বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে মাদক বেচাকেনা, নিষিদ্ধ ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি এবং বিক্রি, দেহব্যবসা, হানিট্র্যাপ, পিগ বুচারিং (অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা) এবং জুয়া পরিচালনার জন্য টেলিগ্রাম অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ অ্যাপ ‘টেলিগ্রাম’ এক নতুন ধরনের ঝুঁকি হয়ে উঠেছে। এটি অপরাধীদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। টেলিগ্রামে প্রতারিত হয়ে অনেকে রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এমনকি অনেকেই নিষিদ্ধ নেশার প্রলোভনে পড়ে ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়ে দিনের পর দিন অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানাতে দ্বিধাবোধ করছেন। কারণ তারা জানেন না কীভাবে বা কোথায় সাহায্য পাবেন।
প্রতারকরা টেলিগ্রাম কেন ব্যবহার করে
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে সাইবার অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভরতা যত বাড়ছে, সাধারণ ব্যবহারকারীরা ততই সাইবার অপরাধীদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। বিভিন্ন কৌশলে ব্যবহারকারীদের প্রতারিত করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি সাইবার ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে টেলিগ্রামে।
সাইবার সুরক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কির ফুটপ্রিন্ট ইন্টেলিজেন্স বিভাগের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ সাইবার অপরাধী এখন তাদের অপকর্মের জন্য টেলিগ্রামকেই বেছে নিচ্ছেন। হ্যাকিং, স্প্যামিং এবং অন্যান্য অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা টেলিগ্রামে বিশেষ গ্রুপ তৈরি করছে। এসব গ্রুপে ফ্রড স্কিম, লিক হওয়া ডাটাবেস এবং অন্যান্য অবৈধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা টেলিগ্রাম প্ল্যাটফর্মে সাইবার অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনে কয়েকটি মুখ্য কারণ চিহ্নিত করেছেন।
টেলিগ্রাম বর্তমানে ৯০ কোটিরও বেশি মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর একটি বিশাল ব্যবহারকারী গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে। ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং প্ল্যাটফর্মটি নিজেকে নিরাপদ ও গোপনীয়তা সংরক্ষণকারী মাধ্যম হিসেবে প্রচার করলেও বাস্তবে এর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত।
এছাড়াও প্ল্যাটফর্মে চ্যানেল তৈরি প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ হওয়ায় সাইবার অপরাধীরা এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। তারা সহজেই বিভিন্ন চ্যানেল তৈরি করে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে, ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণামূলক লিংক ছড়াচ্ছে। যেগুলোতে প্রবেশ করলেই বিভিন্ন ধরনের তথ্যচুরি এবং অর্থ আত্মসাৎ এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের সাথে জালিয়াতি করছে।
টেলিগ্রামের সাহায্যে খুবই কম সময় বৃহত্তর গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব। আরো ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে টেলিগ্রামে প্রতারক রিয়েল টাইম নাম্বার ব্যবহার করেও নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে কাজ করতে পারে।
টেলিগ্রাম ফ্রড
টেলিগ্রামে প্রতারকরা মূলত দুটি কৌশলে শিকারে ফাঁদ পেতে থাকে। সেই ফাঁদে পা দিয়েই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন গ্রাহকেরা।
প্রথম কৌশলে, সহজ আয়ের লোভ দেখিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলা হয়। গ্রাহকদের বলা হয় যে, বাড়ি বসে ছোটখাটো কাজ করেই প্রচুর টাকা আয় করা সম্ভব। এই প্রলোভনে পা দিলে তাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। সেখানে ইউটিউব ভিডিওতে লাইক বা কমেন্ট করার মতো সাধারণ কাজের মাধ্যমে কিছু ব্যবহারকারী আয়ও করতে থাকেন।
অনেক গ্রাহকই সহজে ঘরে বসে আয়ের প্রলোভনে বিশ্বাস করে ফেলছেন। পরবর্তীতে, তাদের এমন কিছু কাজ করতে দেওয়া হয় যেখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হয়। শুরুতে কিছু ‘রিটার্ন’ও দেওয়া হয়—অর্থাৎ বিনিয়োগকৃত টাকার একটি অংশ ফেরত আসে। এই লোভে পড়ে অনেকে বড় অঙ্কের টাকা ঢালতে শুরু করেন। প্রথমদিকে কিছু লাভ দেখালেও, একসময় টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। বরং, বকেয়া টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে আরও বেশি পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত কোন টাকাই আর ফেরত পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমেই ছোট ছোট বিনিয়োগে বড় লাভের লোভ দেখানো হচ্ছে গ্রাহকদের। বেশ কিছু ভুয়ো অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে বলা হচ্ছে। অ্যাপগুলি এই প্রতারণার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও, প্রথম দিকে টাকা ফেরত পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। কিন্তু পরে আর কোনও টাকা মিলছে না।
বেশ কিছু ভুয়ো অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে বলা হচ্ছে। অ্যাপগুলি এই প্রতারণার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও, প্রথম দিকে টাকা ফেরত পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। কিন্তু পরে আর কোনও টাকা মিলছে না। প্রতারকরা এভাবে টেলিগ্রামের বদৌলতে চোখের পলকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
টেলিগ্রামে ক্রিপ্টো স্ক্যাম কিভাবে হয়
টেলিগ্রামে ক্রিপ্টো স্ক্যামের পদ্ধতি দিন দিন আরও পরিশীলিত হয়ে উঠছে। স্ক্যামাররা এখন আগের মতো শুধু ফিশিং লিংকের মাধ্যমে ওয়ালেট কানেক্ট করানোর চেষ্টা করে না, বরং তারা ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে ব্যবহারকারীদের সিস্টেমে সরাসরি প্রবেশ করে ক্রিপ্টো চুরি করছে।
১. ফেক গ্রুপ ও ভেরিফিকেশন বটের মাধ্যমে ম্যালওয়্যার ছড়ানো
স্ক্যামাররা টেলিগ্রামে নকল ট্রেডিং গ্রুপ, এয়ারড্রপ গ্রুপ বা আলফা গ্রুপ তৈরি করে। সেখানে ব্যবহারকারীদের “ভেরিফিকেশন” নামে একটি বটের মাধ্যমে ম্যালওয়্যার ইনস্টল করতে বলা হয়। এই ম্যালওয়্যার ব্যবহারকারীর:
- পাসওয়ার্ড চুরি করে,
- ওয়ালেট ফাইল স্ক্যান করে,
- ক্লিপবোর্ড মনিটর করে (ক্রিপ্টো অ্যাড্রেস পরিবর্তন করে),
- ব্রাউজার ডেটা চুরি করে।
২. নকল ক্লাউডফ্লেয়ার ভেরিফিকেশন পেজ
কিছু ক্ষেত্রে স্ক্যামাররা নকল ক্লাউডফ্লেয়ার ভেরিফিকেশন পেজ তৈরি করে ব্যবহারকারীদের নির্দিষ্ট টেক্সট কপি-পেস্ট করতে বলে। এই টেক্সটের মধ্যে লুকানো কোড থাকে যা সিস্টেমে ম্যালওয়্যার ইনজেক্ট করে।
৩. নকল ইনফ্লুয়েন্সার অ্যাকাউন্ট থেকে টেলিগ্রাম গ্রুপে আমন্ত্রণ
স্ক্যামাররা এক্স (টুইটার) বা টেলিগ্রামে বিখ্যাত ক্রিপ্টো ইনফ্লুয়েন্সারদের নকল অ্যাকাউন্ট তৈরি করে। তারপর ব্যবহারকারীদের টেলিগ্রাম গ্রুপে জয়েন করতে বলে, যেখানে “এক্সক্লুসিভ ইনভেস্টমেন্ট টিপস” বা “ফ্রি এয়ারড্রপ” এর লোভ দেখানো হয়। গ্রুপে ঢুকলেই তাদের ম্যালওয়্যারযুক্ত বটে ভেরিফাই করতে বাধ্য করা হয়।
৪. লেজিটিমেট প্রজেক্ট কমিউনিটিকে টার্গেট করা
ব্যবহারকারীরা এখন ফিশিং লিংক সম্পর্কে সচেতন হওয়ায়, স্ক্যামাররা বড় প্রজেক্টের কমিউনিটিগুলোকে টার্গেট করছে। তারা সাধারণ আমন্ত্রণ মেসেজ দিয়ে ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করে ম্যালওয়্যার ছড়াচ্ছে।
প্রতারকদের জন্য কেন টেলিগ্রাম নিরাপদ?
টেলিগ্রাম বর্তমানে অপরাধীদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে, কারণ এটি তাদের কার্যক্রম গোপন রাখতে সহায়ক। বিশেষ করে, টেলিগ্রাম গ্রুপ এবং চ্যানেল তৈরি করা অত্যন্ত সহজ, এবং প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীদের আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করা বা তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। এটি সাইবার অপরাধীদের জন্য একটি আদর্শ জায়গা, কারণ ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (VPN) ব্যবহারের মাধ্যমে তারা সহজেই নিজেদের গোপন রাখতে সক্ষম হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে হ্যাকাররা টেলিগ্রাম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন স্ক্যাম চালাচ্ছে। তারা ব্যবহারকারীদের কাছে বিভিন্ন প্রলোভনমূলক অফার ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেমন “এক বছরের মধ্যে টাকা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেওয়ার” প্রতিশ্রুতি। যেসব ব্যবহারকারী লোভে পড়ে এই অফারে টাকা জমা দেন, তারা দ্রুত নিজেদের হারিয়ে ফেলেন, কারণ হ্যাকাররা সেই টাকাগুলি তুলে নেয়।
এর সাথে, অপরাধীরা সাধারণত টেলিগ্রাম গ্রুপ বা চ্যানেল তৈরি করে, যেখানে তারা দ্রুত বিভিন্ন ধরনের স্ক্যাম চালিয়ে টাকা আদায় করে। পুলিশের জন্য এসব অপরাধী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ অধিকাংশ সময় অপরাধীরা তাদের গ্রুপ বা লেনদেনগুলো ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালনা করে।
টেলিগ্রাম স্ক্যাম প্রতিরোধের উপায়
জেনে নেওয়া যাক কীভাবে টেলিগ্রামে প্রতারনার হাত থেকে গ্রাহকেরা রক্ষা পেতে পারেন-
১. অল্প সময়ে টাকা দ্বিগুণ করার লোভনীয় অফার এড়িয়ে চলুন। এমন প্রলোভনমূলক বার্তা বা গ্রুপে কখনো সাড়া দেবেন না, নতুবা আপনি প্রতারিত হবেন। তাই এ ধরনের মেসেজ বা গ্রুপ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
২. অনাকাঙ্ক্ষিত লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন। বর্তমানে অনলাইন স্ক্যামের ঘটনা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই অপরিচিত বা সন্দেহজনক কোনো লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করুন।
৩. কোনো লিঙ্কে ক্লিক করবেন না। অনলাইনে প্রতারণার অনেক ঘটনা বাড়ছে। তাই কোনো অজানা লিঙ্কে ভুলেও ক্লিক করবেন না।
৪. অনিরাপদ ওয়েবসাইট এড়িয়ে চলুন। কোনো সাইট ভিজিট বা ডাউনলোড করার আগে তার ডোমেইন নাম সতর্কতার সাথে যাচাই করে নিন। এটি বিশ্বস্ত কি না তা নিশ্চিত হোন।
৫. টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ বা যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কখনই আপনাকে সরাসরি বিনিয়োগের প্রস্তাব দেবে না। কোনো বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানও এভাবে ব্যক্তিগত মেসেজের মাধ্যমে বিনিয়োগের আহ্বান জানায় না। তাই এমন প্রলোভনমূলক বার্তা পেলে অবশ্যই উপেক্ষা করুন এবং সর্বদা সতর্ক থাকুন।
৬.কোনো অপরিচিত ব্যক্তি আপনাকে হঠাৎ করে হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করলে অবিলম্বে সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন।
যদিও বেশিরভাগ মানুষ গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার কারণে টেলিগ্রাম ব্যবহার করেন, তবুও এটি স্ক্যামারদের জন্য একাধিক পদ্ধতিতে প্রতারণা চালানোর সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, যদি আপনি সচেতন থাকেন এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তাহলে তাদের কৌশলগুলোর ফাঁদে পড়া থেকে সহজেই রক্ষা পেতে পারেন।
এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনি টেলিগ্রাম বা অন্য যেকোনো প্ল্যাটফর্মে সন্দেহজনক কোনো লিঙ্কে ক্লিক করার আগে একটু চিন্তা করবেন এবং কখনো আপনার সংবেদনশীল তথ্য অন্য কারো সাথে শেয়ার করবেন না। প্রতারণাকারী হিসাবে কাউকে সন্দেহ হলেতাদের নম্বর ব্লক করে দিন এবং সেই গ্রুপ থেকে বের হয়ে আসুন। এভাবে আপনি আপনার নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারবেন এবং স্ক্যামের শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারবেন।
সতর্ক থাকুন। টেলিগ্রাম ব্যবহারের সময় সচেতনতা নিশ্চিত করুন।