Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

নবী মুহাম্মদের আগেই পবিত্র শহর? ইসলাম-পূর্ব আরবে পেত্রার রহস্য!

বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আগমনের বহু আগে থেকেই পেত্রা ছিল আরব বিশ্বের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র শহর। এটি ছিল এক বিশাল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, যেখানে প্রাচীন আরবের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং বাণিজ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মক্কা নগরীর ছবি আমাদের মনে গেঁথে আছে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মুসলিম কাবা শরিফকে কেন্দ্র করে হজ পালন করতে সেখানে যান। এটি ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র শহর এবং ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু আমরা যদি সময়ের চাকাকে ঘুরিয়ে ইসলামের আবির্ভাবের আরও কয়েক শতাব্দী পেছনে চলে যাই, তবে কি আরবের বুকে অন্য কোনো পবিত্র শহরের অস্তিত্ব ছিল? এমন কোনো নগরী, যেখানে দূর-দূরান্তের মানুষ আসতো দেবতাদের উপাসনা আর প্রাচীন তীর্থযাত্রার মত রীতিনীতি পালন করতে।

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মরুভূমির বুকে পাথরে খোদাই করা এক গোলাপী শহর, যার নাম পেত্রা। জর্ডানের মরুভূমিতে লুকিয়ে থাকা এই বিস্ময়কর নগরীটি ছিল নাবাতীয় সভ্যতার রাজধানী। এটি শুধু এক বাণিজ্যিক কেন্দ্রই ছিল না, ছিল এক বিশাল আধ্যাত্মিক কেন্দ্রও। আজকের জানার চেষ্টা করব, ইসলাম-পূর্ব আরবে এই শহরটির আসল গুরুত্ব কী ছিল। 

পেত্রা: শুধুই বাণিজ্য নগরী, নাকি এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্রও?

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে প্রায় ৫০০ বছর ধরে নাবুতীয়ানরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। তারা ছিল দক্ষ ব্যবসায়ী, যারা মশলা এবং সুগন্ধির বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিল। আর এই সম্পদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তাদের রাজধানী পেত্রা। কিন্তু পেত্রা শুধু তাদের সম্পদ বা প্রকৌশল বিদ্যার নিদর্শন ছিল না; এটি ছিল তাদের ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতির প্রাণ।

প্রাচীন পেত্রা নগরীতে বণিক

পেত্রা শহরটি তৈরি করা হয়েছিল বেলেপাথর খোদাই করে। এর প্রতিটি মন্দির, সমাধি এবং উপাসনালয় যেন প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। এখানকার বিখ্যাত স্থাপত্য ‘আল-খাজনেহ’ (ট্রেজারি) বা ‘আদ-দেইর’ (মঠ) নিছক দালান ছিল না, এগুলো ছিল তাদের পবিত্র স্থান, যেখানে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালিত হতো। এই শহরের গঠনই প্রমাণ করে যে, নাবুতীয়ানদের জীবনে ধর্মের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

ইসলাম-পূর্ব আরবের দেব-দেবী 

ইসলামের আগমনের আগে আরব উপদ্বীপ ছিল বহুদেবতাবাদী বিশ্বাসে পূর্ণ। বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজস্ব দেব-দেবীর পূজা করত, যাদের অনেকেরই উপাসনার কেন্দ্র ছিল নির্দিষ্ট কোনো পবিত্র স্থান বা কাবা। নাবুতীয়ানদের ধর্মবিশ্বাসও এই বৃহত্তর আরব ধর্মবিশ্বাসেরই একটি অংশ ছিল।

  • দুশারা (Dushara): নাবাতীয়দের প্রধান দেবতা ছিলেন দুশারা, যার নামের অর্থ “শারা পর্বতমালার প্রভু”। তিনি ছিলেন উর্বরতা এবং শক্তির দেবতা। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, দুশারার কোনো মানব মূর্তি ছিল না। তার প্রতীক ছিল একটি কালো, চৌকোণা পাথর। এই ধরনের বিমূর্ত পাথরের উপাসনা ইসলাম-পূর্ব আরবের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল।
নাবাতিয়ানদের দেবী ত্রয়ী
  • দেবীত্রয়ী (The Three Goddesses): নাবুতীয়ানরা তিন প্রধান দেবীরও পূজা করত। আল-উজ্জা, আল-লাত এবং মানাত। এই তিন দেবী শুধু পেত্রাতেই নয়, মক্কাসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। কুরআনেও এই তিন দেবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, পেত্রা এবং মক্কার মধ্যে একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংযোগ বিদ্যমান ছিল।

এই দেব-দেবীদের প্রায়শই সূর্য, শুক্র গ্রহ এবং অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর সাথে যুক্ত করা হতো। এটি প্রমাণ  করে যে, নাবুতীয়ানদের ধর্মবিশ্বাস জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং প্রকৃতির পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।

পেত্রা ও প্রাচীন হজ্বের ধারণা: মিল কোথায়?

‘হজ’ বা তীর্থযাত্রা ইসলামের একটি মৌলিক স্তম্ভ হলেও, এই ধারণাটি ইসলাম-পূর্ব আরবেও প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন গোত্রের মানুষ বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তাদের পবিত্র স্থান বা কাবায় একত্রিত হতো। এই তীর্থযাত্রা ছিল একাধারে ধর্মীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মিলনমেলা। পেত্রার দিকে তাকালে আমরা প্রাচীন হজের ধারণার সাথে বেশ কিছু আশ্চর্যজনক মিল খুঁজে পাই, যা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

  • তীর্থযাত্রা ও উৎসব: পেত্রা ছিল এক বিশাল তীর্থক্ষেত্র। দূর-দূরান্ত থেকে বণিক এবং সাধারণ মানুষ এখানে আসত তাদের দেবতাদের উপাসনা করতে এবং ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে। শহরের বিশাল থিয়েটার এবং সভাকক্ষগুলো প্রমাণ করে যে, এখানে বড় ধরনের জনসমাবেশ হতো।
পেত্রায় তীর্থ যাত্রা
  • পবিত্র কাবা ও বিমূর্ত প্রতীক: মক্কার কাবার মতো পেত্রাতেও ছিল এক পবিত্র কেন্দ্র, যেখানে দুশারার প্রতীকী কালো পাথরটি রাখা ছিল। এই ধরনের পাথরকে কেন্দ্র করে উপাসনা করা ছিল প্রাচীন সেমিটিক ধর্মগুলোর একটি সাধারণ রীতি।
  • তাওয়াফের মতো প্রদক্ষিণ: অনেক গবেষক মনে করেন, নাবুতীয়ানরা তাদের পবিত্র পাথরকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করত, যা মক্কার তাওয়াফ রীতির মত। এই ধরনের বৃত্তাকার প্রদক্ষিণ মহাবিশ্বের শৃঙ্খলা এবং ঈশ্বরের একত্বকে বোঝানোর একটি প্রাচীন প্রতীকী আচার।
  • কোরবানি বা বলিদান: পেত্রার বিভিন্ন মন্দিরের বেদিতে পশুবলির চিহ্ন পাওয়া যায়, যা হজ ও অন্যান্য সেমিটিক ধর্মে প্রচলিত কোরবানির রীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এই মিলগুলো প্রমাণ করে না যে, পেত্রা এবং মক্কার হজ একই ছিল। তবে এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, ইসলাম যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আবির্ভূত হয়েছিল, সেখানে তীর্থযাত্রা, কোরবানি এবং একটি পবিত্র কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করার মতো রীতিনীতিগুলো আগে থেকেই গভীরভাবে প্রোথিত ছিল।

বিতর্কিত তত্ত্ব: পেত্রা কি ছিল প্রথম কিবলা?

কিছু পশ্চিমা গবেষক, বিশেষ করে প্রত্নতত্ত্ববিদ ড্যান গিবসন, এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী তত্ত্ব সামনে নিয়ে এসেছেন। তাদের দাবি, ইসলামের ইতিহাসের একেবারে প্রথম দিকে মুসলিমদের কিবলা বা প্রার্থনার দিক মক্কা ছিল না, বরং তা ছিল আজকের জর্ডানের পেত্রা।

এই তত্ত্বের পেছনে তাদের যুক্তিগুলো হলো:

  • ভৌগোলিক বর্ণনা: তাদের মতে, কুরআনে এবং প্রাচীন ইসলামিক বর্ণনায় ‘মক্কা’ বা ‘বাক্কা’র যে ভৌগোলিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে (যেমন—প্রচুর সবুজ গাছপালা, নদী, জলপাই গাছ), তা আরবের শুষ্ক মক্কা নগরীর চেয়ে পেত্রার সবুজ পরিবেশের সাথে বেশি মেলে।
  • প্রাচীন মসজিদের কিবলা: এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে তারা কিছু প্রাচীন মসজিদের কিবলার দিককে উল্লেখ করেন। তাদের দাবি, ৭ম এবং ৮ম শতকের প্রথম দিকে নির্মিত কিছু মসজিদের কিবলা মক্কার দিকে নয়, বরং পেত্রার দিকে নির্দেশ করে।
কাবা শরীফ
  • কাবার ইতিহাস: তারা যুক্তি দেখান যে, ইসলাম-পূর্ব আরবে অনেকগুলো ‘কাবা’ বা পবিত্র ঘর ছিল এবং পেত্রা ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এই তত্ত্বটি যদি সত্যি হয়, তবে তা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আমূল বদলে দেবে। এটি ধারণা দেয় যে, পেত্রা হয়তো একসময় সমগ্র আরবের প্রধান আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ছিল এবং ইসলামের প্রথম দিনগুলোতেও এর গুরুত্ব বজায় ছিল।

কেন এই তত্ত্ব মূলধারায় গৃহীত নয়?

যদিও এই তত্ত্বটি শুনতে আকর্ষণীয় এবং রহস্যময়, তবে এটি মূলধারার ইসলামী বিশেষজ্ঞ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এর কয়েকটি কারণ হলো:

  • প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাব: পেত্রায় এমন কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়নি, যা ৭ম শতকে সেখানে একটি বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি বা কোনো ইসলামিক কাঠামো থাকার প্রমাণ দেয়।
  • কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা: কুরআন এবং হাদিসে মক্কার অবস্থান এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, যা মূলধারার গবেষকদের কাছে অকাট্য।
  • মসজিদের কিবলার ব্যাখ্যা: প্রাচীন মসজিদগুলোর কিবলার সামান্য বিচ্যুতিকে তখনকার দিনের দিক নির্ণয়ের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা স্থানীয় ভৌগোলিক কারণ হিসেবেই ব্যাখ্যা করা হয়।
  • অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্য: মক্কা যে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হজ ও কিবলার কেন্দ্রবিন্দু, এই অবিচ্ছিন্ন এবং জীবন্ত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব।

পেত্রার ইতিহাস স্বীকার করা মানে ইসলামের উৎসকে অস্বীকার করা তা নয়, বরং যে জটিল, বৈচিত্র্যময় এবং আধ্যাত্মিক পৃথিবীতে ইসলামের বার্তা প্রচারিত হয়েছিল, সেই জগতটাকে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়। পেত্রার উপাসনা পদ্ধতি এবং দেব-দেবীদের কাহিনি আমাদের দেখায় যে, ইসলাম আসার আগে আরবের মানুষের জীবনে ধর্মের প্রভাব কতটা গভীর ছিল। এটি আমাদের হজ, কোরবানি এবং কাবার মতো ধর্মীয় আচার বিধি ঐতিহাসিক শিকড় বুঝতে সাহায্য করে।

পেত্রার রহস্য হয়তো কোনোদিনও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হবে না। কিন্তু এর পাথুরে দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, ইতিহাস কোনো সরলরেখায় চলে না। এর বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে বিস্মৃত অধ্যায় আর নতুন সব রহস্য, যা আমাদের অতীত সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

তথ্যসূত্র –

Related posts

সুকুমার রায়ঃ বাংলা সাহিত্যে ব্রেইনরটের পথিকৃৎ

বাংলার ভূত: মেছোভূত থেকে নিশির ডাক

খুনেই আনন্দ!-জোডিয়াক কিলার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More