আজ যে আরবি লিপিতে লেখা হয় কুরআন, সাহিত্য, ইতিহাস – তার গোড়ায় লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন ও ভুলে যাওয়া সভ্যতার ছাপ ‘নাবাতিয়ান’! তাদের লিখনই আজকের আরবি লিপির জন্মদাতা, যেখান থেকে শুরু হয় ভাষার অসাধারণ যাত্রা।
মরুভূমির বুকে গড়ে ওঠা নাবাতিয়ান সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। তারা বাণিজ্য, শিল্প ও ধর্মকে একসঙ্গে মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। তাদের রাজধানী পেট্রা ছিল আরব, মিশর, সিরিয়া ও গ্রীসের মতো বৃহৎ অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় স্থান। নাবাতিয়ানরা পেট্রার পাথুরে শহরকে কেবল বাণিজ্যের কেন্দ্রই করেনি, বরং নিজেদের একটি অনন্য লিখন পদ্ধতিও তৈরি করেছিল, যা পরবর্তীতে আধুনিক আরবি লিপির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নাবাতিয়ান রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, খ্রিস্টীয় ১০৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বিলীন হলেও, তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে তাদের লিখন ব্যবস্থা আজকের আরবি বর্ণমালার সরাসরি পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।
নাবাতিয়ান লিপি: উৎপত্তি ও ইতিহাস
নাবাতিয়ান লিপি ছিল প্রাচীন বিশ্বের এক বিস্ময়কর লিখন ব্যবস্থা। একসময়ে এ লিপি বাণিজ্য, প্রশাসন ও ধর্মীয় চর্চার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রায় ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাবাতিয়ান রাজ্যে একটি বিশেষ ব্যবস্থা বা সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। সেই সময়ে নাবাতিয়ানরা বর্তমান জর্ডান, দক্ষিণ সিরিয়া, উত্তর সৌদি আরব এবং সিনাই উপদ্বীপের বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাস করত। এই জনগোষ্ঠী কেবল ভূগোলগতভাবেই নয়, বরং বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও পুরো অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
তাদের সমাজ ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহুভাষিক। ফলে ভাষা ও লিপির ব্যবহার প্রসঙ্গভেদে ভিন্ন ছিল। প্রাত্যহিক জীবনে তারা একটি প্রাচীন আরবি উপভাষায় কথা বললেও, সরকারি দলিল, বাণিজ্যিক চুক্তি কিংবা ধর্মীয় লেখালেখিতে আরামাইক লিপিই ছিল মূল মাধ্যম।
এখন প্রশ্ন আসে, এই লিপির শিকড় কোথায়? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের আরও পিছনে ফিরতে হবে। নাবাতিয়ান লিপির মূল উৎপত্তি আরামাইক লিপি থেকে, আর সেই আরামাইক লিপি আবার উদ্ভূত হয়েছিল ফিনিশীয় বর্ণমালা থেকে। ফিনিশীয়রা, খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ শতাব্দীতে, প্রোটো-ক্যানানাইট লিপির ভিত্তিতে একটি বর্ণমালা গড়ে তোলে। যেটি ছিল উত্তর-পশ্চিম সেমিটিক ভাষাগুলোর লিখন মাধ্যম। বাণিজ্য ও সামুদ্রিক অভিযানের কল্যাণে এই ফিনিশীয় লিপি দ্রুত সারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে গ্রিক, ল্যাটিন ও অন্যান্য পশ্চিমা বর্ণমালার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
এই ধারাবাহিকতায়, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১০০০ সালে আরামিয়ানরা ফার্টাইল ক্রিসেন্ট অঞ্চলে যে ভাষায় কথা বলত, তা-ই ছিল আরামাইক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষা শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে একীভূত হয়ে বিস্তৃত সাম্রাজ্যগুলোর প্রশাসনিক ভাষায় পরিণত হয়। বিশেষ করে নব্য-অ্যাসিরিয়ান, নব্য-ব্যাবিলনীয় এবং পারস্যের আকেমেনিড সাম্রাজ্যের অধীনে আরামাইক ভাষা ‘ইম্পেরিয়াল আরামাইক’ নামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। পারস্য সম্রাট প্রথম দারিয়ুস এ ভাষাকে সরকারিভাবে গ্রহণ করেন, যার ফলে এটি বাণিজ্য, প্রশাসন, আইন এবং ধর্মীয় কাজে একটি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা হয়ে ওঠে।
এই ইম্পেরিয়াল আরামাইকের প্রভাব তখন শুধু লেভান্ট বা মেসোপটেমিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তা ছড়িয়ে পড়ে জর্ডান, আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশ ও সিনাই উপদ্বীপেও। এই প্রভাবের ধারাবাহিকতায়ই আরামাইক লিপির একটি বিশেষ পরিবর্তিত রূপ হিসেবে জন্ম নেয় নাবাতিয়ান লিপি।
নাবাতিয়ান লিপি ছিল একধরনের “আবজাদ” লিপি, অর্থাৎ এতে কেবল ব্যঞ্জনধ্বনিগুলো লেখা হতো।স্বরধ্বনির জন্য এতে কোনো নির্দিষ্ট বর্ণ ছিল না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাঠের সুবিধার্থে এতে কিছু স্বরচিহ্ন বা ডায়াক্রিটিক যুক্ত হয়। যেগুলো ধ্বনিগত পার্থক্য বোঝাতে সহায়ক ছিল।
নাবাতিয়ান লিপির বিশেষত্ব এখানেই শেষ নয়। এটি ধীরে ধীরে এমন এক রূপ ধারণ করে, যেখানে অক্ষরগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেত। এই ধরণকে বলা হয় “কার্সিভ” বা সংযুক্ত অক্ষরশৈলী। এই সংযুক্ত লেখার ধারা পরবর্তী সময়ে আধুনিক আরবি লিপির ভিত্তি স্থাপন করে। যদিও নাবাতিয়ান লিপিতে ২২টি বর্ণ ছিল, তবুও আরবি ভাষার ২৮টি ধ্বনিকে প্রকাশ করতে তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে, আরবি লিপিতে পরবর্তীতে নতুন বর্ণের সৃষ্টি হয়।
প্রথম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে দক্ষিণ জর্ডান, দামেস্ক, ফিলিস্তিন ও সিনাই অঞ্চলে এই লিপির ব্যবহার ছিল ব্যাপক। তবে, যখন রোমানরা এই অঞ্চল দখল করে, তখন পেট্রার মতো শহরে নাবাতিয়ান লিপির ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। তবুও হাওরান অঞ্চলে এটি আরও কিছুদিন টিকে ছিল। অবশেষে, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে এই লিপি ধীরে ধীরে আরবি লিপিতে রূপান্তরিত হয়।
সপ্তম শতাব্দীতে এসে ইসলাম প্রচারের সময় আরবি লিপি তার পূর্ণাঙ্গ ও শাস্ত্রীয় রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল সেই প্রাচীন নাবাতিয়ান লিপিই।
নাবাতিয়ান থেকে আরবি লিপির বিবর্তনের প্রক্রিয়া
নাবাতিয়ান লিপি ২২টি ধ্বনির জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল, যেখানে আরবি ভাষায় ২৮টি ধ্বনি রয়েছে। ফলে, একই অক্ষর দিয়ে দুটি ভিন্ন ধ্বনি লেখা হতো। এটি মূলত একটি সমঝোতার প্রক্রিয়া ছিল। সময়ের সাথে সাথে অক্ষরের আকার শব্দের মধ্যে অবস্থানের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, একই শিলালিপিতে একই অক্ষরের ক্লাসিক এবং কার্সিভ রূপ পাশাপাশি দেখা যায়।
৭ম শতাব্দীতে আরবি বর্ণমালা তার ক্লাসিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। নাবাতিয়ান লিপির কার্সিভ রূপ এবং লিগেচারের ব্যবহার আরবি লিপির সংযুক্ত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি তৈরি করে। উত্তর-পশ্চিম আরব ও সিনাই অঞ্চলে পাওয়া শিলালিপিগুলো এই রূপান্তরের প্রমাণ দেয়।
নাবাতিয়ান ভাষা ও আরবির সম্পর্ক
নাবাতিয়ান ভাষা ছিল একটি পশ্চিমী সেমিটিক ভাষা, এবং এটি মূলত আরামাইকের একটি উপভাষা। এই উপভাষাটি আরবি ভাষার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত ছিল, যার ফলে ভাষাগত আদান-প্রদান ও প্রভাব সহজতর হয়। নাবাতিয়ান লিপি আরামাইক বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে তৈরি, এবং এতে ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। তবে, আরবি ভাষায় যেহেতু ২৮টি ব্যঞ্জনবর্ণ রয়েছে, তাই নাবাতিয়ান লিপি ব্যবহার করে আরবি লিখতে গিয়ে কিছু অক্ষর পলিভ্যালেন্ট হয়ে উঠত। অর্থাৎ, একটি অক্ষর একাধিক ধ্বনি প্রকাশ করত।
উদাহরণস্বরূপ, জিম অক্ষরটি [ǧ], [ḥ], বা [ẖ] ধ্বনি প্রতিনিধিত্ব করতে পারত। এই পলিভ্যালেন্সের ফলে, আরবি লিপির প্রাথমিক রূপে পঠন জটিল হয়ে পড়ে। তবে, নাবাতিয়ান ভাষা ও লিপির মাধ্যমেই আরবি ভাষার প্রাথমিক রূপের বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীতে আরবি লিপির প্রমিতকরণের দিকে নিয়ে যায়।
এই কারণে, আরবি লিপির পূর্বসূরি হিসেবে নাবাতিয়ান লিপিকে প্রধানত বিবেচনা করা হয়। তবে, এতে সিরিয়াক লিপির প্রভাবও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয়। নাবাতিয়ান লিপির ২২-অক্ষরের বর্ণমালা আরবি ভাষার ২৮টি ব্যঞ্জনবর্ণের জন্য পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়, যা প্রাথমিক আরবি লিপিতে পলিভ্যালেন্স সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে, সিরিয়াক লিপি এসেছে আরামাইক লিপি থেকে এবং এটি ছিল হাতের লেখার মতো বাঁকা ও সংযুক্ত (কার্সিভ) ধরনের। এই লিপি আরবি লিপির অক্ষরগুলোর আকৃতি ও সংযোগের ধরনে বেশ প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরিয়াক লিপির আটটি অক্ষর যেমন আলাফ, দালাত, রিশ—শুধু ডান পাশে অন্য অক্ষরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। একই রকমভাবে, আরবি লিপির পাঁচটি অক্ষর- আলেফ, দাল, রে, জায়ন এবং ওয়াও- শুধু ডান পাশে সংযুক্ত হয়।
এই সাদৃশ্য স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, আরবি লিপি যদিও নাবাতিয়ান বর্ণমালার ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে, তবুও সিরিয়াকের স্টাইলিস্টিক বৈশিষ্ট্য এর চূড়ান্ত রূপ ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
প্রাচীন আরব লিপির উৎস
প্রাচীন আরব লিপির উৎস নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দুটি প্রধান মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। একদিকে, একটি দল মনে করে যে আরবি লিপি মূলত নাবাতিয়ান লিপি থেকে উদ্ভূত, অন্যদিকে, আরেকটি দল সিরিয়াক লিপির প্রভাবের উপর গুরুত্ব আরোপ করে।
এই বিতর্কের সূচনা ঘটে ১৮৬৫ সালে, যখন জার্মান পণ্ডিত টি. নোলডেকে প্রথম যুক্তি দেন যে আরবি লিপির উৎপত্তি নাবাতিয়ান লিপি থেকে হয়েছে। এর বিপরীতে, ১৯৬৬ সালে জে. স্টার্কি সিরিয়াক লিপির কাঠামোগত সাদৃশ্য তুলে ধরে তার প্রভাবের পক্ষে মত দেন।
পরবর্তী সময়ে, ১৯৯৩ সালে বি. গ্রুণ্ডলার তার গবেষণায় নাবাতিয়ান থেকে আরবি লিপিতে ধাপে ধাপে রূপান্তরের বিস্তৃত প্রত্নতাত্ত্বিক ও গ্রাফিক নিদর্শন উপস্থাপন করেন, যা নাবাতিয়ান উৎসের প্রমাণ জোরালো করে। তবে, তিনি পরবর্তীতে (২০০১) এই মতও প্রকাশ করেন যে সিরিয়াক ক্যালিগ্রাফি বা লিখনশৈলী আরবি লিপির গঠনে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছিল।
অন্যদিকে, ২০০০ সালে জে.এফ. হিলি দেখান যে আরবি লিপির অনেক অক্ষরের আকৃতি নাবাতিয়ান ও সিরিয়াক উভয়ের সাথেই সাদৃশ্যপূর্ণ, যদিও কিছু নির্দিষ্ট অক্ষর সরাসরি সিরিয়াক থেকে আসেনি বলেই তিনি মনে করেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ২০১৭ সালে এল. নেহমে “নেবাতিয়ো-আরবি” নামে একটি মধ্যবর্তী লিপির কথা উল্লেখ করেন, যা তিনি চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে নাবাতিয়ান ও আরবি লিপির মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রূপে কাজ করেছে বলে ব্যাখ্যা করেন।
এই সমস্ত গবেষণা ও মতামত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আরবি লিপির বিকাশ একটি সরলরেখায় ঘটেনি। বরং, এটি ছিল ধাপে ধাপে পরিবর্তন ও বহু উৎসের প্রভাবের ফল, যেখানে নাবাতিয়ান লিপি ছিল মূল ভিত্তি, এবং সিরিয়াক লিপি এর কাঠামো ও শৈলীতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।
নাবাতিয়ান ভাষা কীভাবে হারিয়ে গেল
নাবাতিয়ান ভাষার ইতিহাস একটি দীর্ঘ ও চমকপ্রদ যাত্রা। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ভাষাগত পরিবর্তনের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছে এ নাবাতিয়ান ভাষা ও লিপি । প্রায় ১০৬ খ্রিস্টাব্দে, যখন নাবাতিয়ান রাজ্য রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আসে, তখন এই ভাষা ও লিপির অবস্থান ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে শুরু করে। রোমান শাসন ব্যবস্থা এবং তাদের প্রশাসনিক চর্চায় গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার আধিপত্য বাড়তে থাকে। যা নাবাতিয়ান ভাষার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই সময়ে নাবাতিয়ানরা তাদের স্বতন্ত্র ভাষা ও লিপি থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশতে শুরু করে।
একই সঙ্গে, আরবি ভাষার ক্রমবর্ধমান উত্থান এবং এর সাথে জড়িত সাংস্কৃতিক প্রভাব নাবাতিয়ান ভাষার পরিসরকে আরও সংকীর্ণ করে দেয়। আরবি ভাষা তার বিস্তৃতি ও প্রভাবশালী অবস্থানের মাধ্যমে নাবাতিয়ান ভাষার ভূমিকা প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে।
মূলত চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে, নাবাতিয়ান লিপি আরবি লিপির প্রাথমিক রূপে ধাপে ধাপে রূপান্তরিত হতে থাকে। এই রূপান্তর কেবলমাত্র লিপির আকার-আকৃতির পরিবর্তন নয়, বরং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক এক বিশাল পরিবর্তনের প্রতিফলন। নাবাতিয়ান ভাষাও অন্যান্য প্রভাবশালী ভাষা যেমন আরবি ও সিরিয়াকের সঙ্গে মিশে একটি নতুন ভাষাগত মিলনস্থল তৈরি করে।
এরপর সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আগমন ও বিস্তারের সঙ্গে, আরবি ভাষা ও লিপি আরো প্রমিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় থেকে আরবি লিপি আধুনিক আরবির ভিত্তি গড়ে তোলে এবং এটি ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গেও বিশেষ গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে, নাবাতিয়ান ভাষা এবং লিপি ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় বিলীন হয়ে যায়, তবে এর প্রভাব আরবি ভাষা ও লিপির মধ্যে জীবন্ত থেকে যায়।
সুতরাং, নাবাতিয়ান ভাষা ও লিপির এই দীর্ঘ যাত্রাটি শুধুমাত্র একটি ভাষাগত পরিবর্তন ছিল না, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যা প্রাচীন আরবের ঐতিহ্যকে আধুনিক আরবির জন্মের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত করেছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই কিভাবে ভাষা ও লিপি সমাজের পরিবর্তন, বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা ও ধর্মীয় ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় এবং এক ভাষা অন্য ভাষার সঙ্গে মিশে নতুন রূপ নেয়।
নাবাতিয়ান লিপি আরবি লিপির একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বপুরুষ, কিন্তু একক উৎস বলা ঠিক হবে না। নাবাতিয়ান বর্ণমালা আরবি লিপির ভিত্তি দিলেও, সিরিয়াক লিপির লেখার স্টাইল এবং অক্ষর সংযোগের ধরন আরবি লিপির বিকাশে বড় ভূমিকা রেখেছে।