বাজাউ উপজাতি, এমন এক জনগোষ্ঠী যারা সাধারণ মানব শরীরের সব সীমাবদ্ধতাকে তুড়ি মেরে জীবন গড়েছেন জলের বুকে। এই উপজাতির মাঝে এমন মানুষও আছে যারা জীবদ্দশায় কখনো মাটিতে পা রাখেনি।
বাজাউরা যেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যারা গড়ে তুলেছে তাদের ব্যতিক্রমী এক সভ্যতা – রহস্যময়, অনন্য, এবং চিরকাল বিস্ময়ের জন্ম দেয় এমন এক জলজ জীবন।
ভূমিকা
সমুদ্রের তলদেশে ১০-১৩ মিনিট শ্বাস ধরে রাখা কি একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব? আধুনিক বিজ্ঞানের আলোয় দাঁড়িয়ে আমরা হয়তো ভাবতে পারি, এটা কোনো অলৌকিক কল্পনা বা সিনেমার দৃশ্য। কিন্তু বাস্তবে, পৃথিবীর বুকে এক রহস্যময় জনগোষ্ঠী আছে যারা দিনের পর দিন পানিতে কাটিয়ে দেয় অবলীলায়। তাদের বলা হয় বাজাউ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাস করা এই সমুদ্রবাসী জনগোষ্ঠীকে অনেকে “সমুদ্রের জিপসি” নামেও চেনেন।
বাজাউদের জীবন পানির সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে যে তারা জলের নিচেই শিকার করে, সেখানেই খেলাধুলা করে, এমনকি প্রয়োজন হলে বিশ্রামও নেয়। এই সম্প্রদায়ের শ্বাসনালীর নিয়ন্ত্রণ, শারীরবৃত্তীয় অভিযোজন এবং দীর্ঘক্ষণ পানির নিচে থাকার ক্ষমতা বহু বিজ্ঞানীর আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও শারীরিক সক্ষমতা এক বিস্ময়কর মানব ইতিহাসের এক বৈচিত্র্যময় নিদর্শন।
বাজাউ জনগোষ্ঠী কোথায় বাস করে?
সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল বাজাউদের আজও পুরো জীবন কাটে সমুদ্রে। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়াকে ঘিরে বেশ কয়েকটি উপসাগর রয়েছে। যাদের নাম সুলু, সেলেবিস, বান্দা, মালুকু, জাভা, ফ্লোরেস এবং সাভু। এই উপসাগরগুলোর নীল জলে ঘুরে বেড়ান বাজাউরা, তাদের বিশেষ আকৃতির নৌকায় চড়ে। নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা নেই এদের। তাই এদের বলা হয় ‘সি জিপসি’ বা ‘সি নোম্যাড’।
তাদের বসবাসের ধরন একেবারেই ব্যতিক্রম। বাড়িঘর নয়, বরং কাঠের তৈরি নৌকা এবং ভাসমান কুঁড়েঘরই তাদের ঠিকানা। এসব ঘর তৈরি হয় সমুদ্রের উপর বাঁশ বা কাঠের খুঁটি গেঁথে। মাছ ধরা ও সাগরকেন্দ্রিক জীবনযাপনই তাদের প্রধান জীবিকা, ফলে ভূমির প্রয়োজন পড়ে না বললেই চলে। এই বিচ্ছিন্নতা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিশে থাকার জীবনধারা তাদের অন্যান্য উপজাতি থেকে আলাদা করে তুলেছে।
বাজাউ জনগোষ্ঠীর ইতিহাস ও সংস্কৃতি
প্রায় হাজার বছর আগের কথা। কথিত আছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জোহর রাজ্যের রাজকন্যা দায়াং আয়েশাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সুলু রাজ্যের রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে। তাই জোহরের রাজার বিশাল রাজকীয় নৌবহর চলেছে সমুদ্র পথে। কয়েকশো নৌকার বহর। রাজকন্যাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাজাউ নামের এক উপজাতি। যারা এই এলাকার সমুদ্রকে নিজের হাতের তালুর মতই চেনে।
ব্রুনেইয়ের তৎকালীন সুলতান আগেই আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জোহরের রাজা তার মেয়ের সঙ্গে ব্রুনেইয়ের সুলতানকে বিয়ে দিতে রাজি নন।
এই অপমান ভুলতে পারেননি ব্রুনেইয়ের সুলতান। সুলুর রাজার সঙ্গে আয়েশার বিয়ে তিনি মেনে নিতেও পারেননি। তাই অন্য কৌশল নিলেন সুলতান। আরও বড় নৌবহর নিয়ে এসে জোহর রাজ্যের নৌবহরকে অতর্কিতে আক্রমণ করলেন। গভীর সমুদ্রে তুমুল লড়াইয়ের পর ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন জোহরের রাজকন্যাকে।
দেশে ফিরেই রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন সুলতান। আর বিপদে পড়লেন কয়েকশ’ বাজাউ ও তাদের পরিবার। দেশে ফিরলে জোহরের রাজা তাদের হত্যা করবেন। প্রাণের ভয়ে তারা আর দেশে ফিরতে পারেনি। স্থলের সঙ্গে তাদের চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে যায়। সমুদ্রই হয়ে যায় তাদের ঘর। ঘুরতে থাকে বাজাউরা বিভিন্ন উপসাগরে, দেশহীন যাযাবর হয়ে।
বাজাউ জনগোষ্ঠীর জীবনধারা
বাজাউ জনগোষ্ঠীর জীবনধারা এক কথায় “সমুদ্রনির্ভর”। তারা ভূমির বদলে সমুদ্রকে বেছে নিয়েছে তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। তাদের বাড়িঘর সাধারণত কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি, যা সমুদ্রের উপর খুঁটি গেঁথে স্থাপন করা হয়। কিছু বাজাউ পরিবার নৌকায়ই জীবনযাপন করে, যাকে তারা “lepa-lepa” বলে ডাকে।
তাদের জীবিকা মূলত নির্ভর করে মাছ ধরা, মুক্তা সংগ্রহ, শামুক-ঝিনুক তুলে আনা এবং সামুদ্রিক শিকারির ওপর। পুরুষেরা সাধারণত ডুব সাঁতার কেটে সাগরের গভীরে গিয়ে এসব সংগ্রহ করেন, আর নারীরা জাল বুনে, মাছ শুকিয়ে এবং গৃহস্থালি কাজে সাহায্য করেন। শিশুরা ছোট বয়স থেকেই পানির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে – তারা খেলাধুলা করে পানিতে, শিখে ডুব সাঁতার এবং নৌকা চালানো।
খাবারের ক্ষেত্রেও তারা প্রকৃতিনির্ভর – তাজা মাছ, সামুদ্রিক শামুক, চাল এবং নারকেলভিত্তিক খাবার তাদের প্রতিদিনের পাতে দেখা যায়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থেকে দূরে থেকেও বাজাউ জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক নিয়মে, সাদামাটা কিন্তু গভীরভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এক জীবন যাপন করে।
শুনতে অবাক লাগলেও এটা সত্যি, এই উপজাতির অনেক মানুষ আছে যারা মাটিতে কোনওদিন পা রাখেনি। রাখবেই বা কী করে। নিজের দেশ নেই, নাম শুনলেই পুলিশ তাড়া করে। বাজাউরা নিজেদের বয়স বলতে পারে না। এই যুগেও, সময় কিংবা তারিখ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। ঠিক যেমন তারা জানে না বিদ্যুৎ কী এবং কোন কাজে লাগে।
বাজাউদের ডুব সাঁতার ও শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা
বাজাউ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো তাদের অসাধারণ ডুব সাঁতার ও শ্বাস ধরে রাখার ক্ষমতা। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, একজন গড়পড়তা মানুষ যেখানে পানির নিচে ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের বেশি থাকতে পারেন না, সেখানে বাজাউ ডুবুরিরা ১০ থেকে ১৩ মিনিট পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে পারেন। এমনকি কোনো আধুনিক ডাইভিং সরঞ্জাম ছাড়াই!
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাজাউদের দেহে রয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী শারীরিক অভিযোজন। যেমন – তাদের তিলি (spleen) সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রায় ৫০% বড়, যার ফলে শ্বাস বন্ধ রেখে রক্তে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া তাদের হৃদস্পন্দনের গতি পানির নিচে ধীর হয়ে যায়, ফলে শরীর কম অক্সিজেন খরচ করে।
বাচ্চারা খুব ছোট বয়স থেকেই ডুব সাঁতার শেখে, এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের শ্বাস ধরে রাখার সময়ও বাড়তে থাকে। এই অস্বাভাবিক দক্ষতাই বাজাউদের করে তুলেছে বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বিজ্ঞান কী বলছে?
বাজাউ জনগোষ্ঠীর দীর্ঘক্ষণ পানির নিচে থাকার ক্ষমতা শুধু সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নয়, এটি এখন একটি জিনগত অভিযোজনের উদাহরণ হিসেবেও পরিচিত। ২০১৮ সালে নেচার (Nature) জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখান যে, বাজাউদের শরীরে কিছু বিশেষ ধরনের জিনগত পরিবর্তন হয়েছে যা তাদের এই দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাজাউদের তিলি বা spleen সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বড়, যা রক্তে অতিরিক্ত অক্সিজেন মজুদ রাখতে সহায়তা করে। এই অঙ্গটি ‘ডুব প্রতিক্রিয়া’তে (Dive Response) বড় ভূমিকা রাখে। এছাড়া বাজাউদের দেহে PDE10A নামক একটি জিনের রূপান্তর পাওয়া গেছে, যা তিলির আকার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এই শারীরিক অভিযোজনের ফলে বাজাউরা ডুব দিয়ে সমুদ্রের গভীরে মাছ ধরতে বা মুক্তা সংগ্রহ করতে পারে, যেটা সাধারণ মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কয়েক শতাব্দী ধরে সমুদ্রের সঙ্গে নিবিড় জীবনযাপনের ফলেই বাজাউদের দেহে এই জিনগত পরিবর্তন ঘটেছে।
বাজাউ জনগোষ্ঠী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে – মানুষ শুধু মাটি নয়, সমুদ্রের সন্তানও হতে পারে। তাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং শারীরিক অভিযোজন আধুনিক সমাজের কাছে এক জীবন্ত উদাহরণ, কীভাবে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে মিলেমিশে বাঁচতে পারে।
যেখানে আধুনিক সভ্যতা প্রযুক্তি ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারে না, সেখানে বাজাউরা প্রাকৃতিক দক্ষতা এবং অভিযোজনের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে সমুদ্রে টিকে আছেন। তারা আমাদের শেখায় – মানুষের সম্ভাবনা সীমাহীন, শুধু প্রয়োজন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা এবং ধৈর্য।
তথ্যসূত্র –
- https://www.prothomalo.com/world/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%A8%E0%A7%9F-%E0%A6%93%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%B8%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BF%E0%A6%87-%E0%A6%9C%E0%A6%B2%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%AC
- https://www.kalerkantho.com/online/world/2019/06/23/783025
- https://www.tbsnews.net/bangla/tags/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A7%9F
- https://www.tribes.world/en/community/who-are-the-bajau
- https://authentic-indonesia.com/blog/8-unique-facts-of-the-bajau-indonesia-sea-gypsies-tribe/
- https://www.theguardian.com/environment/2023/aug/10/the-last-sea-nomads-stateless-bajau-face-up-to-a-future-on-land-a-photo-essay