Image default
কী ও কেন

প্লুটো: কেন একে রহস্যময় গ্রহ বলা হয়

প্লুটো, একসময় সৌরজগতের নবম গ্রহ, যা এখন শুধুই এক “বামন গ্রহ”। এর বরফে মোড়া ভূপ্রকৃতি, অদ্ভুত কক্ষপথ ও গ্রহত্ব নিয়ে বিতর্ক এখনো বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে!

প্লুটোর রহস্যময় জগৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এক বিস্ময়। ১৯৩০ সালে ক্লাইড টমবাউ প্লুটোকে আবিষ্কার করার পর, এটি সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু, ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা (আইএইউ) প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা বাতিল করে। 

তারপরেও, প্লুটোর আকার, কক্ষপথ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা প্লুটোর রহস্যময় পরিবেশ এবং এর সম্পর্কে অজানা তথ্য জানব।

প্লুটোর আবিষ্কার ও ইতিহাস

প্লুটো আবিষ্কারের কৃতিত্ব মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টম্বাউ-এর। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ সালে তিনি লোয়েল অবজারভেটরি-তে কাজ করার সময় প্লুটোকে শনাক্ত করেন। তবে, প্লুটোর সন্ধান শুরু হয় ১৯০৬ সালে, যখন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পার্সিভাল লোয়েল সৌরজগতের নবম গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দেন।

নেপচুন ও ইউরেনাসের কক্ষপথের অস্বাভাবিকতার ব্যাখ্যা দিতে তিনি “প্ল্যানেট এক্স” নামে একটি গ্রহের সন্ধান করছিলেন। কিন্তু, লোয়েল ১৯১৬ সালে মারা যান, তবে তার গবেষণার ওপর ভিত্তি করেই টম্বাউ ১৯৩০ সালে প্লুটো আবিষ্কার করেন। এই গবেষণার জন্য তিনি একটি বিশেষ ব্লিঙ্ক কম্পারেটর ব্যবহার করা হয়, যা তাকে একাধিক ছবি তুলতে এবং ছবিগুলোর মধ্যে তুলনা করতে সাহায্য করেছিল।

প্লুটো সহ সৌরজগত

প্লুটো আবিষ্কারের পর এটিকে সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৩০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, প্লুটো সম্ভবত পৃথিবীর সমান আকৃতির। তবে ১৯৭৮ সালে ক্যারন উপগ্রহ আবিষ্কারের পর প্লুটোর ভর সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায়, এবং তখনই প্লুটো সম্পর্কে ধারণা বদলাতে শুরু করে। 

পরবর্তীতে, প্লুটোর আকৃতি ও ভর তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ায় বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয় যে এটি সত্যিই একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রহ কি না! এরপর প্লুটো সম্পর্কে গবেষণা চলতে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে এর গ্রহের মর্যাদা হারানোর কারণগুলোর একটি বড় কারন হয়ে দাঁড়ায়। 

প্লুটোর বৈশিষ্ট্য ও গঠন

প্লুটো আমাদের সৌরজগতের অন্যতম ক্ষুদ্রতম বস্তু, যার ব্যাস প্রায় ২,৩৭৪ কিলোমিটার। অর্থাৎ, এটি চাঁদের চেয়েও ছোট। প্লুটোর আকৃতি কিছুটা অনিয়মিত এবং এটি একটি বামন গ্রহ (Dwarf Planet) হিসেবে পরিচিত।

প্লুটোর কক্ষপথ অত্যন্ত উপবৃত্তাকার (Elliptical Orbit), যা অন্য গ্রহগুলোর তুলনায় বেশ ভিন্ন। এটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে ২৪৮ বছর সময় নেয়। তাছাড়া, প্লুটোর কক্ষপথ এক্সেন্ট্রিক (Eccentric), যার কারণে কখনো এটি নেপচুনের চেয়েও সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে।

স্পুটনিক প্লানিটিয়া

প্লুটোর উপগ্রহসমূহ

প্লুটোর প্রধান উপগ্রহ হলো ক্যারন, যা প্রায় প্লুটোর অর্ধেক আকারের। চারন ছাড়াও প্লুটোর আরও চারটি উপগ্রহ রয়েছে: 

  1. নিক্স 2. হাইড্রা 3. ক্যার্বেরোস 4. স্টাইক্স। ক্যারন এবং প্লুটোর মধ্যকার ভরকেন্দ্র প্লুটোর বাইরের দিকে অবস্থিত, যার ফলে এটিকে বিজ্ঞানীরা একটি দ্বৈত-গ্রহ ব্যবস্থা (Binary System) হিসেবে বিবেচনা করেন।
প্লুটোর উপগ্রহ সমূহ

প্লুটো কেন গ্রহ নয়?

২০০৬ সালে, আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা (IAU – International Astronomical Union) গ্রহের জন্য তিনটি শর্ত নির্ধারণ করে:

  1. এটি সূর্যের চারদিকে কক্ষপথে ঘুরতে হবে।
  2. এটি নিজের অভিকর্ষের কারণে গোলাকৃতি হতে হবে।
  3. এটি তার কক্ষপথের আশপাশের অন্যান্য বস্তুকে পরিষ্কার করে ফেলতে পারবে।

প্লুটো প্রথম দুটি শর্ত পূরণ করলেও তৃতীয় শর্তটি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ এটি “কুইপার বেল্ট” নামক গ্রহাণু এলাকায় অবস্থান করে, যেখানে অনেক ছোট ছোট বস্তু রয়েছে। ফলে প্লুটোর কক্ষপথ পুরোপুরি “পরিষ্কার” নয়। তাই, প্লুটোর কক্ষপথ বাকানো ও ডিম্বাকৃতি, যা অন্যান্য গ্রহের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিয়মিত। এটি ১৭ ডিগ্রি কোণে হেলানো অবস্থায় সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, যা সৌরজগতের অন্য কোনও গ্রহের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। আর মাঝে মাঝে এটি নেপচুনের কক্ষপথের ভেতরে প্রবেশ করে, যা আরেকটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য।

তাছাড়া, প্লুটোর ব্যাস মাত্র ২,৩৭৪ কিলোমিটার, যা চাঁদের চেয়েও ছোট। প্লুটোর ভর এতই কম যে এটি গ্রহাণু বেষ্টনী (Asteroid Belt) এবং কুইপার বেল্টের অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে মিশে থাকে। সব কিছু বিবেচনা করে, ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট, IAU প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা বাতিল করে এবং একে “বামন গ্রহ” হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে প্লুটোকে আর সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং সৌরজগতে এখন আটটি গ্রহই স্বীকৃত।

প্লুটোর রহস্যময় পরিবেশ

প্লুটোর বায়ুমণ্ডল ক্ষীণ এবং পরিবর্তনশীল, যা প্রধানত নাইট্রোজেন, মিথেন , এবং কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। ফলে যখন  প্লুটো সূর্যের কাছাকাছি থাকে, তখন তার পৃষ্ঠের বরফ কিছুটা বাষ্পীভূত হয়ে গ্যাসীয় আকারের বায়ুমণ্ডল তৈরি করে। কিন্তু প্লুটো যখন সূর্য থেকে দূরে চলে যায়, তখন এই বায়ুমণ্ডল বরফে পরিণত হয় এবং প্লুটোর পৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে। এছাড়াও, প্লুটোর আকাশ নীল রঙের, যা ২০১৫ সালে নিউ হরাইজনস মহাকাশযান থেকে প্রাপ্ত ছবিতে দেখা যায়।

প্লুটো সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। এর পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা -২২৮°C থেকে -২৩৮°C পর্যন্ত হতে পারে। সূর্য থেকে দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে প্লুটোর পৃষ্ঠে প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং অন্ধকার পরিবেশ বিরাজ করে। এই শীতল পরিবেশের প্লুটোর পৃষ্ঠের বরফ মূলত নাইট্রোজেন, মিথেন, এবং জল বরফের মিশ্রণে গঠিত। প্লুটোর বিখ্যাত “স্পুটনিক প্ল্যানিশিয়া” একটি বিশাল বরফের সমভূমি, যেখানে হিমবাহের মতো বরফ প্রবাহিত হতে পারে। এছাড়াও, প্লুটোর পৃষ্ঠে বিভিন্ন পর্বত, উপত্যকা, এবং গহ্বর রয়েছে, যা মহাকাশ গবেষকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়। 

প্লুটোর এই রহস্যময় পরিবেশই একে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বামন গ্রহগুলোর একটি করে তুলেছে।

প্লুটোতে প্রাণের সম্ভাবনা

প্লুটোর চরম ঠান্ডা ও পাতলা বায়ুমণ্ডলের কারণে জীবনের অস্তিত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি প্লুটোর অভ্যন্তরে তরল পানির উপস্থিতি থাকে, তাহলে সেখানে মাইক্রোবিয়াল জীবন থাকতে পারে।

প্লুটোকে ঘিরে বিতর্ক ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

২০০৬ সালে প্লুটোর গ্রহের মর্যাদা হারানোর পর থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং মহাকাশপ্রেমী দাবি করেন যে প্লুটোকে আবার গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন, IAU-এর গ্রহ সংজ্ঞা খুবই সীমাবদ্ধ, যা প্লুটোর মতো বস্তুগুলোকে বাদ দিয়ে দেয়। ২০১৭ সালে নাসার কিছু বিজ্ঞানী প্রস্তাব দেন যে “গ্রহ” শব্দটির সংজ্ঞা পরিবর্তন করা উচিত, যাতে প্লুটো এবং আরও কিছু মহাকাশীয় বস্তু এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

প্লুটো নিয়ে চলমান গবেষণা

নিউ হরাইজনস (New Horizons) মিশনের মাধ্যমে প্লুটো সম্পর্কে নতুন অনেক তথ্য পাওয়া গেছে, যা বিজ্ঞানীদের আগ্রহ আরও বাড়িয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা প্লুটোর ভূগঠন, বায়ুমণ্ডল, এবং অভ্যন্তরীণ গঠনের ওপর গবেষণা চালাচ্ছেন। কুইপার বেল্টের অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে প্লুটোর সম্পর্ক নিয়েও গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে ভবিষ্যতে নতুন মহাকাশ অভিযান চালানো হলে প্লুটো সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।

এছাড়াও, ভবিষ্যতে প্লুটোর অভ্যন্তরে তরল পানির অস্তিত্ব শনাক্ত করা গেলে এটি বহির্জাগতিক প্রাণের অনুসন্ধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান হতে পারে।

প্লুটো সম্পর্কে অজানা তথ্য

প্লুটোর রঙের রহস্য

প্লুটোর পৃষ্ঠের রঙ লালচে-বাদামি, যা থোলিন (Tholin) নামক জৈব যৌগের কারণে হয়ে থাকে। থোলিন গঠিত হয় যখন সৌর বিকিরণ নাইট্রোজেন ও মিথেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, ফলে প্লুটোর পৃষ্ঠে এক ধরনের লালচে আস্তরণ তৈরি হয়।

প্লুটোর পৃষ্ঠের অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য

প্লুটোর বিখ্যাত “স্পুটনিক প্ল্যানিশিয়া” হলো একটি বিশাল বরফের সমভূমি, যা নাইট্রোজেন বরফে ঢাকা। প্লুটোর পৃষ্ঠে স্ফটিক জলবরফ (Crystalline Ice) পাওয়া গেছে, যা সূর্যালোকের প্রভাবে গঠিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা প্লুটোর পৃষ্ঠে পাহাড়, হিমবাহ এবং ধূমকেতুর মতো গঠন খুঁজে পেয়েছেন, যা সৌরজগতের অন্য কোনো বামন গ্রহে দেখা যায়নি।

প্লুটোর উপগ্রহগুলোর বিশেষত্ব

প্লুটোর প্রধান উপগ্রহ চারন এত বড় যে এটি প্লুটোর সঙ্গে যুগ্ম কক্ষপথ গঠন করেছে। চারনের পৃষ্ঠে গভীর উপত্যকা ও পাহাড় রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে এটি একসময় ভূতাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় ছিল। প্লুটোর অন্যান্য উপগ্রহ—নিক্স, হাইড্রা, ক্যার্বেরোস, এবং স্টাইক্স—অনিয়মিত আকৃতির এবং সম্ভবত কুইপার বেল্ট থেকে ধরা পড়া বস্তু।

প্লুটোর অভ্যন্তরের গঠন

বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্লুটোর অভ্যন্তরে একটি শিলা ও বরফের মিশ্রিত কেন্দ্র রয়েছে। কিছু গবেষণা অনুযায়ী, প্লুটোর অভ্যন্তরে তরল পানি সমৃদ্ধ একটি ভূগর্ভস্থ মহাসাগর থাকতে পারে, যা ভবিষ্যতে বহির্জাগতিক প্রাণের সম্ভাবনা সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে। 

বিজ্ঞানীরা আশা করেন, ভবিষ্যতে আরও উন্নত মহাকাশযান পাঠিয়ে প্লুটো সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে, যা আমাদের সৌরজগতের রহস্য উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

পিঙ্ক ট্যাক্স- কেন নারীদের পণ্যের বেশি দাম দিতে হয়?

পিলের বোতল কেন কমলা রঙের হয়?

আবু সালেহ পিয়ার

পোপ নির্বাচনের রহস্যময় পদ্ধতি- পোপ ফ্রান্সিসের পর যেভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন পোপ

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More