Image default
ইতিহাস ১০১

যেভাবে জন্ম নিল নন্টে ফন্টে: নারায়ণ দেবনাথের কালজয়ী সৃষ্টি

নন্টে-ফন্টে শুধু কমিকস নয়, বরং বাংলা শিশুসাহিত্যের এক চিরসবুজ অধ্যায়।

নারায়ণ দেবনাথের তুলিতে জন্ম নেওয়া এই দুই বন্ধু হোস্টেলজীবনের দুষ্টুমি আর মজার গল্পে মাতিয়ে রেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

নন্টে ফন্টে! নামটা শুনলেই মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলোর কথা, অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে হাসি। মনে পড়ে, সেই দুষ্টু-মিষ্টি দুটো ছেলেকে, যারা সবসময় নানান কাণ্ড করে বেড়াতো। কখনো সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের বকা খেত, আবার কখনো হোস্টেল ওলটপালট করে দিত। নন্টে ফন্টে কেবল একটি কমিকস নয়, এটি অনেকের শৈশবের আনন্দের উৎস, অবসর কাটানোর সঙ্গী আর বন্ধুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করা ছোট ছোট সুখের গল্প।

বাংলা কমিকসের ইতিহাসে নন্টে ফন্টে এক অনন্য নাম। বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য যেসব চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে নন্টে ফন্টে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং কালজয়ী। আজও এই কমিকস নতুন প্রজন্মের মন জয় করে নিচ্ছে সমানভাবে।

এই অসাধারণ চরিত্রগুলোর স্রষ্টা হলেন নারায়ণ দেবনাথ, বাংলা কমিকসের এক কিংবদন্তি নাম। তাঁর তুলনাহীন কল্পনাশক্তি ও নিপুণ আঁকার হাতেই প্রাণ পেয়েছে নন্টে, ফন্টে আর কেল্টুর মতো চরিত্ররা।

নারায়ণ দেবনাথ: এক যুগান্তকারী স্রষ্টা

নারায়ণ দেবনাথ, বাংলা কমিকসের জাদুকর। যিনি শুধু শিশুদের নয়, বড়দের মনেও পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন তার দুর্দান্ত সব চরিত্র দিয়ে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৫ সালে, কলকাতার হাতিবাগানে। ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। সে প্রেমই তাঁকে নিয়ে যায় ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে।

শিক্ষাজীবন শেষে তিনি কাজ শুরু করেন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। সেখানেই ধীরে ধীরে তার আঁকার দক্ষতা ও সৃজনশীলতা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ‘দেব সাহিত্য কুটির’ নামক প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে তাঁর কমিকস ক্যারিয়ার শুরু হয়। এবং তখনই জন্ম নেয় বাংলা কমিকসের এক নতুন অধ্যায়।

নারায়ণ দেবনাথ

নারায়ণ দেবনাথের হাতে গড়া বিখ্যাত চরিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বাটুল দ্য গ্রেট – সেই অদম্য শক্তির মানুষ, আর হাঁদা-ভোঁদা – দুই ভাইয়ের হাস্যকর কাণ্ডকারখানা। কিন্তু তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল সৃষ্টি নিঃসন্দেহে নন্টে ফন্টে।

এই দুজন দুষ্টু ছেলের প্রতিদিনকার মজার ঘটনা, হোস্টেল জীবন, কেল্টুর সাথে বুদ্ধির লড়াই আর সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের ধমক সবকিছু মিলে গড়ে উঠেছে এমন এক জগৎ, যা বাংলা কমিকসে আগে কখনো দেখা যায়নি। নন্টে ফন্টের গল্পে যেমন ছিল নিখাদ মজা, তেমনি সেখানে ছিল সমাজের কিছু বিষয়ের প্রতি সূক্ষ্ম ব্যঙ্গবিদ্রূপ। 

শিশুদের জন্য তৈরি হলেও, এই কমিকস বারবার প্রমাণ করেছে যে এটি সব বয়সী পাঠকের প্রিয়। তাই বলাই যায়, বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় চরিত্রদের ভিড়ে নারায়ণ দেবনাথের নন্টে ফন্টে এক দুর্দান্ত ও কালজয়ী সংযোজন।

নন্টে ফন্টে চরিত্রের জন্ম

নন্টে ও ফন্টে বাংলা কমিকসের এই দুই চরিত্র যেন আমাদের শৈশবের দুষ্টু দুই বন্ধু। কিন্তু জানেন কি, কিভাবে জন্ম নিয়েছিল এই দুই মজার চরিত্র?

১৯৬০-এর দশকে বাংলা সাহিত্যে শিশুদের জন্য হাসির কন্টেন্টের ঘাটতি ছিল। সেই জায়গা থেকেই নারায়ণ দেবনাথ ভাবলেন, এমন কিছু একটা তৈরি করবেন যা শিশুদের যেমন আনন্দ দেবে, তেমনি বড়রাও পড়ে মজা পাবে। সেখান থেকেই জন্ম নিল নন্টে ফন্টে।

নন্টে আর ফন্টে দুই বন্ধু, দুজনেই এক হোস্টেলে থাকে। এই হোস্টেলই পুরো গল্পের কেন্দ্র। হোস্টেলের জীবন, বন্ধুদের দুষ্টুমি, নিয়মভাঙা আর কাকতালীয় মজার ঘটনা নিয়েই সাজানো হয় কমিকসের প্রতিটি কিস্তি। নন্টে একটু চালাক, ফন্টে একটু বোকাসোকা। আর তাদের ধরা পড়া বা পালানোর চেষ্টাই হয়ে ওঠে প্রতিটি পর্বের মূল আকর্ষণ।

তবে নন্টে ফন্টের গল্পে আরও দুটি চরিত্র বিশেষভাবে জনপ্রিয় তা হলো কেল্টু ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যার। কেল্টুর খবরদারি আর হোস্টেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের কড়া অথচ মজাদার চরিত্রটির রাগ, ধমক আর মাঝে মাঝে নিজেই ফাঁদে পড়ার মুহূর্তগুলো গল্পকে করে তোলে আরও প্রাণবন্ত।

নারায়ণ দেবনাথ চেয়েছিলেন, শুধু হাসির গল্প নয়, এই কমিকসে থাকবে সমাজের ছোটখাটো ত্রুটিগুলো নিয়ে মজার ব্যঙ্গও। যেমন, অহেতুক রেগে যাওয়া, অন্যকে ফাঁসানো বা নিয়ম মানার ভান করে না মানা এসবই উঠে আসে গল্পের বাঁকে বাঁকে।

নন্টে ফন্টে কমিকসের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর রসায়ন। দুষ্টুমি, চতুরতা, ভুল বোঝাবুঝি আর ফাঁদ পাতা সবকিছু এত চমৎকারভাবে মিলে যায় যে, একবার শুরু করলে থামা যায় না। এই কমিকস শিশুদের প্রিয় হয়ে উঠেছে ঠিক এই কারণেই।

শুকতারা ও নন্টে ফন্টের যাত্রা

নন্টে ফন্টের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৯ সালে, শিশু-কিশোরদের জনপ্রিয় পত্রিকা শুকতারা-তে। এই পত্রিকাটি সেই সময়ের শিশুদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল। যখন টেলিভিশন বা ইন্টারনেট ছিল না, তখন শুকতারার একটি সংখ্যার অপেক্ষায় থাকত হাজার হাজার ছোট্ট পাঠক।

নারায়ণ দেবনাথ যখন নন্টে ফন্টের গল্প আঁকা শুরু করলেন, তখনই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন এই চরিত্রদ্বয়কে এমনভাবে গড়বেন যেন পাঠকরা নিজেদেরই বন্ধু বলে মনে করে। শুকতারায় প্রথম প্রকাশের পরপরই কমিকসটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শিশুদের চিঠি আসত পত্রিকা অফিসে নতুন নন্টে ফন্টে কখন আসবে? এবার সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যার কীভাবে ধরা খাবেন?

প্রথমদিকে এটি ছিল মাসিক প্রকাশনা। পরে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, বিশেষ সংখ্যা ও আলাদা কমিক বুক হিসেবেও প্রকাশিত হতে থাকে। অনেক সময় একাধিক গল্প একসাথে সংকলন করে বই আকারেও বের হয়।

শুকতারা পত্রিকার প্রচ্ছদ

শুকতারা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নন্টে ফন্টে হয়ে উঠেছিল এক কিংবদন্তি নাম। শুধু শিশুরাই নয়, বড়রাও লুকিয়ে লুকিয়ে এই কমিকস পড়তেন, হাসতেন, মজা করতেন।

এই কমিকস যেন ছিল এক দুষ্টু হাসির জগৎ, যেটা বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া, কিন্তু কল্পনার এক জাদুকরি চালে বাঁধা। আর এই যাত্রার পেছনে ছিল নারায়ণ দেবনাথের তুলির জাদু ও শুকতারার সাহসী মঞ্চ।

নন্টে ফন্টের স্টাইল ও আঁকার বৈশিষ্ট্য

নন্টে ফন্টে কমিকসের সাফল্যের পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো এর চিত্রভাষা। নারায়ণ দেবনাথ ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি গল্প বলতেন তার তুলি দিয়েই। তার আঁকার ধরন ছিল একেবারে সোজাসাপ্টা, স্পষ্ট আর চমৎকারভাবে ব্যঙ্গাত্মক।

তিনি কখনোই জটিল বা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আঁকা পছন্দ করতেন না। বরং চেষ্টা করতেন যেন ছোট থেকে বড় সব বয়সের পাঠক চরিত্রগুলোর মুখাবয়ব, ভঙ্গি আর আবেগ সহজেই বুঝে ফেলতে পারে। নন্টে আর ফন্টের দুষ্টু হাসি, চুপিচুপি ফন্দি আঁটা, সুপারিন্টেন্ডেন্ট স্যারের বিস্ফোরণ ঘটানো রাগ সবকিছুই ফুটে উঠত দারুণ প্রাণবন্তভাবে।

নন্টে ফন্টে কমিকস এর একটি দৃশ্য

নারায়ণ দেবনাথের আঁকা সংলাপ বক্সগুলোতেও ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ভাষা হতো সরল, সংক্ষিপ্ত আর দারুণ রসাত্মক। শব্দচয়ন ছিল এমন যে, শিশুদেরও বোঝা সহজ, আবার বড়রাও পড়ে মজা পায়।

আঁকার ধরনে তিনি অতি সূক্ষ্ম ডিটেইলে না গিয়ে বরং একধরনের “expressive minimalism” বজায় রাখতেন। অর্থাৎ কম রেখায় বেশি অর্থ তুলে ধরতেন যাতে তার আঁকা প্রতিটি ফ্রেম জীবন্ত মনে হয়।

এই আঁকার স্টাইলটাই নন্টে ফন্টে-কে করে তুলেছে চিরন্তন। চোখে দেখা যায়, তবে মনেও গেঁথে থাকে।

কমিকস হিসেবে জনপ্রিয়তার কারণ

নন্টে ফন্টে কমিকসকে বলা যায় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। কিন্তু কী এমন আছে এই কমিকসে, যা একে এত জনপ্রিয় করে তুলেছে?

প্রথমত, এর ভাষা। একদম সরল, প্রাণবন্ত আর হাস্যকর। শিশুদের উপযোগী ভাষায় সংলাপ লিখে নারায়ণ দেবনাথ এমন এক জগৎ তৈরি করেছিলেন, যেখানে কেউই নিজেকে বাইরের মনে করত না। সবাই চরিত্রগুলোর সঙ্গে মিশে যেত।

দ্বিতীয়ত, গল্পের ধরন। প্রতিটি গল্পেই থাকত কোনো না কোনো দুষ্টুমির প্ল্যান, সেটা ব্যর্থ হওয়া, এবং শেষে ধরা পড়ে যাওয়া। এই সহজ ফর্মুলার মধ্যেও প্রতিবারই থাকত নতুন চমক। কখনো খেলাধুলা, কখনো পরীক্ষা, কখনো হোস্টেলের নিয়ম ভাঙা সবকিছুই রিলেটেবল। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা তাদের নিজেদের জীবনের সঙ্গে এই কাহিনির মিল খুঁজে পেত।

তৃতীয়ত, কমিকসের সময়োপযোগী সামাজিক ইঙ্গিত। যেমন – অতিরিক্ত কড়া শাসন, ফাঁকি দেওয়া, নিজের ভুল ঢাকার চেষ্টা এসব ছোট ছোট বিষয় গল্পে হাস্যরসের মাধ্যমে উঠে আসলেও আসলে এগুলো ছিল এক ধরনের স্যাটায়ার।

বাংলা কমিকসে নন্টে ফন্টের গুরুত্ব

বাংলা সাহিত্যে শিশুদের জন্য লেখা বা আঁকা হয়েছে অনেক কিছু, কিন্তু বাংলা কমিকস ধারায় যে ক’টি সৃষ্টি আজও অমলিন, তার শীর্ষে রয়েছে নন্টে ফন্টে। এই কমিকস শুধু হাসি নয়, দিয়েছে চিন্তার খোরাকও। গল্প, সংলাপ, চরিত্র এবং চিত্রায়নের মিশেলে এমন এক জগৎ তৈরি হয়েছিল, যেখানে শিশুরা আনন্দে হারিয়ে যেতে পারত, আর বড়রাও উপভোগ করতে পারত পুরনো সময়ের স্বাদ।

বাংলা কমিকস জগতে বহু চরিত্র এসেছে—বাটুল দি গ্রেট, হাঁদা-ভোঁদা, টিনটিন বা বিদেশি কমিকসের অনুবাদ। কিন্তু নন্টে ফন্টের আলাদা অবস্থান রয়েছে কারণ এটি নিছক দুষ্টুমির গল্প নয়, বরং সমাজের এক প্রতিচ্ছবি। হোস্টেল জীবন, বন্ধুত্ব, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক আর নিত্যদিনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাগুলো এত মজারভাবে দেখানো হয়েছে যে, পাঠক তা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিতে পারে।

বাংলাদেশের শিশুদের কাছেও এই কমিকস জনপ্রিয়। অনেক সময় পুরনো সংখ্যা সংগ্রহ করে আবার পড়া হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় ওঠে, এবং কমিকস বাংলাদেশ-এর অঙ্গনেও এর বিশেষ প্রভাব রয়েছে।

নন্টে ফন্টের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ তার জাদুকরী তুলি দিয়ে বুনে এঁকেছিলেন এমন এক জগতের ছবি যা যুগ পেরিয়ে আজও সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য এবং একই সাথে  প্রাসঙ্গিক। কারণ বাংলা সাহিত্যে এমন সৃষ্টি খুব কমই এসেছে, যেগুলো যুগ পেরিয়েও প্রাণ হারায় না। নন্টে ফন্টে তেমনই এক অবিনাশী গল্প, যার হাসি আজও শোনা যায়, প্রতিটি পাতা উল্টালেই।

তথ্যসূত্র – 

Related posts

টমেটোর ইতিহাস: বিষাক্ত ফলের বিশ্বজয়ের গল্প

আবু সালেহ পিয়ার

“ডেটিং অ্যাপ: ভালবাসার ডিজিটাল ঠিকানা”

খিচুড়ির ইতিহাস: উপমহাদেশের এই প্রাচীন খাবারের অজানা গল্প

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More