Image default
ঘটমান বর্তমান

F-7 যুদ্ধবিমান: পুরনো প্রযুক্তি না কাঠামোগত দুর্বলতা?- বাংলাদেশের আকাশ কতটা নিরাপদ?

একটি বোতাম টিপলেই হয়তো ফিরে আসা যেত, হয়তো বাড়িতে পৌঁছে যেতেন নিরাপদে। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম ফেরেননি। তিনি থেকে গিয়েছিলেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত… কারণ তাঁর কাছে নিজের জীবন নয়, বড় হয়ে উঠেছিল- দায়িত্ব, মানুষ, নিরাপত্তা।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর চৌকস অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরের প্রথম ‘সলো ফ্লাইট ট্রেনিং’ ছিল সেদিন । কিন্তু আকস্মিক ভয়াবহ দুর্ঘটনা সব কিছু বদলে দিল। দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি আছড়ে পড়ে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর আবারো প্রশ্ন উঠছে—এসব প্রশিক্ষণ বিমান কেন বিধ্বস্ত হয়? এর পেছনে কি রয়েছে যন্ত্রাংশের ত্রুটি, নাকি রয়েছে প্রশিক্ষণ কাঠামোর গভীর ঘাটতি? এমনকি বিমান বাহিনীর ভেতর থেকে চলমান দুর্নীতির অভিযোগও দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? 

ফ্লাইট লেফটেনেন্ট তৌকির ও F-7 যুদ্ধবিমান ট্রাজেডি

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ছোট ও বড় বিমান দুর্ঘটনা বারবার কাঁদিয়েছে দেশবাসীকে। এসব দুর্ঘটনার শিকার কখনও বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ, কখনও বা প্রশিক্ষণ বিমান। এই ধারাবাহিকতারই একটি করুণ উদাহরণ আমরা দেখেছি- ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মর্মান্তিক মৃত্যু, এবং তার সাথে কতগুলো নিরীহ ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থীর প্রাণহানি।

সেদিন প্রশিক্ষণ মিশনের অংশ হিসেবে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির তার F-7 বিমান নিয়ে কুর্মিটোলা পুরনো বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেন। এরপর উত্তরা, দিয়াবাড়ী, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরার আকাশজুড়ে উড়তে থাকেন তিনি। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তৌকির বিমানে কিছু সমস্যা আঁচ করেন। কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে দেন, তার বিমান ঠিকমতো ভাসছে না; বরং সেটি নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

উত্তরা বিমান দূর্ঘটনা

এমন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে কন্ট্রোল রুম থেকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। যেন তিনি নিরাপদে বের হতে পারেন তাই তাকে ইজেক্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তৌকির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যান বিমানটিকে রক্ষা করার জন্য। তিনি সর্বোচ্চ গতি তুলে বিমানটি বেজ এর দিকে ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর মাঝেই কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। 

এরপর প্রায় এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বিমানটি এবং সরাসরি গিয়ে আছড়ে পড়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল ভবনের ওপর।কিছু বুঝে ওঠার আগেই মানুষের গা জ্বলে গেল ভয়ঙ্কর আগুনে। বাংলাদেশের মানুষ সাক্ষী হলো আরেক ভয়ঙ্কর জুলাইয়ের, যে জুলাই বারবার ফিরে আসে কেড়ে নিয়ে যায় আপনজনদের।

আরও যত বিমান দূর্ঘটনা 

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত এক দশকে দেশে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখন পর্যন্ত  দেশে  উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী ছিল ১৯৮৪ সালের ৪ আগস্টের ঘটনাটি। বিমানের F-27 ফ্লাইটটি বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় আসার পথে বিধ্বস্ত হলে দেশের প্রথম নারী পাইলট কানিজ ফাতিমা, বিমানের কো-পাইলটসহ মোট ৪৯ জন প্রাণ হারান। এর আগে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম বিমান দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ম্যাগডোনালস ডগলাস কোম্পানির তৈরি DC-3 এয়ারক্রাফটটি বিধ্বস্ত হলে পাঁচজন ক্রু নিহত হন। 

এরপর ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঘটে এক ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনা। সেদিনই ঢাকায় বিমানবাহিনীর উড্ডয়ন প্রশিক্ষণ স্কুলের উদ্বোধন করেন বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান, বীর মুক্তিযোদ্ধা এয়ার ভাইস মার্শাল খাদেমুল বাশার। উদ্বোধনী ফ্লাইটে তিনি ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার মফিজুল হকের সঙ্গে। আকাশে ওড়ার পরপরই চারপাশ কেঁপে ওঠে বিকট শব্দে। সবার চোখের সামনে বিমানটি সজোরে বিধ্বস্ত হয় তেজগাঁওয়ের একটি ভবনের ওপর। সেই সঙ্গে ঝরে যায় দুই সাহসী পাইলটের প্রাণ।

এরপরের বছরগুলোতেও থেমে থাকেনি দুর্ঘটনার ধারাবাহিকতা। ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে পারাবত ফ্লাইং একাডেমির প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে তিনজন পাইলট প্রাণ হারান। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পোস্তগোলায় এয়ার পারাবতের একটি বিমানে আগুন ধরে পাইলট ফারিয়া লারা ও কো-পাইলট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম নিহত হন।

এরপর কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার দেশের নানা প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান। ২০০৮ সালে কুমিল্লায় jc-5 মডেলের একটি বিমান ভেঙে পড়ে, যদিও পাইলট ও প্রশিক্ষণার্থী নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। ২০১৪ সালে টাঙ্গাইলে, ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে, এবং ২০২২ সালে সিলেটেও একইরকম দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের ইনানীতে বিধ্বস্ত হয় একটি F-7 বিএজি যুদ্ধবিমান, যেখানে পাইলট প্রাণ হারান।

এই তালিকায় আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ও ঘটনা যোগ হয় বিভিন্ন বছরে। ২০২৪ সালের ৯ মে চট্টগ্রামে ইয়াক-130 প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভেঙে পড়ে এবং কো-পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ পরবর্তী সময়ে মারা যান। ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর বগুড়ায় একটি পিটি-6 প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার শিকার হলেও পাইলটরা অক্ষত ছিলেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রশিক্ষণের সময় টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিধ্বস্ত হয় F 7 বিজি। এতে নিহত হন পাইলট আরিফ আহমেদ। 

বাংলাদেশে কয়েকটি বিমান দূর্ঘটনার চিত্র

এরপর, ২০১৫ সালের জুনে F-7 যুদ্ধবিমান সাগরে বিধ্বস্ত হলে নিখোঁজ হন পাইলট তাহমিদ, যার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। তার এক বছর আগে, ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, যশোরের মাহিদিয়া গ্রামে একটি পিটি-6 বিমান ধানখেতে জরুরি অবতরণ করে; সৌভাগ্যক্রমে এ যাত্রায় বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এরও আগে, ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীতে ভেঙে পড়ে আরেকটি যুদ্ধবিমান, যদিও পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।

একই ধরণের  ঘটনা ঘটে ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর, যখন শাহ আমানত বিমানবন্দরে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। সেদিনও প্রাণে বেঁচে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মুনতাসিন, যা অনেকটাই অলৌকিকভাবে ঘটে যায়। এর আগে, ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর বরিশালে আবারও একটি পিটি-৬ বিমান বিধ্বস্ত হলে প্রাণ হারান দুইজন পাইলট।

এই ধারাবাহিকতার সবচেয়ে পুরোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ২০০৮ সালের এপ্রিল মাস, যখন টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পাহাড়িপাড়া গ্রামে একটি F-7 প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান পাইলটসহ বিধ্বস্ত হয়। এতে নিহত হন স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান। সে সময় তদন্তে দুর্ঘটনার পেছনে সম্ভাব্য কারিগরি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হওয়া যুদ্ধবিমানটিও ছিল বহু আগের তৈরি একটি চীনা F-7, যার প্রযুক্তি ও কার্যক্ষমতা আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। চীনের তৈরি F-7 হলো একটি হালকা ও পুরনো ধরনের যুদ্ধবিমান, যা সোভিয়েত mig-21 এর উন্নত সংস্করণ হিসেবে বানানো হয়। তবে জেনে অবাক হবেন, নিরাপত্তার খাতিরে এই বিমান ২০১৩ সালেই তৈরি করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও এই পুরনো বিমান ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠছে এমন পুরনো ও নিরাপত্তাহীন বিমান কেন এখনো চালানো হচ্ছে?

বিমান দূর্ঘটনার পেছনে আসল কারণ

চীন, মিসর ও আলবেনিয়ার মতো দেশগুলো এই বিমান ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। এটি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হলেও, আসলে এটি যুদ্ধের জন্য তৈরি বিমান। তাই জনবহুল এলাকায় এমন বিমান ওড়ানো কতটা ঠিক, তা নিয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলছে। অনেকেই বলছেন, এত দুর্ঘটনা ঘটার পরও এই বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? কেউ কেউ আবার শহরের ভেতর থেকে বিমানবন্দর সরানোর দাবি তুলছেন।

F-7 এ ত্রুটি ও পুরানো প্রযুক্তির বিমান 

বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনাতেই ব্যবহৃত হয়েছিল F-7 সিরিজের প্রশিক্ষণ বিমান। সর্বশেষ উত্তরায় যেটি বিধ্বস্ত হলো, সেটিও ছিল চীনের তৈরি জে-7, যা বাংলাদেশে পরিচিত FT-7 BGI নামে। এই বিমানগুলোর নকশা আবার আশির দশকেরও বেশি পুরোনো। একসময় হয়তো চীনের জন্য এটি দ্রুতগতির ও উচ্চতা লাভে সক্ষম যুদ্ধবিমান ছিল। কিন্তু আজকের দিনে এসে এটি আর যুগোপযোগী নয়। বরং এখন এসব বিমানই হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ, বারবার ঘটাচ্ছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

আসলে এগুলো বাংলাদেশের জন্য ছিল একধরনের ‘অস্থায়ী সমাধান’। যতদিন না আমাদের বাহিনীর কাছে আধুনিক এক ইঞ্জিনের মাল্টিরোল জেট আসে, ততদিনের জন্যই এই বিমানগুলো কেনা হয়েছিল। কিন্তু বছর পার হতে থাকলেও সেই আধুনিকায়ন আর হয় নি।

পুরানো মডেলের F-7

কারণও স্পষ্ট,আর তা হচ্ছে- পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নত যুদ্ধবিমান আমাদের নাগালের বাইরে। আর তাই তুলনামূলক সস্তা চীনা জঙ্গিবিমানই হয়ে উঠেছে আমাদের ভরসা। এ পুরনো প্রযুক্তির বিমানগুলো যে শুধু পুরনো তাই নয় বরং ঝুঁকিপূর্ণ বটে। পাইলটদের জন্য জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় এর প্রতিটি উড়ান। তাই তো বিশ্বব্যাপী এই মডেলটিকে অনেকে ব্যঙ্গ করে বলেন “উড়ন্ত কফিন”।

কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কি আদৌ জানে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষার আসল চিত্রটা ঠিক কেমন? আর সেটা কতটা নাজুক? কথাটা শুনতে অবাক লাগলেও মাত্র ৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ঘটেছে ৩২টি বড় ধরনের দুর্ঘটনা! আর সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো—এর বেশিরভাগই ঘটেছে প্রশিক্ষণের সময়, তরুণ পাইলটদের জীবনের ঝুঁকিতে ফেলে। তাহলে প্রশ্ন আসে সমস্যাটা কি শুধু যান্ত্রিক ত্রুটির? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে কাঠামোগত ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা আর পরিকল্পনার ঘাটতি কিংবা দুর্নীতি?

বাংলাদেশে বিমান দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সামনে চলে আসে। 

ফিটনেস টেস্ট

প্রথমত, নিয়ম অনুযায়ী যেকোনো বিমান উড্ডয়নের আগে ‘ফিটনেস টেস্ট’ করা হয়। অর্থাৎ, বিমানটি উড়ার জন্য নিরাপদ কি না, তা যাচাই করে অনুমতি দেওয়া হয়। আমাদের দেশে এই নিয়ম মানা হলেও সমস্যা অন্য জায়গায়। আর তা হচ্ছে বিমানের ‘লাইফ সাইকেল’। অর্থাৎ, একটি বিমান কত বছর পর্যন্ত নিরাপদে ব্যবহারযোগ্য, তার একটি সীমা রয়েছে। কিন্তু সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও যদি বিমানটিকে চালু রাখা হয়, তবে সেটার জন্য দরকার খুবই নিয়মিত, নিখুঁত ও দক্ষ মেইনটেন্যান্স। অনেক সংবাদমাধ্যমের দাবি করেছে, বাংলাদেশে অনেক সময় সেই পর্যায়ের মেইনটেন্যান্স ঠিকমতো হয় না। ফলে, বিমানগুলো বাহ্যিকভাবে উড়তে সক্ষম মনে হলেও ভেতরে থাকে অব্যবস্থাপনা আর দুর্বলতা।

পরিকল্পনার ঘাটতি ও নীতির অভাব

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে নতুন যুদ্ধবিমান কেনার ক্ষেত্রে পরিকল্পনার ঘাটতি ও নীতির অভাব এখন এক গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেকোনো বিমান কেনার আগে প্রয়োজন হয় গভীর গবেষণা, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড স্টাডি এবং ব্যবহারিক যাচাই-বাছাই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক সময় এই প্রক্রিয়াগুলো খুবই সীমিত বা দায়সারা গোছের হয়। আর তার ফল?…পুরনো প্রযুক্তির ঝুঁকিপূর্ণ বিমানগুলো দিয়েই চালাতে হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও অপারেশন। 

টেকনিক্যাল ত্রুটি ও মানবিক ভুল

তৃতীয়ত, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সবচেয়ে সাধারণ দুইটি কারণ হলো টেকনিক্যাল ত্রুটি ও মানবিক ভুল। এই দুই ক্ষেত্রেই আমাদের ঘাটতি রয়েছে। প্রশিক্ষণ বিমানে ব্ল্যাক বক্স থাকলেও, দুর্ঘটনার পর সেগুলোর তদন্ত কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও ফলপ্রসূ হয়; সেটাই এখন প্রশ্ন।

বিমান দূর্ঘটনার সমাধান কী

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অনেক যন্ত্রপাতি এবং যুদ্ধবিমান এখনও পুরনো এবং তা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক করা হয়নি। সামরিক বিশ্লেষণভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘War Per War’–এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কাছে রয়েছে মাত্র ৪৪টি যুদ্ধবিমান। এর মধ্যে ৩৬টি হলো চীনের তৈরি F-7 এবং ৮টি সোভিয়েত আমলের MiG-29। এছাড়াও প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে Yak-130 এবং FT-7 ধরনের কয়েকটি বিমান। 

সোভিয়েত আমলের MiG-29

সংখ্যা দেখে মনে হতে পারে বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু ভেতরের চিত্রটা ভিন্ন। এসব যুদ্ধবিমানের অনেকগুলোর মধ্যেই রয়েছে বিভিন্ন টেকনিক্যাল সমস্যা। কোনোটির অস্ত্র ব্যবস্থা অকেজো, কোথাও ইঞ্জিনের ঘাটতি, আবার কোথাও প্রয়োজনীয় স্পেয়ার পার্টসই নেই। সবচেয়ে বড় কথা পুরনো যুদ্ধবিমান মেরামতের পর্যাপ্ত সক্ষমতাও এখনও গড়ে উঠেনি আমাদের দেশে।

বারবারই সামরিক সক্ষমতা গড়তে গেলেই প্রশ্ন আসে বাজেটের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলো আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি ও কেনার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যয় বাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার উল্টো। যদিও টাকার পরিমাণে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো হয়েছে, ডলারের হিসাবে সেটি কমেছে। এর মধ্যে অধিকাংশ বাজেট চলে যাচ্ছে পরিচালনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানির পরিমাণ গত পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ সামরিক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়লেও নতুন সমরাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমেছে। ফলে দেশের সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরনো কাঠামোয় আটকে রয়েছে, আর যুদ্ধ প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগগুলো বেশ কিছুসময় থেকে অবহেলিত রয়ে গেছে।

ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমান প্রশিক্ষণ এর যৌক্তিকতা

এর মাঝেই ফেসবুকে সবার মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে একটা প্রশ্ন সেটা হচ্ছে- কেন এত ঘনবসতিপূর্ণ একটা এলাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে? এর পেছনের যুক্তিটাই বা আসলে কি? অন্যান্য দেশে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সাধারণত জনমানবহীন, খোলা জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়। দেশগুলোর প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা হলেও তা তেমন আলোচনার বিষয় হয় না, কারণ সেগুলো সাধারণত কম জনবহুল বা জনশূন্য এলাকায় ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ঢাকার আশপাশে এমন কোনো পৃথক ফাইটার বেজ না থাকা। ফলে প্রশিক্ষণ বিমানগুলো জনবহুল এলাকায় উড়াল দেয়, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। এই কারণটিকেই দেশের বিমান দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ হিসেবে ধরা হয়।

তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দিকটিও আমাদের স্পষ্টভাবে ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশ কি চীন, রাশিয়া, ইউরোপ না কি আমেরিকার সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতে বেশি কাজ করবে? এটা এখনো ঠিকভাবে নির্ধারিত নয়। দুঃখজনকভাবে, এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও অনেক সময় যথাযথভাবে গুরুত্ব পায় না। আর এই পরিকল্পনার অভাব, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অনিয়মের কারণেই আজও দেশে বিমান দুর্ঘটনার হার উদ্বেগজনকভাবে বেশি।

সব বাধা আর সংকট সত্ত্বেও, এসব সমস্যা সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করে বাংলাদেশ দ্রুতই একটি আধুনিক ও নিরাপদ বিমান ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাক। 

তথ্যসূত্র-

Related posts

৪ প্রদেশে ভাগ হচ্ছে বাংলাদেশ, রয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ!

বিপ্লবের রঙ – রঙ যেখানে আন্দোলনের পরিচয়

নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপই পৃথিবীর প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ!

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More