Image default
ইতিহাসইতিহাস ১০১

বারকোডের ইতিহাস: এক ছোট্ট লাইন কিভাবে বদলে দিলো দুনিয়া

সৈকতের বালিতে আঁকা মোর্স কোডের সংকেত থেকে জন্ম নিয়েছিল এক প্রযুক্তি, যা আজ বিশ্বের প্রতিটি পণ্যকে দিয়েছে নিজস্ব পরিচয়। এটি বারকোডের সেই অবিশ্বাস্য গল্প যেখানে সাদা-কালো দাগের এই ছোট্ট চিহ্নটি কেনাকাটা এবং ব্যবসার দুনিয়ায় এনেছিল এক নীরব বিপ্লব।

আমরা যখন কোনো সুপারশপে যাই, তখন ক্যাশ কাউন্টারে একটি দৃশ্য আমাদের সবার পরিচিত। ক্যাশিয়ার প্রতিটি পণ্য হাতে নেন, একটি লাল লেজার আলো পণ্যের গায়ে থাকা সাদা-কালো দাগের উপর ফেলেন, আর সাথে সাথে একটি ‘বিপ’ শব্দ হয় এবং কম্পিউটারে পণ্যের নাম ও দাম চলে আসে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি এতটাই দ্রুত এবং স্মুথ যে, আমরা হয়তো এটি নিয়ে ভাবিও না। কিন্তু এই সাধারণ দেখতে সাদা-কালো দাগগুলো, অর্থাৎ বারকোড, আধুনিক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী একটি আবিষ্কার।

এটি শুধু একটি চিহ্ন নয়, এটি একটি নীরব ভাষা, যা মেশিন পড়তে পারে। এই ছোট্ট প্রযুক্তিটিই আজকের গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন, রিটেইল ব্যবসা এবং ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্টের মূল ভিত্তি। কিন্তু কীভাবে জন্ম নিল এই যুগান্তকারী প্রযুক্তি? কে ছিলেন এর পেছনের স্বপ্নদ্রষ্টা? একটি সাধারণ ধারণা থেকে বিশ্ব বদলে দেওয়ার মতো প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার পেছনের গল্পটি সিনেমার চেয়েও বেশি নাটকীয়।

সমস্যার জন্ম: যখন চেকআউট ছিল এক দুঃস্বপ্ন

বারকোডের গল্প বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৪০-এর দশকে। তখন আজকের মতো বড় বড় সুপারশপের ধারণা সবেমাত্র জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। কিন্তু এর সাথে জন্ম নিয়েছিল এক বিশাল সমস্যা। দোকানের প্রতিটি পণ্যের দাম ম্যানুয়ালি টাইপ করে বা পাঞ্চ করে হিসাবে ঢোকাতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। চেকআউট লাইনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা ছিল ক্রেতাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন, আর বিক্রেতাদের জন্য ইনভেন্টরি বা মজুত ব্যবস্থাপনা ছিল এক প্রায় অসম্ভব কাজ।

চেকআউটে দীর্ঘ লাইন

১৯৪৯ সালে, ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির একজন ডিন, স্থানীয় একটি ফুড চেইনের মালিকের কাছ থেকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য চেয়ে একটি অনুরোধ পান। সেই অনুরোধটি শুনতে পান বার্নার্ড সিলভার নামে একজন তরুণ গ্র্যাজুয়েট ছাত্র। তিনি বিষয়টি নিয়ে তার বন্ধু, নরম্যান জোসেফ উডল্যান্ডের সাথে আলোচনা করেন, যিনিও একই প্রতিষ্ঠানের একজন ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। এই একটি সমস্যাই জন্ম দিয়েছিল এক ঐতিহাসিক সমাধানের।

সৈকতের বালিতে জন্ম নিল যে ধারণা

নরম্যান জোসেফ উডল্যান্ড সমস্যাটি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এমন একটি সিস্টেম দরকার, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্যের তথ্য শনাক্ত করতে পারবে। কিন্তু কীভাবে?

এর উত্তর তিনি পেয়েছিলেন এক অপ্রত্যাশিত জায়গায়, মিয়ামির সৈকতে। একদিন তিনি সৈকতে বসে অলসভাবে বালির উপর আঙুল দিয়ে দাগ কাটছিলেন। তিনি মোর্স কোডের কথা ভাবছিলেন, যেখানে ডট (.) এবং ড্যাশ (-)-এর মাধ্যমে তথ্যকে সংকেতে রূপান্তরিত করা হয়। তিনি ভাবলেন, এই ডট এবং ড্যাশগুলোকে যদি টেনে লম্বা করে সরু এবং মোটা লাইনে পরিণত করা যায়, তবে কেমন হয়? তিনি বালির উপর আঙুল দিয়ে চারটি দাগ টানলেন এবং তারপর সেগুলোকে নিচের দিকে টেনে লম্বা করে সরু ও মোটা লাইনের একটি প্যাটার্ন তৈরি করলেন।

মোর্স কোড ও বারকোড

এই মুহূর্তটিই ছিল বারকোডের জন্মের “ইউরেকা মোমেন্ট”। উডল্যান্ড বুঝতে পারছিলেন, এই ভিন্ন ভিন্ন প্রস্থের লাইনগুলো ব্যবহার করে একটি অপটিক্যাল স্ক্যানার দিয়ে তথ্য পড়া সম্ভব। তিনি বার্নার্ড সিলভারের সাথে মিলে এই ধারণাটিকে আরও উন্নত করার কাজ শুরু করেন।

প্রথম বারকোড: ষাঁড়ের চোখের মতো দেখতে

তাদের প্রথম ডিজাইনটি আজকের দিনের আয়তাকার বারকোডের মতো ছিল না। তারা বুঝতে পারছিলেন, একটি আয়তাকার বারকোড স্ক্যান করার জন্য সেটিকে একটি নির্দিষ্ট দিক থেকে স্ক্যান করতে হবে। এই সমস্যা দূর করার জন্য, তারা একটি বৃত্তাকার বারকোড ডিজাইন করেন, যা দেখতে অনেকটা ষাঁড়ের চোখের (Bull’s-eye) মতো ছিল। এর সুবিধা ছিল, এটিকে যেকোনো দিক থেকেই স্ক্যান করা যেত। ১৯৫২ সালের ২০শে অক্টোবর, উডল্যান্ড এবং সিলভার তাদের এই “ক্লাসিফাইং অ্যাপারেটাস অ্যান্ড মেথড”-এর জন্য মার্কিন পেটেন্ট লাভ করেন।

কিন্তু একটি বড় সমস্যা ছিল। তাদের ধারণাটি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। ১৯৫০-এর দশকে, এই বারকোড পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় লেজার এবং কম্পিউটার প্রযুক্তি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং প্রায় অস্তিত্বহীন। ফলে, তাদের এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটি কয়েক দশক ধরে প্রায় বিস্মৃতির অতলেই পড়ে থাকে। উডল্যান্ড আইবিএম (IBM)-এ যোগদান করেন এবং সিলভার তার একাডেমিক ক্যারিয়ারে ফিরে যান।

প্রথম দিকের গোল বারকোড

প্রযুক্তিগত বিপ্লব: স্ক্যানারের জন্ম এবং বারকোডের জাগরণ

ষাটের দশকে দুটি বড় উদ্ভাবন বারকোডের ভাগ্যকে নতুন করে লিখতে সাহায্য করে:

১. লেজারের আবিষ্কার: লেজার প্রযুক্তির উদ্ভব এবং এর দাম কমে আসায়, একটি সস্তা এবং কার্যকর স্ক্যানার তৈরি করার পথ খুলে যায়।

২. কম্পিউটারের বিস্তার: মাইক্রোচিপের আবিষ্কারের ফলে কম্পিউটার আকারে ছোট এবং দামে সস্তা হতে শুরু করে, যা রিটেইল স্টোরগুলোতে ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

এই সময়ে, আমেরিকার গ্রোসারি বা মুদি দোকানগুলোর ইন্ডাস্ট্রি তাদের চেকআউট সমস্যা সমাধানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। তারা একটি স্ট্যান্ডার্ড বা অভিন্ন পণ্য কোডিং সিস্টেম তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠন করে। এই খবর পেয়ে, আইবিএম-এ কর্মরত উডল্যান্ড এবং অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নতুন করে বারকোড প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করে।

উডল্যান্ডের বুলস আই ডিজাইনটি প্রিন্টিং-এর সময় কালি ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে সমস্যা তৈরি করত। তাই, জর্জ লরার নামে আইবিএম-এর একজন প্রকৌশলী, উডল্যান্ডের মূল ধারণার উপর ভিত্তি করে আজকের দিনের আয়তাকার বা লিনিয়ার বারকোড ডিজাইনটি তৈরি করেন, যা ইউনিভার্সাল প্রোডাক্ট কোড (UPC) নামে পরিচিতি পায়। এই ডিজাইনটি প্রিন্ট করা সহজ ছিল এবং এটি আরও বেশি তথ্য ধারণ করতে পারত। ১৯৭৩ সালে, আমেরিকার গ্রোসারি ইন্ডাস্ট্রি আইবিএম-এর এই UPC ডিজাইনটিকেই তাদের অফিসিয়াল বারকোড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গ্রহণ করে।

ঐতিহাসিক সেই মুহূর্ত: প্রথম বারকোড স্ক্যান

অবশেষে, সেই ঐতিহাসিক দিনটি আসে। ১৯৭৪ সালের ২৬শে জুন, সকাল ৮:০১ মিনিটে, ওহাইও-র ট্রয় শহরে অবস্থিত মার্শ’স সুপারমার্কেটে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে একটি পণ্যের বারকোড স্ক্যান করা হয়। ক্লাইড ডসন নামে একজন ক্রেতা ১০টি চুইংগামের একটি প্যাকেট (Wrigley’s Juicy Fruit gum) কিনেছিলেন এবং শ্যারন বুচানন নামে একজন ক্যাশিয়ার সেটি স্ক্যান করেন। ‘বিপ’ শব্দের সাথে সাথে ক্যাশ রেজিস্টারে ৬৭ সেন্ট যোগ হয়ে যায়।

সেই ছোট্ট চুইংগামের প্যাকেটটি এখন আমেরিকার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আমেরিকান হিস্ট্রিতে সংরক্ষিত আছে। এই একটি স্ক্যানই ছিল এক নীরব বিপ্লবের সূচনা, যা আগামী কয়েক দশকে পুরো বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যকে বদলে দেবে।

বারকোড যেভাবে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হলো

প্রথমদিকে, বারকোড সিস্টেম চালু করা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দোকানগুলোকে দামী স্ক্যানার এবং কম্পিউটার সিস্টেম বসাতে হতো, এবং পণ্য প্রস্তুতকারকদের তাদের প্যাকেজিং নতুন করে ডিজাইন করতে হতো। এর ফলে, প্রথম কয়েক বছর এর বিস্তার ছিল বেশ ধীর।

কিন্তু আশির দশকে, কে-মার্ট এবং ওয়ালমার্টের মতো বড় বড় রিটেইল চেইনগুলো যখন তাদের সমস্ত স্টোরে বারকোড সিস্টেম চালু করে, তখন এর আসল সুফল প্রকাশ পেতে শুরু করে।

  • গতি ও নির্ভুলতা: চেকআউট প্রক্রিয়া অবিশ্বাস্যরকম দ্রুত এবং নির্ভুল হয়ে ওঠে।
  • ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট: বিক্রেতারা রিয়েল-টাইমে জানতে পারতেন, কোন পণ্যটি কত পরিমাণে বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে, তারা তাদের মজুদকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে পারত।
  • ডেটা বিশ্লেষণ: বারকোড থেকে প্রাপ্ত ডেটা কোম্পানিগুলোকে ক্রেতাদের কেনার অভ্যাস সম্পর্কে তথ্য দিত, যা তাদের মার্কেটিং এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় সাহায্য করত।

এই সুবিধাগুলো দেখে, ধীরে ধীরে বিশ্বের সব ধরনের ইন্ডাস্ট্রি রিটেইল থেকে শুরু করে লাইব্রেরি, এয়ারলাইন থেকে শুরু করে হাসপাতাল বারকোড প্রযুক্তি গ্রহণ করে।

QR কোড বনাম বারকোড: নতুন প্রজন্মের আগমন

ঐতিহ্যবাহী লিনিয়ার বারকোড শুধু সীমিত পরিমাণ সংখ্যাসূচক তথ্য (সাধারণত ১২-১৪ ডিজিট) ধারণ করতে পারে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে, আরও বেশি তথ্য ধারণ করার জন্য একটি নতুন ধরনের কোডের প্রয়োজন দেখা দেয়।

১৯৯৪ সালে, জাপানের ডেনসো ওয়েভ কোম্পানি কিউআর কোড (Quick Response Code) আবিষ্কার করে। এটি একটি টু-ডাইমেনশনাল (2D) বারকোড, যা লিনিয়ার বারকোডের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি তথ্য ধারণ করতে পারে। এটি শুধু সংখ্যাই নয়, অক্ষর, ওয়েবসাইটের লিঙ্ক এবং অন্যান্য জটিল তথ্যও ধারণ করতে পারে। স্মার্টফোনের ক্যামেরার মাধ্যমে সহজেই স্ক্যান করা যায় বলে, কিউআর কোড আজ পেমেন্ট, মার্কেটিং এবং তথ্য শেয়ার করার জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তবে, কিউআর কোডের জনপ্রিয়তা বাড়লেও, ঐতিহ্যবাহী বারকোডের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। রিটেইল এবং লজিস্টিকসে দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য পণ্য শনাক্তকরণের জন্য UPC বারকোড আজও অপরিহার্য।

পেমেন্টের কিউআর কোড

নরম্যান জোসেফ উডল্যান্ড এবং বার্নার্ড সিলভারের সেই স্বপ্নটি হয়তো তাদের জীবদ্দশায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি এবং তারা তাদের আবিষ্কার থেকে আর্থিকভাবে লাভবানও হতে পারেননি। কিন্তু তাদের সেই ছোট্ট ধারণাটিই এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা ছাড়া আজকের আধুনিক বিশ্বকে কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।

তাই, পরেরবার যখন আপনি সুপারশপের কাউন্টারে সেই পরিচিত ‘বিপ’ শব্দটি শুনবেন, তখন একবারের জন্য হলেও সেই দুই স্বপ্নদ্রষ্টার কথা স্মরণ করবেন, যারা একটি সাধারণ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে পুরো পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র –

Related posts

কীভাবে আপনার হাতে এলো ‘শপিং ব্যাগ’

রূপকুন্ড লেক: হিমালয়ের কঙ্কাল হ্রদের অজানা সব রহস্য

ভালোবাসা দিবসের সাতকাহন

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More