প্রাচীন সিলমোহরের উপর খোদাই করা সাতজন নারীর চিত্র মূলত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের কৌতূহলের কারণ হয়েছে। এই চিত্রটি প্রাচীন ভারতের “সপ্তমাতৃকা” বা সাত মাতৃকা দেবীর ধারণার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, যা বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সাত সতী নামে কোনো ঐতিহাসিক নারী চরিত্রের প্রমাণ পাওয়া যায় না মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতত্ত্বে।
তবে এই কাহিনি গড়ে উঠেছে লোককথা, প্রতীকী ব্যাখ্যা ও প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তিগুলোর উপর ভিত্তি করে। মনে করা হয়, মহেঞ্জোদারোর নারী-মূর্তিগুলোকে ‘সপ্তমাতৃকা’র ধারনার সঙ্গে যুক্ত করে “সাত সতী” নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দু পুরাণে সপ্তমাতৃকা বলতে সাত দেবীমূর্তিকে বোঝায় যারা যুদ্ধ ও রক্ষার প্রতীক।
মহেঞ্জোদারোতে বহু নারী-আকৃতির টেরাকোটা মূর্তি পাওয়া গেছে, যেগুলোর মধ্যে কিছু ছিল পরিপূর্ণ অলঙ্কারে কিছু অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিত্র। গবেষকরা অনেকেই মনে করেন, এগুলো ছিল উর্বরতা, মাতৃত্ব এবং দেবী উপাসনার প্রতীক। লোককাহিনিতে এদেরই রূপান্তর ঘটেছে “সাত সতী” হিসেবে।
আবার কিছু লোককথায় পাওয়া গিয়েছে, মহেঞ্জোদারো ধ্বংসের আগে, এই সাত নারী কখনও শহর ছাড়েননি। তারা হয়তো পুরোহিত, যাজিকা, অথবা সাধারণ নারী হতে পারে, যারা শহরের প্রতি আস্থা রেখে শেষ পর্যন্ত থেকে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এঁদেরকে “সতী” বলে মনে করা হয়, যার অর্থ দাঁড়ায় সত্ চরিত্র ও আত্মবলিদানের প্রতীক।
মহেঞ্জোদারোর নারীদের জীবন
প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় মহেঞ্জোদারো ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর, যা প্রায় ৪৫০০-৫০০০ বছর পূর্বে গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তার উন্নত নগর পরিকল্পনা, জল ব্যবস্থাপনা, এবং শিল্পকলা। মহেঞ্জোদারোতে বসবাসকারী নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান ছিল তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। তারা শুধু ঘরকন্নার দায়িত্ব পালন করতেন না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্বও দিতেন।
তবে, প্রাচীন সভ্যতার নারীদের সম্পর্কে সরাসরি কোনো লিখিত দলিল না থাকার কারণে, তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকটাই প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং আধুনিক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে।
যেহেতু ইন্দুস লিপি এখনও পুরোপুরি পাঠোদ্ধার হয়নি, তাই আমরা আসলে জানি না নারীদের আসল অবস্থান কী ছিল। এই শূন্যতা থেকেই সাত সতী এক ধরনের প্রতীকী প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে, নারী শক্তির, নীরব সাহসের, আর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের।
প্রাচীন সভ্যতায় সাত সতীর গুরুত্ব
“সাত সতী” শব্দটি সাধারণত সাত মহিলার একটি গোষ্ঠী বা সংগঠনকে বোঝায়, যারা বিশেষ ধরনের প্রতীকী বা ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করতেন। এরা হয়তো সমাজের নির্দিষ্ট অংশে বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন, তবে তাঁদের ভূমিকা কী ছিল তা সম্পর্কে খুব বেশি নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে, মন্দিরের বা ধর্মীয় স্থাপত্যের মাঝে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব কিছু বিশেষ অক্ষর বা মূর্তির মাধ্যমে দেখা যায়, যা তাঁদের শক্তিশালী ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়।
সিন্ধ অঞ্চলের সুফি কবি শাহ আবদুল লতিফ (১৬৭০–১৭৫২ খ্রি.) তাঁর “শাহ জো রিসালো” নামক কবিতাসংগ্রহে সাতজন নারীর কাহিনি সংরক্ষণ করেছেন। এই নারীরা ছিলেন সাহসী ও আত্মত্যাগী, যাঁরা প্রেম, ন্যায় ও আত্মসম্মানের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁদের গল্পগুলি স্থানীয় লোককাহিনি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মিশে গিয়ে একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে।
প্রবন্ধে এটাও বলা হয়েছে যে, শাহ আবদুল লতিফের লোককবিতায় যে সাতজন নারীর গল্প বলা হয়েছে, তাঁরা কেবল কল্পিত চরিত্র নন, বরং ঐতিহাসিক ও সামাজিকভাবে সম্ভবত বাস্তব চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। এই নারীরা প্রেম, আত্মসম্মান এবং স্বাধীনতার জন্য সমাজের রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
এই সাত নারীর চিত্র ও কাহিনি মহেঞ্জোদারোর সিলমোহরে খোদাই করা চিত্রের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা প্রাচীন সভ্যতার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের প্রতিফলন হতে পারে। এখান থেকে এটা প্রমাণ হতে পারে যে নারীদের সাহস ও আত্মত্যাগ প্রাচীন ভারতীয় সমাজে গভীরভাবে মূল্যায়িত হতো এবং তাঁদের কাহিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়েছে।
মহেঞ্জোদারোর নারীরা কেন রহস্যময়?
মহেঞ্জোদারোর নারীদের জীবনযাত্রা এবং তাঁদের ভূমিকা নিয়ে রয়েছে একাধিক রহস্য। কিছু বিশেষ মূর্তি এবং নিদর্শন থেকে ধারণা করা হয় যে, মহেঞ্জোদারোতে নারীদের জীবন একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ধারায় বাঁধা ছিল, যা আজও আমাদের কাছে অজানা।
একাধিক পুরানো মূর্তির মধ্যে, বিশেষ করে নারীদের মূর্তি, যেমন “নৃত্যরত নারীর মূর্তি” বা “ধর্মীয় প্রতিমা” আমাদের দেখায় যে, নারীরা সম্ভবত সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতেন।
সিন্ধু সভ্যতার নারী চরিত্র
সিন্ধু সভ্যতায় নারী চরিত্রকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। নারীরা সাধারণত পরিবারের মূল স্তম্ভ ছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিল। নারীদের পোশাক, অলংকার এবং তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতীকী দিকগুলি তাদের সমাজে বিশেষ অবস্থানকে নির্দেশ করে।
তবে, যেহেতু মহেঞ্জোদারোর জন্য সরাসরি কোন লিখিত দলিল পাওয়া যায়নি, সেহেতু তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নির্দিষ্ট করা কঠিন।
সাত সতীর কাহিনি মহেঞ্জোদারোতে কিভাবে জনপ্রিয় হলো?
সাত সতীর কাহিনি মহেঞ্জোদারোর ইতিহাসের অংশ হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রাচীন ইতিহাসবিদরা এবং আধুনিক গবেষকরা, বিশেষ করে সিল্ক রুটের ইতিহাসের ভিত্তিতে, এই কাহিনির উদ্ভব ও বিস্তারকে বিশ্লেষণ করেছেন।
তাদের মতে, “সাত সতী” নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় ও সামাজিক সত্তার প্রতিফলন ঘটানো হয়েছিল। কিছু গবেষক মনে করেন, এই সাত সতী হয়তো রাজকীয় বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশ ছিলেন, যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করতেন।
মহেঞ্জোদারোর সাত সতীর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ
এখন পর্যন্ত মহেঞ্জোদারোর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যক্রমে যেসব নারীদের মূর্তি বা শিল্পকর্ম পাওয়া গেছে, সেগুলি সাত সতীর কাহিনির সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একাধিক মূর্তির মধ্যে নারীর শক্তিশালী উপস্থিতি এবং নৃত্যরত অবস্থায় থাকা মূর্তিগুলি সেসব নারীদের ধর্মীয় বা সামাজিক প্রভাবকে ইঙ্গিত দেয়। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণগুলির মধ্যে কিছু বিশেষ মূর্তি এবং সিল্ক রুটের সঙ্গে সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলো সাত সতীর মিথের গভীরতা এবং তাঁদের স্থানকে আরও পরিষ্কার করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন নারী সংস্কৃতি
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন সময় থেকেই নারীদের সংস্কৃতি ও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। সিন্ধু সভ্যতা নারীদের অবস্থান এবং তাঁদের ধর্মীয় ও সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র ধারণা দেয়।
প্রাচীন ভারতের নারীরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিল্পকলা, এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেন। সেই সময়ের মহিলারা কেবল গৃহস্থালি কাজই করতেন না, বরং তাঁদের সামাজিক অবদানও অমূল্য ছিল।
সাত সতী কি সত্য নাকি কল্পনা?
সাত সতীর কাহিনি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন, এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, অন্যরা বলেন এটি শুধুই একটি কল্পনা। তবে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং মহেঞ্জোদারোর খননকাজের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, যা এই কাহিনির সত্যতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই যে, সাত সতীর কাহিনি কেবল একটি মিথ নয়, বরং সিন্ধু সভ্যতার নারীদের সামাজিক ও ধর্মীয় ভূমিকার একটি প্রতীক।
মহেঞ্জোদারোর সাত সতী আজও এক রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। প্রাচীন সভ্যতার নারীদের জীবন এবং তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন হলেও, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং গবেষণাগুলির মাধ্যমে আমরা কিছু মূল্যবান তথ্য পেতে সক্ষম হয়েছি। এই কাহিনির মধ্যে যে সমাজ, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে, তা আমাদের প্রাচীন ভারতের নারী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোকে এক নতুন আলোতে তুলে ধরেছে।