Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

যে বাজারে বিয়ের জন্য বিক্রি হচ্ছে মেয়ে, জানুন রোমাদের বিয়ের হাটের বাস্তবতা

একটি খোলা মাঠে আকাশের নিচে বসেছে এক জমজমাট মেলা। সেখানে রঙিন পোশাকে সেজে এসেছে তরুণীরা। অনেকেই মুখে মেকআপ, কানে দুল, হাতে ঝকমকে চুড়ি। ঠিক সেখানেই আবার আছে আরও একদল তরুণ ছেলে। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, তারা হয়তো মেলাতে ঘুরতে কিংবা জিনিসপত্র কিনতে এসেছে। 

কিন্তু, না………তারা ঘুরতে বা জামা-কাপড় কিনতে আসেনি। তারা এসেছে নিজেদের জন্য জীবনসঙ্গিনী খুঁজতে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, মেয়েরাও এখানে এসেছে নিজেকে ‘বিক্রি’ করতে! 

চমকে উঠলেন তাই না? হ্যাঁ, এটা কোনো গল্প নয়, বরং বাস্তবতা। এটি হচ্ছে “বুলগেরিয়ার রোমা সম্প্রদায়ের ম্যারিজ মার্কেট”। শতাব্দী ধরে চলে আসা এই প্রথা শুধু বিয়ে নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

কীভাবে চলে এই “বিয়ের বাজার”, মেয়েরা কীভাবে এতে অংশ নেয়, আর ছেলেরাই বা কিভাবে তাদের পছন্দ করে! এবং এত সমালোচনার পরেও, কেন এই হাট আজও টিকে আছে রোমা সমাজে?

বুলগেরিয়ার রোমাদের ইতিহাস

রোমা বা ‘জিপসি’ নামটা আমরা অনেকেই শুনেছি। কিন্তু এদের ইতিহাসটা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। প্রায় এক হাজার বছর আগে বুলগেরিয়াতে রোমাদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন ভারতের রাজস্থান ও পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে। তখন তারা যাযাবরদের মত জীবন যাপন করতো। বিভিন্ন সময়ে তারা পারস্য, তুরস্ক, গ্রীস হয়ে ইউরোপে পৌঁছায়। বুলগেরিয়ায় আজ যাদের আমরা রোমা বলি, তারা সেই যাযাবরদেরই উত্তরসূরী।

তবে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘জিপসি’ শব্দটি মূলত ইউরোপীয় উপনিবেশিকদের দেওয়া নাম, যা অনেক রোমা অপমানজনক বলে মনে করেন। তারা নিজেদের পরিচয় দেন ‘রোমা’ নামে। মূলত তারা একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবেই পরিচিতি পায়। তাদের নিজস্ব ভাষাও রয়েছে, আর তা হলো ‘রোমানি’। এছাড়াও তাঁদের রয়েছে অনন্য সঙ্গীত, পোশাক, এবং জীবনদর্শন।

রোমা জনগোষ্ঠী

বর্তমান বুলগেরিয়ায় রোমা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। সংখ্যার দিক থেকে তারা দেশটির অন্যতম বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী হলেও, বাস্তবে তারা সবচেয়ে বঞ্চিত ও প্রান্তিক। আজও অনেক রোমা পরিবার বসবাস করে জরাজীর্ণ ঘরে। যেখানে নেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, নেই কোন পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা। এমনকি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরির ক্ষেত্রেও তারা বহু পিছিয়ে। এই প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা আর সামাজিক বৈষম্যের কারণে তারা মূলস্রোত থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তবু এই দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর সুযোগের অভাবের মাঝেই রোমাদের অনেক পুরনো সামাজিক প্রথা এখনও টিকে আছে। আর সেই পুরনো রীতিরই একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ হলো,“ম্যারিজ মার্কেট” বা বিয়ের হাট।

রোমাদের বিয়ের হাট

“বিয়ের হাট”……এই কথাটি শুনলেই প্রথমে মনে হতে পারে, কোনো পুরোনো লোককথা বা কোনো নাটকের গল্প। কিন্তু না, এটি একেবারে বাস্তব একটি আয়োজন। প্রতিবছর বসন্তে বুলগেরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্টারা জাগোরা শহরে এই হাট বসে।

এসময় মেয়েরা সেজে-গুজে, রঙিন পোশাক পরে, হাতে গয়না পরে পরিবারের সঙ্গে নির্দিষ্ট স্থানে এসে উপস্থিত হয়। ছেলেরাও আসে তাদের মা-বাবা বা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই, নিজের জন্য বা সন্তানের জন্য ভালো জীবনসঙ্গী খুঁজে পাওয়া। 

বিয়ের বাজারের জন্য সাজগোজ করছেন নারীরা

এটি জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক উন্মুক্ত মঞ্চ। এখানে প্রেম হয় হাটের ভিড়েই; পছন্দ-অপছন্দও হয় প্রকাশ্যেই। আবার এর সবটাই হয় পরিবার ও সমাজের সম্মতিতেই। এই হাটে একপলকের দৃষ্টিতে শুরু হতে পারে নতুন সম্পর্কের গল্প। কখনো চোখে চোখ পড়তেই গড়ে ওঠে বোঝাপড়া, কখনোবা দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছায় দুই পক্ষ। এমনকি, অনেক সময় আলোচনায় চলে আসে দেনমোহরের অঙ্ক বা যৌতুকের পরিমাণও।

জেনে অবাক হবেন, এই দিনটির জন্য প্রতিটি রোমা মেয়ে, প্রায় বছরজুড়ে অপেক্ষা করে। অনেকে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে, মেয়েরা কীভাবে সেজেগুজে এই বিয়ের হাটের জন্য নিজেকে তৈরি করে। তাই প্রথমবার অংশ নিতে যাওয়া মেয়েদের চোখে থাকে উচ্ছ্বাস, ভয় আর অনেক অনেক স্বপ্ন। এই বাজারের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে দোকান থেকে কেনা হয় ঝকঝকে পোশাক, অলংকার, হিল জুতো। অনেকেই মেকআপ করে, চুলে ফ্লাওয়ার ক্লিপ লাগায়, কারও চোখে থাকে চোখ ধাঁধানো কাজল। 

বিয়ের বাজারের উপযুক্ত মেয়ে

বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া অধিকাংশ মেয়ের বয়স হয় ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে। এই বয়সেই তাদের পরিবার চায় তারা বিয়ে করে তাদের কন্যা নতুন পরিবারে পা রাখুক। অনেক মেয়েই চায় ভালো, সচ্ছল কোনো পরিবারে বিয়ে হোক, যাতে তাদের ভবিষ্যৎ একটু নিরাপদ হয়। আর ছেলেরা সাধারণত আসে পরিবারের সদস্য কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। বাজারে এসে তারা মেয়েদের চালচলন, পোশাক-আশাক, ও সাজসজ্জা পর্যবেক্ষণ করে। এমনকি মেয়েদের কথা বলার ভঙ্গিও হয়ে ওঠে আলোচনার বিষয়। হাটের ভিড়ে কখনো কখনো দু’জনের মাঝে কানে কানে ছোটো করে কথাও হয়। আর এটিই হলো অলক্ষ্যে গড়ে ওঠে একটি সম্ভাব্য সম্পর্কের সূচনা। আবার অনেক সময় মেয়েরা গানের তালে তালে নাচেও অংশ নেয়।

আরো আশ্চর্যের বিষয়, এই হাটে কেবল পছন্দ-অপছন্দই নয়, বিয়ের আলোচনা অনেক সময় বেশ দ্রুতই এগিয়ে যায়।  কিছুক্ষেত্রে দেখা যায়, বিয়ের আগেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়, আর একেই বলা হয় “যৌতুক”। তবে এটিকে শুধুমাত্র টাকার হিসাব-নিকাশ বললে ভুল হবে। এই লেনদেন অনেক সময় দুই পরিবারের সামাজিক মর্যাদা, সম্পর্কের গভীরতা, ও পারস্পরিক সমঝোতার প্রতীকও হয়ে ওঠে। যে মেয়ে দেখতে যত বেশি সুন্দর তার দামও তত বেশি হয়।

বিয়ের বাজারে পাত্র-পাত্রী কথা বলছেন

তবে এই বিয়ের হাটের আনন্দ আর উৎসবের আড়ালে লুকিয়ে থাকে গভীর অর্থনৈতিক চাপ। রোমা সমাজে এই অনুষ্ঠান শুধু একটা সামাজিক মিলনমেলা নয়, বরং অনেক পরিবারের জন্য বড় ধরনের আর্থিক বোঝা। মেয়েদের পরিবার অনেক সময় এই বিশেষ দিনের জন্য ঋণ নেয়। কারণ, সাজসজ্জা, নতুন পোশাক, গয়না, এবং অন্য আনুষঙ্গিক খরচগুলো কিন্তু নিতান্ত কম নয়। 

রোমা ম্যারেজ মার্কেট বিতর্ক

তাই এই প্রথাটিকে ঘিরে ইউরোপজুড়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বহু ইউরোপীয় নাগরিক এই দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে চোখ কপালে তোলেন। তাঁদের অনেকের কাছে এটি যেন একবিংশ শতাব্দীর বুকে দাঁড়িয়ে, নারীদের ‘পণ্যে রূপান্তরের’ উদাহরণ। কারও কারও ভাষায়, এটি আধুনিক দাসত্বেরই আরেক রূপ। যেখানে মেয়েদের ‘দাম’ হয়, পছন্দ-অপছন্দ হয় জনসমক্ষে, আর জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় একটি লেনদেনের মতো।

কিন্তু রোমা সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। তারা বলেন, এটি তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে। তাঁদের মতে, বাইরের কারও পক্ষে এই আয়োজনের আবেগ, সামাজিক কাঠামো, কিংবা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। তাই বাইরে থেকে দেখে, একে সমালোচনা করা যেমন সহজ, তেমনি ভুল বোঝার সম্ভাবনাও প্রবল।

BBC, VICE, Al Jazeera সহ বহু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই “ম্যারিজ মার্কেট” নিয়ে রিপোর্ট করেছে।  অনেক রিপোর্টে উঠে এসেছে সেই তরুণীদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা। যেমন- শিশুবয়সে বিয়ে, শিক্ষার অভাব, কিংবা পারিবারিক চাপে সিদ্ধান্ত নেওয়ার গল্প। কারো কারো চোখে ছিল স্বপ্নভঙ্গের কান্না, আবার কারো মুখে ছিল নীরব সম্মতি। 

সব প্রতিবেদন শুধু নেতিবাচক আলোতেই আলোড়িত হয়নি। কিছু রিপোর্ট চেষ্টা করেছে এই বাজারের ভেতরের গল্পগুলোও তুলে ধরতে। যেখানে মেয়েরা নিজের পছন্দে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়, পরিবার পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে, এবং রোমা সংস্কৃতির একটি বিশেষ অধ্যায় রক্ষা পায়। এমনও দেখা গেছে, মেয়েরা নাচে-গানে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের উপস্থাপন করছে, পরিবারকে পাশে রেখে নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছে।

রোমা বিয়ের বাজারের ভবিষ্যৎ

তবে সময় বদলাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় রোমা সমাজের তরুণ-তরুণীদের ভাবনাতেও এসেছে পরিবর্তন। এখনকার রোমা মেয়েরা আগের মতো শুধু সংসার গড়ার স্বপ্নে সীমাবদ্ধ নয়। তারা নিজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে গড়তে চায়। আবার, অনেক তরুণী স্পষ্টভাবেই এই আয়োজন থেকে নিজেকে দূরে রাখে। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে, কেউ নীরবে সরে দাঁড়ায়।

তবে সব ক্ষেত্রেই গল্পটা এতটা সহজ নয়। পরিবার ও সমাজের চাপ ,বিশেষ করে যেখানে সম্মান আর রীতি মিশে গেছে একসূত্রে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অনেকের পক্ষেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে কিছু মেয়ে আজও এই হাটে অংশ নেয়, কখনো অনিচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়ে। 

তবে এর মানেই এই নয় যে, এই হাট শুধু চাপের প্রতীক। কারো কারো কাছে এটি একটি উৎসব, একটি সামাজিক মিলনমেলা। সারা বছর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা না হলেও, এই আয়োজনের সময় সবাই একত্রিত হয়। গান বাজে, খাবার তৈরি হয়, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠে। অনেক তরুণী শুধু বিয়ের জন্যই নয়, বরং সংস্কৃতির অংশ হিসেবে, পরিবারের পাশে দাঁড়াতে কিংবা নিজের উপস্থিতি প্রকাশ করতেই এই উৎসবে অংশ নেয়।

নিশ্চিতভাবে রোমা জাতির “ম্যারিজ মার্কেট” আমাদের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু তাদের সমাজের ভেতরে গেলে বোঝা যায়, এটি এক দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার এক প্রথাগত উপায়। যেখানে বিয়ে শুধু সম্পর্ক নয়, বরং নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতির প্রতীক। তবে সমালোচনা করতে গেলে আগে বোঝা দরকার যে, সংস্কৃতি সবসময় সাদাকালো হয় না। কখনো কখনো তা হয় ধূসর, যেখানে প্রশ্ন, বেদনা, আশা আর বাস্তবতা একসঙ্গে মিশে থাকে। রোমা সমাজের এই ম্যারিজ মার্কেট তারই এক জটিল রূপ, যা একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে পরিবর্তনের টানাপোড়েন নিয়ে এগিয়ে চলছে। 

তথ্যসূত্র-

Related posts

থিসিয়াসের জাহাজ রহস্য ও অদ্ভুত সব দ্বন্দ্ব

admin

কেন জাপানে ১ লাখের কাছাকাছি মানুষ ১০০ বছরের বেশি বেঁচে আছেন?

বাংলার ভূত: মেছোভূত থেকে নিশির ডাক

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More