“ধর্মের কাছে যেমন কুসংস্কার, জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাছে তেমন জ্যোতিষশাস্ত্র— এক বিদুষী মায়ের পাগলি মেয়ে। এই দুই মেয়ে বড় দীর্ঘকাল পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে।” – ভল্টেজয়ার
ছোটবেলায় পত্রিকা খুললেই খুব আগ্রহ করে একটা ছকের উপর চোখ পড়তো। আজকের দিন কেমন যেতে পারে? আজকে কোন রঙের জামা শুভ বা অশুভ হবে। এমন অনেকরকম চিন্তা নিয়ে আমরা ছকটি দেখতাম বা এখনো দেখি। এই ছকটি হলো রাশিচক্রের।
ট্রেন্ডের বশেই হোক বা বিশ্বাসের কারণে, নিজের রাশি কী তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। বর্তমানে ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক এর মত সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্যারোট রিডিং এবং ম্যাট্রিক্স চার্ট জনপ্রিয় হচ্ছে, যা অনেকটাই রাশির চক্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
রাশিচক্রের ইতিহাস ও উৎপত্তি
রাশিচক্র (Zodiac) হলো একটি প্রাচীন জ্যোতিষশাস্ত্রীয় ধারণা, যা সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহগুলোর গতিবিধি এবং পৃথিবীর আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর উৎপত্তি এবং বিকাশের ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং বহু সংস্কৃতির সাথে জড়িত।
মেসোপটেমিয়া (প্রাচীন ব্যাবিলন)
রাশিচক্রের প্রথম ধারণার উদ্ভব হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়ায়। প্রাচীন ব্যাবিলনীয়রা আকাশকে ১২টি সমান ভাগে ভাগ করে এবং প্রতিটি ভাগের নক্ষত্রপুঞ্জের একটি নাম দেয়। এগুলোকে রাশি বলা হয়।
বিভিন্ন রাশিতে জ্যোতিষ্কগুলোর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের বিষয়ে পূর্বাভাস প্রদান করা বা কোন ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে, কিছু বিশেষ ব্যক্তিরাই এই ব্যাখ্যাগুলি করতে পারতেন। তাদের দায়িত্ব ছিল সমাজকে, বিশেষ করে রাজা এবং রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করবে এমন বিষয়ে বিবরণ দেওয়া।
এনুমা আনু এনলিল (Enuma Anu Enlil) এর মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে। এনুমা আনু এনলিল হলো খোদায় করে পাওয়া কিছু পোড়ামাটির ফলক, যেখানে ধারাবাহিকভাবে ৭০টি কিইউনিফর্ম (প্রাচীন ব্যাবিলনীয় চিত্রলিপি) পাওয়া গিয়েছে। এই ফলকগুলোতে প্রায় ৭০০০টি মহাজাগতিক শুভ বা অশুভ পূর্বলক্ষণের বিবরণ রয়েছে।
এই পদ্ধতিতে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জকে পর্যবেক্ষণ করে কৃষি, ঋতু, এবং ধর্মীয় আচারের সময়ও নির্ধারণ করা হতো।
প্রাচীন মিশর
প্রাচীন মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম থেকে ৪র্থ শতাব্দীতে ব্যাবিলনীয় রাশিচক্রের ধারণা আসে। মিশরীয়রা সূর্য এবং তার প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু করে এবং এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জ্যোতিষশাস্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রাচীন মিশরীয়রা আগেও নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করত, তবে ব্যাবিলনীয় রাশিচক্র তাদের এই ধারণাগুলোতে একটি নতুন কাঠামো প্রদান করেছিল।
গ্রিক সভ্যতা
খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে গ্রিক জ্যোতিষবিদেরা ব্যাবিলন এবং মিশরের ধারণাগুলোকে মিশিয়ে “জ্যোতিষশাস্ত্রের” আধুনিক রূপ দেন। গ্রিক জ্যোতিষবিদ ক্লডিয়াস টলেমি তাঁর বই Tetrabiblos-এ রাশিচক্রের পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। গ্রিকরা রাশিগুলোর নাম দেয় প্রাণী ও পৌরাণিক চরিত্রের নামে, যেমন- মেষ (Aries), কুম্ভ (Aquarius)।
ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের দিকে ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রভাব পড়ে। ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে রাশিচক্রের ধারণা সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থান এবং নক্ষত্রপুঞ্জের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। এ শাস্ত্রে “রাশি” (zodiac sign) এবং “নক্ষত্র” (constellation)-এর মাধ্যমে ব্যক্তির ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়।
এটি জ্ঞান মূলত বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০) বেদ ও বিশেষত বেদের সহায়ক গ্রন্থগুলি থেকে উদ্ভুত হয়েছে। এসব বই এর মধ্যে বেদাঙ্গ, এর মূল ভিত্তি।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত অভিযানের পরে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬), গ্রীক জ্যোতিষবিদ্যার ধারণাগুলি (যেমন ১২ রাশিচক্র) ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।
রাশিচক্রের গঠন
জোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী রাশিচক্র হলো আকাশের একটি কাল্পনিক বেল্ট, যা সূর্যের বার্ষিক গতিপথ অনুযায়ী ১২টি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রপুঞ্জ এবং রাশি থাকে। এই অনুযায়ী রাশিচক্রের নামকরণ করা হয়েছে।
এই ১২টি রাশি হলো:
১.মেষ (Aries)
২. বৃষ (Taurus)
৩. মিথুন (Gemini)
৪. কর্কট (Cancer)
৫. সিংহ (Leo)
৬. কন্যা (Virgo)
৭. তুলা (Libra)
৮. বৃশ্চিক (Scorpio)
৯. ধনু (Sagittarius)
১০. মকর (Capricorn)
১১. কুম্ভ (Aquarius)
১২. মীন (Pisces)
আধুনিক রাশিচক্র
বর্তমানে পত্রপত্রিকা, ওয়েবসাইট এবং অ্যাপে রাশিচক্রের মাধ্যমে মানুষের ভবিষ্যৎ, ব্যক্তিত্ব, এবং জীবনের বিভিন্ন দিক বিশেষ করে জীবনসঙ্গী বিশ্লেষণ বেশ জনপ্রিয়। আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্রের মূল লক্ষ্য হলো ব্যক্তির মানসিকতা, আবেগ এবং আত্ম-উন্নয়ন বোঝা।
২০শ শতকের জ্যোতিষীরা যেমন- কার্ল জং-এর মতো মনস্তত্ত্ববিদরা, জ্যোতিষশাস্ত্রকে মানব মনের গভীর স্তরের বিশ্লেষণে ব্যবহার করা শুরু করেন।
জ্যোতিষশাস্ত্রে গ্রীকদের অবদান থাকা সত্ত্বেও প্রাচীন গ্রিসে রাশিফলের তেমন প্রচলন ছিল না। বরং, এলমারের মতে, তাদের মনোযোগ নক্ষত্ররাজীর মধ্য দিয়ে দেবতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মধ্যে নিবদ্ধ ছিল। কালের পরিক্রমায় ব্যাবিলনীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র, যা মহাজাগতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করত, তা গ্রীক ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে মিলিত হয়ে ক্রমে ক্রমে আজকের রাশিফল এর সৃষ্টি হয়।
রাশিচক্র এবং ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক
জ্যোতিষশাস্ত্রের মতে রাশিচক্র (Zodiac) দিয়ে মানুষের জন্মের সময় আকাশে সূর্য, চন্দ্র, এবং গ্রহগুলোর অবস্থানের ভিত্তিতে ব্যক্তিত্ব এবং আচরণগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা যায়। এটিতে মূলত মানুষের জন্মতারিখ এবং রাশি (Zodiac Sign) ব্যবহার করে করা হয়।
এখানে প্রতিটি রাশি বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে। রাশিচক্রে ১২টি রাশি রয়েছে এবং প্রতিটির সাথে নির্দিষ্ট চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য ও শক্তি বিদ্যমান।
প্রধান ভাগ
রাশিগুলোকে চারটি মৌলিক উপাদানের (Fire, Earth, Air, Water) ভিত্তিতে ভাগ করা হয় এবং জ্যোতিষশাস্ত্র এ চারটি প্রধান ভাগের কিছু স্বতন্ত্র গুণাবলী নির্ধারণ করেছে।
গুণাবলি (Modalities)
রাশিগুলোকে যে তিনটি গুণে ভাগ করা হয়,
কার্ডিনাল (Cardinal): নেতৃত্বগুণসম্পন্ন (মেষ, কর্কট, তুলা, মকর)
ফিক্সড (Fixed): স্থির ও দৃঢ় (বৃষ, সিংহ, বৃশ্চিক, কুম্ভ)
মিউটেবল (Mutable): অভিযোজনশীল (মিথুন, কন্যা, ধনু, মীন)
তাহলে রাশিচক্র কীভাবে ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে?
সূর্যের রাশি (Sun Sign),
সাধারণত মানুষের জন্ম মাসের উপর ভিত্তি করে সূর্যের রাশি নির্ধারণ করা হয়, যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, উদ্দেশ্য এবং আত্মপরিচয় নির্দেশ করে। উদাহরণ,
সিংহ (Leo): আত্মবিশ্বাসী ও নেতৃত্বগুণসম্পন্ন।
মীন (Pisces): সংবেদনশীল ও সৃজনশীল।
আবার, চাঁদের অবস্থান মানুষের আবেগ, মনোভাব, এবং অভ্যন্তরীণ প্রকৃতি প্রকাশ করে। এটি ব্যক্তির আবেগপ্রবণ দিক এবং কীভাবে তারা মানসিক স্থিতি বজায় রাখে তা নির্দেশ করে।উদাহরণ:
তুলা (Libra): শান্তিপ্রিয় এবং ভারসাম্যপূর্ণ।
কর্কট (Cancer): যত্নশীল এবং আবেগময়।
এমন, উদিত রাশি (Rising Sign বা Ascendant) মানুষের বাইরের আচরণ বা সামাজিক পরিচয় নির্দেশ করে। একজন কীভাবে অন্যদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেন, তা উদিত রাশির দ্বারা বোঝা যায়। উদাহরণ,
ধনু (Sagittarius): বন্ধুত্বপূর্ণ এবং স্বাধীনচেতা।
মকর (Capricorn): গম্ভীর এবং সংগঠিত।
কিন্তু এর কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই।
এজন্যেই ভল্টেয়ার বলেছেন, “ধর্মের কাছে যেমন কুসংস্কার, জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাছে তেমন জ্যোতিষশাস্ত্র –– এক বিদুষী মায়ের পাগলি মেয়ে। এই দুই মেয়ে বড় দীর্ঘকাল পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে।”
প্রতিটি রাশির প্রভাব ও বৈশিষ্ট্য
প্রতিটি রাশি মানুষের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং শক্তির নির্দিষ্ট দিককে চিহ্নিত করে:
প্রধান ভাগ |
রাশি | বৈশিষ্ট্য |
অগ্নি রাশি (Fire Signs) | মেষ, সিংহ, ধনু | উদ্যমী, আত্মবিশ্বাসী, এবং উদ্ভাবনী |
পৃথিবী রাশি (Earth Signs) | বৃষ, কন্যা, মকর | বাস্তববাদী, ধৈর্যশীল, এবং নির্ভরযোগ্য। |
বায়ু রাশি (Air Signs) | মিথুন, তুলা, কুম্ভ | বিশ্লেষণধর্মী, যোগাযোগপ্রবণ, এবং চিন্তাশীল |
জল রাশি (Water Signs) | কর্কট, বৃশ্চিক, মীন | আবেগময়, কল্পনাপ্রবণ, এবং অন্তর্মুখী |
রাশিচক্র অনুযায়ী প্রেম জীবন
অনেকেই রাশিচক্রের মাধ্যমে তাদের প্রেম জীবন কেমন হতে পারে তা জানতে মজা পান। আবার অনেকে নিজেদের ব্যক্তিত্বের ও জীবনের সাথে এর মিল খুঁজে পান।
রাশি | প্রেম জীবনে তাদের চরিত্র |
মেষ (Aries) | উৎসাহী, উদ্যমী এবং রোমাঞ্চপ্রিয়। প্রেমে সাহসী ও সরাসরি। তবে অতিরিক্ত জেদি হতে পারে। |
বৃষ (Taurus) | স্থিতিশীল ও বিশ্বস্ত। ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে, কিন্তু একবার জড়িয়ে গেলে ভীষণ নিবেদিত। |
মিথুন (Gemini) | বুদ্ধিদীপ্ত এবং প্রফুল্ল। সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন পছন্দ করে। |
কর্কট (Cancer) | সংবেদনশীল, যত্নশীল এবং গভীর প্রেমিক। নিরাপত্তা ও আবেগের সংযোগে বিশ্বাসী। |
সিংহ (Leo) | আত্মবিশ্বাসী, রোমান্টিক এবং উদার। প্রেমে একটু ড্রামা এবং আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে ভালোবাসে। |
কন্যা (Virgo) | বিশ্লেষণী, বাস্তববাদী, এবং নিখুঁত প্রেমিক। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছোটখাটো বিষয়গুলিতেও মনোযোগী। |
তুলা (Libra) | সামঞ্জস্য ও রোমান্সপ্রিয়। সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। চেহারা ও আচার-ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়। |
বৃশ্চিক (Scorpio) | গভীর, আবেগপ্রবণ এবং রহস্যময়। একবার বিশ্বাস করলে পুরোপুরি সমর্পণ করে। |
ধনু (Sagittarius) | উদার এবং স্বাধীনচেতা। প্রেমে রোমাঞ্চ এবং স্বাধীনতা চায়। দম বন্ধ হওয়া সম্পর্ক এড়ায়। |
মকর (Capricorn) | গম্ভীর, বাস্তববাদী এবং দায়িত্বশীল। সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব এবং ভবিষ্যতের কথা ভাবে। |
কুম্ভ (Aquarius) | স্বাধীনচেতা ও উদ্ভাবনী। প্রেমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং মানসিক সংযোগকে গুরুত্ব দেয়। |
মীন (Pisces) | রোমান্টিক, স্বপ্নপ্রবণ এবং সংবেদনশীল। আবেগে গভীর এবং সঙ্গীকে পুরোপুরি নিবেদন করে। |
আগে বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে “কুন্ডলি” বা জন্মছক ব্যবহার করে বিবাহ ও প্রেমজীবনের জন্য রাশির মিল দেখা হতো। এখনও এটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রচলিত। ১৯ শতকে পশ্চিমে রাশিচক্রের ব্যবহার প্রেম ও রোমান্সের ভবিষ্যদ্বাণীতে জনপ্রিয় হয়। পত্র-পত্রিকায় “লাভ কম্প্যাটিবিলিটি” বা প্রেমে রাশির মিলন নিয়ে ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু হয়। এখন এর বিস্তার সোশাল মিডিয়াতেও খুবই স্পষ্ট।
ক্যারিয়ারে রাশিচক্রের ইতিহাস
প্রাচীন কাল থেকে রাশিচক্রের মাধ্যমে একজন মানুষের শক্তি, দুর্বলতা, দক্ষতা, এবং সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা করা হয়ে আসছে।
গ্রিক জ্যোতিষী ক্লডিয়াস টলেমি তাঁর বই Tetrabiblos এ রাশিচক্রের কার্যকারিতা এবং এর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছে। এই সময় থেকেই রাশিচক্র জীবনের বিভিন্ন দিক—ব্যক্তিত্ব, সম্পর্ক, এবং ক্যারিয়ার—এ ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে রাশিচক্রকে গাণিতিকভাবে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত এবং এটি কর্ম, জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। বেদের যুগ থেকে শুরু করে, বৈদিক জ্যোতিষীরা “কুন্ডলি” বা জন্মছক দেখে একজন ব্যক্তির ক্যারিয়ার এবং ভবিষ্যত কর্মজীবন সম্পর্কে পরামর্শ দিতেন।
রাশিচক্র এবং আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র
রাশিচক্র এবং আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র উভয়ই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, সম্পর্ক, এবং ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে ব্যবহৃত হয়, তবে তাদের পদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
রাশিচক্রের ধারণা প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও মিশরীয় সভ্যতায় উদ্ভূত হওয়া ১২টি তারামণ্ডল বা রাশির সমন্বয়ে গঠিত, যা সূর্যের বার্ষিক গতিপথের সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ, রাশিচক্রের ভিত্তি মূলত সূর্যের অবস্থান এবং তার প্রভাবের উপর। এতে ব্যক্তির জন্ম তারিখের উপর ভিত্তি করে রাশি নির্ধারণ করা হয়।
এদিকে আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিত্তি প্রাচীন ভারতীয় এবং গ্রিক জ্যোতিষশাস্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। এতে গ্রহ, নক্ষত্র এবং তাদের অবস্থানের উপর জোর দেওয়া হয়।
আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র ব্যক্তির জন্মের সময়ের সূর্য, চাঁদ, এবং গ্রহগুলোর অবস্থান বিশ্লেষণ করে। এর উপর জন্মকুণ্ডলি বা হরোস্কোপ তৈরি করা হয়, যা ব্যক্তির জীবন, সম্পর্ক, এবং ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেয়। এরই একটি উদাহরণ ম্যাট্রিক্সভচার্ট।
রাশিচক্র সাধারণত দৈনন্দিন পূর্বাভাস এবং সম্পর্কের সামঞ্জস্যতা নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়, যেখানে আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্র ব্যক্তির জীবন, ক্যারিয়ার, এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রদান করে।
রাশিচক্রের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী
গ্রিকরা বিশ্বাস করতেন যে আকাশের শক্তি মানুষের জীবন এবং সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলে। তারা নক্ষত্রপুঞ্জকে ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করেন।
কারণ, তখন কত দিনে এক বছর হয়, বা কোন সময় কি ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয় তা আকাশে তারার অবস্থান দেখে বুঝত। এতে তাদের মধ্যে এই ঘটনাগুলোতে যে আকাশে কোন শক্তির প্রভাব থাকতে পারে এই ধারণা তৈরি হয়।
ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্র (প্রায় ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাশিচক্রের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করার একটি উন্নত পদ্ধতি তৈরি করেছিল। এখানে জন্মকুণ্ডলি বা “কুণ্ডলি” ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির জীবনের সকল দিক বিশ্লেষণ করা হত। এই পদ্ধতি এখনও ভারতীয় সমাজে জনপ্রিয়, যেখানে জন্মকুণ্ডলির ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। কিন্তু এটি এখনো ছদ্ম বিজ্ঞানে সীমাবদ্ধ।
মধ্যযুগে, ইসলামি সভ্যতা রাশিচক্রের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করার পদ্ধতিটি গ্রহণ করে এবং কিছু মুসলিম জ্যোতিষী যেমন আল-বাতানী ও আল-ফারাবি প্রাচীন গ্রন্থগুলি পুনরুদ্ধার করেন এবং তাদের গবেষণা করেন। এই সময়ে রাশিচক্র এবং গণিতের সংমিশ্রণে আরো উন্নতি ঘটে।
১৮-২০ শতকে পশ্চিমা জ্যোতিষশাস্ত্র এবং নিউ এজ ধারায় রাশিচক্র ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতে রাশিচক্রের গুরুত্ব বাড়ে এবং পত্রিকায় রাশিচক্রের ভিত্তিতে দৈনিক ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ শুরু হয়।
রাশিচক্রে নিয়ে কিছু মজার বিষয়
১.বারো রাশি এবং তাদের প্রতীক:
প্রতিটি রাশি একটি প্রাণী বা চিহ্নের প্রতিনিধিত্ব করে, যা সেই রাশির মূল বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে।
উদাহরণ: সিংহ রাশি (Lion) সাহস ও নেতৃত্বের প্রতীক।
২. আগে ১৩টি রাশি ছিল:
প্রাচীন কালে রাশিচক্রে ওফিউকাস নামে একটি ১৩তম রাশি ছিল, তবে আধুনিক জ্যোতিষে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে।
৩. চন্দ্র রাশির প্রভাব:
ভারতীয় জ্যোতিষে (বৈদিক) চন্দ্র রাশিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা তাদের মতে মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৪.জ্যোতিষে যুগের ধারণা:
প্রতিটি রাশি প্রায় ২,১৬০ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে একটি যুগকে প্রতিনিধিত্ব করে। সে অনুযায়ী বর্তমানে আমরা কুম্ভ যুগে আছি।
জ্যোতিষশাস্ত্র ছদ্মবিজ্ঞান বা কোন অন্তর্নিহিত মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু এটি এক বিস্ময়কর ধারণা যা মানুষ ধারণ করেছে নিজেদের মধ্যে। এখান থেকে মানুষদের আকাশে জ্যোতিষ্ক কেমনে তাদেরকে ভাবিয়েছে, কেমনে মানুষ আকাশের সাথে নিজের জীবনকে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্নভাবে কানেক্ট করতে চেয়েছে তার এক ঝলক দেখা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
- The 12 Zodiac Signs and Their Influence on Our Lives
- The Influence of Zodiac Signs on Daily Life – The Times of India
- What are the ancient origins of your zodiac sign?
- Astrology in Ancient Rome: A Brief Overview
- https://timesofindia.indiatimes.com/astrology/others/role-of-astrology-in-ancient-religious-practices/articleshow/108844307.cms
- https://www.folklore.ee/folklore/vol15/ancient.htm