Image default
প্রযুক্তি

এআই বদলে দিচ্ছে দুনিয়া: ২০২৫ সালে আপনার প্রস্তুতি কী হওয়া উচিত?

চাকরির বাজার বদলে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ২০২৫ সালের এই বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে ভয়ের বদলে প্রস্তুতি নিলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই হতে পারে আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সুযোগ।

সালটা ২০২৫। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এখন আর কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার ধারণা নয়; এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা যে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিউজফিড স্ক্রল করি, অফিসে যাওয়ার পথে যে ম্যাপ ব্যবহার করি, এমনকি স্মার্টফোনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখি তার সবকিছুই পরিচালনা করছে কোনো না কোনো এআই অ্যালগরিদম। চ্যাটজিপিটি আমাদের জন্য ইমেইল লিখে দিচ্ছে, মিডজার্নি আমাদের ভাবনাকে ছবিতে রূপ দিচ্ছে, আর এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাদের মিটিংয়ের সময়সূচি তৈরি করছে।

এই প্রযুক্তিগত বিপ্লব মানব ইতিহাসের শিল্প বিপ্লব বা ইন্টারনেট বিপ্লবের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাবটি পড়েছে চাকরির বাজারে। এর ফলে জন্ম নিয়েছে এক বিরাট প্রশ্ন এবং একই সাথে এক গভীর উদ্বেগ, “এআই কি আমাদের চাকরি কেড়ে নেবে?”

এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বাস্তবতা হলো, কিছু চাকরির অস্তিত্ব সত্যিই সংকটের মুখে। কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। এআই যেমন কিছু দরজা বন্ধ করছে, তেমনই খুলে দিচ্ছে সম্ভাবনার শত শত নতুন দরজা। যারা এই পরিবর্তনকে ভয় না পেয়ে, এর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে, তারাই হবে এই নতুন যুগের বিজয়ী। 

এআই কীভাবে চাকরির বাজারকে নতুন করে সাজাচ্ছে?

এআই চাকরির বাজারকে ধ্বংস করছে না, বরং এটিকে নতুন করে ‘রিস্ট্রাকচার’ বা পুনর্গঠন করছে। এই পরিবর্তনের মূল দুটি প্রক্রিয়া হলো: অটোমেশন (Automation) এবং অগমেন্টেশন (Augmentation)।

  • অটোমেশন (Automation): এআই সেইসব কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে দিচ্ছে, যেগুলো মূলত পুনরাবৃত্তিমূলক, ডেটা-নির্ভর এবং একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যে কাজগুলো করতে মানুষের মেধার চেয়ে বেশি সময় এবং ধৈর্যের প্রয়োজন হতো, সেই কাজগুলো এখন এআই টুলস মুহূর্তের মধ্যে করে ফেলতে পারে।
অটোমেশন ও অগমেন্টেশন
  • অগমেন্টেশন (Augmentation): এআই মানুষের ক্ষমতাকে কমিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে, বহু ক্ষেত্রে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি একজন মানুষের ‘সহকারী’ বা ‘কো-পাইলট’ হিসেবে কাজ করছে। যেমন একজন প্রোগ্রামার এখন এআই-এর সাহায্যে দ্রুত কোড লিখতে পারছেন, একজন লেখক এআই-এর মাধ্যমে তার টপিক রিসার্চের কাজ সহজ করছেন, এবং একজন ডিজিটাল মার্কেটার এআই ব্যবহার করে গ্রাহকদের আচরণ আরও নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করতে পারছেন।

এর ফলে, চাকরির বাজারের চাহিদা বদলে যাচ্ছে। এখন আর শুধু একটি নির্দিষ্ট কাজ জানার দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না; বরং যে কর্মী এআই টুলস ব্যবহার করে নিজের কাজকে আরও দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে করতে পারবে, তার মূল্যই সবচেয়ে বেশি।

ঝুঁকির মুখে কোন চাকরিগুলো?

এআই-এর উত্থানের ফলে কিছু চাকরি সরাসরি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যে কাজগুলোতে সৃজনশীলতা, জটিল সমস্যা সমাধান বা মানব সুপারভিশনের প্রয়োজন কম, সেগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২৫ সালে যে কাজগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে:

  • ডেটা এন্ট্রি অপারেটর: বিশাল পরিমাণ ডেটা কপি-পেস্ট বা একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে সাজানোর কাজ এআই সফটওয়্যার মানুষের চেয়ে হাজার গুণ দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে করতে পারে।
  • বেসিক কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি: সাধারণ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য বা অভিযোগ শোনার জন্য এখন চ্যাটবট এবং এআই-ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট অনেক বেশি কার্যকর। শুধুমাত্র জটিল সমস্যাগুলোর জন্যই এখন মানুষের প্রয়োজন হচ্ছে।
কন্টেন্ট জেনারেটিং উইথ চ্যাটজিপিটি
  • সাধারণ কনটেন্ট রাইটিং ও অনুবাদ: যারা শুধুমাত্র তথ্যকে এক জায়গা থেকে নিয়ে অন্য ভাষায় অনুবাদ করেন বা সাধারণ SEO আর্টিকেল লেখেন, তাদের কাজ এআই (যেমন চ্যাটজিপিটি) দিয়ে সহজেই করানো যাচ্ছে।
  • টেলিমার্কেটার: স্বয়ংক্রিয় ডায়ালার এবং এআই-চালিত ভয়েসবট এখন টেলিমার্কেটিং-এর কাজগুলো দখল করে নিচ্ছে।
  • বুককিপিং ও ক্যাশিয়ার: হিসাব-নিকাশের রুটিন কাজ এবং পেমেন্ট প্রসেসিং এখন উন্নত সফটওয়্যার এবং সেলফ-চেকআউট সিস্টেমের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।

এখানে একটি বিষয় বোঝা জরুরি, ঝুঁকিটা পুরো পেশার জন্য নয়, বরং পেশার ভেতরের পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলোর জন্য। একজন সৃজনশীল লেখক, যিনি গভীর বিশ্লেষণ বা গল্প লিখতে পারেন, তার চাকরি নিরাপদ। কিন্তু যিনি শুধু সাধারণ তথ্যমূলক লেখা তৈরি করেন, তার জন্য সময়টা কঠিন।

নতুন দিগন্ত: এআই-এর হাত ধরে তৈরি হওয়া নতুন সুযোগ

এআই যেমন কিছু চাকরিকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলছে, তেমনই জন্ম দিচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন কিছু পেশা এবং সুযোগের।

  • নতুন ধরনের চাকরি:
    • এআই প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ার (AI Prompt Engineer): এআই মডেলগুলোর (যেমন চ্যাটজিপিটি বা মিডজার্নি) কাছ থেকে সবচেয়ে সেরা এবং নিখুঁত আউটপুট বের করে আনার জন্য সঠিক প্রশ্ন বা ‘প্রম্পট’ লেখা একটি নতুন এবং অত্যন্ত মূল্যবান দক্ষতায় পরিণত হয়েছে।
    • এআই এথিক্স অফিসার (AI Ethics Officer): এআই যেন কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা লিঙ্গের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ না করে এবং এর ব্যবহার যেন নৈতিকভাবে সঠিক হয়, তা নিশ্চিত করা একটি বড় দায়িত্ব।
এ আই মডেলকে ট্রেইন করা হচ্ছে
  • এআই ট্রেইনার (AI Trainer): এআই মডেলগুলোকে আরও উন্নত করার জন্য তাদের প্রচুর পরিমাণে ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। এই ডেটা লেবেলিং এবং প্রশিক্ষণের কাজটি মানুষের দ্বারাই করানো হয়।
  • এআই টুলস কনসালটেন্ট (AI Tools Consultant): বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের কাজের প্রক্রিয়াতে কোন এআই টুল ব্যবহার করলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে, সেই পরামর্শ দেওয়ার কাজটিও একটি নতুন পেশা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
  • ফ্রিল্যান্সিং জগতে বিপ্লব:
    কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। একজন ফ্রিল্যান্সার এখন এআই-এর সাহায্যে তার কাজের গতি এবং পরিধি দুটোই বাড়াতে পারছেন। যেমন:

    • একজন গ্রাফিক ডিজাইনার এখন এআই দিয়ে দ্রুত প্রাথমিক ডিজাইন তৈরি করে ক্লায়েন্টকে একাধিক অপশন দেখাতে পারছেন।
    • একজন ভিডিও এডিটর এআই টুলস ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাবটাইটেল তৈরি বা ভিডিওর অপ্রয়োজনীয় অংশ কেটে ফেলতে পারছেন।
    • একজন ডিজিটাল মার্কেটার এআই দিয়ে অল্প সময়ে একাধিক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য কনটেন্ট তৈরি করতে পারছেন।

এর ফলে, ফ্রিল্যান্সাররা এখন আরও বেশি প্রজেক্ট নিতে পারছেন এবং তাদের আয়ের সম্ভাবনাও বহুগুণ বেড়ে গেছে।

আপনার প্রস্তুতি: ২০২৫ সালে এআই শেখার সেরা উপায়

এআই-এর যুগে সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি হলো মানসিকতার পরিবর্তন। এআই-কে শত্রু না ভেবে, একে নিজের সবচেয়ে শক্তিশালী সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। নিচে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য প্রস্তুতির একটি রূপরেখা দেওয়া হলো:

  • সাধারণ মানুষের জন্য:
    • ব্যবহার শুরু করুন: এআই শেখার সেরা উপায় হলো এটি ব্যবহার করা। ChatGPT, Google Gemini, Microsoft Copilot-এর মতো টুলগুলো বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। এগুলো দিয়ে ইমেইল লেখা, তথ্য খোঁজা বা নতুন কিছু শেখার অভ্যাস করুন।
    • আপডেটেড থাকুন: ইউটিউবে বা বিভিন্ন টেক ওয়েবসাইটে এআই নিয়ে যে নতুন নতুন খবর আসছে, সেগুলোর উপর নজর রাখুন।
    • প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং শিখুন: কীভাবে প্রশ্ন করলে এআই সবচেয়ে ভালো উত্তর দেয়, এই শিল্পটি আয়ত্ত করার চেষ্টা করুন।
  • পেশাজীবীদের জন্য:
    • নিজের কাজকে বিশ্লেষণ করুন: আপনার কাজের কোন অংশগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক, তা খুঁজে বের করুন এবং সেই কাজগুলো করার জন্য কোনো এআই টুল আছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা করুন।
    • আপস্কিলিং করুন: আপনার পেশা সম্পর্কিত এআই কোর্স করুন। যেমন আপনি যদি মার্কেটার হন, তবে “AI in Digital Marketing”-এর উপর কোনো অনলাইন কোর্স করতে পারেন।
  • ছাত্রছাত্রী এবং যারা এআই বিশেষজ্ঞ হতে চান:
    • প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা: কম্পিউটার সায়েন্স, ডেটা সায়েন্স বা এআই-এর উপর স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বর্তমান চাকরির বাজারে অনেক মূল্যবান। 
    • অনলাইন কোর্স: Coursera, edX, Udemy-র মতো প্ল্যাটফর্মে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এআই কোর্স পাওয়া যায়। অ্যান্ড্রু এনজি-র (Andrew Ng) মেশিন লার্নিং কোর্সটি এই ক্ষেত্রে কিংবদন্তিতুল্য।
    • বাংলাদেশে এআই শেখার সুযোগ: বর্তমানে বাংলাদেশেও অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এআই এবং মেশিন লার্নিং-এর উপর বিভিন্ন ট্রেনিং এবং বুটক্যাম্প আয়োজন করছে। সরকারের ICT Division থেকেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
    • হাতে-কলমে কাজ: শুধু শিখলেই হবে না, নিজে থেকে প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে। ডেটা সায়েন্সের জন্য Kaggle-এর মতো প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বা প্রোগ্রামারদের জন্য GitHub-এ নিজের এআই প্রজেক্ট তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক বিশাল ঢেউয়ের মতো, যা আমাদের জীবনের প্রতিটি প্রান্তকে স্পর্শ করতে চলেছে। এই ঢেউকে ভয় পেয়ে তীরে বসে থাকলে চলবে না, বরং সার্ফিং শিখে এই ঢেউয়ের উপর নিজেকে সাহসের সাথে এগিয়ে নিতে হবে। ২০২৫ সালের বাস্তবতা হলো, এআই আমাদের সহকারী, আমাদের সহযোগী। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যত দ্রুত এই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে পারবে এবং এর সাথে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করবে, ভবিষ্যৎ তারই।

তথ্যসূত্র –

Related posts

কাজের চাপ কমাবে এই ১০টি এআই টুল

কিভাবে ফেসবুক থেকে আয় করতে পারেন?

ইউটিউবে ভিউ পড়ে যাওয়ার কারণ

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More