“জন এফ কেনেডির মৃত্যুতে কবরের নীরবতা যতটা গভীর, ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো তার চেয়েও জোরালোভাবে বেঁচে আছে।”
— রবার্ট গ্রোডেন (Robert Groden), The Killing of a President
কোনো কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে স্বভাবতই মনে এক ধরনের রহস্যময়তা বা অদৃশ্য আতঙ্ক জেগে ওঠে, যেন প্রতিটি কবরের নীরবতা নিজের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে হাজারো অজানা গল্প, হাজারো রহস্য। বিশ্বে আসলেই এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কবর রয়েছে যাদের কবরকে ঘিরে রয়েছে রহস্য ঘেরা নানান ষড়যন্ত্রের গল্প। এমনই একটি কবর হলো জন এফ কেনেডির কবর।
“কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পর, পৃথিবী থেমে গিয়েছিল।” এই বিখ্যাত লাইনটি আমরা অনেকেই শুনেছি, কিংবা পড়েছি বহুবার। এই লাইনের মতোই সত্য কেনেডি মৃত্যু, আর তাই তো আজও তাঁর কবর জুড়ে রহস্যের শেষ নেই।
১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর, ডালাসের একটি কনভেনশন রোডে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা, যেখানে জন এফ কেনেডি, আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট, সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। তার মৃত্যু শুধু একটা রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না, বরং তা বহুমাত্রিক তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্ম দেয়, আর বিশ্বব্যাপী আজ অবধি এক ষড়যন্ত্রের রহস্য মোড়া অমীমাংসিত ধাঁধাঁ হয়ে রয়েছে। রবার্ট গ্রোডেন (JFK assasination researcher) তাঁর The Killing of a President বইয়ে জন এফ কেনেডির কবরকে ঘিরে থাকা এসব ষড়যন্ত্রেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
জন এফ কেনেডি: ইতিহাসের এক আইকন
জন ফিটজেরাল্ড কেনেডি aka JFK, ছিলেন একজন প্রগতিশীল নেতা, যার প্রশাসনের মাধ্যমে আমেরিকান জনগণের বিশাল সম্ভাবনা এবং নতুন প্রজন্মের আশা-আকাংখা প্রতিফলিত হয়েছিলো। তিনি ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার নেতৃত্বে আমেরিকা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একাধিক বড় পরিবর্তন দেখতে পায়। ১৯৬০-এর দশকে, কেনেডির নেতৃত্বে আমেরিকা আধুনিকতার দিকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। তিনি “নিউ ফ্রন্টিয়ার” নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, এবং আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিলেন।
কিন্তু, এই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে সেই মর্মান্তিক দিনে, যখন তাকে হত্যা করা হয়। সেই দিনটি ছিল তাঁর এবং তাঁর জনগণের জন্য এক ভয়ংকর এবং হতাশাজনক দিন।
হত্যাকাণ্ডের দিন: বিশাল শোক ও এক ঘোরলাগা মুহূর্ত
তাঁর শেষ মুহূর্ত ছিল কিছুটা এমন, ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর, প্রেসিডেন্ট কেনেডি টেক্সাসের ডালাসে এক রাষ্ট্রীয় সফরে যাচ্ছিলেন। এসময় তিনি একটি খোলা ছাদযুক্ত লিমুজিন গাড়িতে সেখানকার এক মোটর শোভাযাত্রায় বেরিয়েছিলেন। সাথে ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী জ্যাকলিন এবং তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন। কিন্তু সেদিন কিছুই সাধারণ ছিল না। এই ভ্রমনের সময়ই দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর শরীরে মর্মান্তিকভাবে একাধিক অংশে গুলি লেগেছিল এবং ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এই গুলিবিদ্ধ হওয়া নিয়েই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে যে আসলেই কি একজন দায়ী নাকি এ পিছনে রয়েছে আরও কোন গভীর ষড়যন্ত্র?
তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় এমন একটি ঘটনা গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেয় এবং এর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক যুগের সমাপ্তি ঘোষিত হয়।
কেনেডির কবর: Arlington Cemetery-তে চিরস্থায়ী বিশ্রাম
কেনেডির মৃত্যুর পর প্রথমে তার দাফন কোথায় হবে, তা নিয়ে পরিবারের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত স্ত্রী জ্যাকলিন কেনেডির ইচ্ছায় আর্লিংটনই হয় তার শেষ ঠিকানা। আর্লিংটন ছিল এক ঐতিহাসিক জায়গা, যা মার্কিন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ কবরস্থান। এটি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সমাধিক্ষেত্রই নয়, এখানে যুদ্ধাহত সৈনিক থেকে শুরু করে দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক—সবাইকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
জ্যাকলিন মনে করেন, প্রেসিডেন্ট কেনেডির মতো একজন রাষ্ট্রনায়কের কবর হওয়া উচিত এমন জায়গায়, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষ দেখতে আসবে এবং অনুপ্রাণিত হবে। তার কবরের পাশে বসানো হয়ে জ্বলন্ত একটি “Eternal Flame” বা চিরন্তন শিখা, যা তার স্মৃতিকে চিরকাল জীবন্ত রাখে।
কিন্তু এই কবর নিজেই একটা রহস্য। কারণ তার কবর ঘিরে ঘটে গিয়েছে কিছু অদ্ভুত ঘটনা।
জন এফ কেনেডির কবর নিয়ে কেন এত রহস্য?
কেনেডির মৃত্যুর পরপরই এক বিরাট রাষ্ট্রীয় আয়োজনের মাধ্যমে তার দাফন হয়। তবে রহস্যের সূত্রপাত ঘটে যখন তার কবরস্থান ঘিরে কিছু ‘অস্বাভাবিক’ ঘটনা ঘটে যায়। বিশেষভাবে, ১৯৭০-এর দশকে যখন কেনেডির কবরের জন্য নির্মিত একটি ভাস্কর্য রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়।
এদিকে, ‘ইটারনাল ফ্লেম’—অর্থাৎ কবরের সামনে জ্বলন্ত চিরন্তন শিখা কেন স্থাপন করা হলো, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে। এই ‘ইটারনাল ফ্লেম’ জ্বালানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন খোদ জ্যাকলিন কেনেডি। মজার বিষয় হলো, ১৯৬৩ সালের ২৫ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়, একজন দর্শনার্থী দূর্ঘটনাক্রমে শিখার কাছে পানি ঢেলে দিলে, এটি নিভে যায়। পরবর্তীতে এটি পুনরায় জ্বালানো হয়।
কেনেডির কবরের এই চিরন্তন শিখা নিয়ে অনেকেই মনে করেন যে তা কেবলমাত্র কোনো প্রতীক নয়, বরং কোনো গভীর বার্তা বহন করে। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, এটি ফ্রিম্যাসন বা ইলুমিনাতির প্রতীক ।
অন্যদিকে, কিছু গবেষকের মতে, তাঁর দাফনের স্থান ও পদ্ধতিতেও লুকানো আছে নানা চিহ্ন। অনেকে মনে করেন কবরের অবস্থান ইচ্ছাকৃতভাবে এমন স্থানে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখান থেকে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট এবং লিঙ্কন মেমোরিয়াল সরাসরি দেখা যায়।
এমনও অনেকের ধারনা আছে যে কেনেডির দাফন ও রাষ্ট্রীয় আয়োজন ছিল চোখ ধাঁধানো হলেও জ্যাকলিন কেনেডি আসলে প্রকৃত কবরের জায়গা নিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন। অনেকের বিশ্বাস অনুসারে,কেনেডির দেহ আসলে অন্যত্র সমাহিত করা হয়েছিল এবং কবরটি শুধুই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতীক।
কেননা কবরের অবস্থান এবং নকশা নিয়ে আজও অনেক তথ্য সর্বসাধারণের অজানা। এমনকি একাধিক FBI এবং CIA ডকুমেন্ট আজও পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি, যা এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আরও বেশি রহস্যময় করে তোলে। আবার আর্লিংটন কবরস্থানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই কড়া, যে অনেকেই ধারণা করেন, এখানে আরও গোপন কিছু রাখা হয়েছে। এমনকি দাফনের সময় নাকি কফিনের কিছু অংশ সিল করা ছিল। এই তথ্য বহু কন্সপিরেসি বিষয়ক বইয়ের মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।
কেনেডি হত্যা কি সত্যিই ছিল এক বিশাল ষড়যন্ত্র?
সরকারি অনুসন্ধান অনুযায়ী, জন এফ কেনেডিকে হত্যা করেন লি হার্ভে অসওয়াল্ড (Lee Harvey Oswald)। ঘটনার দিন ডালাসের ডিলি প্লাজা থেকে অসওয়াল্ড প্রেসিডেন্ট কেনেডির ওপেন-টপ লিমুজিন লক্ষ্য করে রাইফেল দিয়ে গুলি চালান। কেনেডি মাথা ও গলায় গুলিবিদ্ধ হলে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান।
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশ অসওয়াল্ডকে গ্রেপ্তার করে। তবে হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর, ২৪ নভেম্বর ১৯৬৩-তে ডালাস পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করে জ্যাক রুবি (Jack Ruby) নামে এক নাইটক্লাব মালিক। ওয়ারেন কমিশন (Warren Commission) — যেটি ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক গঠিত হয়। তাদের চূড়ান্ত রিপোর্টে জানানো হয়: “Lee Harvey Oswald acted alone in the assassination of President John F. Kennedy.” এখান থেকেই মূলত ষড়যন্ত্রের ধারনার সুত্রপাত হয়।
এই সরকারি রিপোর্টের বাইরে বহু মানুষ, গবেষক এবং সাংবাদিক মনে করেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। Dr. Cyril Wecht (Forensic Pathologist) বলেছিলেন,“Kennedy’s assassination was the work of a sophisticated, organized conspiracy.” (কেনেডির হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত একটি ষড়যন্ত্রের ফলাফল।) আবার Jim Marrs (Author, Crossfire: The Plot That Killed Kennedy) এর মতে “It is hard to believe that a single man could change history so violently and so permanently.”(বিশ্বাস করা কঠিন যে, একজন মানুষ এতো হিংস্র এবং স্থায়ীভাবে ইতিহাস বদলে দিতে পারে।)
কেনেডি হত্যা নিয়ে যত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
সরকারি তদন্ত এবং অন্যান্য শোনা রূপরেখা অনুসারে, লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে একমাত্র আততায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু একথা তো পুরোপুরি মানতে পারেননি অনেকেই। কেনেডির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, এবং কয়েক দশক ধরে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলে। জন এফ কেনেডি (JFK) ও তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ কিছু আইকনিক এবং আলোচিত সিনেমা তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, রাজনৈতিক রহস্য এবং তার জীবনের প্রভাব নিয়ে।
১. সিআইএ এবং সামরিক বাহিনীর ভূমিকা
অনেকে দাবি করেছেন, কেনেডি তার ভিয়েতনাম নীতি ও সিআইএ’র কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার কারণে তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং, তাদের মধ্যে কেউ তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল কিনা, এটি এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে ওঠে।
২. মাফিয়া সংযোগ
একটি তত্ত্ব দাবি করে, প্রেসিডেন্ট কেনেডি তার ভাই, রবার্ট কেনেডির মাধ্যমে মাফিয়া বিরোধী অভিযান চালানোর পর মাফিয়া তাদের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এই হত্যা ঘটিয়েছিল।
৩. কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন
কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কেনেডির সম্পর্কও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মতে, কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কিউবা বা সোভিয়েত সংযোগ থাকতে পারে।
৪. লিন্ডন বি. জনসনের ভূমিকা
অন্য একটি তত্ত্বে দাবি করা হয়, প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার জন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন জড়িত থাকতে পারেন। তার প্রচারণা এবং রাজনীতির মধ্যে বিভিন্ন জটিলতা ছিল, যা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বের জন্ম দেয়।
৫. “ম্যাজিক বুলেট” তত্ত্ব
ওয়ারেন কমিশন কর্তৃক উপস্থাপিত “ম্যাজিক বুলেট” তত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেকেই আপত্তি জানান, যেখানে একটি গুলি একাধিক ব্যক্তি ও লক্ষ্যকে আঘাত করার কথা বলা হয়েছিল।
জন এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ড, তাঁর কবর, এবং তার চারপাশের ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো এখনও পৃথিবীজুড়ে আলোচিত হয়ে আসছে। তার মৃত্যু, কবরের আশেপাশে ঘটিত রহস্য এবং তার জীবনের অজ্ঞাত দিকগুলো সকলের জন্যই চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ। হয়তো কখনো এসব রহস্যের সমাধান পাওয়া যাবে না, তবে তার হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকা ষড়যন্ত্রগুলো পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দিয়ে গেছে এক অমিমাংসিত রহস্য হিসেবে।
তথ্যসূত্র-
- John F. Kennedy ০জconspiracy theories – Wikipedia
- The JFK assassination conspiracy theories | The Week
- 5 Unbelievable Facts About the Kennedy Graves at Arlington
- 10 Conspiracy Theories About the JFK Assassination | HowStuffWorks
- What are the main conspiracy theories about JFK’s assassination? | US News