Image default
কী ও কেন

পিঙ্ক ট্যাক্স- কেন নারীদের পণ্যের বেশি দাম দিতে হয়?

পুরুষ এবং নারীর জন্য তৈরি একই ধরনের প্রোডাক্ট হওয়া সত্ত্বেও  আপনি স্রেফ নারী বলে দিতে হচ্ছে অধিক মূল্য।

খেয়াল করে দেখবেন, ফোন, ঘড়ি, জামাকাপড়, জুতো, বা ফ্যাশন সম্পর্কিত যে কোনও জিনিস কিনতে গেলে, এর গোলাপী রঙ এর পণ্যটির দাম হয় সবচেয়ে বেশি। 

কারণ, গোলাপী নারীদের রঙ বলে মনে করা হয়। এটাকে ‘পিঙ্ক ট্যাক্স’ বা ‘গোলাপী কর’ বলা হয়। তবে, এটা কোনও সরকারি ট্যাক্স নয়।

গোলাপী রঙের শাড়ি

পিঙ্ক ট্যাক্স কী?

পিঙ্ক ট্যাক্স বলতে বোঝায়, নারীদের জন্য বাজারজাত করা পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অতিরিক্ত মূল্য। শেভিং রেজর, শ্যাম্পু, এমনকি খেলনার মতো সাধারণ পণ্যগুলোও যদি নারীদের জন্য তৈরি হয়, তবে সেগুলোর দাম পুরুষদের অনুরূপ পণ্যের তুলনায় বেশি রাখা হয়। শুধু গোলাপী রঙের প্যাকেজিং বা “for her” ট্যাগ যোগ করলেই দাম বেড়ে যায়!

গবেষণায় দেখা গেছে, পোশাক, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সম্পর্কিত সামগ্রী ও খেলনাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নারীদের পণ্যের দাম গড়ে ৭.০ শতাংশ বেশি রাখা হয়। উদাহরণ হিসেবে, জনপ্রিয় জিলেট ভেনাস রেজর নেওয়া যেতে পারে—এর ডিজাইন প্রায় একই রকম হলেও পুরুষদের রেজরের তুলনায় এর দাম বেশি। ভেবে দেখুন যে একটি রেজরের মূল কাজ কী? পুরুষের ক্ষেত্রে একটি রেজরের যা ভূমিকা একজন নারীর ক্ষেত্রে কি সেটি বদলে যায়? 

তবুও নীলের বদলে গোলাপী রঙের মোড়কে কিছুটা ফুলেল নকশায় (তথাকথিত নারীসুলভ) যদি সেটি নারীদের উদ্দেশ্য করেই বাজারে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে দাম হাঁকা হবে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। এমনকি শিশুদের খেলনাও এই বৈষম্য থেকে মুক্ত নয়; সামান্য গোলাপী রঙ যোগ করলেই বেড়ে যায় মূল্য!

‘পিঙ্ক ট্যাক্স’ শব্দটি প্রথম আলোচনায় উঠে আসে ২০১৫ সালে। নিউইয়র্কের একটি গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষের জন্য তৈরি নানা জিনিসের তুলনায় নারীদের জন্য তৈরি জিনিসের দাম বেশি। এটিকে পিঙ্ক ট্যাক্স বলে অবিহিত করা হয়। নারীদের কাছ থেকে গোপনে এই কর আদায়ের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ হয়েছিল, কিন্তু এখনও এই কর আদায় করা হচ্ছে।

নারীদের শেভিং রেজর

পিঙ্ক ট্যাক্স কীভাবে কাজ করে?

এই ধরনের কর মূলত সেইসব পণ্য থেকে সংগ্রহ করা হয়, যেগুলো বিশেষভাবে নারীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়। নারীরা নিজেদের মেক-আপ, নেইল পেইন্ট, লিপস্টিক, কৃত্রিম গয়না, স্যানিটারি প্যাড ইত্যাদি পণ্যের জন্য বেশি অর্থ খরচ করেন। পুরুষ ও নারী উভয় দ্বারাই ব্যবহার হয়, যেমন সুগন্ধি, পেন, ব্যাগ, চুলের তেল, রেজার এবং জামাকাপড় ইত্যাদি, একই কোম্পানির হওয়া সত্ত্বেও, নারীদের জিনিসগুলোর দাম হয় বেশি। 

উদাহরণ হিসেবে গবেষণায় দেখানো হয়, পুরুষদের লিপ বাম ৭০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে, নারীদের লিপ বামের দাম হচ্ছে প্রায় ১৫০ টাকা। বিউটি প্রোডাক্ট হোক বা ফ্যাশন ব্র্যান্ড, সব জায়গায় একই অবস্থা।

গোলাপী করের কারণ কী?

মার্কিন সংস্থাগুলোর যুক্তি ছিল নারীদের জন্য পণ্য তৈরি করতে বেশি খরচ হয়। পাশাপাশি দাবি করা হয়, নারীরা একই ধরনের জিনিসের জন্য বেশি অর্থ দিতে প্রস্তুত, তাই বাজারের এই সুবিধা নেওয়া উচিত।

অনেকেই এই ট্যাক্সের বিরোধিতা করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, এটি মূল্য বৈষম্য এবং ন্যায্য কর প্রকল্পের আওতায় পড়া উচিত নয়। নারীদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করে কোম্পানিগুলো ভুল করছে বলে মনে করেন তারা। একজন নারীর কোনও পণ্য তৈরিতে যদি বেশি খরচ হয়, তাহলে ব্যয়বহুল হওয়া যুক্তিযুক্ত। তবে, অনেকেই বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের দামও বাড়ে। উদাহরণস্বরূপ, নারীদের জন্য তৈরি পোশাক, জুতো এবং প্রসাধনীর দাম প্রায়শই বেশি হয়।

নারীদের জন্য তৈরি এবং গোলাপী রঙ প্যাকেজ করা পণ্যগুলি একটি নিরপেক্ষ রঙে প্যাকেজ করা পণ্যগুলির চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল হতে পারে। গোলাপী সাইকেল, হেলমেট এবং মেয়েদের জন্য ডিজাইন করা অন্যান্য খেলনা যেমন লাল বা নীল বাইক, স্কুটার এবং হেলমেটের চেয়ে বেশি দামী।

পুরুষ বনাম নারী পণ্যের মূল্য

লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে এই বৈষম্য প্রচলিত বলে কখনো কখনো একে অর্থনৈতিক লিঙ্গ বৈষম্যও বলা হয়। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কর্তৃক পরিচালিত এক গবেষণাতে এই তথ্য-প্রমাণ মেলে। ডিওডোরেন্ট স্প্রের প্রতি বোতলে নারীরা পুরুষদের চেয়ে গড়ে ৩০ সেন্ট বেশি খরচ করে থাকেন। বাজারজাত করার সময় নারীদের বেলায় সাধারণত গোলাপী রঙ এবং পুরুষদের লক্ষ্য করে ছাড়া পণ্যের ক্ষেত্রে নীল রঙের আধিক্য ছাড়া মৌলিক তেমন কোনো তারতম্যই চোখে পড়ে না। ফোর্বসের সূত্রমতে, পিংক ট্যাক্সের কারণে নারীরা বছর প্রতি তাদের কেনাকাটার পেছনে ১,৪০০ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করেন।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে একজন পুরুষ যদি একটি রেজর কিনতে যান, তাহলে তাকে খরচ করতে হয় গড়পড়তা ৮০ রুপির কাছাকাছি। সেই একই প্রতিষ্ঠানের, একই মানের একটি রেজর, যা সুনির্দিষ্টভাবে বাজারজাত করা হয় নারীদের জন্য, কিনতে গেলে খরচ পড়বে ২৫০ রুপির কাছাকাছি। অ্যাক্টিভিস্টদের অসামান্য পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রতিবাদের মুখে ২০১৮ সালে দেশটির সরকার নারীদের মাসিকের সময় ব্যবহৃত সকল পণ্যে ১২% জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স) হ্রাসে বাধ্য হয়।

পুরুষের পণ্যের মূল্য ও নারীর পণ্যের মূলের তালিকা

পুঁজিবাদ কীভাবে বাহ্যিক সৌন্দর্যের একটি প্রতারণামূলক ধারণা তৈরি করে রেখেছে তার একটি সরাসরি উদাহরণ হলো পিংক ট্যাক্সের অস্তিত্ব। পৃথিবীজুড়ে চলমান বাণিজ্য ব্যবস্থা নারীদের একটি দুর্বলতাকে (insecurity) পুঁজি করে প্রতিনিয়ত বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ব্যবসাকে জিইয়ে রেখেছে। নারীদের মাঝে খুব নগণ্য সংখ্যক আছেন যারা এই দুর্বলতা অতিক্রম করতে সমর্থ হন। বাকিরা হয় বোঝেনই না যে তারা মূলত পুঁজিবাদের একটি চক্করে আবদ্ধ, আর না হয় বুঝেও তারা এই শোষণের সাথে নিজেদের একটি আপোষমূলক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন।

নারীদের অর্থনৈতিক বৈষম্য

একজন নারী আয়ের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকবেন আবার ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তাকেই বেশি খরচ করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে- পিংক ট্যাক্স এত বহাল তবিয়তে আছে তার কারণ কী? 

বাজার ব্যবস্থায় যখন কোনো পণ্য উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়, তখন নকশার ওপর জোর দেওয়া হয়। কিছু স্টেরিওটাইপকে ভিত্তি করে পণ্যের বর্ণনা কিংবা পণ্যের মোড়ক এমনভাবে করা হয় যাতে ক্রেতারা (এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে নারীরা) ওই পণ্যটি কিনতেই উৎসাহী হন। 

পুরুষদের জন্য যে রেজর সেটির হাতল সোজা করে বানানো হলে নারীদের জন্য কখনো কখনো হাতলে কিছুটা বাঁক (curvy) থাকে। পুরুষদের বডি স্প্রেতে যে গন্ধ থাকে সেটির তুলনায় কিছুটা অন্যরকম ঘ্রাণ যোগ করা হয় নারীদের স্প্রেতে। এরকম নানা খুঁটিনাটি বিষয় মাথায় রেখে নারীদের জন্য একই পণ্যকে বিশেষায়িত বলে চালিয়ে দেওয়া হয় মাত্রাতিরিক্ত দামে।

আরেকটি বিষয় কাজ করে এখানে- প্রাইস ইলাস্টিসিটি বা দামের স্থিতিস্থাপকতা। কোনো ব্যক্তি যদি পণ্যের দামকে বিবেচনা না করে পণ্যটির মান, নকশা, দীর্ঘস্থায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়কে সবসময় নজর দেন এবং এসব বৈশিষ্ট্যের সাথে উল্লেখিত দাম সত্যিই কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সেটি বিচার না করেন তাহলে তাকে একজন প্রাইস ইলাস্টিক ব্যক্তি বলা হয়। অর্থাৎ পণ্যের দাম যা-ই হোক না কেন তিনি সেটি কিনবেনই। প্রতিষ্ঠানগুলোর অভ্যন্তরীণ গবেষণামতে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অধিক প্রাইস ইলাস্টিক হয়ে থাকেন।

নারী গোলাপী রঙের পণ্য ক্রয় করছে

পিঙ্ক ট্যাক্সের প্রভাব

গোলাপী করের প্রভাব শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত নারীদের দ্বারা কেনা জিনিসপত্রের উপর প্রযোজ্য এবং এর একটি স্পষ্ট প্রভাব পড়তে পারে, এমনকি যদি তা অলক্ষিতও হয়।

উদাহরণস্বরূপ, নিউ ইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অফ কনজিউমার অ্যাফেয়ার্স কর্তৃক পরিচালিত প্রায় ৮০০টি পণ্যের তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে পুরুষদের জন্য একই ধরণের পণ্যের তুলনায় নারীদের পণ্যের দাম গড়ে ৭% বেশি – ব্যক্তিগত যত্ন পণ্যের জন্য ১৩% পর্যন্ত বেশি। 

ফলস্বরূপ, একজন ৩০ বছর বয়সী নারী ইতিমধ্যেই কমপক্ষে ৪০,০০০ ডলার গোলাপী কর পরিশোধ করেছেন। একজন ৬০ বছর বয়সী নারী পুরুষদের দ্বারা প্রদত্ত ফি বাবদ ৮০,০০০ ডলারের বেশি ফি পরিশোধ করেছেন। বর্তমানে এমন কোনও ফেডারেল আইন নেই যেখানে ক্রেতার লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে একই ধরণের পণ্যের জন্য বিভিন্ন মূল্য নির্ধারণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

 পিংক ট্যাক্সের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে কীভাবে?

সমতার লড়াই কীভাবে করা যেতে পারে সেই বিষয়ে চমৎকার সূত্রের সন্ধান দিচ্ছে রাইস ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা। এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, কোনো দেশের প্রশাসনিক পর্যায়ে কিংবা সরকার 

গঠনের ক্ষেত্রে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ বেশি হলে সেই দেশে পিঙ্ক ট্যাক্সজনিত সমস্যার প্রকোপ হ্রাস পায়। সমস্যা হচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী পুরুষের স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ এতটাই বৈষম্যমূলক যে চট করে প্রতিটি দেশের রাজনীতিতে নারীরা পদার্পণ করবে এটা আশা করা বর্তমান বাস্তবতায় কিছুটা বাড়াবাড়ি। সেজন্য কিছু বিকল্প পন্থা বেছে নেওয়া যেতে পারে।

সবচেয়ে সোজাসাপ্টা উপায় হচ্ছে কিছুটা চালাক হওয়া। নারীরা চাইলে কিছুটা হিসেবনিকেশ করে দেখতে পারেন যে তারা যে পণ্য কিনবেন বলে মনস্থির করেছেন সেই একই পণ্য পুরুষদের জন্য বাজারে আছে কি না? চাইলে তারা সেটি কিনতে পারেন। আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত যারা বাবা মা হবেন কিংবা সদ্য সন্তানের মুখ দেখেছেন তাদের জন্য। আপনার সন্তানকে (ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে) লিঙ্গ নিরপেক্ষ খেলনা সামগ্রী কিনে দিন।

তথ্যসূত্র-

Related posts

পিলের বোতল কেন কমলা রঙের হয়?

আবু সালেহ পিয়ার

পোপ নির্বাচনের রহস্যময় পদ্ধতি- পোপ ফ্রান্সিসের পর যেভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন পোপ

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More