তারা লিখেছিল, কিন্তু আমরা পড়তে পারি না।
তারা বার্তা রেখে গেছে, কিন্তু তা আমাদের কাছে অর্থহীন!!!
মনে করুন আপনি সময়ের স্রোতকে উল্টে দিয়ে চার হাজার বছর আগের এক বিস্ময়কর নগরীতে পৌঁছে গেছেন। একটা উন্নত সভ্যতা যেখানে আছে বিশাল নগর, উন্নত জলব্যবস্থা এবং সমৃদ্ধ শিল্প । কি ভাবছেন এটি কোনো আধুনিক নগরীতে পৌঁছে গেছেন? এটি কোন আধুনিক নগরী না এটি হলো ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন নগর সভ্যতা ইন্দুস ভ্যালি।
এই বিস্ময়কর ও উন্নত সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো তার ভাষা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে এত উন্নত একটি সভ্যতার ভাষার কোন স্পষ্ট রেকর্ড নেই। তাদের লিপি যেন এক “ক্রিপ্টোগ্রাফিক চ্যালেঞ্জ”, যা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি।
এ যেন এক নীরব কণ্ঠস্বর যা আজও আমাদের কাছে দুর্বোধ্য এক ধাঁধার মতো। কী ছিল সেই উন্নত সভ্যতা ভাষা? কেন আমরা তা বুঝতে পারি না? এটি কি কোনোদিন উন্মোচিত হবে?
চলুন, এই বিস্ময়কর রহস্যের গভীরে প্রবেশ করি।
ইন্দুস ভ্যালি সভ্যতা
ইন্দুস ভ্যালি সভ্যতা (Indus Valley Civilization) ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর ও উন্নত নগরসভ্যতা। সভ্যতাটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে ১৩০০ সালের মধ্যে প্রসার লাভ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে সভ্যতাটি স্বর্ণযুগে পৌঁছায়। বর্তমান পাকিস্তান, উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং আফগানিস্তানের কিছু অংশ জুড়ে এই সভ্যতাটি বিস্তৃত ছিল।
ইন্দুস সভ্যতার দুটি প্রধান শহর ছিল হরপ্পা ও মোহনজোদারো। ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চলে খনন কাজ শুরু করেন তখন তারা মোহনজোদারো (Mohenjo-Daro) ও হরপ্পা (Harappa) নামে দুটি বিস্ময়কর নগরীর সন্ধান পান।
ভেবে দেখুন প্রায় ৪০০০ বছর আগেও এই শহরগুলোর রাস্তায় ছিল নির্দিষ্ট লেন, সুসংগঠিত ড্রেনেজ সিস্টেম, এমনকি পাবলিক টয়লেট! মোহনজোদারোর ‘দ্য গ্রেট বাথ’ (একটি বিশাল স্নানাগার) দেখে অনেক গবেষক মনে করেন হয়তো এটি ছিল কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্র। চোখের সামনে বিশাল স্নানাগার, সুসজ্জিত বাড়ি, প্রশস্ত সড়ক, উন্নত নিষ্কাশন ব্যবস্থা; সেই সময়ের এই বিস্ময়কর সভ্যতা প্রমাণ করে যে ইন্দুসবাসীরা ছিল ব্যতিক্রমী বুদ্ধিমান ও দক্ষ।
এত উন্নত একটি সভ্যতা কেবল মৌখিক ভাষার ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তারা লিখত কিন্তু কী লিখত?
ইন্দুস ভ্যালির ভাষা ও লিপি
এই বিস্ময়কর নগর সভ্যতার মানুষেরা যে লিপি ব্যবহার করত সেটি আজও অপঠিত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন গবেষণা করে হাজারেরও বেশি সীলমোহর ও পাত্রে খোদাই করা কিছু চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা ৪০০-৬০০টি প্রতীক চিহ্ন শনাক্ত করেছেন, যা তাদের ভাষার নিদর্শন হতে পারে। ইন্দুস বাসীদের প্রতিটি লিপি খুব ছোট সাধারণত ৫-৬টি প্রতীক নিয়ে গঠিত। কিছু প্রতীকে দেখা যায় জ্যামিতিক নকশা, পশুপাখির চিত্র, ও সাংকেতিক চিহ্ন, যা এখনো রহস্যময়।
এগুলোর প্রতিটি যেন এক অজানা ভাষার সংকেত। ঠিক যেন একটি প্রাচীন “এনিগমা কোড”, যা কেউ ডিকোড করতে পারেনি।
কিন্তু কেন এত জটিল এই ভাষা?
ইন্দুস লিপির রহস্য
বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন ইন্দুস লিপির প্রতিটি চিহ্ন স্বতন্ত্র এবং একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সাজানো। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি যে এটি আসলে একটি সম্পূর্ণ ভাষা ছিল নাকি শুধু ব্যবসায়িক বা ধর্মীয় সংকেত!
কেন আজও পাঠোদ্ধার করা যায়নি ইন্দুস লিপি?
বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন লিপি যেমন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ (Egyptian Hieroglyphs) বা কিউনিফর্ম (Cuneiform) পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলেও, ইন্দুস লিপি যেন এক রহস্যের মেঘে ঢাকা রয়ে গেছে। কিন্তু কেন? চলুন জেনে নিই।
রোজেটা স্টোনের মতো ‘কী’ পাওয়া যায়নি
আপনি কি জানেন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল “রোজেটা স্টোন” নামের এক বিশেষ শিলালিপির কারণে? এতে একই বার্তা তিনটি ভাষায় লেখা ছিল। গ্রীক, ডেমোটিক, এবং হায়ারোগ্লিফ। ফলে তুলনা করে ভাষাটি বোঝা সম্ভব হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইন্দুস লিপির ক্ষেত্রে এমন কোনো দ্বিভাষিক শিলালিপি (Bilingual Inscription) পাওয়া যায়নি। ফলে গবেষকদের হাতে এমন কিছু নেই যা থেকে আমরা সহজে বুঝতে পারি এই লিপির অর্থ কী হতে পারে।
খুব ছোট ছোট লেখাগুলো পাঠোদ্ধারকে কঠিন করে তুলেছে
একটি ভাষা বুঝতে হলে তার অনেক নমুনা থাকা দরকার। যেমন লম্বা লিপি বা বই, যেখানে শব্দের ব্যবহার এবং ব্যাকরণ বোঝা যায়।
কিন্তু ইন্দুস লিপির বেশিরভাগ নমুনা পাওয়া গেছে ছোট ছোট সিলমোহর (Seals) ও ফলকে। প্রতিটি লেখার দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫ থেকে ২৬টি চিহ্নের বেশি নয়। এত কম তথ্য থেকে ভাষার কাঠামো বোঝা প্রায় অসম্ভব।
ভাষার প্রকৃতি নিয়ে ধোঁয়াশা
মিশরীয় লিপির ক্ষেত্রে গবেষকরা জানতেন এটি মিশরীয় ভাষারই কোনো এক পুরনো রূপ। কিন্তু ইন্দুস লিপির ক্ষেত্রে গবেষকরা নিশ্চিত নয় এটি কোন ভাষার অংশ।
গবেষকদের ধারণা এটি হয়তো দ্রাবিড়ীয় (Dravidian) ভাষাগোষ্ঠীর কোনো পূর্বপুরুষ হতে পারে (যেমন আধুনিক তামিল বা তেলেগুর পূর্বসূরী)। কেউ কেউ মনে করেন এটি ইন্দো-আর্য (Indo-Aryan) ভাষার প্রাচীন রূপ।
আবার অন্যদের মতে এটি হয়তো সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিলুপ্ত ভাষা, যার কোনো উত্তরাধিকার নেই।
লিপির প্রকৃতি অজানা :বর্ণমালা, প্রতীক নাকি শব্দচিত্র?
আমরা কেউ জানি না ইন্দুস লিপি ঠিক কেমন পদ্ধতিতে লেখা হতো? এটি কি
বর্ণমালা ভিত্তিক (Alphabetic)?সিলাবিক (Syllabic)? (যেখানে প্রতিটি প্রতীক একটি শব্দাংশ বোঝায়)লোগোগ্রাফিক (Logographic)? (যেখানে প্রতিটি প্রতীক একটি শব্দ বোঝায়, যেমন চীনা ভাষায়)
যদি আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম এটি কেবলমাত্র একটি বর্ণমালা বা সিলাবিক লিপি। তাহলে তুলনা করে কিছু অর্থ বের করা যেত। যার ফলে এখনো এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
ইন্দুস সভ্যতার রহস্যময় পতন ও উত্তরাধিকারীর অনুপস্থিতি
ইন্দুস সভ্যতা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০ সালের দিকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। কিন্তু এর পরবর্তী কোনো সভ্যতা এই লিপির উত্তরাধিকার বহন করেনি।
মিশরীয় সভ্যতা যেমন হাজার বছর ধরে টিকে ছিল। তাই হায়ারোগ্লিফের বিকাশ এবং পরিবর্তন ট্র্যাক করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ইন্দুস সভ্যতা একসময় হারিয়ে গিয়েছিল এবং নতুন সমাজব্যবস্থা বা ভাষা তাদের কোনো লেখা সংরক্ষণ করেনি। ফলে এই ভাষা ও লিপির অর্থ একসময় পুরোপুরি হারিয়ে যায়।
এসব কারণেই মূলত ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যায় ইন্দুসবাসী এবং তাদের ভাষা। তবে কি আমরা কখনোই এই ভাষার রহস্য উন্মোচন করতে পারব না?
প্রযুক্তি কি আমাদের সাহায্য করতে পারবে এই ভাষার রহস্য উন্মোচন করতে?
ভারতের রখিগড়ি ও ধোলাভিরার মতো নতুন প্রত্নস্থল থেকে নতুন নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে। যদি কোনো দ্বিভাষিক শিলালিপি পাওয়া যায় তাহলে এটি হতে পারে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার!
আধুনিক বিজ্ঞানীরা AI এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ইন্দুস লিপি বিশ্লেষণের চেষ্টা করছেন। কিছু গবেষক দাবি করেছেন এই লিপির গঠন প্রাকৃতিক ভাষার মতোই। তবে এখনো এটি পাঠোদ্ধার করার কোনো নিশ্চিত পদ্ধতি পাওয়া যায়নি।
আমরা কি কোনোদিন এই ভাষার রহস্য উন্মোচন করতে পারব?
হয়তোবা নতুন এক ইতিহাস লেখা হবে যা আমাদের অতীতের অজানা অধ্যায় উন্মোচিত করবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় আমরা কি কখনোই এই হারিয়ে যাওয়া ভাষার অর্থ খুঁজে পাবো? নাকি এটি চিরতরে এক নিঃশব্দ অতীত হয়েই থেকে যাবে?
হয়তো একদিন কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক খনন বা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ইন্দুস ভাষার কণ্ঠস্বর আবার ফিরে আসবে। আর সেই দিন হাজার বছর ধরে নীরব থাকা এক সভ্যতা আমাদের সঙ্গে কথা বলবে।
“আমরা ছিলাম, আমরা আছি, এবং আমরা চিরকাল ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকব!”
সেই দিনের অপেক্ষায়…