বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবার আলোচনায় এসেছে বহুল আলোচিত নিষিদ্ধ সংগঠন, ‘হিযবুত তাহরীর’। সংগঠনটি মূলত একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল, যার মূল লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী ইসমি খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা। তবে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বেশ কিছু দেশে ..এই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে হিযবুত তাহরীরকে ঘিরে জনমনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে! কী চায় এই দলটি? কেনই বা এতগুলো দেশ এই দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে? বিশেষ করে বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা কি বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
চলুন, এ বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক।
হিযবুত তাহরীর কী
হিজবুত তাহরীর বিশ্বাস করে যে, মুসলিম বিশ্বের সব সমস্যার মূল কারণ হলো, খিলাফত ব্যবস্থা না থাকা, এবং সারা বিশ্বে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া।
তবে, হিযবুত তাহরীর খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোনো ধরনের সশস্ত্র পন্থায় বিশ্বাস করে না, বরং, তারা একমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনাতে বিশ্বাসী।
আর এ লক্ষ্যেই ১৯৫৩ সালে ‘তাকি আল-দীন আল-নাবহানি’ হিযবুত তাহরীর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর তাদের প্রথম কাজ ছিল মুসলিম দেশগুলোতে খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
হিজবুত তাহরীরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
কখনো ভেবেছেন কি, যে দলটি দাবি করে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবে, তারা কেনো বিশ্বের একাধিক দেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে?
আসলে, এই দলটির আদর্শ এবং কার্যক্রম এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে একাধিক দেশের সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। কেবল বাংলাদেশ নয়, হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করেছে চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, কাজাখস্তান, ইন্দোনেশিয়া এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশও।
সংগঠনটির প্রকাশিত খসড়া সংবিধান থেকে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পাওয়া যায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য হল ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা। এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন তাঁর মাক্কী জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হিযবুত তাহরীরও সেই আদর্শ অনুসরণ করতে চায়। তারা বিশ্বাস করে, মুসলিমদের ঐক্য এবং শক্তির জন্য খিলাফত পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি।
হিজবুত তাহরীরের সংবিধানে যা আছে
এই খসড়া সংবিধান অনুযায়ী, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠিত ‘খিলাফত রাষ্ট্রের’ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে।
খিলাফত রাষ্ট্রের ভাষা ও শাসনভার- থাকবে না কোন নারী নেতৃত্ব
প্রথমত, ধারা ৮ এ বলা হয়েছে, খিলাফত রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রভাষা হবে আরবি। শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে খলিফা দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাঁকে শুধুমাত্র মুসলিম পুরুষ হতে হবে। ধারা ৩১ অনুযায়ী, রাষ্ট্রে অমুসলিম বা নারীদের কোন ভূমিকা থাকবে না। এছাড়াও, ধারা ৩৭ এ বলা আছে, খলিফা শর্তসাপেক্ষে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন, তবে তার কাজ শরিয়া আইন বিরোধী হতে পারবে না, যেমন একজন খলিফা জন্মনিয়ন্ত্রণ বা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করার আদেশ দিতে পারবেন না।
খিলাফত রাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক সেনা প্রশিক্ষণ
এছাড়া, ধারা ৫৬ ও ৬৫ অনুযায়ী, সেনাবাহিনী হবে ইসলামী সেনাবাহিনী, এবং দেশের সকল মুসলিম পুরুষকে সেনা প্রশিক্ষণ নিতে হবে। বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র মুসলিম পুরুষরা বিচারক হতে পারবেন, এবং একমাত্র একজন বিচারক রায় দেবেন, যার কোন আপিল বা পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে না।
খিলাফত রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিক
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারায় বলা হয়েছে, “মজলিস আল উম্মাহ” নামে একটি পার্লামেন্ট সদৃশ প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে। সেখানে নারী এবং অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার সুযোগ থাকবে, তবে তারা শুধুমাত্র নিজেদের উপর অত্যাচার বা ইসলামী খিলাফতের অপব্যবহারের বিষয়ে আলোচনা করতে পারবে। অপরদিকে, ধারা ১০৫ অনুযায়ী “শুরা” এবং “মাশুরা” নামে দুটি প্রতিষ্ঠান থাকবে, যেখানে শুরা, শুধু মুসলিমদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে, আর মাশুরাতে কিছু অমুসলিম সদস্য থাকতে পারবেন।
খিলাফত রাষ্ট্রে সমাজ ও শিক্ষা- জিজিয়া কর
এছাড়া, তাদের খসড়া সংবিধানে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিধিনিষেধ-এর ধারণা দেওয়া হয়েছে। যেমন- জনসমক্ষে নারীদের মুখমণ্ডল এবং হাত ছাড়া সব অংশ ঢেকে রাখতে হবে, মুসলিম-অমুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে শিশুকে অবশ্যই মুসলিম অভিভাবকের সাথে থাকতে হবে। এছাড়া ধারা ১৪৫ অনুযায়ী, অমুসলিমদের থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হবে।
এদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রেও থাকবে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। যেমন- ধারা ১৬৯ এবং ১৭১ অনুযায়ী, বিজ্ঞান বিষয়ে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু শেখানো যাবে না। এমনকি ধারা ১৭২ এও উল্লেখ আছে, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী-পুরুষ মেলামেশা করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
খিলাফত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল
অন্যদিকে, তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র ইসলাম ভিত্তিক হতে হবে, এবং ইসলামী ভাবধারার বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না।
এছাড়া, ধারা ১৭৭ ও ১৮৬ অনুযায়ী বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক এবং অনৈসলামিক সংগঠনগুলোর সাথে যোগদান নিষিদ্ধ করা হবে।
হিজবুত তাহরীরের এজেন্ডা ও বাংলাদেশ
হিযবুত তাহরীরের আদর্শ এবং ‘খিলাফত রাষ্ট্রের’ খসড়া সংবিধান নিয়ে বেশ কিছু বিতর্কিত ধারণা উঠে আসে, যা থেকে প্রশ্ন আসতে পারে বাংলাদেশে সংগঠনটির এজেন্ডা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কি না?
মূলত এই ধারা ও আইনের মাধ্যমে হিযবুত তাহরীর তাদের যে খিলাফত রাষ্ট্রের আদর্শ তুলে ধরেছে, তা বাংলাদেশের মতো বহুত্ববাদী, গণতান্ত্রিক, এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ অমিল।
বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। মোটাদাগে হিযবুত তাহরীরের আদর্শ, যেমন নারীদের সামাজিক অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা, অমুসলিমদের রাজনৈতিক দলের অধিকার সীমিত করা, শরীয়া আইন বাস্তবায়ন -এগুলো বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো এবং সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের আইনি ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, হিযবুত তাহরীরের এই আদর্শ কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়।
হিযবুত তাহরীর বিশ্বজুড়ে ‘ইসলামি খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, তবে তাদের আদর্শ এবং কার্যক্রম মুসলিম দেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য সমস্যা তৈরি করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে, হিযবুত তাহরীরের খিলাফত প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম সাংবিধানিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে একাধিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশে এই দলের প্রতিষ্ঠা কতটা যৌক্তিক তা বিশ্লেষণ করা এখন সময়ের দাবি। জন্মের সূচনালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ নানা ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত। কোনো বিশেষ মতবাদ বা দলের প্ররোচনায় সমাজে সহিংসতা বা বিভেদ সৃষ্টি না হোক এ কামনায় আমাদের করা উচিৎ!