বায়ান্নর রাজপথ থেকে একাত্তরের রণাঙ্গন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিটি অধ্যায়ে মিশে আছে ছাত্রদের রক্ত। সাথে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবগাঁথা আর আগুনঝরা ইতিহাস। কিন্তু সেই ছাত্র রাজনীতি আজ দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।
যে রাজনীতি একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে নিজেই এখন পথভ্রষ্ট। কিন্তু কেন?
বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করতে চাইলে তার প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাওয়া যাবে ছাত্রদের অবদান, ছাত্র রাজনীতির অবদান। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন অথবা চব্বিশের, এই ভূখণ্ডের প্রতিটি ঐতিহাসিক বাঁক বদলের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল এদেশের ছাত্রসমাজ।
কারণ একসময় এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল মুক্তচিন্তা চর্চার পীঠস্থান এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার। ছাত্রনেতারা শুধু শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নন, তারা ছিলেন জাতির বিবেক। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতি আজ বিতর্কিত।
আজকের লেখায় আমরা বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির সেই গৌরবময় ইতিহাসের বিভিন্ন দিক তুলে ধরব আর জানবো কীভাবে সময়ের সাথে সাথে এর চরিত্র বদলে ধারণ করেছে ভয়ংকর রূপ৷
সূচনা পর্ব: ব্রিটিশ ভারতে অধিকার আদায়ের প্রথম পাঠ
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির শিকড় প্রোথিত রয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, বিশ শতকের শুরুর দিকে। তখন ছাত্র রাজনীতি ছিল মূলত ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অংশ। ১৯২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি হয়ে ওঠে ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তখন ছাত্রদের দাবি-দাওয়া ছিল মূলত একাডেমিক অধিকার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সংগঠিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সময়েই ছাত্ররা প্রথম শেখে কীভাবে সংগঠিত হতে হয়, কীভাবে দাবি আদায় করতে হয় এবং কীভাবে একটি বৃহত্তর লক্ষ্যের জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হয়।
স্বাধিকারের সংগ্রাম: ছাত্র রাজনীতির স্বর্ণযুগ (১৯৪৭-১৯৭১)
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, যখন বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়, তখন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই সময়টাতেই ছাত্রসমাজ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান রক্ষক এবং মুখপাত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ, সবক্ষেত্রেই ছাত্রদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজই সর্বপ্রথম এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে বাংলা ভাষার মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলো পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে।
এছাড়া ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে যে বিশাল ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার নেতৃত্বে ছিল তৎকালীন ছাত্র সংগঠনগুলো, বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র লীগ। এই কমিশন শিক্ষাকে ব্যয়বহুল এবং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য সীমাবদ্ধ করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ছাত্ররা এই বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যার ফলে পাকিস্তান সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
১৯৬৬-এর ছয় দফা এবং ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানেও ছাত্ররাই ছিল সম্মুখ সারীর যোদ্ধা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা বা ‘বাঙালির মুক্তির সনদ’-কে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এবং এর পক্ষে জনমত তৈরি করার প্রধান কাজটিই করেছিল ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯ সালে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করা হলে, ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১-দফা দাবি পেশ করে যে গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা করে, তা আইয়ুব খানের মতো লৌহমানবকেও ক্ষমতাচ্যুত করতে বাধ্য করে।
বলাই বাহুল্য, এই পুরো সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি ছিল অত্যন্ত আদর্শভিত্তিক। ছাত্র ইউনিয়ন (বামপন্থী) এবং ছাত্র লীগ (জাতীয়তাবাদী)—এই দুটি প্রধান সংগঠনের মধ্যে আদর্শিক বিতর্ক থাকলেও, দেশের স্বার্থে তারা কাধে কাধ মিলিয়ে রাজপথে নেমেছে, ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে দেশের জন্য নিজের জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি৷
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র রাজনীতি
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং গৌরবের অধ্যায়টি রচিত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। ২৫শে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন ছাত্রসমাজই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।
তারা শুধু সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই লড়াই করেনি, অনেক ছাত্র সংগঠন নিজস্ব বাহিনীও গঠন করেছিল। যেমন- মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (মোজাফফর)-এর যৌথ উদ্যোগে একটি বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়, যা ভারতের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে অসংখ্য সফল অপারেশন পরিচালনা করে। অন্যদিকে, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘মুজিব বাহিনী’ বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ), যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান প্রশিক্ষিত গেরিলা শক্তি।
সেসময় দেশের ছাত্র নেতারা শুধু সম্মুখ সমরেই অংশ নেননি, তারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা, বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি এবং শরণার্থীদের সহায়তা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোও অত্যন্ত সফলতার সাথে সামলেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়: নতুন স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ (১৯৭২-১৯৯০)
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর, ছাত্র সংগঠনগুলোর সামনে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সহায়তা করার বিশাল দায়িত্ব। প্রথমদিকে, তারা সেই কাজে আত্মনিয়োগও করেছিল। কিন্তু ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া দেশটিকে জাগিয়ে তোলার কাজটি অতোটা সহজ ছিল না। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাজনীতির চেহারাও ক্রমশ পালটে যেতে থাকে। যেমন- স্বাধীনতার পরপরই, আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্র লীগ ভেঙে জাসদ ছাত্রলীগ গঠিত হয়, যা সদ্য স্বাধীন দেশে এক বড় রাজনৈতিক সংঘাতের জন্ম দেয়।
দেশকে সামলে নেওয়ার আগেই শকুনের কালো থাবার মত বাংলার বুকে ধেয়ে আসে দুর্ভিক্ষ। চরম সংকটপূর্ণ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতিও সংকটের মুখে পড়ে।
তবে, ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমির আমূল পরিবর্তন হয়, যার সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ছাত্র রাজনীতির উপর।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে, ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের নিজস্ব আদর্শ এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ থেকে সরে গিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ‘অঙ্গসংগঠন’ বা লেজুড়বৃত্তি দাসে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো হয়ে ওঠে দলীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রধান কেন্দ্র। ছাত্রদের হাতে কলমের পরিবর্তে অস্ত্র উঠে আসে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ক্যাম্পাসগুলো প্রায়শই পরিণত হতো রণক্ষেত্রে।
এই অবক্ষয়ের মধ্যেও, ছাত্র রাজনীতি তার শেষ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়টি রচনা করে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। সকল ছাত্র সংগঠন একসাথে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ গঠন করে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং অবশেষে ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটায়।
ছাত্র রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তা বেশিরভাগ সময়ে প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতই থেকে গেছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ; প্রতিটি সংগ্রামেই ছাত্রীরা সামনের সারিতে ছিলেন।
ষাটের দশকে মতিয়া চৌধুরী, আইভি রহমান এবং সত্তরের দশকে শিরিন আখতারের মতো নারী নেত্রীরা তাদের মেধা এবং সাহসিকতা দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছিলেন। তারা শুধু মিছিলে অংশগ্রহণই করেননি, সংগঠনের নীতি নির্ধারণ এবং নেতৃত্বেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে বলা বাহুল্য, সংকটের সময় নারীর সর্বোচ্চ সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নারীরা চলে যেতেন ফোকাসের বাইরে।
বর্তমান সময়ে ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তন ও বিতর্ক
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, ছাত্র রাজনীতির মারাত্মক অবক্ষয় ঘটে। এটি ধীরে ধীরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকসু, জাকসু, রাকসু-র মতো নির্বাচনগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং নেতৃত্বের বিকাশ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে শিবির সন্দেহে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলে বর্তমানে নিষিদ্ধ দল ছাত্রলীগের কয়েকজন ছাত্র। এই ঘটনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ দেখতে পায় এবং বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। তবে এই দাবি তখন আর কেবল বুয়েটে সীমাবদ্ধ থাকে না। এই দাবি হয়ে উঠে শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি।
একটি বিষয় না বললেই নয়, বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন যেমন- কোটা সংস্কার আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো বড় বড় ছাত্র আন্দোলনগুলো কোনো প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে। এটি প্রমাণ করে যে, প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির উপর শিক্ষার্থীদের আস্থা অনেকাংশে কমে গেছে।
তবে, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্র রাজনীতির প্রেক্ষাপট আবারও বদলাতে শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়েছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবারও তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে।
জুলাই অভ্যুত্থান ও নতুন দিনের সূচনা: বর্তমান ছাত্র রাজনীতির বাস্তবতা
দীর্ঘ কয়েক দশকের স্থবিরতা কাটিয়ে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্ররা আবারও নতুন ইতিহাস তৈরি করে বাংলাদেশের বুকে। যা ‘জুলাই অভ্যুত্থান’ বা ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ নামে পরিচিত।
এই আন্দোলন ছিল মূলত প্রচলিত ধারার দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক স্বতঃস্ফূর্ত ও শক্তিশালী বিদ্রোহ। জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন ঘটায়নি, বরং ছাত্র রাজনীতির সম্পূর্ণ গতিপথকেই বদলে দিয়েছে।
এই অভ্যুত্থানের পর, ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনটি হলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নতুন করে তৈরি হওয়া গণজাগরণ।
দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছিল শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ, সেই নির্বাচনকে ঘিরেই ক্যাম্পাস এখন উত্তাল।
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরাই এখন মনে করছে যে, ছাত্র রাজনীতির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং ক্যাম্পাসে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এই নির্বাচনের মাধ্যমেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
এই নতুন বাস্তবতায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, এবং ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও ডাকসু ও জকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। এবারের নির্বাচনী প্রচারণার ধরণও সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে গতানুগতিক পেশিশক্তির প্রদর্শন বা দলীয় স্লোগানের পরিবর্তে, প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন আবাসন সংকট, উন্নত লাইব্রেরি, পরিবহন ব্যবস্থা এবং গবেষণার সুযোগ নিয়ে কথা বলছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীরাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং প্যানেল তৈরি করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা ছাত্র রাজনীতির জন্য এক নতুন পদক্ষেপ।
মূলত, এই নির্বাচনগুলোই নির্ধারণ করে দেবে, জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত পরিবর্তন কতটা টেকসই হবে এবং ছাত্র রাজনীতি তার গৌরবোজ্জ্বল অতীতে ফিরে যেতে পারবে কি না।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস যেমন গৌরব, ত্যাগ এবং দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জ্বল, তেমনই এর সাম্প্রতিক ইতিহাস সহিংসতা, লেজুড়বৃত্তি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের অভিযোগে কলঙ্কিত। আজকের পরিবর্তিত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে ছাত্র রাজনীতিকে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে তাকে অবশ্যই দলীয় লেজুড়বৃত্তির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক নেতৃত্ব গড়ে তোলাই হতে পারে এই উত্তরণের প্রধান পথ।
তথ্যসূত্র –
- https://www.bbc.com/bengali/articles/ceqjng174q9o
- https://samakal.com/opinion/article/287020/%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF:-%E0%A6%97%E0%A6%A3%E0%A6%A4%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AE%E0%A7%8D%E0%A6%AD-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-
- https://www.jagonews24.com/feature/article/959178
- https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0_%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF
- https://www.chhatrasangbadbd.com/%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%87%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B82
- https://www.ajkalerkhobor.net/news/156343
- https://www.amarsangbad.com/opinion/news-210193