Image default
ইতিহাস ১০১

ইসলামী ছাত্র শিবির এর ইতিহাস – ধর্মীয় রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ বিতর্ক থেকে বর্তমান

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে সুসংগঠিত এবং একই সাথে সবচেয়ে বিতর্কিত সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসে সহিংসতার অভিযোগ, এমন কোন সমালোচনা নেই যা ঘিরে থাকেনি দলটিকে। এত বিতর্কিত হওয়ার পরও কেন ইসলামী ছাত্র শিবির বাংলাদেশে এখনো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে?

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এমন কিছু সংগঠন রয়েছে, যেগুলো তুমুল জনপ্রিয় এবং একই সাথে ব্যাপক বিতর্কিত ও সমালোচিত।

ইসলামী ছাত্র শিবির নিঃসন্দেহে সেই তালিকার শীর্ষে থাকা একটি নাম। দেশের অন্যতম সুসংগঠিত ও আদর্শগতভাবে শক্তিশালী এই ছাত্র সংগঠনটি বহু সমালোচনার জন্ম দেওয়ার পরও বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে গত পাঁচ দশক ধরে।

কেন এই সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল? জামায়াতে ইসলামীর সাথে এর সম্পর্ক ঠিক কেমন?  ২০২৪-২৫ সালের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের অবস্থানই বা কোথায়?

আজকের লেখায় আমরা ইসলামী ছাত্র শিবিরের ইতিহাস, আদর্শগত অবস্থান ও কার্যক্রম  এবং তাদের ঘিরে থাকা সবচেয়ে বড় বিতর্কগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

ইসলামী ছাত্র শিবিরের জন্ম 

ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাস বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে এর মূল সংগঠন, জামায়াতে ইসলামীর জন্মের সময়কালে। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশভাগের পর, পাকিস্তানেও জামায়াতে ইসলামী তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং তাদের ছাত্র শাখা হিসেবে ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ গঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ বিতর্ক: জামায়াতে ইসলামীর কলংকিত ইতিহাস

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ পাকিস্তানের পক্ষ নেয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতা করে। ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আল-বদর, আল-শামস এবং রাজাকার বাহিনী গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য যে আল-বদর বাহিনী কুখ্যাত, তার নেতৃত্বে ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা, এই অভিযোগটি শিবিরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলংকিত এক অধ্যায়।

স্বাধীনতার পর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, ইসলামী ছাত্র সংঘের কার্যক্রমও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

ছাত্র শিবির এর লোগো

১৯৭৭: নতুন নামে, নতুন প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। সেসময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এই সুযোগেই জামায়াতে ইসলামী আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায়।

এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে এক সম্মেলনের মাধ্যমে ইসলামী ছাত্র সংঘ তাদের পুরনো নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামী ছাত্র শিবির’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও সংগঠনটি দাবি করে যে, এটি সম্পূর্ণ নতুন ও স্বতন্ত্র সংগঠন, কিন্তু এর নেতৃত্ব, আদর্শ এবং গঠনগত কাঠামো পুরোটাই ছিল পুরনো ছাত্র সংঘের অনুরূপ।

মূলত, নাম পরিবর্তনের কারণ ছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় বিতর্কিত ভূমিকা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নতুন পরিচয়ে ছাত্রসমাজের কাছে পৌঁছানোর কৌশল।

ইসলামী মতবাদ ও শিবিরের মূলনীতি

ইসলামী ছাত্র শিবির কোন সাধারণ ছাত্র সংগঠন নয় বরং এটি একটি আদর্শভিত্তিক বা আইডিওলজিক্যাল সংগঠন। এর মূল ভিত্তি হলো জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর রাজনৈতিক ইসলামের ধারণা।

শিবিরের মূলনীতিগুলো হলো:

আল্লাহর সার্বভৌমত্ব:  তারা বিশ্বাস করে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, আল্লাহর আইন বা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ইসলামী বিপ্লব: তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, একটি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা।

চরিত্র গঠন: শিবির তাদের কর্মীদের পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী অনুশাসন, যেমন-নামাজ, রোজা এবং নৈতিক চরিত্র গঠনের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।

এই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য শিবির একটি পাঁচ-দফা কর্মসূচি অনুসরণ করে, যা তাদের কর্মীদের ধাপে ধাপে সংগঠনের সাথে একাত্ম করে তোলে।

সাংগঠনিক কাঠামো

ইসলামী ছাত্র শিবির তার সুশৃঙ্খল এবং স্তরবিন্যাসিত কাঠামোর জন্য পরিচিত, যা অনেকাংশেই জামায়াতে ইসলামীর কাঠামোর অনুরূপ।

স্তরবিন্যাস:  শিবিরের সমর্থক থেকে শুরু করে কর্মী, সাথী (Associate Member) এবং সবশেষে সদস্য (Member), এই কয়েকটি ধাপে একজন শিক্ষার্থী শিবিরের পূর্ণাঙ্গ অংশ হয়ে ওঠে। প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করার জন্য নির্দিষ্ট পড়াশোনা, পরীক্ষা এবং সাংগঠনিক কাজে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে হয়।

গোপনীয়তা: শিবিরের কার্যক্রমের একটি বড় অংশই পরিচালিত হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে। তাদের ‘শাখা’ এবং ‘স্টাডি সার্কেল’ বা পাঠচক্রগুলো সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কর্মীদের আদর্শিক এবং কৌশলগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই গোপনীয়তার কারণেই অনেকে শিবিরকে একটি ‘রহস্যময়’ বা ‘গোপন’ সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে।

শাখাভিত্তিক কার্যক্রম: দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মাদ্রাসাগুলোতে তাদের শাখা রয়েছে। এই শাখাগুলোর মাধ্যমেই তারা নতুন সদস্য সংগ্রহ এবং তাদের আদর্শ প্রচার করে থাকে। 

মূলত, এই ক্যাডারভিত্তিক এবং সুসংগঠিত কাঠামোই শিবিরকে বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনে পরিণত করেছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবিরের প্রভাব ও কার্যক্রম

আশি এবং নব্বইয়ের দশকে, যখন ক্যাম্পাসে অস্ত্রের রাজনীতি তুঙ্গে, তখন ইসলামী ছাত্র শিবির দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির কার্যক্রম

শিবিরের অন্যতম প্রধান কৌশল হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী এবং ভালো ছাত্রদের টার্গেট করা। তারা কোচিং সেন্টার, লাইব্রেরি এবং হোস্টেলগুলোতে সক্রিয় থাকে এবং পড়াশোনায় সাহায্য করা, নোট দেওয়া বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তারা সম্পর্ক স্থাপন করে।

এছাড়া রক্তদান কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ বা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার মতো বিভিন্ন সেবামূলক কাজের মাধ্যমে তারা ছাত্রসমাজে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করে।

তবে, শিবিরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো ক্যাম্পাসে সহিংসতা এবং আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি। তাদের বিরুদ্ধে প্রায়শই প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের উপর নৃশংস হামলা, রগ কেটে দেওয়া বা মারধোর করার মতো ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে।

চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আশি ও নব্বইয়ের দশকে সংঘটিত বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্য শিবিরকে দায়ী করা হয়। যদিও শিবির সবসময়ই এই অভিযোগগুলো অস্বীকার করে এসেছে এবং এগুলোকে তাদের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ বলে দাবি করেছে। তবে এই বিতর্ক এখনো পিছু ছাড়েনি দলটির।

জাতীয় রাজনীতিতে শিবিরের ভূমিকা ও অংশগ্রহণ 

ইসলামী ছাত্র শিবির সরাসরি কোনো নির্বাচনে অংশ না নিলেও, এটি জামায়াতে ইসলামীর জন্য আগামীর নেতা তৈরির প্রধান পাইপলাইন হিসেবে কাজ করে। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি বা সেক্রেটারি জেনারেলসহ প্রথম সারির নেতারা তাদের ছাত্র রাজনীতি শেষ করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অন্তর্ভুক্ত হন। অর্থাৎ, শিবির পরিচালিত হয় জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হিসেবে।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পর, শিবির প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম থেকে কিছুটা সরে আসে। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর, শিবির আবারও আবারও নতুনভাবে দেশের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেছে।

২০২৪–২৫ সালের বাস্তবতা এবং শিবিরের ভবিষ্যৎ

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির জন্য এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই নতুন পরিস্থিতিতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

বর্তমানে, শিবির প্রকাশ্যে কোনো বড় ধরনের কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে, একটি নীরব পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। তারা সম্ভবত পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তার দিকে তাকিয়ে আছে। অতীতের মতো, এবারও শিবির তাদের পুরনো বিতর্কিত পরিচয় মুছে ফেলে একটি নতুন, গ্রহণযোগ্য নামে ছাত্রসমাজের সামনে আসার চেষ্টা করতে পারে বলে অনেকে ধারণা করছেন। 

কিন্তু, মাঠের রাজনীতির চেয়ে তারা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনেক বেশি সোচ্চার। সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছাত্রশিবির তাদের আদর্শ প্রচার এবং সদস্য সংগ্রহে অনেক বেশি সক্রিয় হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। কারণ যেহেতু গুপ্ত সংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবিরের বেশ নাম আছে, তারা আবারও নতুনভাবে সে পথে হাটছেন বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

ছাত্র শিবির এর বর্তমান কার্যক্রম

তবে শিবিরের গায়ে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতা করার মত যে ভয়ংকর কালিমা লেগে আছে, তা কোনভাবেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করার মত ঐতিহাসিক অভিযোগ এবং অতীতে সংঘটিত তাদের সহিংস রাজনীতির ইতিহাস; তাদেরকে দেশের মূলধারার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবেই থাকবে।

ইসলামী ছাত্র শিবির বাংলাদেশের রাজনীতির এক জটিল বাস্তবতা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কোন পথে এগোবে, তার উপরই নির্ভর করছে শিবিরের মতো ধর্মভিত্তিক ছাত্র সংগঠনগুলোর ভবিষ্যৎ। তবে, একটি অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে তাদের আদর্শ এবং কার্যক্রম কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবে, সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়, থেকে যাবে আজীবন। 

তথ্যসূত্র –

Related posts

বিশ্বের প্রথম ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল: সিএনএন-এর ইতিহাস

সিনেমা তারকা থেকে ওয়াই-ফাই উদ্ভাবক, যে ইতিহাস জানে না অনেকেই!

ফাবিহা বিনতে হক

কিভাবে পশ্চিম জয় করলো ইরান: ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়

আবু সালেহ পিয়ার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More