“তাস, পাশা, রুলেট, ক্রিপ্টো”- সময়ের সাথে সাথে জুয়া তার রূপ বদলেছে। কিন্তু চরিত্র ? তা কি আদৌও বদলেছে?
জুয়া কি শুধুই ভাগ্যের খেলা? নাকি এটি এক অদৃশ্য আগুন। যেই আগুনে সাম্রাজ্য পুড়েছে, পরিবার ভেঙেছে এমনকি প্রেমও বিলীন হয়েছে।
জুয়া কেবল অর্থের খেলা নয় এটি ব্যক্তির নিজস্ব সত্তার সঙ্গে লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের ইতিহাস কখনো রোমাঞ্চকর তো কখনোবা হৃদয়বিদারক আবার কখনো কখনো নিঃশব্দে ভয়ঙ্কর। পাশা থেকে ক্যাসিনো, কুরুক্ষেত্র থেকে ভেগাস মানবজাতি এই খেলায় শুধু টাকা নয় বরং নিজের অস্তিত্বকেও হারিয়েছে বারবার।
এই লেখায় আমরা সেই পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ঘুরে দেখব যেখানে মানুষ হাতের তালু দিয়ে ভাগ্যকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ।
প্রাচীন যুগে জুয়া: মেসোপটেমিয়া থেকে মহাভারত
কখনো বিনোদন, কখনো ধ্বংস কিংবা কখনো রাজনীতির হাতিয়ার আবার কখনো সমাজ পতনের কারণ সবমিলিয়ে জুয়ার ইতিহাস যেন এক গোলমেলে গল্প।
জুয়া একেবারে নতুন কোন বিষয় নয়। বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর (প্রাচীন মিশর, চীন, গ্রিস কিংবা রোম) দিকে তাকালেই দেখা যায় মানুষ তখনও “ভাগ্য” নামক এক অদৃশ্য শক্তির উপর বিশ্বাস রেখেছে।
কিন্তু কিভাবে এই খেলা প্রাচীন রাজপ্রাসাদের গন্ডি পেরিয়ে আমাদের মোবাইল স্ক্রিনে চলে আসল?
চলুন এই বিধ্বংসী খেলার ইতিহাস সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনে আসি।
মেসোপটেমিয়া জুয়া
ইতিহাসের প্রথম বাজির ঘর বলা হয় মেসোপটেমিয়াকে। ধারণা করা হয়,টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে ওঠা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মানুষ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে প্রথমবারের মতো হাতে নিয়েছিল “পাশা”।
যেই পাশা ছিল হাড় বা পাথর দিয়ে তৈরি এবং যার গায়ে ছিল অসংখ্য দাগ কাটা। এ যেন প্রাচীন যুগের ভাগ্য-নির্ণায়ক যন্ত্র।
মেসোপটেমিয়ারা মনে করত, পাশা নিক্ষেপ করে তারা খুব সহজেই ঈশ্বরের ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে পারবে। তারা মূলত “ফরচুন” বা ভাগ্যের দেবীর আশির্বাদ লাভের জন্য জুয়া খেলত। ভাবুন তো, একখানা হাড় ছুঁড়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ টের পাওয়ার চেষ্টা এটাই তো ছিল আদিম মানুষের “গ্যাম্বল”!
মিশরীয় সভ্যতায় জুয়া
ফারাওদের সময়ে প্রাচীন মিশরে প্রথম জুয়া খেলার সূত্রপাত হয়েছিল । মিশরীয় সভ্যতায় জুয়াকে মূলত নৈতিক ও দৈনন্দিন জীবনের খেলা হিসেবে মনে করা হতো। মিশরীয়রা খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগেই “সেনেট” নামে এক ধরনের খেলা খেলতো। যেটাকে অনেকেই জুয়ার প্রাচীন রূপ বলে থাকেন।
তারা মনে করত জুয়া খেলার মাধ্যমে পরলোকে প্রবেশের আগে তারা নিজেদের আত্মার শক্তি পরীক্ষা করতে পারবে। তবে এটাকে শুধু খেলা বললে ভুল হবে এটা ছিল মিশরীয়দের একধরনের আধ্যাত্মিক রিচুয়াল।
চীনে জুয়া
প্রাচীন চীনের সম্রাটেরা ও সাধারণ মানুষ প্রায় ৪০০০ বছর আগে একই সঙ্গে ভাগ্য পরীক্ষার এই মজার খেলাই মেতেছিল।
শাং রাজবংশের সময় থেকেই শুরু হয় চীনের এই জুয়ার ইতিহাস। তখনকার দিনে মানুষেরা পাথর, কাঠের টুকরো কিংবা ডাইস ব্যবহার করতো তাদের ভাগ্যের দরজা খোলার জন্য।
প্রাচীন চীনে কুই রাজবংশে চালু হয় সরকারি লটারি। যার মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে বানানো হয় প্রাচীন সব বড় বড় স্থাপনা। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় কাগজে লেখা ভাগ্যের চিঠি। যা আজকের স্ক্র্যাচ কার্ড, কুপন কিংবা অনলাইন লটারির প্রাচীনতম রূপ।
গ্রিস-রোম সাম্রাজ্যে জুয়া
জুয়া মানেই কি কেবল নেশা আর ভাগ্যের খেলা? প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে জুয়া ছিল এক জটিল সাংস্কৃতিক অভ্যাস। যেখানে নৈতিকতা, আইন আর আনন্দের মধ্যে চলত এক সূক্ষ্ম দড়ি টানাটানি।
প্রাচীন গ্রিসে জুয়া শুধু মানুষের নয় বরং দেবতাদেরও প্রধান নেশা ছিল। গ্রিক পুরাণে বর্ণিত আছে জিউস, পোসেইডন ও হাডেস দেবতারা ভাগ্যের মাধ্যমে অর্থ্যাৎ জুয়া খেলে ভাগ করে নিয়েছিলেন স্বর্গ, সাগর আর পাতাল। আর এই বিশ্বাস থেকেই গ্রীসের সাধারণ মানুষদের বেশ মধ্যে পাশা খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তারা মূলত ‘অস্ট্রাগালোস’ নামে একটি জনপ্রিয় খেলা খেলত। হাড়ের দিয়ে তৈরি এক ধরনের বিশেষ পাশা। যেখানে গাধার হাড় বা পাথরের কিউব ছুঁড়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনুমান করা হতো।। যদিও তা আইনত নিষিদ্ধ ছিল।
অন্যদিকে রোমে জুয়া এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে রোমানরা জুয়া খেলাই নিজের অন্তর্বাস পর্যন্ত বাজি ধরত। । রোমান সাম্রাজ্যে জুয়া খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও কড়া ছিল। কিন্তু নিষেধই যেন আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে মানুষ গোপনে খেলত এবং বাজি ধরেত। এমনকি যুদ্ধে যাওয়ার আগে সৈন্যরা ‘লাস্ট বাজি’ ধরত কে মরবে আগে, কে বেঁচে ফিরবে।
রোমে Lex Talaria”নামে একটি বিশেষ আইন প্রচলিত ছিল। যার মাধ্যমে সাধারণ সময়ে জুয়াকে নিষিদ্ধ করা হলেও প্রতি বছর Saturnalia উৎসব চলাকালে এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হতো। এবং তখন রাস্তায় রাস্তায় চলত জুয়া, মদ আর আনন্দের মাতামাতি।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমানরা জুয়াকে দেখতেন দ্বিমুখী চোখে।একদিকে আনন্দের খেলা, আরেকদিকে নৈতিক ও সামাজিক সংকট।
মহাভারতে জুয়া
ভারতের ইতিহাসেও জুয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় মহাভারতে। মহাজ্ঞানী রাজা যুধিষ্ঠির যিনি শুধু মাত্র এই পাশা খেলার মাধ্যমে হারিয়েছিলেন তার রাজ্য, ভ্রাতা, এবং স্ত্রী দ্রৌপদীকে। এই ঘটনা শুধু একটি গল্প নয় বরং সমাজে জুয়ার বিষাক্ত পরিণতির এক চিরন্তন উদাহরণ।
আধুনিক জুয়ার ইতিহাস
আধুনিক জুয়া মানে আজ শুধু পাশা বা তাস নয় এটা এখন এক ডিজিটাল ভূত।যা ফোনের স্ক্রিনে, অ্যাপে, ক্রিপ্টো কারেন্সির গোপন দুনিয়ায় ঘোরাফেরা করে।
কিভাবে জুয়া গোপন রুম থেকে শুরু হয়ে বিশ্বের আলো ঝলমলে ক্যাসিনো শহর এবং তারপর আমাদের মোবাইল স্ক্রিনে ঢুকে পড়ল ? চলুন একবার ঘুরে দেখা যাক কিভাবে জুয়ার আধুনিক ইতিহাস গড়ে উঠল?
ক্যাসিনোর আগমন
১৮শ শতকের ইউরোপে ধনীদের বিনোদনের জন্য জন্ম নেয় প্রথম বৈধ ক্যাসিনো। ১৮৩৭ সালে মোনাকোর Casino de Monte-Carlo ছিল আধুনিক ক্যাসিনো ইতিহাসের মাইলফলক। এলিট সমাজের বিনোদনের জন্য গড়ে ওঠে এসব ক্যাসিনো। যেখানে ভাগ্য বদলের মিথ নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে।
পরবর্তীতে ১৯শ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে ‘সেলুন’ নামক পানশালায় শুরু হয় পশ্চিমমুখী জুয়ার সংস্কৃতি। যা ক্যালিফোর্নিয়ার স্বর্ণের খনির শ্রমিকদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই খেলা।
লাস ভেগাস: জুয়ার রাজধানী
১৯৩১ সালে নেভাদা রাজ্যে জুয়া বৈধ হলে লাস ভেগাস ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে জুয়ার স্বর্গরাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মাফিয়া এবং বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এখানে বিলাসবহুল হোটেল-ক্যাসিনো গড়ে তোলে। ‘The Strip’ নামে পরিচিত রাস্তার দুপাশে গড়ে ওঠে একের পর এক ক্যাসিনো। Caesars Palace, Bellagio, MGM Grand এগুলো শুধু জুয়ার কেন্দ্রই নয় বরং বিনোদনের দুনিয়াও বটে।
আপনি জানলে অবাক হবেন যে, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ক্যাসিনো থেকে ৬০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি টাকা আসে। যা অনেক দেশের জিডিপির চেয়েও বেশি। ক্যাসিনোর লাল-সবুজ বাতি, চিপসের ঠকঠক আওয়াজ, জ্যাকপটের বেজে ওঠা মিউজিক এসব আসলে ভাগ্যের এক carefully designed trap।
এখানে জেতা মানেই আপনাকে আবারো খেলতে বাধ্য করা । আর হারলে আপনি খেলতেই থাকবেন-এটাই মডেল, এটাই ম্যাজিক, এটাই পাঁশার বানানো মনস্তত্ত্ব।
টেকনোলজির জাদু: অনলাইন ক্যাসিনো ও মোবাইল গ্যাম্বলিং
৯০-এর দশকে ইন্টারনেটের আবির্ভাবের পর জুয়া অনলাইনে চলে আসে। ১৯৯৪ সালে Antigua & Barbuda নামের ছোট একটি দেশ প্রথম অনলাইন জুয়া বৈধ করে।
এরপর শুরু হলো PokerStars, 888.com, Betfair, Bet365 এর মতো কোম্পানিগুলোর উত্থান। শুরুতে কম্পিউটারে হলেও বর্তমানে মোবাইলের অ্যাপ দিয়েই খুব সহজেই ভার্চুয়াল ক্যাসিনোতে প্রবেশ করা যায় । রুলেট, ব্ল্যাকজ্যাক, লাইভ ডিলার গেমস, স্পোর্টস বেটিং সবই এখন যেন আঙুলের এক ট্যাপে।
তাস, পাশা, রুলেট, ক্রিপ্টো” সময়ের সাথে সাথে জুয়া তার রূপ বদলেছে । কিন্তু নেশা ? আদৌও কি নেশা বদলেছে? মহাভারতের দ্রৌপদী থেকে আজকের অনলাইন বেটিং এ যেন প্রাচীন সেই মঞ্চ শুধু অভিনেতা নতুন।
কেন মানুষ বারবার হেরে যাওয়ার পরেও জুয়া খেলে?
“ভাগ্য কি বিক্রি হয়?” হয়তো না। কিন্তু মানুষ তবু কেন বারবার ভাগ্যকে বাজিতে রাখে?
মানুষ কেন বারবার জুয়া খেলে এ প্রশ্নের জবাব শুধু অর্থের লোভে সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে আছে মনস্তত্ত্ব, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা এবং ভ্রমের এক জটিল মিশ্রণ। প্রতিবার হারার পরেও জুয়াড়ির মনে হয় “পরের বার সে হয়তো বা জিতবে। এটা আসলে “gambler’s fallacy”। অর্থাৎ মানুষ ভাবে বারবার হারের পর এবার জেতা বাধ্যতামূলক।
অন্যদিকে মনোবিজ্ঞান বলছে, জুয়া মানুষের “reward system” কে টার্গেট করে। কোন ব্যক্তি যখন জুয়া খেলে তখন তার মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক এক অদৃশ্য রাসায়নিক ঝড় তোলে। জয়ের সম্ভাবনার উত্তেজনা ডোপামিনের প্রবাহ বাড়ায়। যার ফলে জুয়াড়ি “জিতবই” বলে মনে করে even after heavy loss.এই “near miss phenomenon” মানুষের ব্রেনে নেশার মতো আসক্তি তৈরি করে।
যদিও কেউ কেউ জীবনের হতাশা, আর্থিক সমস্যা বা মানসিক যন্ত্রণা থেকে পালাতে জুয়াকে আশ্রয় করে। “চাকরি নাই, টাকা নাই জুয়া জিতলে সব ঠিক হয়ে যাবে”।এই আশাটা একজন জুয়ারিদকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়।
জুয়া কি থামবে?
জুয়া মানুষের লোভ আর স্বপ্নের লড়াই। হারানোর ভয়, জয়ের আকাঙ্ক্ষা এই দুটোই মানুষকে বারবার টানে। কঠোর আইন আর সামাজিক সচেতনতা থাকলেও এ নেশা মনের গভীরে গেঁথে থাকে। তাই জুয়া থামাতে হলে প্রথমে লড়তে হবে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে। নাহলে এই খেলা থামবে না কখনো।
রেফারেন্স:
- https://teachers.gov.bd/content/details/1292952
- https://www-britannica-com.translate.goog/topic/gambling?_x_tr_sl=en&_x_tr_tl=bn&_x_tr_hl=bn&_x_tr_pto=tc
- https://bn.m.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A6%
- https://archive.roar.media/bangla/main/history/history-of-casino