Image default
ইতিহাস ১০১

ছাত্র ইউনিয়ন: ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে আজকের রাজনীতির ইতিহাস

‘শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি’ এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে ১৯৫২ সালে যে ছাত্র সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল, তা কীভাবে হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান শক্তি? ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন, ছাত্র ইউনিয়নের সেই আগুনঝরা ইতিহাস ও ত্যাগের কাহিনি, যা আজকের প্রজন্মেরও অনুপ্রেরণা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রসমাজের প্রতিবাদ, ত্যাগ এবং প্রগতির ইতিহাসের কথা উঠলে যে নামটি অপরিহার্যভাবে চলে আসে, তা হলো ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’। এটি শুধু একটি ছাত্র সংগঠন নয়, এটি একটি আদর্শের নাম, একটি চেতনার বাতিঘর, যা দেশের প্রতিটি ক্রান্তিকালে পথ দেখিয়েছে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে যার জন্ম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যার ছিল নিজস্ব গেরিলা বাহিনী, এবং স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে যার ছিল অগ্রণী ভূমিকা সেই ছাত্র ইউনিয়ন আজ কোথায় দাঁড়িয়ে? ‘শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি’ এই তিন মূলনীতিকে ধারণ করে যে সংগঠনটি একদিন দেশের তরুণ সমাজকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার বর্তমান অবস্থাই বা কী?

জন্মের প্রেক্ষাপট: কেন একটি নতুন সংগঠনের প্রয়োজন ছিল?

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র রাজনীতি মূলত দু’টি ধারায় বিভক্ত ছিল। কিন্তু উভয় ধারার মধ্যেই ধর্মীয় পরিচয় এবং সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রভাব ছিল প্রবল। এমন একটি সময়ে, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছাত্র-ছাত্রীরা একটি নতুন প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন, যা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করে, শুধুমাত্র সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার এবং একটি শোষণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে।

ভাষা আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন এর নেতাকর্মীরা

এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে, যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বুলেটের সামনে তরুণেরা বুক পেতে দিচ্ছে, তখন প্রয়োজন ছিল একটি সংগঠিত এবং আদর্শিক শক্তির, যা এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই ঐতিহাসিক প্রয়োজনের গর্ভ থেকেই জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন।

২৬ এপ্রিল ১৯৫২: এক ঐতিহাসিক ঘোষণার দিন

ভাষা আন্দোলনের চরম মুহূর্তগুলো পার হওয়ার ঠিক পরেই, ১৯৫২ সালের ২৬শে এপ্রিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ গঠিত হয়। এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন মোহাম্মদ সুলতান এবং সাধারণ সম্পাদক হন কাজী আনোয়ারুল আজিম। এই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রেই সংগঠনটির মূল চরিত্র নির্ধারণ করে দেওয়া হয় যে এটি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন, যার প্রধান লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং একটি প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণ।

ছাত্র ইউনিয়ন এর ব্যানারে শীর্ষ নেতারা

কাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ছাত্র ইউনিয়ন?

ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃত্বে ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে মেধাবী, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী তরুণেরা। কাজী আবদুল বারি, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সুলতান, কাজী আনোয়ারুল আজিম, কামরুল আহসান খান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং মোহাম্মদ তোয়াহার মতো ব্যক্তিত্বরা ছিলেন এর নেপথ্যের কারিগর। তাদের দূরদৃষ্টি এবং আদর্শিক অবস্থানই ছাত্র ইউনিয়নকে একটি অনন্য সংগঠনে পরিণত করেছিল।

ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ: ছাত্র ইউনিয়নের অগ্নিপথ

ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস হলো বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এটি দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

  • ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা: যদিও ছাত্র ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক জন্ম ভাষা আন্দোলনের ঠিক পরে, কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা নেতারা ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই সক্রিয় ছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর, ছাত্র ইউনিয়ন ২১শে ফেব্রুয়ারির চেতনাকে ধারণ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
  • শিক্ষা আন্দোলন (১৯৬২): আইয়ুব খানের শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে যে বিশাল ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার নেতৃত্বে ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। এই কমিশন শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার এবং একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ছাত্র ইউনিয়ন এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
  • ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান: ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র ইউনিয়ন এবং তার নেতৃত্বে গঠিত ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনই আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের পতন ঘটায় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করতে বাধ্য করে।
গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র ইউনিয়ন

ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনী: যখন কলম ছেড়ে যোদ্ধারা অস্ত্র তুলে নেয়

ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল এবং অনন্য অধ্যায়টি রচিত হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন ছাত্র ইউনিয়নের হাজার হাজার কর্মী দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

শুধু অংশগ্রহণই নয়, ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (মোজাফফর)-এর যৌথ উদ্যোগে একটি নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের সহায়তায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা দেশের ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য সফল গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। তারা ছিলেন একাধারে মেধাবী ছাত্র এবং দুঃসাহসী যোদ্ধা। কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার এই ঘটনা ছাত্র ইউনিয়নের দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই গেরিলা বাহিনীর অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মূলনীতি: কেন এটি অন্যদের থেকে আলাদা?

ছাত্র ইউনিয়নের দীর্ঘ পথচলার পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এর তিনটি মৌলিক নীতি:

১. শিক্ষা: ছাত্র ইউনিয়ন সবসময়ই একটি অবৈতনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার এবং সবার জন্য সমান শিক্ষা ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছে। শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার বিরুদ্ধে এবং বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে তারা বরাবরই সোচ্চার।

২. ঐক্য: ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল ছাত্র-ছাত্রীর ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন, যা সব ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে।

৩. প্রগতি: ছাত্র ইউনিয়ন একটি প্রগতিশীল এবং শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখে। তারা সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ এবং সব ধরনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে বিশ্বাসী।

এই তিনটি মূলনীতিই ছাত্র ইউনিয়নকে বাংলাদেশের অন্যান্য ছাত্র সংগঠন থেকে আলাদা করেছে এবং তাকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

স্বাধীনতার পর, বিশেষ করে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে এবং আশির দশকে, যখন দেশ বারবার সামরিক শাসনের অধীনে চলে যায়, তখন ছাত্র ইউনিয়ন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলন চলেছিল, তার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ছাত্র ইউনিয়ন।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের মশাল মিছিল

এই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা বহুবার জেল, জুলুম এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ডা. মিলনের মতো অনেক কর্মী স্বৈরাচারের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু তারা তাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। অবশেষে, ১৯৯০ সালে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে এবং দেশে গণতন্ত্রের ধারা ফিরে আসে। এই অর্জনের পেছনে ছাত্র ইউনিয়নের অবদান ছিল অপরিসীম।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও ছাত্র ইউনিয়নের সংকট

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর যখন ছাত্র ইউনিয়ন একটি গণতান্ত্রিক ধারার ছাত্র রাজনীতির স্বপ্ন দেখছিল, ঠিক তখনই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক বিশাল পরিবর্তনের ঢেউ এসে লাগে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঘটনাটি ছিল বিশ্বজুড়ে বামপন্থী রাজনীতির জন্য এক বিরাট ধাক্কা। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যা আদর্শিকভাবে সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সবাদের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হতো, এই ঘটনায় মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সংগঠনটির ভেতরে এক গভীর আদর্শিক সংকট তৈরি করে। কর্মীদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এবং সংগঠনের রাজনৈতিক পথ নিয়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। একটি অংশ মনে করত, সোভিয়েত মডেলের ব্যর্থতার পর সংগঠনের উচিত তাদের কৌশল পরিবর্তন করা। অন্য অংশটি চিরায়ত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পথেই অটল থাকতে চেয়েছিল। এই আদর্শিক বিভেদ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হতাশাজনক প্রেক্ষাপট সংগঠনকে ভেতর থেকে দুর্বল করে ফেলে। একই সময়ে, দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ধর্মীয় রাজনীতি এবং পুঁজিবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রভাব বাড়তে থাকে, যা ছাত্র ইউনিয়নের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

ছাত্র ইউনিয়ন: আজকের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ

নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র ফিরে এলেও, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির জন্য এক নতুন সংকট শুরু হয়। ক্যাম্পাসগুলোতে পেশিশক্তি এবং দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, ছাত্র ইউনিয়নের মতো আদর্শভিত্তিক সংগঠনগুলো ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে শুরু করে। দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু, রাকসু) বন্ধ থাকায়, ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

আজকের দিনে, ছাত্র ইউনিয়ন আগের মতো প্রভাবশালী না থাকলেও, তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়নি। তারা এখনও দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সক্রিয় রয়েছে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বৃদ্ধি, আবাসন সংকট, যৌন হয়রানি এবং বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে তারা এখনও প্রতিবাদ ও কর্মসূচি পালন করে। কোটা সংস্কার আন্দোলন বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো সাম্প্রতিক বড় ছাত্র আন্দোলনগুলোতেও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং আন্দোলনকে আদর্শিক দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

বর্তমান ধারায় ভাঙন ও আদর্শের লড়াই

বিগত দশকগুলোতে ছাত্র ইউনিয়ন বেশ কয়েকটি ভাঙনের শিকার হয়েছে, যা তার সাংগঠনিক শক্তিকে আরও খর্ব করেছে। আদর্শিক বিরোধ, নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন মেরুকরণের প্রভাব পড়েছে এই সংগঠনের উপর। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ফলস্বরূপ, ছাত্র ইউনিয়ন একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার প্রতিটি অংশই নিজেদেরকে ‘মূল স্রোত’ বলে দাবি করে।

এই বিভক্তিগুলো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে এবং সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ ইমেজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বর্তমানে, ছাত্র ইউনিয়ন (আংশিক), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (জলালী), এবং আরও কিছু ছোট ছোট গ্রুপ একই নাম ও পতাকা ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করছে। তবে এই ভাঙন সত্ত্বেও, প্রতিটি অংশই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি’র মূলনীতিকে ধারণ করে শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষাঙ্গনের গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার রয়েছে। আদর্শের এই লড়াই হয়তো সংগঠনকে বিভক্ত করেছে, কিন্তু ছাত্র রাজনীতির ময়দানে তাদের অস্তিত্বকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি।

ছাত্র ইউনিয়নের সামনে আজ অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনগুলোর বিশাল অর্থ ও পেশিশক্তির সামনে টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন। এছাড়াও, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ রাজনীতি-বিমুখ, যা নতুন কর্মী সংগ্রহে একটি বড় বাধা।

তবে, ছাত্র ইউনিয়নের আদর্শের আবেদন আজও ফুরিয়ে যায়নি। একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়েছিল, সেই স্বপ্ন আজও প্রাসঙ্গিক। যতদিন ক্যাম্পাসে এবং সমাজে অন্যায়, বৈষম্য এবং স্বৈরাচারী প্রবণতা থাকবে, ততদিন ছাত্র ইউনিয়নের মতো আদর্শিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর গ্যাংদের ইতিহাস: রক্তাক্ত অপরাধ, ক্ষমতার লড়াই ও অন্ধকার সাম্রাজ্য

ফাবিহা বিনতে হক

লিপস্টিক এর ইতিহাস- যেভাবে লিপস্টিক হয়ে উঠলো নারী স্বাধীনতার প্রতীক

নির্বাচনের ইতিহাস- এথেন্স থেকে AI

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More