Image default
ঘটমান বর্তমান

‘কিংস পার্টি’ বাহাস: শুরুতে আলোচনায়, শেষে ধরাশায়ী

রাজনীতি পাড়ায় এখন নতুন সরগরম শব্দ “কিংস পার্টি”। কেউ পক্ষে, কেউবা বিপক্ষে। প্রশ্ন উঠছে কিংস পার্টি আসলে কী? এর উত্থানের পেছনে কি গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, নাকি ক্ষমতার অদৃশ্য খেলা?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘কিংস পার্টি’ একটি পরিচিত বিষয়। বিশেষ করে, যখনই দেশে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, তখন এই ধরনের রাজনৈতিক দল গঠনের তৎপরতা দেখা যায়। এমনকি নির্বাচিত সরকারের সময়েও কিংস পার্টির তৎপরতা বেড়ে ওঠে। 

এই দলের মূল লক্ষ্যই থাকে ক্ষমতাসীন সরকারকে বৈধতা প্রদান করা এবং রাজনৈতিক মাঠে বিরোধী দলগুলোর বিপরীতে কার্যক্রম চালানো। তবে, একাধিকবার নির্বাচন থেকে জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এর ফলে দীর্ঘ সময় ধরে তারা রাজনৈতিক ইতিহাসের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।

‘কিংস পার্টি’র ইতিহাস

হাওয়াই থেকে শুরু

অনেকে মনে করেন, ‘কিংস পার্টি’ ধারণার উৎপত্তি বোধহয় সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যে। বাস্তবে ইতিহাসের প্রথম কিংস পার্টি গঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই স্টেটে। দ্বীপপুঞ্জটি স্বাধীন ‘হাওয়াই কিংডম’ থাকাকালে নিয়ম ছিল যে, রাজার বংশগত উত্তরাধিকার না থাকলে এবং তিনি কাউকে মনোনীত না করে গেলে দেশটির বিধানসভা পরবর্তী রাজা নির্বাচন করবে। 

১৮৭৪ সালে কিং লুলালিলোর মৃত্যুর পর এমনই একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। রাজকীয় সেনাপ্রধান ডেভিড কালাকাউয়া এবং পূর্ববর্তী রাজা চতুর্থ কামেহামেহার স্ত্রী কুইন এমা নির্বাচনে দাঁড়ান। বিধানসভার সদস্যরা তখন ‘কিংস পার্টি’ ও ‘কুইনস পার্টি’ নামে বিভক্ত হন এবং ৩৫-৬ ভোটে কালাকাউয়া নির্বাচিত হন। 

জনসাধারণের মধ্যে রানীর প্রভাব বেশি থাকায় নির্বাচনের পর দাঙ্গা বেধে যায় এবং আমেরিকান ও ব্রিটিশ নৌ সেনাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে, পরবর্তী দেড় দশকের মধ্যে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্রের ‘টেরিটোরি’ হিসেবে ‘যোগ’ দিয়েছিল। 

রাজকীয় সেনাপ্রধান ডেভিড কালাকাউয়া এবং কুইন এমা

বাংলাদেশে ‘কিংস পার্টি’ 

বাংলাদেশে ‘কিংস পার্টি’ ধারণা মুখরোচক হয়ে ওঠে অবশ্য ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকারের সময়। সেই সময় জরুরি অবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকলেও রাজনীতিক ও সাংবাদিক ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর নেতৃত্বে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি’। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৪৫ দিন আগে দলটি নিবন্ধন পায়। 

অবশ্য ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর নিবন্ধন হারায় পিডিপি। একই সময়ে ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর নিবন্ধন পেয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন ‘বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি’। দলটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলনে ‘ক্লান্ত’ হয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো। আবার, ওয়ান ইলেভেন কালেই নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দল ‘নাগরিক শক্তি’ আত্মপ্রকাশের মাস তিনেক পরেই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি

কিংস পার্টির বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশে

গত ৮ সেপ্টেম্বর গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এই কমিটি তারুণ্যনির্ভর একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কিছু বক্তব্য সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষত দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই, যা তাদের কার্যক্রম নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা?

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা এখন তিনভাগে বিভক্ত হয়ে তিন রকম ভূমিকা পালন করছেন।

ছাত্রনেতাদের তিনজন আছেন সরকারে, বাকিরা “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” আর “জাতীয় নাগরিক কমিটি” এর ব্যানারে পালন করছেন নানা কর্মসূচি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করতে দেখা যাচ্ছে এসব নেতাদের। তবে, এসব প্রক্রিয়ায় প্রকাশ্যে যুক্ত নেই সরকারে থাকা তিন ছাত্র প্রতিনিধি। যদিও ছাত্রদের এসব উদ্যোগকে অনেকেই বলছেন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আগের পর্যায় হিসেবে।

তাহলে কি ক্ষমতায় থেকে নেপথ্যে ‘কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা করছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা?

নতুন রাজনৈতিক দলের গঠনে জাতীয় নাগরিক কমিটির পরিকল্পনা ও অবস্থান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা কোনো “কিংস পার্টি” গঠন করছে না। তাদের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের দল গঠনের কোনো ইচ্ছা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য সদস্যদেরও দল গঠনের বিষয়ে কোনো আগ্রহ রয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়।

তারা আরও জানিয়েছেন, অভ্যুত্থান-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই সিদ্ধান্ত নেবেন কবে এবং কীভাবে দল ঘোষণা করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা হবে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি তাদের সহযোগিতা করবে। দল ঘোষণার সম্ভাব্য সময়সীমা দুই মাসের মধ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে।

তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে থানা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠনের পর, সেগুলোকে ওয়ার্ড পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর প্রতিটি থানার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জেলা কমিটি গঠন করা হবে। তারা জানিয়েছেন, এই কাঠামো লোয়ার লেভেল থেকে টপ লেভেল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির থানা-উপজেলা পর্যায়ের কমিটি গঠনের কাজ সরাসরি দল গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বলে দাবি করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিংস পার্টির ভূমিকা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘কিংস পার্টি’র ভূমিকা চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। কারণ তারা কখনোই সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। যদিও তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করা, তবুও, তারা দীর্ঘকাল ধরে জনগণের সমর্থন থেকে বঞ্চিত। 

বিশেষ করে, ওয়ান ইলেভেনের পর গড়ে ওঠা বিভিন্ন কিংস পার্টির কোনো খোঁজ নেই এখন। এসব দলগুলোর নেতাকর্মীরা কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ক্ষমতার ভাগিদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ওয়ান ইলেভেনের সময়ে একত্রিত হওয়া রাজনৈতিক শক্তি এখন একেবারে লাপাত্তা। 

এসব পার্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীন শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা লাভ করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই আশাও পূর্ণ হয়নি। শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর এই ‘কিংস পার্টি’রা রাজনীতি থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাদের প্রভাব এখন অতীতের ধূলিসাৎ অংশে পরিণত হয়েছে।

এখন, রাজনীতি পাড়ায় কিংস পার্টি যাদের “মীরজাফর পার্টি” বলেও উল্লেখ করা হয়। তাদের অস্তিত্ব বা প্রভাবের কোনো বিশেষ মূল্য নেই। এটা আর কোনো অতিরিক্ত অভিযোগ নয়। বরং তাদের রাজনৈতিক অবস্থান এবং কার্যক্রম কখনই জনগণের কাছে সৎ, নিরপেক্ষ বা গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হয়নি। একাধিক সরকারে পেছনের দরজা দিয়ে সুবিধা নেওয়ার পর, তারা আজ ইতিহাসের একাংশ হয়ে গেছে। 

কিংস পার্টির কার্যক্রম 

কিংস পার্টি হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক আঙিনায় এক রহস্যময় শক্তি। এটি  প্রায় সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। তবে, এই পার্টির মূল উদ্দেশ্য কী? সরলভাবে বললে, কিংস পার্টি সরকারের বৈধতা নিশ্চিত করা এবং নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা। অতীতে, নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার জন্য তাদের উপস্থিতি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, আর আজও সেই একই কৌশল পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

কিংস পার্টি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রভাব

কিংস পার্টি আসলে কী লাভ করে? বাংলাদেশের রাজনীতিতেই বা কি ধরনের প্রভাব বিস্তার করে? এক্ষেত্রে সরকারের জন্য মূল লাভটি হল বিরোধী দলগুলোর অনুপস্থিতিতে নির্বাচন বৈধ হয়ে যায়। 

সরকার যেহেতু বিরোধী পক্ষের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া নির্বাচন করতে চায়, সেহেতু কিংস পার্টির উপস্থিতি তাদের জন্য খুবই উপকারী। অন্যদিকে, কিংস পার্টির জন্যও একটি সুযোগ তৈরি হয়। তারা নির্বাচনেও অংশ নেয়, কিছু আসন লাভ করে এবং সরকারের ছেড়ে দেয়া জায়গাগুলো ভোগ করার সুযোগ পায়। এই সুবিধা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কিছুটা শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।

তবে, দীর্ঘমেয়াদে, এই লাভ কতটা স্থায়ী হয়? ইতিহাস দেখিয়েছে, কিংস পার্টি কখনই বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। যেমন, মেজর ইবরাহিমের ‘যুক্তফ্রন্ট’ কিংবা তৃণমূল বিএনপি- এই সমস্ত দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়ে কিছু আসন পেতে পারে। কিন্তু কখনোই তারা রাজনৈতিকভাবে বড় কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি।

‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দলের ভবিষ্যৎ একপ্রকার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকে।এসব দলের নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকে না। কিছু সংসদ সদস্য পদ হয়তো তারা পায়, কিন্তু ভিত্তিহীন এসব দলের ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। এসব দল করার মধ্য দিয়ে জাতির সঙ্গে একধরনের মশকরা করা হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিংস পার্টির পরিণতি কখনও সুখকর হয়নি। কারণ যাদের ইশারা বা ইন্ধনে দলগুলো গঠিত হয়, প্রয়োজন ফুরালে তারা কলার খোসার মতো ছুড়ে ফেলতে দ্বিধা করে না।

রেফারেন্স :

Related posts

হিজবুত তাহরীর কী এবং কেন তারা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ

ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল কী জনপ্রিয় হয়ে উঠবে?

৪ প্রদেশে ভাগ হচ্ছে বাংলাদেশ, রয়েছে বিশাল চ্যালেঞ্জ!

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More