Image default
যাপন

৫টি কার্যকরী টিপস: অনলাইনে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব শপিং করার উপায়

আপনার একটি কেনাকাটাই বাঁচাতে পারে পরিবেশকে। নিশ্চয়ই ভাবছেন কিভাবে?

পছন্দের ব্র্যান্ড বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে ডেলিভারির সময় বাছাই ; এরকম ছোট ছোট পরিবর্তনেই পরিবেশে বড় ইতিবাচক প্রভাব রাখা সম্ভব। পরিবেশ রক্ষা করে কীভাবে স্মার্ট ও সবুজ শপিং করবেন, সেটিই জানবো আজকের লেখায়।

মাত্র একটি ক্লিকেই ঘরের দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে নিজেদের পছন্দের পোশাক, প্রয়োজনীয় গ্যাজেট বা নিত্যদিনের বাজার। অনলাইন শপিং নিঃসন্দেহে আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। যানজট এড়িয়ে, সময় বাঁচিয়ে কেনাকাটার এই সুবিধা আমরা সবাই উপভোগ করি। 

কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, আমাদের এই সহজ জীবনযাত্রার পেছনে পরিবেশকে কী পরিমাণ মূল্য দিতে হচ্ছে?

প্রতিটি অনলাইন অর্ডারের সাথে জড়িয়ে আছে প্লাস্টিকের মোড়ক, কার্ডবোর্ডের বাক্স, ডেলিভারি ভ্যানের কার্বন নিঃসরণ এবং তার সাথে যোগ হয়েছে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার এক বিশাল সংস্কৃতি। এই সবকিছু মিলেই তৈরি হচ্ছে এক বিরাট পরিবেশগত সংকট, যা আমরাও বুঝতেও পারছি না। 

তবে এর মানে এই নয় যে, আমাদের অনলাইন শপিং পুরোপুরি বর্জন করতে হবে। বরং, একজন সচেতন ক্রেতা হিসেবে আমরা কিছু কার্যকরী কৌশল অবলম্বন করে খুব সহজে আমাদের কেনাকাটাকে অনেক বেশি টেকসই  এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারি।

আজকের লেখায় আমরা তেমনই ৫টি কার্যকরী টিপস নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনাকে একজন সবুজ এবং দায়িত্বশীল অনলাইন ক্রেতা হতে সাহায্য করবে। এই উপায়গুলো শুধু পরিবেশ রক্ষাই করবে না, দীর্ঘমেয়াদে আপনার অর্থ সাশ্রয় করতেও হবে দারুণ সহায়ক।

টিপস ১: ব্র‍্যান্ড ও তার উপাদান বাছাই

কেনাকাটার আগে ব্র্যান্ডটির ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ ভালোভাবে দেখুন। তারা কি তাদের পণ্য তৈরিতে পরিবেশবান্ধব উপাদান ব্যবহার করে? তাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া কি পরিবেশের ক্ষতি কম করে? তারা কি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি দেয়? 

যে ব্র্যান্ডগুলো এই বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখে (যেমন—তাদের ওয়েবসাইটে ‘Sustainability’ বা ‘Our Ethics’ নামে আলাদা সেকশন থাকে), তাদের অগ্রাধিকার দিন। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অনেক ছোট-বড় ব্র্যান্ড গড়ে উঠেছে, যারা রিসাইকেল করা উপাদান বা অর্গানিক কটন দিয়ে পোশাক তৈরি করে।

বাংলাদেশী বিভিন্ন পোশাক ব্র‍্যান্ড

এছাড়া, ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ ব্র্যান্ডগুলো খুব কম দামে নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাক বাজারে নিয়ে আসে। এই পোশাকগুলো সাধারণত নিম্নমানের উপাদান দিয়ে তৈরি হয় এবং খুব বেশিদিন টেকে না। এর ফলে, মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পোশাক কেনে এবং পুরনো পোশাকগুলো দ্রুতই আবর্জনায় পরিণত হয়, যা পরিবেশের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। এর পরিবর্তে, এমন পোশাক বা পণ্য কিনুন যা টেকসই এবং দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়।

পাশাপাশি, পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে অর্গানিক কটন, লিনেন বা রিসাইকেল করা পলিয়েস্টারের মতো উপাদান বেছে নিন। প্লাস্টিকের পণ্যের পরিবর্তে কাঠ, বাঁশ বা কাঁচের মতো প্রাকৃতিক এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি জিনিস কিনুন।

টিপস ২: একসাথে অর্ডার করুন এবং ধীরগতির ডেলিভারি বেছে নিন 

আমরা প্রায়শই প্রয়োজনের কথা না ভেবেই ছোট ছোট জিনিস আলাদাভাবে অর্ডার করে ফেলি। আজ একটি বই, কাল একটি চার্জার; এই ছোট ছোট অর্ডারগুলো পরিবেশের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।

এছাড়া, কার্বন ফুটপ্রিন্ট শব্দটির সাথে আমাদের অনেকেরই পরিচয় নেই৷ কিন্তু এই কার্বন ফুটপ্রিন্ট আমাদের পরিবেশকে কতটা ক্ষতির মুখে ফেলছে, তা আমাদের চিন্তারও বাইরে।

প্রতিটি ডেলিভারির জন্য ডেলিভারি ভ্যান বা মোটরসাইকেলকে রাস্তা দিয়ে চলতে হয়, যা কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। একেই বলা হয় কার্বন ফুটপ্রিন্ট। যত বেশি আলাদা ডেলিভারি, তত বেশি কার্বন নিঃসরণ। আর এ কারণে পরিবেশও প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

ডেলিভারি ম্যান একজন ক্রেতাকে ডেলিভারি দিচ্ছে

এই সমস্যা থেকে বাঁচতে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর একটি তালিকা তৈরি করুন এবং মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এক বা দুটি বড় অর্ডারে সেগুলো একসাথে কিনুন। এর ফলে, বিক্রেতা একটি মাত্র প্যাকেজে সবগুলো জিনিস পাঠাতে পারবে এবং ডেলিভারি গাড়িকে একবারই আপনার ঠিকানায় আসতে হবে। এতে প্যাকেজিং বর্জ্য এবং কার্বন নিঃসরণ দুটোই কমবে। তার সাথে ‘এক্সপ্রেস শিপিং’ বা ‘দ্রুত’ ডেলিভারি বর্জন করুন। 

টিপস ৩: প্যাকেজিং নিয়ে সচেতন হন 

অনলাইন শপিংয়ের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো প্রোডাক্টের অতিরিক্ত প্যাকেজিং। একটি ছোট পণ্যের জন্যও অনেক সময় একাধিক প্লাস্টিকের ব্যাগ, বাবল র‍্যাপ এবং বড় কার্ডবোর্ডের বাক্স ব্যবহার করা হয়, যা মুহূর্তের মধ্যেই আবর্জনায় পরিণত হয়।

অর্ডার করার সময় বিক্রেতার কাছে একটি নোট বা মেসেজ পাঠানোর অপশন থাকলে, সেখানে সবিনয়ে অনুরোধ করুন যেন তারা ন্যূনতম এবং প্লাস্টিক-মুক্ত প্যাকেজিং ব্যবহার করে। অনেক পরিবেশ-সচেতন ব্র্যান্ড এখন রিসাইকেল করা কাগজ বা বায়োডিগ্রেডেবল উপাদান দিয়ে প্যাকেজিং করছে।

আপনার অর্ডারের সাথে যে বাক্স বা প্যাকেটগুলো আসে, সেগুলো ফেলে না দিয়ে রিসাইকেলিং বা পুনরায় ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। যেগুলো পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব নয়, সেগুলো রিসাইকেল করার জন্য সঠিক জায়গায় ফেলুন।

অনলাইন প্রোডাক্ট এর ডেলিভারি পাওয়ার পর প্যাকেজিং খোলা হচ্ছে

টিপস ৪: আবেগে পড়ে কেনাকাটা বন্ধ করুন এবং প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিন 

অনলাইন শপগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে আমরা আবেগতাড়িত হয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ফেলি। ‘ফ্ল্যাশ সেল’, ‘লিমিটেড টাইম অফার’ বা আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন—এই সবকিছুই আমাদের মধ্যে ‘এখনই কিনতে হবে’ এমন একটি তাড়না তৈরি করে।

যদি কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস (যেমন-একটি নতুন পোশাক বা গ্যাজেট) কেনার খুব ইচ্ছে জাগে, তবে সাথে সাথে না কিনে সেটিকে আপনার ‘উইশলিস্ট’-এ যোগ করে ৩০ দিন অপেক্ষা করুন। এক মাস পরেও যদি আপনার মনে হয় যে, জিনিসটি আপনার সত্যিই প্রয়োজন, তবেই কিনুন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কয়েকদিন পরেই সেই কেনার ইচ্ছাটি আর থাকে না।

অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা কমাতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রমোশনাল ইমেইল বা নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখতে পারেন। 

টিপস ৫: সেকেন্ড-হ্যান্ড পণ্য কিনুন

টেকসই জীবনযাত্রার অন্যতম সেরা উপায় হলো নতুন পণ্য উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করে পুরনো পণ্যকেই নতুন করে ব্যবহার করা৷  আর এই কাজ করতে সেকেন্ড-হ্যান্ড বা পূর্বে ব্যবহৃত পণ্য কেনার কোন বিকল্প হতে পারে না। 

নিশ্চয়ই ভাবছেন কেন সেকেন্ড-হ্যান্ড ভালো? 

উত্তরটা খুবই সহজ। যখন আপনি একটি পূর্বে ব্যবহৃত পণ্য কেনেন, তখন আপনি সেটিকে আবর্জনায় পরিণত হওয়া থেকে বাঁচান। এর ফলে, একটি নতুন পণ্য তৈরির জন্য যে প্রাকৃতিক সম্পদ, শক্তি এবং পানি খরচ হতো, সেটিও বেঁচে যায়।

বর্তমানে ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এমন অনেক গ্রুপ বা অনলাইন শপ রয়েছে, যেখানে ভালো মানের ব্যবহৃত পোশাক, বই, আসবাবপত্র বা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট কেনা-বেচা হয়। এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে আপনি খুব কম খরচে দারুণ সব জিনিস পেতে পারেন।

এছাড়া, সেকেন্ড-হ্যান্ড কেনাকাটা ‘সার্কুলার ইকোনমি’ বা বৃত্তাকার অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মূল ধারণা হলো, কোনো কিছুকে একবার ব্যবহার করে ফেলে না দিয়ে, সেটিকে বারবার ব্যবহার, মেরামত বা রিসাইকেল করে তার জীবনচক্রকে দীর্ঘায়িত করা।

অনলাইন শপিং আমাদের আধুনিক জীবনের এমন একটি বাস্তবতা যেটিকে পুরোপুরি বর্জন করা একেবারেই সম্ভব নয়। তবে একজন সচেতন ক্রেতা হিসেবে আমরা অবশ্যই এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো কমাতে পারি। উপরে আলোচিত ৫টি টিপস অনুসরণ করার বিষয়টি প্রথমদিকে একটু কঠিন মনে হলেও একবার অভ্যাসে পরিণত করতে পারলে এটিই একসময় আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠবে।

তথ্যসূত্র- 

Related posts

মাত্র ৫ মিনিটে স্ট্রেস কমাবেন কীভাবে? বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সহজ উপায়

রিজওয়ানা রহমান

ফেস ইয়োগা: উপায় তরুণ দেখানোর প্রাকৃতিক জাদু

আশা রহমান

হতাশা, একাকীত্ব আর ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল: কীভাবে সামলাবেন?

ফাবিহা বিনতে হক

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More