Image default
সভ্যতা

সুমেরীয় সভ্যতার পতন: পৃথিবীর প্রথম “স্টার্ট-আপ”

তারা ছিল পৃথিবীর প্রথম “স্টার্ট-আপ” সভ্যতা। তারা ছিল ইতিহাসের প্রথম লেখক, নির্মাতা ও আইনদাতা!!

মেসোপটেমিয়ার বুক চিরে গড়ে ওঠা সুমেরীয় সভ্যতা ছিল পৃথিবীর প্রথম মহান সভ্যতাগুলোর একটি। একদিন যাদের হাত ধরেই সূচনা হয়েছিল মানব সভ্যতার‌। যারা ছিল ইতিহাসের প্রথম লেখক, নির্মাতা ও আইনদাতা। যেই সুমেরীয় সভ্যতা একসময় পৃথিবীকে দিয়েছিল লেখা, আইন, নগর পরিকল্পনা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান।

আজ তারা মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এতো উন্নত একটি সভ্যতা কেন হারিয়ে গেল? কেমন করে এই প্রাচীন গৌরব বিলুপ্ত হয়ে গেল মরুভূমির ধুলোয়?

চলুন এক নজরে দেখে নিই সেই পতনের পেছনে লুকিয়ে থাকা বাস্তবতা।

সুমেরীয় সভ্যতা 

সুমেরীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও প্রভাবশালী সভ্যতা। এটি মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। যা বর্তমানে ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকায় অবস্থিত। প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গড়ে ওঠা এই সভ্যতার যার উপর মানব সভ্যতার বহু ক্ষেত্র যেমন লেখা-পড়া, প্রশাসন, ধর্ম, বিজ্ঞান ও নগর পরিকল্পনা বিকশিত হয়েছে। 

সুমেরীয় সভ্যতা

সুমেরীয়দের নগর রাষ্ট্র

সুমেরীয়রা গড়ে তোলে উর, উক, লাগাশ, কিশ ও উরুক এর মতো পৃথিবীর প্রথম শহরসমূহ। প্রতিটি শহর ছিল একটি স্বতন্ত্র নগর-রাষ্ট্র। যার ছিল নিজস্ব রাজা, সৈন্য ও দেবতা। শহরগুলোর কেন্দ্রস্থলে থাকত “জিগুরাত” নামের বিশাল মন্দির‌। যেখানে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

সমাজ ব্যবস্থা ও শ্রেণিবিন্যাস

সুমেরীয় সমাজ ছিল পিরামিড আকৃতির। যেখানে সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা অনুসারে মানুষদের শ্রেণিতে ভাগ করা হতো।তাদের সমাজ প্রধানত তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল।

উচ্চ শ্রেণি (ঈশ্বরপুত্র, রাজা ও পুরোহিত)

এই শ্রেণির লোকেরা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। রাজারা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হতো এবং পুরোহিতরা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করত। এমনকি তারা মন্দির নিয়ন্ত্রণ করত এবং ফসলের একটি বড় অংশ কররূপে পেত।

মধ্য শ্রেণি (কর্মচারী, ব্যবসায়ী, কারিগর)

এই শ্রেণির মানুষরা ছিল বণিক, লেখক (স্ক্রাইব), কারিগর, কৃষক, এবং সেনাবাহিনীর সদস্য। তারা সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলত।

নিম্ন শ্রেণি ও দাস

দাসরা ছিল সমাজের নিচু স্তরের মানুষ। অনেকেই যুদ্ধবন্দি, ঋণের বোঝায় জর্জরিত বা দাসপ্রথার মাধ্যমে নিম্নতর অবস্থানে ছিল। তাদের প্রধান কাজ ছিল কষ্টকর শ্রম, যেমন কৃষিকাজ, নির্মাণ, মন্দির পরিষ্কার ইত্যাদি।

ধর্ম ও দেবতা

সুমেরীয় সমাজ ছিল ধর্মকেন্দ্রিক।তারা বহু দেবতার উপাসক ছিল। তাদের প্রধান দেবতারা ছিলেন আনু (আকাশের দেবতা), এন্নিল (বায়ুর দেবতা), এনকি (জল ও জ্ঞান), ও ইনানা (ভালোবাসা ও যুদ্ধের দেবী)। তারা বিশ্বাস করত, দেবতারা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।

এই যুগান্তর সৃষ্টিকারী সভ্যতা শুধু নগর রাষ্ট্র নির্মাণ কিংবা ধর্মচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তারা পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর পথ দেখিয়ে গেছেন। চলুন তাদের কিছু অভিনব আবিষ্কার সম্পর্কে জেনে নিই।

সুমেরীয়দের আবিষ্কার 

আপনি জানলে অবাক হবেন যে আমরা আজকে যেই আধুনিক সভ্যতায় বসবাস করছি, এতো উন্নত জীবন যাপন করছি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে সুমেরীয়দের হাত ধরেই। তারা আমাদেরকে চাকা, আইন ও বিচার, লিপির ও সাহিত্য এমনকি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে ও পরিচিত করেছে। তাদের দেখানো পথ ধরেই আজকে আমারা আধুনিক। 

আইন ও বিচার ব্যবস্থা 

সুমেরীয়রা এক আদর্শ শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।যেখানে ছিল কঠোর আইন এবং নিয়ম। ‘হাম্মুরাবির কোড’ নামক বিশ্বের প্রথম আইন বইটি সেই সময়ে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।

এই বইটিতে সুমেরীয়দের সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জন্য সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের রূপরেখা ছিল। এমনকি চুরি করলে কী শাস্তি হবে, হত্যার বিচার কীভাবে হবে,সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদিও এই বইটিতে উল্লেখ ছিল। এই আইন বিষয়ক বইটি মানুষকে নিয়ম মেনে চলার এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের ভিত্তি দেয়।

লিপি ও সাহিত্য

সুমেরীয় সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল কিউনিফর্ম লিপির উদ্ভব। কিউনিফর্ম হলো বিশ্বের প্রথম লিখন পদ্ধতি। এই লিপি পাথরের ফলকে খোদাই করে লেখা হতো। 

প্রথম দিকে কিউনিফর্ম শস্য, গবাদিপশু, কর ও সম্পদের হিসাব রাখতে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে সাহিত্য, ধর্ম, আইন, চুক্তিপত্র ইত্যাদিতেও এই লিপির ব্যবহার শুরু হয়।

কিউনিফর্ম লিপি

সাহিত্য

সুমেরীয়দের সাহিত্য জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো “এপিক অব গিলগামেশ”। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম মহাকাব্য। যেখানে নায়ক গিলগামেশের মৃত্যু ও অমরত্বের অনুসন্ধানের কাহিনি রয়েছে। এটি ধর্ম, দার্শনিক চিন্তা এবং নৈতিক প্রশ্নে ভরপুর।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

তারা গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা, ও স্থাপত্যে অগ্রগামী ছিল। সুমেরীয়রা উন্নত গণিত জানত। তারা ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি তৈরি করেছিল। তাদের আবিষ্কৃত এই সংখ্যা পদ্ধতির  ফলে আজকের “৬০ সেকেন্ড = ১ মিনিট” এবং “৩৬০ ডিগ্রি বৃত্ত” ধারণা এসেছে। এমনকি তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানেও পারদর্শী ছিল। তারা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করত এবং বর্ষপঞ্জি তৈরি করত।

একটা সময় ছিল, যখন পৃথিবীর মানচিত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে জ্বলজ্বল করত সুমের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত উন্নত এক সভ্যতা কীভাবে ধ্বংস হলো?

এটা কি শুধুই প্রকৃতির খেয়াল, নাকি মানুষের নিজস্ব অহংকারই ছিল তাদের পতনের কারণ?

চলুন খুঁজে বের করি সুমেরীয় সভ্যতার ধ্বংসগাথা।

সুমেরীয় সভ্যতার পতনের রহস্য

সুমেরীয় সভ্যতার পতন কোনো একক ঘটনার ফল নয় বরং এটি ছিল এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ভিতরের ফাটল, বাইরের আঘাত আর প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা মিলেই এই মহৎ সভ্যতাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।

সুমেরীয় সভ্যতার অর্থনীতি মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক। সভ্যতাটি গড়ে উঠেছিল ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মাঝামাঝি অঞ্চলে। নদীর পলিমাটি ছিল অত্যন্ত উর্বর। ফলে কৃষিকাজে সুমেরীয়রা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে।

তবে দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত সেচের ফলে জমির লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে উৎপাদন কমতে থাকে। একে বলে “সালিনাইজেশন”।শস্য ফলাতে না পারায় খাদ্যাভাব শুরু হয়। ফলস্বরূপ,সমাজে অস্থিরতা দেখা দেয়।

সুমের ছিল বহু নগররাষ্ট্রের সমষ্টি। এদের প্রতিটি ছিল স্বতন্ত্র ও প্রভাবশালী। কিন্তু ক্ষমতার লোভ এবং একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত হতো। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব সামগ্রিকভাবে সভ্যতাকে দুর্বল করে তোলে। ফলে বাইরের আক্রমণকারীদের পক্ষে তাদের পরাজিত করা সহজ হয়ে পড়ে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত সুমেরীয় সভ্যতা

সুমেরীয়দের রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং সেনাবাহিনীর সীমিত শক্তির সুযোগ নিয়ে আশেপাশের গোত্র ও সভ্যতাগুলি হামলা চালায়। বিশেষত গুটিয়ানরা পাহাড়ি এলাকা থেকে এসে বহু শহর দখল করে নেয়। পরে আমোরাইটদের হাতে পড়ে সুমেরীয় ভূখণ্ডের অনেকটাই। এই বহিরাগত আগ্রাসন তাদের সংস্কৃতি ও শাসন কাঠামো ধ্বংস করে দেয়।

সুমেরীয় সমাজে রাজা ও পুরোহিতরা ছিল ঈশ্বরের প্রতিনিধি। প্রশাসন ও ধর্ম ছিল একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সময়ের সাথে এই কাঠামো স্থবির হয়ে পড়ে। নতুন উদ্ভাবনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে শাসকদের দূরত্ব বেড়ে যায়।ফলে অভ্যন্তরীণ সমর্থন কমে যায়।

সুমেরীয় সভ্যতার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল চিরস্থায়ী সম্পদহানি এবং অতিরিক্ত কর আদায়। পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থা এবং ভূমির অতিরিক্ত ব্যবহার ফলস্বরূপ কৃষির আয় কমে যায়। যা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরো খারাপ করে । 

সুমেরীয় সমাজে গভীর সামাজিক বৈষম্য ছিল। যেখানে শাসক ও ধর্মীয় নেতা একদিকে এবং কৃষক ও শ্রমিকরা অন্যদিকে বাস করতেন। এই বৈষম্য সুমেরীয় সভ্যতার মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল। সমাজের নিচু শ্রেণী একসময় আন্দোলনে যুক্ত হয়। যা পারিপার্শ্বিক অস্থিরতা তৈরি করেছিল এবং এটি শেষ পর্যন্ত সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।

যদিও সুমেরীয় সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়, তবু তাদের জ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি পরবর্তী সভ্যতাগুলির (যেমন আক্কাড, ব্যাবিলন) মধ্যে স্থান করে নেয়। কিউনিফর্ম লিপি, আইনব্যবস্থা, গণনা পদ্ধতি  সবই ছড়িয়ে পড়ে এবং নতুন সভ্যতার ভিত্তি গড়ে তোলে।

সুমেরীয় সভ্যতার পতন শুধুই ইতিহাস নয় বরং এটি একটি সতর্কবার্তা। আধুনিক সমাজও প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও প্রযুক্তির অবিবেচিত ব্যবহারের কারণে একই পথে হাঁটছে না তো? ইতিহাস আমাদের শেখায় প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি যতই উন্নত হোক, টেকসই ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো সভ্যতাই চিরস্থায়ী নয়।

রেফারেন্স:

Related posts

সাত সতীর ছায়ায় মহেঞ্জোদারো: এক রহস্যময় অধ্যায়ের উন্মোচন

অমানবিক ঠাণ্ডায় বেঁচে থাকা অদ্ভুত সম্প্রদায় ‘নেনেট’

যে খেলা মায়া সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো!

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More