“বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুনা বলেছিলো, ‘যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালোবাসবে, সেদিন আমার বুকেও এই আতরের গন্ধ থাকবে!’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কথাগুলো যেন ভালোবাসার এক নতুন ভাষা, যেখানে প্রতিটি অনুভূতির গভীরতা গুনে গুনে বেড়ে যায়। ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট দিন দরকার নেই, তবে এক বিশেষ দিনে তা একটু বেশি বিশেষ হলে কি দোষ!”
১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস, ভালোবাসার দিন! এই দিনটার আসল সুর হল ভালোবাসা। আপনি যে বয়সেরই হোন, যে সম্পর্কেই থাকুন না কেন, ভালোবাসার জন্য কোনও বয়স বা শর্তের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো একটুখানি আদর, কিংবা একটু নির্ভরতা। এই ছোট্ট, সাদামাটা জাদুকেই বলা যায়, “কতটা ভালোবাসি!”
আজকাল ভ্যালেন্টাইন’স ডে মানে পছন্দের মানুষের সাথে একান্ত সময় কাটানো, উপহার বিনিময় , সারা শহরের সেরা রেস্টুরেন্টে ডিনার রিজার্ভেশন আরো কত কি! কিন্তু এর শুরুর গল্পটা একদম রোমান্টিক নয়। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস রোম-কোম মুভির মতো ছিল না। সেন্ট ভ্যালেনটাইন, তার প্রেম, আত্মত্যাগ এবং নানা সংস্কৃতির যোগসূত্র নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই দিনটির উৎপত্তি।
আসুন, জানি সেই গল্প, যা আপনি হয়তো কখনও শোনেননি!
ভালোবাসার দিন
ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই বাতাসে ভালোবাসার স্পর্শ, মনে প্রেমের গান আর চারপাশে রোমান্সের আবহ অনুভব করা যায়। এ মাসে ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস আছে, এটা সম্ভবত কাউকে মনে করিয়ে দিতে হবে না!
এবার একটু চোখ রাখি ২০২৫ সালের দিকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি আবার আসছে, এ বছর দিনটি পড়বে বুধবার। বার যাই হোক না কেন, ভালোবাসা দিবসের তারিখ কখনোই বদলাবে না। পৃথিবীর যেখানেই থাকুন, ভালোবাসা দিবস সবসময়ই ১৪ ফেব্রুয়ারি, একই দিনে উদযাপিত হবে।
কেন ১৪ ফেব্রুয়ারি?
সাধারণভাবে, প্রাচীন খ্রিষ্টানরা অনেক সময় তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো এমন দিনেই উদযাপন করতেন, যেগুলো আগে থেকেই উৎসব বা বিশেষ অনুষ্ঠানের দিন হিসেবে পরিচিত ছিল। যেমন, ক্রিসমাস বা শীতকালীন সূর্যগ্রহণ। এই একই কারণে, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন’স ডে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তার পরের দিন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিল লুপারকেলিয়া উৎসব। এটা এক ধরনের কৌশল ছিল, যাতে নতুন ধর্মীয় উৎসবগুলি পুরনো ঐতিহ্য ও উদযাপনগুলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে আরও গ্রহণযোগ্যতা পায়।
ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস
এখন যদি মনে করেন, ভালোবাসা দিবসের শুরুটা কেমন ছিল, তাহলে চলুন এক মিনিটের জন্য ইতিহাসে ফিরে যাই। পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে, পোপ জেলাসিয়াস ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এরপর থেকেই, এই দিনটি শুধু রোমান্টিক উদযাপনই ছিল না, বরং এক ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবেও পালিত হচ্ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, এটি হয়ে উঠেছে প্রেম, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও আন্তরিকতার এক চমৎকার উৎসব।
ভালোবাসা দিবস প্রতিষ্ঠার মিথ
ভালোবাসা দিবস প্রতিষ্ঠা নিয়ে আছে নানা মিথ। এসবের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বেশি পেয়েছে তৃতীয় শতকে এক পাদ্রির শহীদ হওয়ার ঘটনা।
তখন রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছেন তিনি। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুকে পরাজিত করতে সেনাবাহিনীকে আরও বড় করার কথা ভাবলেন সম্রাট।
ওই সময়ে তরুণরা যুদ্ধের দামামার প্রতি অনাগ্রহী। ক্লডিয়াস ভাবলেন, সঙ্গী না থাকলেই যুদ্ধমুখী হবে তারুণ্য। তাই নিষিদ্ধ করলেন বিয়ে। তারুণ্যকে নিয়মের বেড়াজালে বন্দি করার কাজটিও তো মুশকিলের। সম্রাটের চোখ ফাঁকি দিয়ে তরুণদের পাশে দাঁড়ালেন এক পাদ্রি, নাম সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন।
গোপনে তিনি বিয়ে দিচ্ছিলেন তরুণ-তরুণীদের। কিন্তু সম্রাটের চোখকে বেশি দিন ফাঁকি দিতে পারলেন না। ধরা পড়লেন ভ্যালেন্টাইন। শুরু হলো কারাজীবন।
ভ্যালেন্টাইনের কারাবাস ও প্রেম
মুক্তির পথ জানা না থাকলেও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে জেলখানায় যেতেন তরুণরা। ভ্যালেন্টাইনের প্রজ্ঞায় মুগ্ধ ছিলেন এক তরুণী। বলা হয়ে থাকে সেই তরুণী ছিলেন কারারক্ষীর মেয়ে।
প্রায়ই সে বন্দি ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে কারাগারে যেতেন। ধর্মযাজক হয়েও এক সময় রীতিনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই তরুণীর প্রেমে মজেন ভ্যালেন্টাইন।
আরো একটি মিথ
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই জানা যায়, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের গাঁথা। রোমের বাসিন্দা, খ্রিষ্টধর্মের পুরোহিত ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেই উদ্যাপিত হয়েছিল এই দিনটি।
সে দেশে নিষিদ্ধ হওয়া খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য রোমের তৎকালীন সম্রাট রাজা দ্বিতীয় ক্লডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে বন্দি করার আদেশ দেন। সেখানে আটক থাকাকালীন দৃষ্টিহীন এক মহিলার চিকিৎসা করে চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন তিনি। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তার জয়গান। ভ্যালেন্টাইনের এই জনপ্রিয়তায় রাজা ক্লডিয়াস ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং তাকে নিশ্চিহ্ন করতে মৃত্যুদণ্ড দেন।
ভালোবাসা দিবসের শুরু
২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইন প্রেয়সীকে চিঠি লেখেন তিনি।
যার শেষ বাক্যটা ছিল, ‘তোমার ভ্যালেন্টাইনের কাছ থেকে ভালোবাসা।’
সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসার দিন। যদিও দুই শতাব্দী নীরবে-নিভৃতে পালন করতে হয়েছে দিনটি। অবশেষে ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমের রাজা পোপ জেলুসিয়াস আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে ঘোষণা করেন।
পাখিদের বিয়ের দিন
ভ্যালেন্টাইন ডে এর শুরু নিয়ে আরেকটি মিথ বেশ আলোচিত। এই মতের মানুষরা মনে করেন ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার অনেকে বলেন, মধ্যযুগের শেষ দিকে মানুষ বিশ্বাস করত, এদিনে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। তাদের দেখাদেখি মানুষও সঙ্গী নির্বাচন করে এ দিনে।
জুনো উৎসব
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর আগে প্রতি বছর রোমানরা ১৪ ফেব্রুয়ারিতে জুনো উৎসব পালন করত। রোমান পুরাণের বিয়ে ও সন্তানের দেবী জুনো। দিনটিতে অবিবাহিত তরুণরা কাগজে নাম লিখে লটারির মাধ্যমে তার নাচের সঙ্গীকে বেছে নিত।
৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রোমানরা যখন খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে, তখন ‘জুনো’ উৎসব আর সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে গাথা হয় সূত্রে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা ইউরোপ এবং ইউরোপ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ভালোবাসা দিবস পালনের সেরা উপায়
ফ্রেব্রুয়ারি মাস এলেই যেন বাড়তি হাওয়া লাগে প্রেমের পালে। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ মঙ্গলবার বিশ্ব মাতবে প্রেমে।
ভালোবাসা দিবস উদযাপনে সারাবিশ্বে শুরু হয় প্রস্তুতি। বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, শপিংমলও ভালোবাসা দিবস পালনে দেয় বিশেষ অফার।
এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে তুলতে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা সাজায়, যেমন উপহার কেনা, রেস্তোরাঁয় যাওয়া, ঘুরতে যাওয়ার ব্যবস্থা করা, অথবা সঙ্গীকে চমকে দেওয়ার জন্য নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ভাবা। অনেকেই দিনটি আরো রোমান্টিক এবং বিশেষভাবে উদযাপন করতে চায়, তাই এই দিনটির জন্য পরিকল্পনা করার সময় তাদের চিন্তা এবং প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয় না!
ভালোবাসা দিবসের জনপ্রিয় উপহার আইডিয়া
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের এদিনে অনেকেই ভালোবাসার মানুষটিকে উপহার দেওয়ার কথা প্ল্যান করে থাকেন। কিন্তু বুঝতে পারেন না কী উপহার দেবেন প্রিয় মানুষটিকে। তবে উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এমন কিছু উপহার বেছে নিতে পারেন যা প্রিয় মানুষটি ব্যবহার করতে পারবে। তাই উপহার কেনার আগে কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করে এবং ভালোবাসার মানুষটির পছন্দের বিষয় মাথায় রেখে উপহার বাছাই করা যেতে পারে।
ফুল
ফুল ভালবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কম-বেশি সবাই ফুলকে ভালবাসে। কাজেই ভালোবাসা দিবসে আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে একগুচ্ছ ফুল দিয়েই বরণ করে নিন। তাতে ফুলের মতো ভালোবাসাকেও পবিত্র মনে হবে। তাই ফুল হোক ভালোবাসার মানুষটির জন্য প্রথম উপহার।
চকলেট
চকলেটও ভালোবাসা দিবসের একটি ভালো উপহার হতে পারে। কাজেই প্রিয় মানুষটির জন্য তার পছন্দমতো এক বাক্স চকলেট কিনে রাখুন। চাইলে ব্র্যান্ডেড দামি কোনো চকলেটও উপহার দিতে পারেন। কনফেকশনারী দোকানগুলোতে বিভিন্ন আকৃতির চকলেটের বাক্সগুলো ২০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়।
কার্ড
ভালোবাসার মানুষটিকে উপহার হিসেবে কার্ডও দিতে পারেন। তাতে ভালো লাগা কোনো মুহূর্তের কথা অথবা মনের কোনো ইচ্ছার কথা লিখে দিতে পারেন। এমনকি মনের না বলা কথাও লিখে জানাতে পারেন। এতে ভালোবাসার মানুষটি আপনাকে আরও গভীরভাবে চিনবে।
বই
শুধু ফুল, চকলেট আর কার্ড নয়, ভালোবাসার মানুষটিকে তার পছন্দমতো কোনো বইও উপহার দিতে পারেন। কথার ছলেই তার কাছ জেনে নিন কোন ধরনের বই তার পছন্দ।
হাতে তৈরি কার্ড
মডেল পেপার, রঙিন কাগজ, কাঁচি, স্কেল, আঠা ও পেনসিল হাতের কাছে থাকলেই ঝটপট বানিয়ে ফেলতে পারেন ভালোবাসা দিবসের কার্ড। কার্ড বানিয়ে সাজিয়ে নিন ইচ্ছে মতো। ইউটিউবে পেয়ে যাবেন কার্ড বানানোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল।
ভালোবাসা দিবসের জন্য বিশেষ খাবার
ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে চমৎকার কেক বানিয়ে ফেলতে পারেন। অথবা হার্টের আকৃতির বিস্কুট বানিয়েও পরিবেশন করতে পারেন প্রিয় মানুষের সামনে।
ভালোবাসা দিবসের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা
ভালোবাসা প্রকাশ করতে এ বিশেষ দিনে কপোত-কপোতীরা নানা উদ্যোগ নেন। সব দেশে যে ভালোবাসা দিবসের প্রথা একই রকম এমন নয়।
জার্মানি
জার্মানিতে ভালোবাসা দিবস মূলত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত। এবং এটি একটি পূর্ণবয়স্কদের বিষয় হিসেবে দেখা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেখানে ভালোবাসা দিবসে রোমান্টিকতার জন্য শূকরকে পছন্দ করা হয়। কারণ শূকরকে ভাগ্য এবং যৌনকামনার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরকে শূকরের মূর্তি বা ছবি উপহার দেয়, এমনকি শূকরের আকৃতির চকলেটও উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। অন্যদিকে, যেখানে আমেরিকানরা ভালোবাসা দিবসে চকলেট ডেজার্ট পছন্দ করে, সেখানে জার্মানরা হৃদয়-আকৃতির জিনজার কুকিতে রোমান্টিক বার্তা লিখে তা উপভোগ করে।
দক্ষিণ কোরিয়া
যুক্তরাষ্ট্রে ভালোবাসা দিবসে বেশিরভাগ উপহার পুরুষেরা দিয়ে থাকে; কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়াতে এর বিপরীতটাই সত্য। এখানে নারীরা তাদের পুরুষ সঙ্গীদের চকলেট উপহার দেয়। এক মাস পর হোয়াইট ডে-তে পুরুষেরা ক্যান্ডি প্রদান করে এই শুভেচ্ছা রিটার্ন করে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, কখনো কখনো সিঙ্গেল ফ্রেন্ডরা ব্ল্যাক ডে-তে (১৪ এপ্রিল) ব্ল্যাক নুডলস খাওয়ার জন্য একত্রিত হয়।
জাপান
জাপানেও ভালোবাসা দিবসে নারীরা চকলেট উপহার দেয়, তবে এখানে কিছু তারতম্য রয়েছে। সহকর্মী ও সহপাঠীরা সাধারণত অবলিগেশন চকলেট বা গিরি চকলেট প্রত্যাশা করে। যা উপহার দেওয়ার একটি বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখা হয়। নারীরা তাদের প্রিয়জনদের ট্রু ফিলিং চকলেট বা হনমেই চকলেট উপহার দেয়।যা সাধারণত অত্যন্ত দামি এবং বেশিরভাগ সময় হাতে তৈরি করা হয়।
এছাড়া, যদি তারা এক মাস পর হোয়াইট ডে-তে পুরুষদের কাছ থেকে প্রতিদানের অপেক্ষায় থাকতে না চায়, তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি নিজেই নিজেদেরকে জিবুন চকো বা নিজেই নিজের জন্য চকলেট উপহার দেয়।
ইতালি
‘ভালোবাসা দিবসে যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যরা কার্ড বিনিময় করে, সেখানে ইতালিতে শুধুমাত্র প্রেমিক-প্রেমিকারা এ দিনটি উদযাপন করে। ইতালিতে ‘বাচি পেরুজিনা’ নামের একধরনের চকলেট জনপ্রিয় যার ফয়েলের ভেতর রোমান্টিক ম্যাসেজ থাকে। ইতালিয়ান ‘বাচি’ শব্দের অর্থ ‘চুম্বন’। এক বাক্স বাচি পেরুজিনা হ্যাজেলনাট চকলেট বিনিময়ের মানে হচ্ছে চুম্বন বিনিময় করা।
ডেনমার্ক
ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখা হয় লাল গোলাপকে। তবে ডেনমার্কে লাল গোলাপের বিকল্প হিসেবে ‘স্নো ড্রপ’ নামক ফুলটি জনপ্রিয়। ডেনিশ পুরুষেরা মাঝেমাঝে নারীদেরকে মজার কবিতা পাঠায় যা ‘গায়েক্কেব্রেভ’ নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা এসব কবিতা বেনামে পাঠায়। যেখানে ডটের সিরিজের মাধ্যমে নিজেদের নাম পরিচয় গোপন রাখে। যদি প্রাপক অনুমান করতে পারে যে কে পত্রটি পাঠিয়েছে, তবে সে তাকে ওই বছর ইস্টার এগ উপহার দেয়।
ফ্রান্স
“ভালোবাসার শহর” হিসেবে পরিচিত শহর হচ্ছে প্যারিস। অনেকেই মনে করেন প্যারিস হচ্ছে ভালোবাসা দিবসের জন্য বিশ্বের প্রধান কেন্দ্রে বা মন্দির। দম্পতি বা প্রেমিক-প্রেমিকারা ‘পন্ট দেস আর্ট’ বা ‘লাভ লক ব্রিজ’-এ একটি তালা ঝুলিয়ে তা সাইন নদীতে নিক্ষেপ করে। যাতে তাদের ভালোবাসা চিরকাল স্থায়ী হয়।
ফ্রান্সে রোমান্সের জন্য প্যারিসই একমাত্র গন্তব্য নয়। ভ্যালেন্টাইন নামে একটি গ্রামই আছে ফ্রান্সে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছোট্ট এই গ্রাম ‘ভিলেজ অব সেন্ট ভ্যালেন্টিন’, সুন্দরভাবে সেজে ওঠে। প্রত্যেক বাড়িতে গ্রিটিংস কার্ড, ভালবাসার বার্তা, প্রেমের প্রস্তাব লেখা চিরকুটে সাজিয়ে তোলা হয়।
লতা-পাতা ফুলও থাকে সেই অন্দরসজ্জায়। বাড়ির বাগানও সাজানো হয় একইভাবে। এলাকাবাসী মহা ধুমধামে পালন করে দিনটি।
চীন
চীনে ভালোবাসা দিবস দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, তবে এখানে ‘কিশি ফেস্টিভ্যাল’ কে প্রায়ই চীনা ভালোবাসা দিবস বা চাইনীজ ভ্যালেন্টাইন’স ডে বলা হয়। এই উৎসব চৈনিক দিনপঞ্জি অনুসারে সপ্তম চান্দ্রমাসের সপ্তম দিনে উদযাপন করা হয়, যা সাধারণত আগস্ট মাসে পড়ে। ঐতিহ্যগতভাবে, এই দিনে নারীরা ভালো স্বামী পাওয়ার জন্য বা সেলাই দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রার্থনা করতেন।
বর্তমানে, চীনা ভালোবাসা দিবস এবং পাশ্চাত্য ভালোবাসা দিবসের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন ভালোবাসা ও প্রেমের উদযাপন এবং উপহার বিনিময়।
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস উদ্যাপন
বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীরা ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবসটি ব্যাপকভাবে উদযাপন করে থাকে। তবে গ্রামাঞ্চলে এই দিবসটির কোনো বিশেষ প্রভাব পড়ে না। সাধারণত, শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায় এই দিনটির উদযাপন, যেখানে বিশেষ করে তরুণ সমাজ ফুল, চকোলেট, কার্ড, এবং অন্যান্য উপহার দিয়ে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে।
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় না, তবে তা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন শহরে প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধব, স্বামী-স্ত্রী, মা-সন্তান, এমনকি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কেও ভালোবাসার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়।
এদিন, দেশের বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো প্রেমিক-প্রেমিকা এবং ভালোবাসার মানুষদের দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই দিনটি মানুষদের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা এবং আন্তরিকতা প্রকাশের একটি বিশেষ দিন হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালন কেন বিতর্কিত?
বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালন নিয়ে নানামূখী বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের কেউ কেউ মনে করেন, এ দিনটি উদ্যাপন করা সংস্কৃতি এবং ইসলাম ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য নয়। ভালোবাসা দিবস নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কও রয়েছে।
ভালোবাসা দিবস পালনের আগে বাংলাদেশে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার বিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ১৯৮৩ সালে সেই সময়কার সরকারের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৪ই ফেব্রুয়ারিতে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা মিছিল করে সচিবালয়ের দিকে যায়। সেসময় পুলিশের গুলিতে ১০ জন নিহত হয়েছিলো। তবে ভালোবাসা দিবস পালন করতে গিয়ে সে দিবস ছাপিয়ে গেছে। সরকার নিজেদের স্বার্থেই এ দিবস পালন অব্যাহত রেখেছেন বলে কারো ধারণা করা হয়।
ভ্যালেন্টাইন’স ডে ম্যাসাকার
ভ্যালেন্টাইন’স ডে শুধুমাত্র রোমান্টিক আনন্দের উদযাপন নয়, এর ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা রয়েছে যা এই দিনটিকে একটি ভীষণ ট্রাজেডির সঙ্গে যুক্ত করেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৯-এ শিকাগো শহরে প্রহিবিশন অর্থাৎ মদ নিষিদ্ধকালীন সময়ে ‘আল কপোন’ এর নেতৃত্বাধীন একটি গ্যাং নারকীয় হামলা চালায়। এই হামলায় সাতজন মানুষ নিহত হয়। ঘটনাটি ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে ম্যাসাক্র’ (Valentine’s Day Massacre) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এবং এটি প্রহিবিশন সময়ের অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
এ সময় পুলিশ ও আইনপ্রণেতারা শহরের গ্যাং এবং মাফিয়া সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। এই গ্যাংগুলো অবৈধ মদ উৎপাদন এবং পাচারের জন্য সংগঠিত হয়েছিল। ১৪ ফেব্রুয়ারির এই হত্যাকাণ্ড তাই শুধু একটি মর্মান্তিক ঘটনার কারণই হয়নি, এটি প্রহিবিশনের সময়ে গ্যাং যুদ্ধের একটি বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে।
বন্ধুত্বের ভালোবাসা : ভ্যালেন্টাইন’স ডে থেকে গ্যালেন্টাইন’স ডে
গ্যালেন্টাইন’স ডে, হচ্ছে ভ্যালেন্টাইন’স ডে-এর একটি নতুন এবং মজার সংস্করণ। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যালেন্টাইন’স ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পার্কস অ্যান্ড রিক্রিয়েশন টিভি শো এর অ্যামি পোহলার চরিত্র লেসলি নোপ এর মাধ্যমে দিনটি প্রথম জনপ্রিয় হয়েছিল।
গ্যালেন্টাইন’স ডে হলো এমন একটি দিন, যখন মানুষ তাদের প্রিয় বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটি ১৩ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়, যাতে করে পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি তারা তাদের সঙ্গীর সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদযাপন করতে পারে।
এদিন, অনেকেই তাদের বন্ধুদের উপহার দিয়ে, একসাথে সময় কাটিয়ে অথবা ছোট ছোট চিঠি লিখে তাদের মূল্যায়ন করেন। গ্যালেন্টাইন’স ডে শুধুমাত্র প্রেমের সম্পর্কের জন্য নয়, বন্ধুত্বের ভালোবাসাও উদযাপন করার একটি দিন। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, ভালোবাসা শুধু রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বন্ধুত্বও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ভালোবাসা দিবস পালন নিষিদ্ধ
বিভিন্ন দেশে ভালোবাসা দিবস পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সবচেয়ে সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পাকিস্তান, যেখানে ভালোবাসা দিবস জনসম্মুখে উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানে ইসলাম ধর্মের অনুসরণ করা হয়, এবং তারা বিশ্বাস করে যে, এই দিবসটি ইসলামের ধর্মীয় নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এর আগে, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়া থেকেও ভালোবাসা দিবসের আয়োজন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
এছাড়াও, ২০০৯ সাল থেকে ইরানে ভালোবাসা দিবস উদযাপন সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যক্রম, যেমন: ফুল বা কার্ড দেওয়া, নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইরানের সরকার এটি ধর্মীয় বিধির বিরুদ্ধে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব হিসেবে দেখছে।
এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর মাধ্যমে কিছু দেশ তাদের সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখার চেষ্টা করছে, তবে অন্যদিকে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ভালোবাসা দিবস হল একটি সার্বজনীন উপলক্ষ, যা সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের গুরুত্বকে উদযাপন করার একটি উপায়।
ভ্যালেন্টাইন’স ডে শুধুমাত্র রোমান্টিক ভালোবাসার উদযাপন নয়, এটি জীবনের সম্পর্কের গভীরতা এবং আন্তরিকতার একটি শক্তিশালী প্রতিচ্ছবি। সত্যিকারের ভালোবাসা কোনো একদিনের নয়, এটি এক চিরকালীন অনুভূতি, যা প্রতিদিন নতুনভাবে উদ্ভাসিত হতে পারে।
ভালোবাসা আনন্দ এবং বিরহের এক অদ্ভুত মিশ্রণ, যেখানে দুটো অনুভূতির সুরে গড়তে থাকে গভীর সম্পর্ক।এ কারণে হাজারো বিতর্ক ও সমালোচনাকে পিছনে ফেলে, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে আজও নানা উৎসাহের সঙ্গে উদযাপিত হচ্ছে এই দিনটি।
রেফারেন্স
- https://www.dhakatimes24.com/2024/02/14/343389
- https://bangla.dhakatribune.com/feature/53476/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%AC-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87
- https://bangla.thedailystar.net/life-living/news-450056
- https://www.banglatribune.com/lifestyle/180791/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A4%E0%A7%88%E0%A6%B0%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%87
- https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE_%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%B8
- https://www.newsbangla24.com/lifestyle/240214/How-did-the-World-Valentines-Day-come-about?
- https://www.bbc.com/bengali/news-51499093
- https://www.realsimple.com/holidays-entertaining/holidays/valentines-day/history-of-valentines-day