নদ-নদী, পাহাড়-পাহাড়ি ঝর্ণা-পাহাড়ি জীবন, চা-বাগান; এই সবকিছুর ফুল প্যাকেজ হলো সিলেটের জাফলং; এ যেন এক টিকেটে বহু সিনেমা দেখার সুযোগ!
কর্মব্যস্ত জীবনে আমাদের দম ফেলার সময়টুকু নেই। অনিচ্ছাকৃতভাবে সময়ের নিখুঁত খাঁচায় আমরা সকলে বন্দী হয়ে যাই। কিন্তু, রক্ত-মাংসের মানুষ এভাবে যন্ত্রের মতো চলতে পারে না। একটা সময়ে সে হাঁপিয়ে উঠে, একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। এক্ষেত্রে ভ্রমণ করাটা সবথেকে ভালো উপায়। গবেষণায় জানা যায়, ভ্রমণ মানুষের ক্লান্তি এবং দুশ্চিন্তার টনিক হিসাবে কাজ করে ।
ভ্রমণের জন্য মানুষ কাছে-দূরে, দেশে-বিদেশে নানান জায়গায় যেতে পারে। তবে দেশের বাইরে ভ্রমণে নানা ঝামেলা হবার কারণে মানুষ সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে দেশের ভেতরে ভ্রমণে। আপনি যদি একদম প্রকৃতির কাছাকাছি পাহাড়ি নদীর স্নিগ্ধ সাহচার্যে সবুজের মহাসমারোহে হারিয়ে যেতে চান, তবে ‘সিলেটের জাফলং’ হতে পারে আপনার এবারের ভ্রমণস্পট।
জাফলং কোথায় অবস্থিত
সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে, গোয়ানঘাট উপজেলায় অবস্থিত জাফলং। ভৌগোলিকভাবে এটি বাংলাদেশ-ভারত মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত। এই স্থানটি উপক্রান্তীয় পর্বত ও রেইনফরেস্ট দিয়ে ঘেরা।
জাফলং এর ইতিহাসঃ খাসিয়া জৈন্তা রাজ্য
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, জাফলং একসময় খাসিয়া ‘জৈন্তা-রাজা’র অধীনে একটি নির্জন বনভূমি ছিলো। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার কারণে ১৯৫৪ সালে খাসিয়া জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটে। এরপর এই জায়গা বেশ কয়েক বছর ফাঁকা পড়েছিল।
পরবর্তীতে পাথরের সন্ধানে ব্যবসায়ীরা নৌপথে জাফলং আসা শুরু করেন। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জাফলং এ নতুন জনবসতি গড়ে উঠতে শুরু করে।
এরপর আশির দশকে সিলেট এবং জাফলং এর সড়ক যোগাযোগ তৈরি হয়। আস্তে আস্তে মানুষ থেকে মানুষে জাফলং এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে দেশী পর্যটকদের সঙ্গে বিদেশী পর্যটকদেরও দেখা মেলে এই জাফলং-এ।
জাফলং এ গিয়ে যা যা দেখবেন
জাফলং এর আরেক নাম ‘প্রকৃতি কন্যা’। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা সবমিলিয়ে প্রকৃতির সব সৌন্দর্যই যেন ধারণ করেছে জাফলং। তাই, খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় ও এর পাদদশে অবস্থিত জাফলং মানুষকে মুগ্ধ করে।
পিয়াইন নদী ও নৌকা
এখানে পিয়াইন নামের পাহাড়ি নদ রয়েছে। এই নদের তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলং এর সৌন্দর্যকে আরও বৃদ্ধি করেছে। এই সুন্দর, বিছানো বিভিন্ন ধরনের পাথরের উপর পরিস্কার ও স্বচ্ছ পানি প্রবাহ যেন কোন এক রুপকথার গল্পের নদীর সাথে হুবহু মিলে যায়।
এখানে শৌখিন পর্যটকদের জন্য রয়েছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। আবার কিছু ছোট ছোট ডিঙি নৌকাও দেখা যায়। এছাড়াও অবশ্য স্থানীয়দের জীবীকা নির্বাহে ব্যবহৃত সরু লম্বা আরেক ধরনের নৌকা রয়েছে। স্থানীয়রা এসব নৌকাভর্তি করে পাথর বয়ে নিয়ে যায়। পাথর সংগ্রহ করাই এদের পেশা। এখানকার পাথর দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থাপনায় নির্মাণশৈলীতে ব্যবহার করা হয়।
খাসিয়াপুঞ্জি
পিয়াইন পার করলেই সামনে রয়েছে খাসিয়াপুঞ্জি। খাসিয়াপুঞ্জি মানে হচ্ছে খাসিয়া গ্রাম। এখানে পা ফেললে প্রথমেই চোখে পড়বে খাসিয়াদের নিজেদের হাতে তৈরি করা, ৩-৪ ফুট উচু, অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ি বাড়ি।
এদের প্রতিটি বাড়ির সাথেই রয়েছে পানের বরজ। এখানকার খাসিয়া সম্প্রদায় মাতৃতান্ত্রিক। পুরুষরা এখানে গাছ বেয়ে বরজের পান পাতা নিয়ে আসেন। আর বাড়ির উঠানে বসে নারীরা পান পাতা ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখে বাজারে বিক্রি করার জন্য। এ যেন এদের রোজকার কাজ; কত স্নিগ্ধ, সরল তাদের জীবনাচরণ!
এখানে একটু লক্ষ্য করলে আরেকটা জিনিস দেখতে পাবেন। আর তা হলো কমলার বাগান। ছোট-বড়, কাঁচা-পাকা কমলার বাগান যেন ছবির মতোই সুন্দর। প্রকৃতির এই অপরুপ সৌন্দর্যে যে কেউ বারবার আটকে যেতে চাইবেন।
জাফলং এর পাহাড় ও মেঘ
সৌন্দর্য্যের এই বিশাল সমারোহের মাঝে আরও দেখতে পাবেন, সীমান্তের ওপারে দৃশ্যমান ভারতীয় পাহাড় টিলা। জাফলং এর সৈান্দর্যকে যেন আরও বৃদ্ধি করে এই পাহাড়গুলো। এ জায়গাটায় আপনি যেতে পারবেন না কিন্তু দেখতে পাবেন কিভাবে পাহাড়ের বুক চিরে সেখানে বয়ে যাচ্ছে শীতল ঝর্ণা। আর পাহাড়ের গায়ে তুলার মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন অপরুপ সৌন্দর্য জাফলং ছাড়া আর কোথায় পাবেন? এছাড়াও, এখানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং মালভূমি থেকে উৎপন্ন ডাউকি নদী জাফলং দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
এশিয়ার সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির নদীঃ ডাউকি
এশিয়ার সবচেয়ে স্বচ্ছ পানির নদী ডাউকি। প্রথম দেখাতে দৃষ্টি ফেরাতে পারবেন না এই নদীর থেকে। ছবির মতো সুন্দর ডাউকি নদীর উপরে আবার রয়েছে ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ। এই ব্রিজ যেন জাফলং এর সৌন্দর্য্যের মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করে।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা এই ব্রিজ স্বাক্ষী হয়ে আছে ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হওয়া ডাউকি ফল্টের। এই ব্রিজে যাতায়াত করার সময় যখন জলপ্রপাতের পানি ব্রিজের নিচ দিয়ে এসে দুই পা স্পর্শ করবে, তখন, পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়বে এক শীতল অনুভূতি।
সিলেটের চা বাগান
সিলেটে গিয়েছেন কিন্তু চা-বাগানের দেখা মেলেনি এমন কি হতে পারে! তাই জাফলংয়েও মিলবে চা-বাগানের হদিস। সবুজ চা বাগানের সাথে পাহাড়ী পথ আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করে আপনি সংগ্রামপুঞ্জির রাস্তা ধরে একটু সামনের দিকে গেলে নকশিয়াপুঞ্জিতে আবার দেখতে পাবেন দেশের প্রথম সমতল চা বাগান। এইখানটায় যেন শুধু সবুজ আর সবুজই চারিদিকে। সবুজের মহাসমারোহে সত্যিই আপনি যেন হারিয়ে যাবেন।
জাফলং যাওয়ার উপযুক্ত সময়
প্রত্যেকটি ঋতুতেই জাফলং তার সৌন্দর্যের সবটুকুই যেন বিভিন্নরকমভাবে ঢেলে দেয়। তবে, জাফলং-এ শীত এবং বর্ষা এই দুই ঋতুতে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। বর্ষায় জাফলং এর ধূলি ধূসরিত পরিবেশ হয়ে উঠে স্বচ্ছ ও সতেজ। এখানকার সুন্দর, নির্মল, প্রাকৃতিক বায়ুতে নিঃশ্বাস নিলে মনে হবে একদম অন্য পৃথিবীতে চলে এসেছেন। মনে আপনা-আপনি প্রশান্তি ভাব চলে আসবে। বর্ষায় উপচে পড়া পিয়াইন নদীর পানি শীত আসলে আবার একদম কমে যায়। চিরচেনা ডাউকি তখন হয়ে যায় শান্ত। তখন আপনি হেঁটেই পার হতে পারবেন নদের এপার থেকে ওপার। স্বচ্ছ পানি আর জেগে উঠা পাথরের মিতালীতে অপূর্ব সুন্দর দেখায় শীতের জাফলং।
কিভাবে জাফলং যাবেন
ঢাকা থেকে ট্রেন, বাস বা বিমানে আপনি সিলেট যেতে পারবেন। এরপর সিলেট সদর থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গোয়াইনঘাট।গোয়াইনঘাট থেকে মাত্র ১০ কি.মি. দূরে জাফলং।আপনি চাইলে সিলেট থেকে গোয়াইনঘাট এরপর গোয়াইনঘাট থেকে জাফলং যেতে পারেন। তবে এটা সময়সাপেক্ষ হবে।তাই ভালো হবে সিলেট সদর থেকে সরাসরি জাফলং যাওয়া।
যানবাহনভেদে এখানে মোটামুটি সময় লাগে এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা। আর্থিক খরচ এখানে ভিন্ন হবে।
সিএনজিতে ভাড়া পড়বে ১০০০-১২০০ টাকা।
মাইক্রোবাস রিজার্ভ করলে যাওয়া-আসায় ৩০০০-৪০০০ লাগবে।
বাসে আবার সস্তায় মাত্র ৮০ টাকা দিয়েই জাফলং যেতে পারবেন।
সবকিছু মিলিয়ে একটু নির্ঝঞ্ঝাট সময় যদি আপনি উপভোগ করতে চান তবে সিলেটের জাফলং এ যেতেই পারেন। এর একের পর একেক সৌন্দর্য আপনার ব্যস্ত সত্ত্বাকে কিছুসময়ের জন্য স্বস্তির দিশা দিবে।
আবাসন ও খাওয়া-দাওয়া
এখানে তেমন কোনো ভালো মানের হোটেল দেখা যায় না। তবে সিলেটের দরগা গেট থেকে আম্বরখানা, কদমতলী পর্যন্ত বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়। খাবারের জন্য স্থানীয় কিছু ছোট-মাঝারি হোটেল আছে। এখানে ভাত, মাছ ও অন্যান্য দেশীয় খাবার পাওয়া যায়। অধিকাংশ পর্যটক দিনের বেলা জাফলং ভ্রমণ করে এসে সিলেট শহরেই থাকেন; চাইলে আপনিও সিলেট শহরেই থাকতে পারবেন এবং দিনের ভ্রমণ করতে পারেন জাফলং এ।
সতর্কতা
পিয়াইন নদের একটু সামনে গেলে দেখতে পাবেন বিজিবি এবং ভারতের বিএসএফ একসাথে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা একটি সীমান্তবর্তী এলাকা তাই ভ্রমণের সময় স্থানীয় আইন এবং সীমান্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত নির্দেশনা মেনে চলা উচিত সকলের।
রেফারেন্সঃ
- https://www.sylhet.gov.bd/bn/site/tourist_spot/DXYa-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%B2%E0%A6%82
- https://adarbepari.com/jaflong-sylhet
- https://www.dhakapost.com/amp/tourism/237691
- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Jaflong
- https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%B2%E0%A6%82_%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A7%80#:~:text=%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%B2%E0%A6%82%20%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A7%80%20%E0%A6%AC%E0%A6%BE%20%E0%A6%A1%E0%A6%BE%E0%A6%89%E0%A6%95%E0%A6%BF%20%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A7%80,%E0%A6%89%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%B0%2D%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%A8%E0%A6%A6%E0%A7%80%20%E0%A6%A8%E0%A6%82%20%E0%A7%A9%E0%A7%A6%E0%A5%A4