জার্মানির অর্গসবার্গ শহরের ছোট্ট গ্রাম ফুগেরেই-এ গত ৫০০ বছরে বাড়ি ভাড়া না বাড়লেও গত ১০ বছরে ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
ভাড়াটিয়াদের জন্য বাড়ি ভাড়া এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। বাড়ি ভাড়ার এই ক্রমাগত বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, বাড়িওয়ালাদের বাড়তি খরচ, এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাব।
বাড়ি ভাড়ার এই ক্রমবর্ধমান চাপ আজকাল অনেক শহরবাসীর জন্য এক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বাড়ি ভাড়া অব্যাহতভাবে বাড়ছে, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
বাড়ি ভাড়া বাড়ছে কেন?
বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যার মধ্যে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা, বাড়িওয়ালাদের বাড়তি খরচ, এবং সরকারি নীতির অভাব উল্লেখযোগ্য।
বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির অন্যতম কারন হচ্ছে সময়ের সাথে বাড়ছে জমির দাম, বাড়ছে নির্মান ও রক্ষনাবেক্ষন খরচ ও জীবন-যাপন ব্যয়। পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও বাড়ছে না পৃথিবীর আয়তন। ফলে জমির দাম সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়ছে না নতুন বসতি স্থাপনের জায়গা। ফলে, বাড়িওয়ালারা তাদের জমির দামের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়াচ্ছেন বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যেসব জায়গায় জমির দাম বেশি সেসব জায়গায় বাড়ি ভাড়াও বেশি। ঢাকা শহরের জমির দাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জমির দামে যেমন অনেক পার্থক্য, তেমনি পার্থক্য সেখানকার বাড়ি ভাড়ায়ও।
পাশাপাশি, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ও জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় নতুন আবাসন প্রকল্পের সংখ্যা সীমিত হচ্ছে। বিশেষ করে সস্তা আবাসন প্রকল্পের অভাব দেখা যাচ্ছে, যার ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জন্য বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাড়িওয়ালারা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচের জন্য অধিক টাকা ব্যয় করছেন, এবং সম্পত্তি কর বৃদ্ধির ফলে তাদের ওপরও চাপ বাড়ছে। আর এসব বাড়তি খরচ বহন করতে বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যাতে তারা লাভের মুখ দেখতে পারেন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শহরগুলোর দিকে অভিবাসনের চাপ বাড়ছে। প্রতিদিন নতুন মানুষ শহরে আসছে, যা আবাসনের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি, ফলে গ্রামের মানুষও এখানে বাসস্থান খুঁজতে আসছেন। এর ফলে, চাহিদা বেশি এবং সরবরাহ কম থাকায় ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এছাড়াও, রিয়েল এস্টেট বাজারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে, যা বাজারে প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে কিছু বাড়িওয়ালা তাদের ভাড়া আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন যাতে তাদের লাভের অংকটাও বৃদ্ধি পায়।
তাছাড়া, বাংলাদেশে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়নে কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যার ফলে ইচ্ছামত বাড়ছে বাড়িভাড়া। এক্ষেত্রে, সরকারী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও সরকার যদি নির্দিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দেয়, তবে ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালাদের জন্য কিছু বাধ্যবাধকতা তৈরি হতে পারে। কারন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকরী আইন না থাকে, তাহলে বাড়িওয়ালারা একতরফাভাবে ভাড়া বাড়াতে থাকেন, যা ভাড়াটিয়ার জন্য অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির চিত্র
শহরভেদে বাড়ি ভাড়ার বৃদ্ধি ভিন্ন ভিন্ন কারণে ঘটে। ঢাকায় ভাড়ার ১০ বছরে দ্বিগুণ হওয়া এক ধরনের বাস্তবতা হলেও অন্যান্য শহরেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
ঢাকায় দেশের প্রধান বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র অবস্থিত হওয়ায় এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। ফলে চাকরিজীবী ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, যা বাসস্থানের চাহিদা বাড়িয়ে তুলছে এবং ভাড়া বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
ঢাকার ভাড়া বেশি হলেও শহরটির অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার কারণে অনেকেই অন্য শহরে স্থানান্তর হতে পারেন না। ফলে, শহরের কেন্দ্রীয় এলাকাগুলোতে তুলনামূলক বেশি চাহিদা থাকায় এসব এলাকায় ভাড়া দ্রুত বাড়ছে।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও অন্যান্য শহরের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
ঢাকার পর সবচেয়ে বেশি ভাড়া বৃদ্ধি দেখা যায় চট্টগ্রামে। কারণ, এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশালের মতো শহরগুলোর কিছু অংশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাড়া বেড়েছে, তবে ঢাকার তুলনায় বৃদ্ধির হার কম।
যেসব শহরে নতুন শিল্প, প্রযুক্তি বা পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটছে, সেসব শহরে ভাড়া বাড়ছে। যেমন, সিলেটে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি হওয়ায় সেখানে উচ্চবিত্তদের জন্য বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের কারণে বাসস্থানের চাহিদা বেড়েছে।
এই সব কারণে দেশের বিভিন্ন শহরে ভাড়ার হার ভিন্ন হলেও বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা সার্বিকভাবে একই রয়েছে।
বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের উপায় ও সম্ভাবনা
বাড়ি ভাড়ার ক্রমাগত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি সরকার, বাড়িওয়ালা এবং ভাড়াটিয়ারা সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন দেশ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন থাকলেও এটি তেমন কার্যকর নয়। ভাড়াটিয়ারা অনেক সময় অন্যায্য ভাড়া বৃদ্ধির শিকার হন, কারণ আইন প্রয়োগের তদারকি দুর্বল। যদি এই আইনকে শক্তিশালী করে কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা চালু করা যায়, তবে ভাড়া বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
কিছু উন্নত দেশে ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নিউ ইয়র্কে ‘Rent Control’ ও ‘Rent Stabilization’ নীতির মাধ্যমে বাড়ির ভাড়া নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা হয়। বার্লিন ও সিঙ্গাপুরেও ভাড়া বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে এ ধরনের মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বাড়িওয়ালাদের এমন ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত, যা ভাড়াটিয়াদের পক্ষে সহনীয় এবং তাদের নিজস্ব খরচও মেটাতে সক্ষম হয়। এ জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে ভাড়া নির্ধারণে নির্দিষ্ট মানদণ্ড থাকবে।
যদি বাড়িওয়ালাদের জন্য কিছু কর ছাড় বা আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়, তবে তারা বাড়ি ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে রাখতে উৎসাহী হতে পারেন। সিঙ্গাপুর ও জাপানে সরকার বাড়িওয়ালাদের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা দেয়, যাতে তারা ভাড়া কমাতে সক্ষম হয়।
এই ধরণের উদ্যোগ নেওয়া হলে ভবিষ্যতে ভাড়া বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।
ভাড়াটিয়ার অধিকার ও সুরক্ষা ব্যবস্থা
ভাড়াটিয়াদের অধিকার রক্ষা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেসব শহরে ভাড়া দ্রুত বাড়ছে। সঠিক নীতি ও আইন থাকলে ভাড়াটিয়ারা অন্যায্য ভাড়া বৃদ্ধি ও হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
বাংলাদেশে বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে আইনি কাঠামো থাকলেও এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হয় না। ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, বাড়িওয়ালা একতরফাভাবে ভাড়া বাড়াতে পারেন না এবং ভাড়াটিয়াকে নোটিশ ছাড়া উচ্ছেদ করতে পারেন না। তবে বাস্তবে এসব নিয়ম অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয় না। ভাড়াটিয়ারা যদি লিখিত চুক্তি করে ও আইন সম্পর্কে সচেতন থাকে, তাহলে নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারবে।
ভাড়া সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে ভাড়াটিয়ারা নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারেন:
- চুক্তি ছাড়া বাসা ভাড়া না নেওয়া
- বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা
- প্রয়োজনে আইনজীবীর সাহায্য নেওয়া
সস্তায় বাসা ভাড়া পাওয়ার কৌশল
ঢাকায় বা অন্য বড় শহরে তুলনামূলক কম খরচে বাসা ভাড়া পাওয়ার কিছু উপায় রয়েছে, যেমন:
প্রধান সড়কের বাইরে, অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল এলাকায় বাসা খোঁজা। এছাড়াও একক বাসার পরিবর্তে অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করা যা সাবলেট নামে পরিচিত। পাশাপাশি, ভাড়া চুক্তির মেয়াদ দীর্ঘ করে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে কম রেটে ভাড়া নির্ধারণ করানো।
অন্যদিকে, অনেক দেশে কো-লিভিং এবং শেয়ার্ড অ্যাপার্টমেন্টের সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের জন্য এ ধরনের বাসস্থান ব্যবস্থা তৈরি হলে ভাড়া কমে আসতে পারে। ‘মেস’ বা ‘ব্যাচেলর’ নামে এ পদ্ধতি জনপ্রিয় হলেও বেশিরভাগ বাড়িতেই এ সুযোগ পাওয়া যায় না।
ভবিষ্যতে বাড়ি ভাড়া কতটা বাড়বে বা কমবে, তা নির্ভর করবে নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত এবং বাজারের গতিপথের ওপর। তবে সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।
তথ্যসূত্র –
- https://www.economist.com/finance-and-economics/2025/03/16/why-rents-are-rising-too-fast
- https://www.cbsnews.com/news/rent-cost-us-2024-housing-national/
- https://www.dhakapost.com/national/343232
- https://www.prothomalo.com/bangladesh/7i1utp9lso
- https://www.somoynews.tv/news/2025-01-31/yDHvLSCP
- https://www.thetolet.com/bd/article/why-is-rent-increasing-for-houses
- https://thedailycampus.com/national/38538/%E0%A6%A2%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A6%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8