Image default
কী ও কেন

ভুড়ি, ভাত আর বাঙালি: কেন আমাদের শরীরে এত সহজে চর্বি জমে?

ভুঁড়ি আমাদের লজ্জা নয়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ।

আপনার আশেপাশে এমন বহু মানুষকে দেখবেন, যাদের শরীর বেশ রোগা, কিন্তু পেটে গোল পুটলির মতো ভুড়ি আছে। বা হতে পারে, আপনি নিজেও এমন একজন। বেশি খাওয়া-দাওয়া করেন না, কিন্তু ভুড়ি হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মজার ছলে বলে, “বাঙালির জাতিগত বৈশিষ্ট্যই বুঝি ভুড়ি!”

তাহলে প্রশ্ন হলো, কেন বাঙালিদের শরীরে এত সহজে চর্বি জমে? কেন আমাদের ভুড়ি একটা পারিবারিক ঐতিহ্যের মতো ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে?

এই লেখায় আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব সেই সব ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক কারণগুলো। চলুন, বুঝে নিই, ভাত, ভুড়ি আর বাঙালির সম্পর্কটা কত গভীর।

জিনে লেখা চর্বির কাহিনি: ‘থ্রিফ টি জিন হাইপোথিসিস’

থ্রিফটি জিন

আজকাল অনেকেই বলে থাকেন,”আমি তো বেশি কিছু খাই না, তাও মোটা হয়ে যাচ্ছি!” বিজ্ঞানীদের মতে, বাঙালিসহ দক্ষিণ এশীয়দের শরীরে রয়েছে একধরনের “থ্রিফটি জিন” বা “মিতব্যয়ী জিন।”  এর কাজ হলো ক্যালরি জমিয়ে রাখা। প্রাচীন কালে  দুর্ভিক্ষ, খাদ্যসংকট আর অপুষ্টি ছিল নিয়মিত ঘটনা। এই সময় দেহ ‘শিক্ষা’ পায়, কীভাবে খাবারের অভাবেও টিকে থাকতে হয়। পরবর্তীতে বংশগতভাবে এই গুণাবলী ছড়িয়ে পড়ে।

এই থ্রিফটি জিন মূলত দক্ষিণ এশীয়, আফ্রিকান বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি দেখা যায়। ২০০১ সালে প্রকাশিত “Diabetologia” জার্নালে বলা হয়, দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে থ্রিফটি জিনের উপস্থিতি বেশি। এই অঞ্চলের মানুষের insulin sensitivity কম এবং পেটের চর্বি জমার প্রবণতা বেশি। ফলে একটু বাড়তি ক্যালোরি খেলেই শরীর সেটা ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখে।

এই জিনের সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো সহজে ওজন বেড়ে যাওয়া বা মোটা হওয়া। এর পাশাপাশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, জেনেটিক কারণে এসব সমস্যা অনেক সময় কম খাওয়ার পরেও দেখা দেয়। এটি হাজার বছরের জৈবিক অভিযোজনের ফল। 

ইতিহাসের ক্ষুধা: দুর্ভিক্ষ, ঔপনিবেশিক শোষণ ও খাদ্যের লড়াই

১৭৭০ সালের গ্রেট বেঙ্গল ফ্যামিন

ঐতিহাসিকভাবে বারবার ঘটে যাওয়া দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকটগুলো বাংলা অঞ্চলের মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এর বেশ কিছু ভয়ংকর দৃষ্টান্ত রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ১৭৭০ সালের ‘গ্রেট বেঙ্গল ফ্যামিন’। অনুমান করা হয় এই সময় প্রায় ১ কোটির মতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কঠোর রাজস্বনীতি আর  প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

আরও ভয়াবহ ছিল ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর। এটি বাংলায় ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য বাংলা থেকে রপ্তানি করে নিয়ে যায়। এই কারণে বাংলার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ অনাহারে মারা যান। আশ্চর্যজনকভাবে এই দুর্ভিক্ষে প্রকৃত খাদ্য ঘাটতি ছিল না। বরং সমস্যার মূল ছিল বণ্টনের বৈষম্য এবং ঔপনিবেশিক অবহেলা।

এই ধরনের ধারাবাহিক খাদ্যসংকট বাঙালির জীবনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। এই সময় থেকে দেহে থ্রিফটি জিনের প্রভাব দেখা যায়। এই অভিযোজনই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জেনেটিকভাবে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। 

আমাদের ভাত-নির্ভর খাদ্যাভ্যাস

বাঙালিদের খাদ্য তালিকা

বাঙালিদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত। আর সেটি সকাল, দুপুর, রাত করে প্রতিদিন চলতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আলু, ডাল, ভাজি, ভর্তা, মিষ্টি এবং বিশেষ উপলক্ষে তেল-মশলায় ভরা খাবার। এই পুরো খাদ্যসংস্কৃতি মূলত “হাই-কার্বোহাইড্রেট ও লো-প্রোটিন” ভিত্তিক। এর ফলে শরীরে অতিরিক্ত শ্বেতসার (starch) জমা হয়।

ভাত ও আলুর মতো খাবারে প্রচুর শ্বেতসার থাকে। এই শ্বেতসার হজম হয়ে রূপ নেয় গ্লুকোজে (Glucose)। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে, একে নিয়ন্ত্রণে আনতে শরীর ইনসুলিন হরমোন নিঃসরণ করে। ইনসুলিন মূলত গ্লুকোজকে শক্তিতে রূপান্তর করে। কিন্তু অতিরিক্ত গ্লুকোজকে শরীর শক্তি হিসেবে ব্যবহার না করে ফ্যাট আকারে জমিয়ে ফেলে। তাই শুধু “কম খাচ্ছি” বললেই হবে না! কী খাচ্ছেন, সেটা বোঝাও অত্যন্ত জরুরি। 

অলস জীবনধারা

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি সমাজে কায়িক শ্রমের চেয়ে মানসিক শ্রমই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষ করে শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে ঘরের কাজ করার জন্য “কাজের লোক” রাখা হত।এছাড়াও অফিসে ডেস্কে বসে কাজ করা, কিংবা দৈনন্দিন জীবনে হাঁটাচলা কম করাটাই ছিল স্বাভাবিক। আজকের দিনে এসে এই প্রবণতা আরও খারাপ হয়েছে।

একদিকে ৮–১০ ঘণ্টা অফিসে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, অন্যদিকে যাতায়াতে ব্যক্তিগত গাড়ি বা রাইড-শেয়ারিংয়ের ওপর নির্ভরশীলতা, আমাদের দৈনন্দিন চলাফেরাকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। ছুটির দিনগুলোতেও ব্যতিক্রম হয় না। ঘরে বসে মোবাইল, টেলিভিশন বা স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে সময় কাটানো, সঙ্গে দীর্ঘ ঘুম ও অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া এখন যেন “রিলাক্সেশন”-এর সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই জীবনধারার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, আমরা খাই ঠিকই, কিন্তু সেটা ব্যয় করার মতো পরিশ্রম করি না। ফলে প্রতিদিন জমে থাকা অতিরিক্ত ক্যালোরি শরীরে চর্বি হিসেবে জমা হতে থাকে। এই অবস্থা স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। 

হরমোন, স্ট্রেস আর ঘুম

দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ

শরীরে মেদ জমার পেছনে শুধু খাবার বা ব্যায়ামের অভাবই দায়ী নয় । এর সাথে হরমোন, ঘুমের অভাব ও মানসিক চাপ-এর মতো উপাদানও বড় ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যারা বলে থাকেন “হাত-পা তো রোগা, কিন্তু ভুঁড়ি বেড়েই চলেছে”, তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে গড়ে ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম দরকার। যখন আমরা নিয়মিত কম ঘুমাই, তখন শরীরে কর্টিসল (Cortisol) নামের এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন বাড়তে থাকে। কর্টিসলের উচ্চ মাত্রা শরীরকে সংকেত দেয় খাবার জমিয়ে রাখার। ফলে ঘুম কম হলে ধীরে ধীরে ভুঁড়ি বাড়তে শুরু করে।

এছাড়া, মানসিক চাপও শরীরে চর্বি জমার একটি বড় কারণ। দীর্ঘ সময়ের স্ট্রেস ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে এবং রক্তে ইনসুলিন লেভেল বাড়িয়ে দেয়। এই অতিরিক্ত ইনসুলিন শরীরকে ফ্যাট জমাতে উৎসাহিত করে। একে বলে Fat Storing Mode। তাই মানসিক চাপ দীর্ঘমেয়াদে ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ।

এছাড়াও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে টেস্টোস্টেরন (পুরুষদের ক্ষেত্রে) বা ইস্ট্রোজেন (নারীদের ক্ষেত্রে) হরমোনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসে। এই হরমোনগুলো মাংসপেশি গঠন ও ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়ার সঙ্গেও সরাসরি জড়িত। তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ফ্যাট বার্নিং ক্ষমতা কমে যায়  এবং সহজেই চর্বি জমে।

ভুড়ি আমাদের টিকে থাকার এক জীবন্ত প্রমাণ। তেমনই আধুনিক জীবনযাত্রায় এই ভুড়ি আমাদের জন্য তৈরি করছে নতুন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ইতিহাস যে চর্বি এনেছে, আধুনিক বিজ্ঞান ও সচেতনতার মাধ্যমে সেটাকে বিদায় জানানো অসম্ভব না। দরকার শুধু সঠিক জ্ঞান, ধৈর্য আর নিয়মিত অভ্যাসের।

আপনার আশেপাশে কি একরকম “ভুড়ি প্রবণতা” চোখে পড়ে? তাহলে এই লেখাটা তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন। কারণ ইতিহাস জানলেই পরিবর্তনের পথ খুলে যায়।

তথ্যসূত্র –

 

Related posts

পিঙ্ক ট্যাক্স- কেন নারীদের পণ্যের বেশি দাম দিতে হয়?

পিলের বোতল কেন কমলা রঙের হয়?

আবু সালেহ পিয়ার

পাহাড়ে খাবার সিদ্ধ হতে বেশি সময় লাগে কেন?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More