কোথাও ফানুসের আলো, কোথাও ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, আর কোথাও মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে উদযাপিত হয় মুসলমানদের প্রাণের উৎসব ঈদ উল ফিতর।
ঈদ উল ফিতর, মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি শুধু একটি উৎসব নয়, বরং মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা এক বিশেষ পুরস্কার।
তবে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঈদ উল ফিতর উদযাপনের চিত্র কিন্তু একই রকম নয়। ভৌগোলিক অবস্থান, স্থানীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি ভেদে ঈদ উদযাপনের রীতি-নীতিতে দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য।
কোথাও ঈদের জামাতের পর বিশেষ খাবার বিতরণের ধুম পড়ে, আবার কোথাও আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য ও গান-বাজনার। পোশাকে থাকে ভিন্নতা, খাবারে থাকে আলাদা স্বাদ, আবার ঈদ মোবারক জানানোর ধরনেও থাকে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য।
এই আর্টিকেলে, আমরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঈদ উল ফিতর কীভাবে পালিত হয়, সেইসব অদ্ভুত ও আকর্ষণীয় রীতিনীতিগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
মধ্যপ্রাচ্যে ঈদ উৎযাপন
মধ্যপ্রাচ্যে ঈদ উল ফিতর এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশেই ঈদ উদযাপনের রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি, যা হাজার বছর ধরে চলে আসছে।
সৌদি আরব
সৌদি আরবে, বিশেষ করে মক্কা ও মদিনা শহরে ঈদ উল ফিতরের উদযাপন এক ভিন্ন মাত্রা পায়। ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবা শরীফ ও মসজিদে নববীতে ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য সারা বিশ্ব থেকে মুসলিমরা এসে জড়ো হন। মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হওয়া এক অসাধারণ দৃশ্য, যেখানে লক্ষ লক্ষ মুসল্লির সমাগম ঘটে।
ঈদের দিন সকালে, ফজরের নামাজের পর থেকেই ঈদের বিশেষ তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। নামাজ শেষে খুতবা প্রদান করা হয়, যেখানে ইমাম সাহেব ঈদ এবং ইসলামের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন। নামাজ শেষে মুসল্লিরা একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
সৌদি আরবের ঈদ উদযাপনে খেজুর ও আরবি কফি দিয়ে মেহমানদারি করা হয়, এবং ছোটদের মধ্যে ঈদ সালামি বিতরণের প্রচলন রয়েছে। সরকারিভাবে ঈদ উপলক্ষে কয়েকদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং শহরজুড়ে উৎসবের আমেজ লেগে থাকে। অনেকে এই সময় মক্কা ও মদিনার পবিত্র স্থানগুলো জিয়ারত করে ঈদ উদযাপন করেন।
মিশর
মিশরে ঈদ উল ফিতর উদযাপনের একটি অন্যতম আকর্ষণ হল ফানুস। ঈদের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই মিশরের বাজারগুলোতে নানা রঙের ও আকারের ফানুস বিক্রি হতে শুরু করে। ফানুস শুধু উড়ানোর জন্য নয়, বরং এটি মিশরের ঈদ ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ঈদের রাতে মিশরীয়রা তাদের বাড়ি এবং শহরের রাস্তাঘাট ফানুস দিয়ে সাজায়, যা এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করে। মিশরে ঈদ জামাত ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে পরিবার ও প্রতিবেশীদের মধ্যে মিষ্টি ও খাবার বিতরণ করা হয়। মিশরের ঈদে “কাহক” নামক বিশেষ বিস্কুট তৈরি করা হয়, যা খেজুর বা বাদাম দিয়ে ভরা থাকে। ছবি – মিশরের ফানুস ও ঈদগাহ
তুরস্ক
তুরস্কে ঈদ উল ফিতর “রামাজান বাইরাম” অথবা “সেকের বাইরাম” নামে পরিচিত, যার অর্থ “মিষ্টি উপহারের মতোই”, এই ঈদে মিষ্টি বিতরণের একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।
তুরস্কে ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন পোশাক পরা হয় এবং পরিবারের সদস্যরা একসাথে নাশতা করে। এই দিনের বিশেষ খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে বাকলাভা, তুর্কি ডিলাইট এবং বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি।
শিশুরা এবং ছোটরা তাদের পরিবারের বড়দের হাতে চুমু খেয়ে সালাম করে এবং ঈদ মোবারক জানায়, বিনিময়ে তারা ঈদ সালামি ও উপহার পায়।
তুরস্কের গ্র্যান্ড মসজিদগুলোতে ঈদের বিশেষ সালাত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে অসংখ্য মানুষ অংশ নেয়। নামাজ শেষে তুরস্কের মুসলিমরা কবরস্থানে গিয়ে তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের জন্য দোয়া করেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদ উল ফিতর এক জমকালো উৎসবে পরিণত হয়। এখানে ঈদ উদযাপন শুরু হয় চাঁদ দেখার রাত থেকেই, যখন শহরজুড়ে শুরু হয় আতশবাজি ও আলোকসজ্জা। এসময় দুবাই ও আবুধাবির মত শহরগুলো ঈদের রাতে বর্ণিল আলোয় সেজে ওঠে!
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদের নামাজ সাধারণত মসজিদগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়, এবং নামাজ শেষে আমিরাতি নাগরিকরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে একে অপরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে।
ঈদের দিনে এখানকার খাবার টেবিলে থাকে ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন – হারিস, খুজি এবং বিভিন্ন প্রকার ডেজার্ট। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঈদের সময় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে স্থানীয় নৃত্য, গান এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা প্রদর্শিত হয়।
দুবাই ফেস্টিভ্যাল সিটি এবং অন্যান্য প্রধান পর্যটন স্পটগুলোতে ঈদের বিশেষ ফেস্টিভ্যাল ও শো-এর আয়োজন করা হয়, যা ঈদ উদযাপনকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
এশিয়ায় ঈদ উদযাপন
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে ঈদ উদযাপনের চিত্র দেখলে মনে হয় যেন প্রাচ্যের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক মহামিলন ঘটেছে। পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, রীতিনীতি এবং আনন্দ উদযাপনের ধরনে প্রতিটি দেশেই রয়েছে নিজস্বতা, যা ঈদকে এশিয়ার সংস্কৃতিতে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ঈদ উল ফিতর সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঈদের দিন শুরু হয় ঈদের জামাতের মাধ্যমে। দেশের প্রধান ঈদগাহ ও মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে লাখো মানুষ একসাথে নামাজ আদায় করে। জামাত শেষে মুসল্লিরা কোলাকুলি ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এছাড়াও, ঈদের দিন ছোটরা বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করে এবং বড়রা তাদেরকে ঈদ সালামি দেন।
বাংলাদেশের ঈদে ফিরনি ও সেমাই এই দুইটি খাবারের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে যা প্রতিটি ঘরে তৈরি হয়। এছাড়াও পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানি এবং নানা ধরনের মিষ্টান্ন থাকে খাদ্য তালিকায়।
গ্রামীণ বাংলাদেশে ঈদের সময় মেলা বসে, যা ঈদ উৎসবের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেয়। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ, লোক গান এবং বিভিন্ন ধরনের গ্রামীণ হস্তশিল্পের পসরা সাজানো হয়। নৌকা বাইচ এবং ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের ঈদের আরও দুটি জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয়, যা ঈদের আনন্দকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
ভারত
ভারতে ঈদ উল ফিতর “ঈদুল ফিতর” বা “মিঠি ঈদ” নামে পরিচিত। ভারতে ঈদের দিন মুসলিম পুরুষরা নতুন শেরওয়ানি বা কুর্তা-পাজামা পরে ঈদগাহ বা মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে যান। মহিলারা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী সালোয়ার কামিজ অথবা শাড়ি পরেন।
ভারতীয় ঈদ খাবারের মধ্যে বিরিয়ানি ও শির খুরমা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শির খুরমা হল দুধ, সেমাই, খেজুর এবং বাদাম দিয়ে তৈরি একটি মিষ্টি খাবার, যা ঈদের সকালে প্রায় প্রতিটি মুসলিম পরিবারে পরিবেশন করা হয়।
ঈদের সময় ভারতে ঈদ কার্ড ও শুভেচ্ছা বিনিময় একটি জনপ্রিয় রীতি। বিভিন্ন শহরে ঈদের দিন বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং মুসলিম মহল্লাগুলোতে উৎসবের আমেজ লেগে থাকে।
পাকিস্তান
পাকিস্তানে ঈদ উল ফিতরের প্রস্তুতি শুরু হয় রমজানের শেষ দশ দিন থেকেই, তবে চাঁদ রাত উদযাপনের মাধ্যমে ঈদের মূল আনন্দ শুরু হয়। চাঁদ রাতে মহিলারা মেহেদি পরে এবং চুড়ি কেনে, যা ঈদ উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পাকিস্তানের ঈদ ফ্যাশনে নতুন পোশাক ও গহনার চল খুব বেশি। ঈদের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা পোশাক এবং জমকালো গহনা কেনা হয়। পাকিস্তানের ঈদ খাবারের প্রধান আকর্ষণ বিরিয়ানি এবং বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। ঈদের দিন সকালে নামাজ আদায়ের পর ঘরে ঘরে বিরিয়ানি ও মিষ্টিমুখ করা হয়।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ উল ফিতর “লেবারান” নামে পরিচিত, এবং এটি ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইন্দোনেশিয়ার ঈদ উদযাপনের শুরুটা হয় পারিবারিক কবরস্থান জিয়ারতের মাধ্যমে। ঈদের দিন সকালে পরিবারের সদস্যরা কবরস্থানে গিয়ে তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের জন্য দোয়া করেন।
নামাজ শেষে ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিটি ভোজনের আয়োজন করা হয়, যেখানে সমাজের সকল স্তরের মানুষ একসাথে খাবার গ্রহণ করে। “কেতুপাট” এবং “ওপর আয়াম” ইন্দোনেশিয়ার ঈদের দুটি বিশেষ খাবার।
ইন্দোনেশিয়ার ঈদ উদযাপনে পাটুপাট বাজানো একটি ঐতিহ্যবাহী রীতি। পাটুপাট হলো বাঁশের তৈরি এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র, যা ঈদের আনন্দ মিছিলে বাজানো হয়।
ইউরোপ ও আমেরিকাতে ঈদ উদযাপন
ইউরোপ ও আমেরিকাতে ঈদ উল ফিতর উদযাপন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর তুলনায় কিছুটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে ঈদ উদযাপনের ধরন এবং রীতি-নীতিতে কিছু স্বকীয়তা দেখা যায়।
যুক্তরাজ্য
লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার এবং লিডস-এর মতো শহরগুলোতে বিশাল ঈদগাহ ময়দান এবং বড় মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজার হাজার মুসলিম একসাথে নামাজ আদায় করে।
যুক্তরাজ্যের ঈদ উদযাপনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে সকল স্তরের মানুষ একসাথে মিলিত হয়ে খাবার গ্রহণ করে এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। যুক্তরাজ্যের পার্কগুলোতেও ঈদের দিন আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
ফ্রান্স
ফ্রান্সে ঈদ উদযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল পারিবারিক মিলন। ঈদের দিন ফরাসি মুসলিমরা তাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলিত হয়, একসাথে খাবার খায় এবং আনন্দ উদযাপন করে। ঐতিহ্যবাহী ফরাসি মুসলিম পরিবারগুলোতে ঈদের দিন আলজেরিয়ান, মরোক্কান বা তিউনিসিয়ান খাবার তৈরি করা হয়, যা তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। শহরের ইসলামিক সেন্টারগুলোতে ঈদের দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতি থেকে আসা মুসলিমরা নিজ নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদ উদযাপন করে। যুক্তরাষ্ট্রে ঈদের নামাজ সাধারণত ইসলামিক সেন্টার, মসজিদ অথবা কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টার ও মুসলিম সংগঠন ঈদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে মেলা অনুষ্ঠিত হয় এবং মুসলিম ও অমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই সেখানে আমন্ত্রিত হয়। এই পার্টিগুলো আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ এবং সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধির একটি সুযোগ তৈরি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঈদ উৎসবে বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন করা হয়, যা দেশটির মুসলিম কমিউনিটির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমরা তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন – বিরিয়ানি, কাবাব, হালিম, বাকলাভা এবং অন্যান্য ডেজার্ট পরিবেশন করে।
কানাডা
কানাডার মুসলিম সম্প্রদায় বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতি থেকে আগত, এবং তারা সম্মিলিতভাবে ঈদ উদযাপন করে। কানাডার শহরগুলোতে মাল্টিকালচারাল ঈদ ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়।
টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, ভ্যানকুভার এবং অটোয়ার মতো শহরগুলোতে ঈদ উপলক্ষে বড় আকারের ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা হয়, যেখানে বিভিন্ন দেশের মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। এই ফেস্টিভ্যালগুলোতে খাবার, পোশাক, হস্তশিল্প এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনার স্টল থাকে, যা ঈদকে একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করে।
কানাডাতে ঈদ উদযাপনে বিভিন্ন ইসলামিক সংস্থা এবং কমিউনিটি গ্রুপ দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে খাদ্য ও উপহার বিতরণের কার্যক্রম চালায়, যা ঈদের আনন্দকে আরও মানবিক করে তোলে।
আফ্রিকা মহাদেশে ঈদ উদযাপন
আফ্রিকার মুসলিম সম্প্রদায় ঈদকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবেই পালন করে না, বরং এটিকে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার এবং নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার এক মূল্যবান সুযোগ হিসেবেও গ্রহণ করে।
নাইজেরিয়া
নাইজেরিয়া, আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, এবং এখানে ঈদ উল ফিতর অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। নাইজেরিয়ার মুসলিমরা ঈদের দিন সকালে নতুন ও রঙিন পোশাকে সজ্জিত হয়ে ঈদ উদযাপন করে। পোশাকের রঙ এবং নকশা স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়, যা নাইজেরিয়ার ঈদ ফ্যাশনকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে।
ঈদের দিন নাইজেরিয়ার ঘরে ঘরে বিশেষ খাবার তৈরি করা হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “তুও ও অ্যামালা” (Tuwo and Amala), “রাইস উইথ স্ট্যু” (Rice with Stew) এবং বিভিন্ন ধরনের মাংসের পদ।
ঈদের আনন্দে নাইজেরিয়ার মানুষজন নাচ-গান ও বিভিন্ন লোকজ অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। তবে নাইজেরিয়ার ঈদ উদযাপনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো দরবার উৎসব (durbar festival)। এই উৎসবে দেশটির আমির (শাসক) এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করেন।
মরক্কো
মরক্কোতে ঈদ উল ফিতর “ঈদ সেগির” বা ছোট ঈদ নামে পরিচিত, এবং এটি অত্যন্ত ভক্তি ও আনন্দের সাথে পালিত হয়। মরক্কোর মুসলিমরা ঈদের দিন সকালে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান। পুরুষরা সাধারণত “জিলবাব” এবং “টারবৌশ” পরেন, এবং মহিলারা “কাফতান” ও “হিজাব” পরিধান করেন।
ঈদের নামাজের পর মরক্কোর পরিবারগুলোতে পারিবারিক ভোজন ও মিষ্টি খাবার এর আয়োজন করা হয়। “তাজিন” (Tagine) এবং “কুসকুস” (Couscous) মরক্কোর ঈদের প্রধান খাবার, এছাড়াও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি যেমন – “গাজেল হর্নস” (Gazelle Horns) এবং “বাকলাভা” পরিবেশন করা হয়।
মরক্কোর ঈদ উদযাপনের একটি বিশেষ ঐতিহ্য হলো হেনা নাইট উদযাপন। ঈদের আগের রাতে মহিলারা হাতে ও পায়ে মেহেদি লাগান, যা আনন্দ ও উৎসবের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেনেগাল
সেনেগালে ঈদ উল ফিতর “কোরিতে” নামে পরিচিত এবং এটি অত্যন্ত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয়।
সেনেগালের ঈদে থিয়েবুডিয়েন সহ ঐতিহ্যবাহী খাবার এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। থিয়েবুডিয়েন হলো মাছ, ভাত এবং সবজি দিয়ে তৈরি একটি জনপ্রিয় সেনেগালী খাবার, যা ঈদের দিনে প্রায় প্রতিটি ঘরে রান্না করা হয়। এছাড়াও, ইয়াসা” (Yassa) এবং “মাফে” (Mafé) -এর মতো ঐতিহ্যবাহী খাবারও পরিবেশন করা হয়।
সেনেগালের ঈদ উদযাপনের অন্যতম আকর্ষণ হলো গামুস উৎসব। এটি মূলত একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব, যা ঈদ উল ফিতরের কয়েক দিন পর পালিত হয়। গামুস উৎসবে স্থানীয় সুফি মুসলিম তরিকার অনুসারীরা বিশেষ গান, নাচ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যা সেনেগালের ঈদ উদযাপনকে আরও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার ঈদ উদযাপনের অন্যতম বিশেষত্ব হলো বর্ণিল ঈদ প্যারেড। কেপ টাউন এবং ডারবানের মতো শহরগুলোতে ঈদের দিন মুসলিমরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক, ইসলামিক গান ও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক উপাদান তুলে ধরা হয়। এই প্যারেড দেখতে বহু মানুষ রাস্তায় ভিড় করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ঈদে খাবারের তালিকায় বুয়েরওয়ার্স সহ বিভিন্ন খাবার-এর মিশ্রণ দেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ঈদ উদযাপন মূলত বহু সংস্কৃতি, আনন্দ এবং সামাজিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
যতই বৈচিত্র্যেপূর্ণ হওক, ঈদ উল ফিতরের মূল সুর কিন্তু একই। আর তা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, রমজানের ত্যাগ ও সংযমের উদযাপন, এবং সমাজের সকলের মাঝে শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমরা ঈদ উদযাপন করে, তবে তাদের সকলের বিশ্বাস, ঐক্য এবং মূল রীতিনীতি একই থাকে। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়, যাকাতুল ফিতর প্রদান, দরিদ্রদের সাহায্য করা, এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া – এই মৌলিক বিষয়গুলোতে পুরো মুসলিম বিশ্ব যেন একাত্ম।
তথ্যসূত্র
- https://www.news24bd.tv/details/169732
- https://www.bbc.com/bengali/news-48523018
- https://www.dailyjanakantha.com/international/news/684747
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A7%80-%E0%A6%88%E0%A6%A6-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8-%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%A4%E0%A6%BF
- https://bangla.thedailystar.net/%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%88%E0%A6%A6-343981