Image default
জীবনী

রায়হান রাফি – বাংলা চলচ্চিত্রের তরুণ নির্মাতা

রায়হান রাফি বাংলা সিনেমার ভবিষ্যতের জন্য এক আশাবাদের নাম। তিনি প্রমাণ করছেন সাহস, পরিকল্পনা ও সৃজনশীলতা থাকলে মৃতপ্রায় দেশীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও হতে পারে হাউজফুল।

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের ভুবনে যখন গতানুগতিক ধারায় একঘেয়েমি ছড়িয়ে পড়ছিল, ঠিক তখনই টাটকা হাওয়ার মতো আবির্ভাব ঘটে নির্মাতা রায়হান রাফির। তার হাত ধরে এসেছে গল্প বলার নতুন কৌশল, চিত্রগ্রহণে অভিনবত্ব আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নতুন প্রজন্মের দর্শকদের আকৃষ্ট করার মন্ত্র।

রায়হান রাফির সিনেমাগুলো যেন তরুণদের মনের কথাই বলে। সম্পর্ক, সমাজ, প্রেম, লড়াই সবকিছু উঠে আসে খুব জীবন্তভাবে, যেন তারা নিজেরাই পর্দায় নিজেদের জীবনের একাংশ খুঁজে পান। একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা দিয়ে তিনি শুধু তারকা নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতই করেননি, বরং বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রেও এক নতুন ঢেউ এনেছেন। পোড়ামন ২ থেকে শুরু করে পরাণ, দামাল কিংবা সুড়ঙ্গ প্রত্যেকটি সিনেমাই হয়ে উঠেছে আলোচনা ও দর্শকপ্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু।

মাদ্রাসার ছাত্র থেকে সফল পরিচালক: রায়হান রাফির স্বপ্নযাত্রা

রায়হান রাফি বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রের অন্যতম আলোচিত নাম। তবে তার আলোয় ভরা পথচলা শুরু হয়েছিল একেবারে ভিন্ন এক জগত থেকে। একজন মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী হিসেবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হলেও পরবর্তীতে তিনি পা বাড়ান বিনোদনের আলো ঝলমল জগতে। 

রায়হান রাফির জন্ম ১৯৮৯ সালের ৩ মার্চ, সিলেটের এক সাধারণ পরিবারে। বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই ভর্তি হয়েছিলেন একটি মাদ্রাসায়। মাদ্রাসায় পড়তে রায়হান রাফির ভালো লাগতো না। পাঞ্জাবি পড়তে বাধ্য হতেন বলে রাফির মাথায় প্রশ্ন আসতো আমাকে বাধ্য কেন করা হবে। সেখানে তিন মাস পর পর ছুটি মিলত। বাকি সময় হোস্টেলের চার দেয়ালের ভেতরেই কাটাতে হতো। সেই নির্জন হোস্টেলের জানালা দিয়ে দেখা যেত একটি পুলিশ স্টেশন। মাঝে মাঝে সেখানে লাশ আসত। দেখতে পেতেন কান্নারত মানুষজন কে। কিন্তু হোস্টেলের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শোনা যেত না, শুধু দৃশ্যটা দেখা যেত। ছোট্ট রাফি তখন নিজের কল্পনায় এসব দৃশ্যের পেছনে গল্প দাঁড় করাতেন। ভাবতেন, “হয়তো বাবাকে মেরে ফেলেছে কেউ, তাই কাঁদছে।” এভাবেই গড়ে উঠতে থাকে তার কল্পনাশক্তির ভিত।

তবে একসময় মনে হতে থাকে। মাদ্রাসার ছাত্র হয়ে সিনেমার পরিচালক হওয়া হয়তো সম্ভব নয়। চারপাশের সমাজ-সংস্কৃতি, বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা যেন বলছিল, “তুমি পারবে না!” কিন্তু ছোটবেলা থেকেই “পরিচালক” শব্দটি তার মনে গেঁথে বসেছিল। এই আকাঙ্ক্ষাই তাকে ঘুমোতে দিত না। অন্য অনেকের মতো স্রেফ সিনেমা দেখে মুগ্ধ হওয়া তার আগ্রহের শেষ ছিল না, বরং ধীরে ধীরে নিজেই ক্যামেরার পেছনের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন।

তখন ক্লাস নাইনে পড়েন, শর্টফিল্ম বানাতে মরিয়া রায়হান রাফির মন। যে করেই হোক শর্ট ফিল্ম বানাতেই হবে। কিন্তু টাকা কোথায়? টাকার জন্য কান্না জুড়ে দিলেন। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন মা। ছেলেকে সঙ্গে করে বাজারে গেলেন। নিজের সোনার চেইন বিক্রি করে ১২ হাজার টাকা তুলে দিলেন ছেলের হাতে। সেই টাকা দিয়ে রাফি নির্মাণ করেন তার প্রথম শর্টফিল্ম ‘আজব বাক্স’। এটাই ছিল তার নির্মাতা জীবনের প্রকৃত সূচনা।

২০১৩ সালে নির্মিত আরেকটি শর্টফিল্ম ‘বেওয়ারিশ’ দিয়ে তার স্বপ্নপথ একটু বিস্তৃত হয়। এরপর ইউটিউব কনটেন্ট, টেলিফিল্ম ও ওয়েব ভিডিওর মাধ্যমে নিজের দক্ষতা বাড়াতে থাকেন। এই পথ ধরে ২০১৮ সালে জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে মুক্তি পাওয়া ‘পোড়ামন ২’ দিয়ে তার বড় পর্দার অভিষেক ঘটে।

রায়হান রাফির কয়েকটি সিনেমার পোস্টার

‘পোড়ামন ২’ শুধু বাণিজ্যিকভাবেই সফল হয়নি, বরং এটি প্রমাণ করে দেয় রায়হান রাফির ভেতরে এক স্বতন্ত্র গল্প বলার দক্ষতা রয়েছে। এখান থেকেই খুলে যায় তার চলচ্চিত্রের নতুন দরজা। এরপর একে একে ‘দহন’, ‘পরাণ’, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তুফান’ প্রতিটি সিনেমায় নিজস্বতা ও বৈচিত্র্য ধরে রেখে জয় করে নেন দর্শকের হৃদয়। রাফীর এই সাফল্যের জার্নিটা ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ এরকমটা নয়। পরিশ্রম আর স্বপ্ন নিয়ে তিলে তিলে তৈরি করেছেন নিজের ক্যারিয়ার।

মাদ্রাসায় পড়া রায়হান রাফির এক সময় মনে হতো তার স্বপ্নের পথে বাধা ছিল মাদ্রাসা। কিন্তু এখন তার আর এরকম মনে হয় না। মাদ্রাসার সেই ছোট্ট জানালা দিয়ে দেখা দুনিয়া থেকেই তিনি শিখেছিলেন গল্প বলা, দর্শকের সামনে একটা দৃশ্য কিভাবে পরিবেশন করতে হবে। মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে তিনি চিনেছেন জীবনকে, চিনেছেন মানুষকে। হোস্টেলে বিভিন্ন রকম ছেলের সংস্পর্শে এসে শিখেছেন জীবনের বিভিন্নতা। একেক মানুষের একে দৃষ্টিভঙ্গি। বুঝেছেন পলিটিক্স। এখান মাদ্রাসাকেই রায়হান রাফির চলচ্চিত্র নির্মানের অন্যতম শিক্ষা বলে মনে হয়।

রায়হান রাফি মাদ্রাসার ছাত্র এটা মানুষ জেনেছে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর স্ট্যাটাস থেকে। রায়হান রাফি এটা নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন না। কারন মানুষ ভাবে মাদ্রাসার ছেলে উচ্ছন্নে গেছে তাই সিনেমা বানায়। তবে এক ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেছেন এখন আর এসব ভ্রুক্ষেপ করেন না তিনি। তাই সিনেমা বানিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় এই পরিচালক। 

রায়হান রাফির ক্যারিয়ারের প্রতিটি ধাপই ছিল আত্মজয়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রাচীরঘেরা হোস্টেলের জানালায় দাঁড়িয়ে যে কিশোর কল্পনায় গল্প আঁকতো, সে আজ দেশের কোটি দর্শকের হৃদয়ে সিনেমার পর্দা জুড়ে জীবন্ত করে তোলে সেই গল্পগুলোই। মাদ্রাসা থেকে সিনেমার রাজপথ, এই রূপকথার পথচলা আজও চলছে, এবং প্রতিনিয়ত বিস্মিত করছে বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের।

রায়হান রাফির বিখ্যাত সিনেমাগুলো

রায়হান রাফির ক্যারিয়ারে বেশ কিছু সিনেমা তাকে শুধু জনপ্রিয়ই নয়, বরং একজন ট্রেন্ডসেটার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেছে। এসব সিনেমা গল্প, নির্মাণ কৌশল এবং অভিনয়ের জন্য দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

পোড়ামন ২: সিয়াম আহমেদ ও পূজা চেরিকে নিয়ে নির্মিত এই রোমান্টিক ট্র্যাজেডি সিনেমাটি ছিল তার প্রথম হিট। এটি মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ আরও বেশ কিছু পুরস্কার অর্জন করে এবং দেশের তরুণ দর্শকদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

দহন: এই সিনেমাটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়। শহুরে সহিংসতা, অস্থিরতা, এবং মিডিয়া ম্যানিপুলেশন নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি চিন্তাশীল দর্শকদের মন জয় করে।

পরাণ: ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি বাস্তব এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত। বিদ্যা সিনহা মিম, শরিফুল রাজ ও ইয়াশ রোহান অভিনীত এই সিনেমাটি বক্স অফিসে দুর্দান্ত সাড়া ফেলে এবং সে বছরের অন্যতম সফল চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুড়ঙ্গ: আফরান নিশোর সিনেমায় অভিষেক ঘটে এই ক্রাইম থ্রিলারের মাধ্যমে। দর্শকরা যেমন তার পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হন, তেমনি রাফির স্ক্রিপ্ট ও থ্রিল তৈরির কৌশলেও প্রশংসা করেন।

তুফান: ২০২৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাকিব খান অভিনীত এই সিনেমাটি অ্যাকশন ও ড্রামার সংমিশ্রণে তৈরি এবং এটি রাফির সবচেয়ে বড় বাজেটের সিনেমাগুলোর একটি বলে ধারণা করা হয়।

তুফান সিনেমার পোস্টার

বর্তমানে রায়হান রাফি আবারও কাজ করছেন শাকিব খানের সাথে। ঈদ উল আজহা-তেই আসতে চলেছে তান্ডব। এছাড়াও তার লাইনাপে রয়েছে আরেকটা সিনেমা স্বপ্নবাজি।

রায়হান রাফির সিনেমা হিট হওয়ার কারণ

রায়হান রাফির সিনেমাগুলো নিয়মিতভাবে দর্শকের মাঝে আগ্রহ তৈরি করে এবং বক্স অফিসে ভালো সাড়া ফেলে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে:

সমসাময়িক গল্প ও সামাজিক ইস্যুতে ফোকাস:

রাফির সিনেমাগুলোতে আমরা দেখতে পাই সমকালীন সমাজের বাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, তরুণদের মনস্তত্ত্ব সবকিছুর মিশেল। তিনি শুধু বিনোদনের উদ্দেশ্যে সিনেমা বানান না, বরং সমাজকে আয়নার মতো তুলে ধরেন।

দর্শকদের সাথে রায়হান রাফি

তরুণ প্রজন্মের সাথে সংযোগ

রাফি জানেন, বাংলাদেশে তরুণ দর্শক সংখ্যায় সবচেয়ে বড়। তিনি তাদের ভাষা বোঝেন, তাদের অনুভূতি ও চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন। তার সিনেমায় যে ধরনের প্রেম, দ্বন্দ্ব, স্বপ্ন বা প্রতিবাদ উঠে আসে, তা তরুণদের খুব সহজেই স্পর্শ করে।

উচ্চমানের প্রোডাকশন ও অভিনয়

রাফি সবসময় চেষ্টা করেন সিনেমার প্রোডাকশন ভ্যালু উন্নত রাখতে। সেট ডিজাইন, চিত্রগ্রহণ, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সব ক্ষেত্রেই তিনি আন্তর্জাতিক মানের কাজ করার চেষ্টা করেন। সেইসাথে, অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয় দক্ষতা নিয়েও তিনি আপসহীন।

স্মার্ট মার্কেটিং ও ওটিটিতে দখল: 

রাফি খুব ভালো বোঝেন কীভাবে সিনেমা নিয়ে আগ্রহ তৈরি করতে হয়। সিনেমা মুক্তির আগে টিজার, ট্রেলার, সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট, কাস্ট ইন্টার‍্যাকশন সব কিছুর মাধ্যমে তিনি স্মার্টলি সিনেমার প্রচার করেন। পাশাপাশি, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তার সিনেমা রিলিজ দিয়ে তিনি নতুন দর্শক তৈরি করেছেন।

রায়হান রাফি পরিচালিত ওয়েব ফিল্ম

সিনেমা ছাড়াও রায়হান রাফি ওয়েব কনটেন্টের দিকেও মনোযোগ দিয়েছেন- 

আমলনামা (২০২৫): সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি শক্তিশালী সোশ্যাল থ্রিলার।

ব্ল্যাক মানি (২০২৫): অপরাধ, অর্থ এবং সম্পর্কের বেড়াজালে গড়ে ওঠা একটি গল্প।

মায়া (২০২৪): মানসিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে নির্মিত ওয়েব ফিল্ম।

ফ্রাইডে (২০২৩): সমাজের বিভিন্ন স্তরের চরিত্র নিয়ে গঠিত একটি মাল্টিপারসপেকটিভ থ্রিলার।

নিঃশ্বাস (২০২২): নিঃসঙ্গতা, বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর নির্মিত।

জানোয়ার (২০২১): করোনাকালীন এক বিভীষিকাময় রাত্রির গল্প, যা দর্শকের মনে আলোড়ন তুলেছিল।

রায়হান রাফির নতুন সিনেমা ২০২৫

২০২৫ সালেও রায়হান রাফির ব্যস্ততা তুঙ্গে। এ বছর তার দুটি আলোচিত সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায়। একটি প্রেক্ষাগৃহের জন্য, আরেকটি ওটিটির জন্য।

তাণ্ডব: এই সিনেমার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান। রাজনৈতিক থ্রিলার ঘরানার এই ছবিতে রাফি চেষ্টা করেছেন সামাজিক বাস্তবতা ও ক্ষমতার লড়াই একসাথে তুলে ধরতে। ২০২৫ সালের কোরবানির ঈদে মুক্তির পরিকল্পনায় নির্মিত সিনেমাটি ঘিরে শুরু থেকেই দর্শকের আগ্রহ তুঙ্গে।

শাকিব খান ও রায়হান রাফি

আমলনামা: সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই ওয়েব ফিল্মটি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে। নারীর প্রতি সহিংসতা, বিচারহীনতা এবং সমাজের নীরব নিষ্ঠুরতা তুলে ধরার মাধ্যমে এটি দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।

রায়হান রাফি ও তমা মির্জার কাজ

রায়হান রাফি ও তমা মির্জার জুটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় এসেছে। তমা মির্জা, যিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী, তার সঙ্গে রাফির কাজগুলো হয়েছে বেশ সংবেদনশীল ও ভাবনা-উদ্রেককারী।

রায়হান রাফির পরিচালনায় প্রথমবার ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন তমা মির্জা। এরপর ‘৭ নম্বর ফ্লোর’, ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় অভিনয় করেন তমা। সিনেমায় আফরান নিশোর সঙ্গে জুটি বাঁধেন তমা। এরপর সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া আমলনামা ওয়েব ফিল্মে সর্বশেষ এক সাথে কাজ করেন তারা।

রায়হান রাফির সিনেমাটিক ইউনিভার্স

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টায় রয়েছেন রায়হান রাফি। তিনি গড়ছেন রাফি সিনেমাটিক ইউনিভার্স (RCU), যেখানে বিভিন্ন সিনেমা একে অপরের সঙ্গে কনসেপ্টচুয়ালি ও চরিত্রের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে।

এই ইউনিভার্সের শুরুর পাথর হচ্ছে তাণ্ডব সিনেমা। এতে এমন কিছু চরিত্র ও ঘটনার সূচনা ঘটবে, যেগুলো পরবর্তী সিনেমাগুলোতে ফিরে আসবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আন্তর্জাতিক ট্রেন্ড অনুসরণে এবং দীর্ঘমেয়াদি গল্প বলার ফর্ম্যাটে রাফির এই উদ্যোগ অনেকটাই ভিন্নধর্মী ও সাহসী পদক্ষেপ। এই ইউনিভার্স ঘিরে ইতোমধ্যে তার ভক্ত-দর্শকদের মাঝে তৈরি হয়েছে কৌতূহল ও তর্ক-বিতর্ক। কেউ কেউ বলছেন, এটি বাংলাদেশি সিনেমার জন্য “মার্ভেল-স্টাইল” বিপ্লবের শুরু।

রায়হান রাফি ও তমা মির্জার সম্পর্ক: গুঞ্জন ও বাস্তবতা

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে রায়হান রাফি ও অভিনেত্রী তমা মির্জাকে ঘিরে নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছে। একাধিক প্রজেক্টে একসাথে কাজ করায় এবং ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি ও পোস্টের সূত্র ধরে দর্শক মহলে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

রায়হান রাফি ও তমা মির্জা

তবে এসব গুজবের জবাবে দুজনই পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন। তাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ পেশাগত ও বন্ধুত্বপূর্ণ। রাফি ও তমা দুজনেই মিডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা একে অপরকে শ্রদ্ধা করেন এবং কাজের জায়গায় একজন আরেকজনের উপর আস্থা রাখতে পারেন বলেই একসাথে একাধিক সফল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে তমা মির্জা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মানুষ কাজের বাইরে কল্পনা করতে ভালোবাসে, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা যতটা সরল, সেটা বোঝানো কঠিন।” অন্যদিকে, রাফি মন্তব্য করেন, “ভালো কাজ করলেই সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা বেশি হয়। এটাই স্বাভাবিক।”

রায়হান রাফির পুরস্কার ও অর্জন

রায়হান রাফি তার ক্যারিয়ারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, যা তার কাজের গুণগত মান এবং জনপ্রিয়তার স্বীকৃতি বহন করে।

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার: পোড়ামন ২ সিনেমার জন্য তিনি মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে মনোনয়ন পান, যা তাকে মূলধারার দর্শকের নজরে আনে।

চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার: বিভিন্ন ঘরানার সাহসী নির্মাণ ও সমাজ সচেতন গল্প উপস্থাপনার জন্য তিনি প্রশংসিত হন।

চরকি অ্যাওয়ার্ডস: জানোয়ার, নিঃশ্বাস ও আমলনামা-র মতো ওয়েব ফিল্মে অনন্য গল্প ও নির্মাণ শৈলীর জন্য রাফি চরকি অ্যাওয়ার্ডসে দর্শকপ্রিয় নির্মাতার স্বীকৃতি পান।ক

বাইফা পুরস্কার (২০২২): পরাণ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে পুরস্কৃত হন।

বিএফডিএ অ্যাওয়ার্ডস (২০২২): পরাণ ও দামাল চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনি, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক বিভাগে মনোনয়ন পান।

ব্লেন্ডারস চয়েস-দ্য ডেইলি স্টার ওটিটি অ্যান্ড ডিজিটাল কনটেন্ট অ্যাওয়ার্ডস (২০২৩): ফ্রাইডে ওয়েব ফিল্মের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক (সমালোচক) বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেন।

সিজেএফবি পারফরম্যান্স পুরস্কার (২০২১): খাঁচার ভেতর অচিন পাখি ওয়েব ফিল্মের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক (ওয়েব ফিল্ম) বিভাগে মনোনীত হন।

ভারত-বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০১৯): দহন চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে মনোনয়ন পান।

রায়হান রাফি কি নারী বিদ্বেষী?

সমালোচকদের একটি অংশ মনে করেন, রায়হান রাফির কিছু সিনেমায় নারীদের চরিত্র চিত্রণে পক্ষপাতিত্ব কিংবা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে সূড়ঙ্গ, পরাণ, জানোয়ার কিংবা খাঁচার ভেতর অচিন পাখি সিনেমায় নারী চরিত্রগুলোর পরিণতি বা উপস্থাপনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

তবে রাফি নিজে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ্যে, “আমি সমাজের বাস্তবতা দেখাতে চাই, সেটা কারো পছন্দ না-ও হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “আমার ছবিতে নারীরা দুর্বল নয়, বরং তারা বাস্তব, জটিল ও প্রভাবশালী।”

এই বিতর্কের পেছনে কিছুটা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সিনেমার শিল্প-স্বাধীনতার সংঘাতও রয়েছে। ফলে, ‘নারী বিদ্বেষী পরিচালক’ তকমা রাফির ক্ষেত্রে কতটা ন্যায্য, সেটি এখনো বিতর্কের বিষয়।

রায়হান রাফি বাংলাদেশের চলচিত্র জগতে এক ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি গল্প বলার কৌশল, ভিজ্যুয়াল এক্সপ্রেশন এবং বিষয় নির্বাচনে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে সহজেই সংযোগ তৈরি করতে পেরেছে।

“তাণ্ডব” দিয়ে শুরু হওয়া তার সিনেমাটিক ইউনিভার্স যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলা চলচ্চিত্র পাবে এক নতুন দিগন্ত, যেখানে গল্প, চরিত্র এবং ভাবনা একে অন্যকে ছুঁয়ে যাবে দীর্ঘ সময়জুড়ে।

তথ্যসূত্র

Related posts

যোগেন মন্ডল- রাজনীতির হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে মন্ত্রিত্ব: কে এই আসিফ মাহমুদ?

সাকিব আল হাসান এর শেষ ইনিংস: ক্রিকেটের নায়ক, নাকি জনগণের বিশ্বাসভঙ্গ?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More