Image default
নগর পরিচিতি

ভারতের বিহার: গৌতম বুদ্ধের দেশ থেকে অপরাধের রাজ্য

যে বিহার এক সময় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ছিলো, আজ সেটা অপরাধীদের স্বর্গে পরিণত হয়েছে। এমনকি  ১৯৮০ সালে অর্থনীতিবিদ আশিষ বোস বিহারকে অসুস্থ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিধর দেশ ভারতের এই রাজ্যটির আজ এমন বেহাল দশা কেন? 

আজকের দিনে যদি আপনাকে বিহার সম্পর্কে কল্পনা করতে বলা হয়, তাহলে প্রথমেই আপনার মাথায় ভেসে উঠবে ভারতের অন্যতম দরিদ্র একটি রাজ্যের ছবি। যেখানে নেই বড় কোনো শিল্প, নেই কোনো শিক্ষার যথাযথ প্রসার। এছাড়াও, রিলস জুড়ে ভোজপুরি গান, চটুল ভিডিওগুলো বিহারেরই একটি অংশের ছবি। কিন্তু ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন জ্ঞানের ভান্ডার বললে যে নামটি আমাদের মাথায় আসে, তা হলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময়, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে পণ্ডিতেরা পড়াশুনা করতে আসতেন। আর এই নালন্দা ছিল মগধ রাজ্যে, যার বর্তমান নাম বিহার। 

যে বিহার এক সময় জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ছিলো, আজ সেটা অপরাধীদের স্বর্গে পরিণত হয়েছে। এমনকি  ১৯৮০ সালে অর্থনীতিবিদ আশিষ বোস বিহারকে অসুস্থ রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিধর দেশ ভারতের এই রাজ্যটির আজ এমন বেহাল দশা কেন? 

আজকের লেখায় আমরা বিহার সম্পর্কে এমন অনেক প্রশ্নেরই উত্তর খুজবো, পাশাপাশি এই রাজ্যটি সম্পর্কে জানবো নানা জানা-অজানা গল্প। 

বিহারের অবস্থান

বিহার ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। মানচিত্রে লক্ষ করলে দেখা যায়, এর পূর্বে  রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরে নেপাল, দক্ষিণে ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমে আছে উত্তর প্রদেশ। এই রাজ্যের আয়তন প্রায় ৯৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। ভৌগলিকভাবে বিহার যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি এর ইতিহাসও বেশ  সমৃদ্ধ ও প্রাচীন।

ম্যাপ

বিহারের ইতিহাস

আজকের এই বিহারই প্রাচীন কালে ভারতের শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেসময় এই অঞ্চলের নাম ছিল মগধ। আর এখান থেকেই মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের মতো শক্তিধর রাজবংশগুলো উঠে এসেছিল। এমনকি প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে সম্রাট অশোকের হাত ধরে মগধ শুধু রাজনৈতিক শক্তির নয়, বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোক মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে শাসন চালাতেন। এই পাটালিপুত্র বর্তমানে পাটনা নামে পরিচিত। তাঁর শাসনকালেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারত থেকে বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করে। পাশাপাশি জৈন ধর্মেরও জন্মভূমি বিহার, মহাবীর এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ফলে এই অঞ্চল প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।

মগধ রাজ্যের ম্যাপ

মধ্যযুগে বিহার ইসলামি শাসনের অধীনে আসে এবং দিল্লি সুলতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ হয়। পরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে এটি বাংলার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯১২ সালে বিহারকে আলাদা প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামেও বিহারের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই শুরু হয়েছিলো চম্পারণ সত্যাগ্রহ, যেখানে মহাত্মা গান্ধী প্রথম গণআন্দোলন পরিচালনা করেন। এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আজকের দিনে বিহার ভারতের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। যার ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূলধারার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

বিহারের সংস্কৃতি

বিহারের সংস্কৃতি মূলত ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। সংস্কৃত শব্দ ‘বিহার’ এর অর্থ মঠ বা বাসস্থান। কারণ এই অঞ্চল ছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের জন্মভূমি এবং অসংখ্য মঠ, স্তূপ ও শিক্ষাকেন্দ্রের কেন্দ্রস্থল। এখানকার নালন্দা ও বিক্রমশীলা মহাবিহার শুধু ভারতের নয়, সমগ্র এশিয়ার শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল।

লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বিহার সমৃদ্ধ। ভোজপুরি, মৈথিলি ও মগধি এই তিনটি ভাষাভিত্তিক অঞ্চলের লোকগান, নৃত্য ও নাট্যধারা এখনো জনপ্রিয়। বিশেষ করে মৈথিলি পেইন্টিং বা মধুবনী শিল্প আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, যেখানে উজ্জ্বল রঙে কাগজ বা কাপড়ে আঁকা হয় দেবদেবী, প্রকৃতি ও লোককাহিনি। ভোজপুরি লোকগান, বিশেষ করে বিয়ে ও উৎসবের সময় গাওয়া কাহরাওয়া ও সোহর সংগীত মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

বিহারের পোশাক পড়া নারী ও পুরুষ

উৎসবের ক্ষেত্রেও বিহার অনন্য। ছট পূজা এখানকার সবচেয়ে বড় উৎসব। সূর্যদেবতার প্রতি নিবেদিত এই পুজা নদী বা পুকুরের তীরে মহাসমারোহে পালিত হয়। এছাড়া হোলি, দীপাবলি, ঈদ, বৈশাখী, ও বিভিন্ন গ্রামীণ মেলা বিহারের সামাজিক জীবনে বিশেষ রঙ যোগ করে।

এখানকার খাদ্যসংস্কৃতিও বেশ সমৃদ্ধ। বিহারের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে আছে লিট্টি-চোখা, খিচড়ি, পোস্তদানা কারি, আর মিষ্টির মধ্যে খাজা ও থেকুয়া বিশেষ জনপ্রিয়। পোশাকে পুরুষেরা সাধারণত ধুতি, কুর্তা ও গামছা ব্যবহার করে, আর নারীরা শাড়ি পরে। সব মিলিয়ে বিহার হলো এমন এক সাংস্কৃতিক ভূখণ্ড যেখানে প্রাচীন ইতিহাস, ধর্মীয় ঐতিহ্য, লোকশিল্প, ভাষা, সংগীত ও উৎসব মিলেমিশে এক বহুমাত্রিক জীবনধারা তৈরি করেছে।

বিহারের দর্শনীয়স্থান

বিহারকে তার দর্শনীয় স্থানগুলোর মাধ্যমে আরো ভালো ভাবে চেনা যায়। এখানে রয়েছে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের অমূল্য তীর্থস্থান, প্রকৃতির অরণ্যভূমি আর পাহাড়ি সৌন্দর্য। 

মহাবোধি মন্দির 

প্রথমেই যাওয়া যাক, বিহারের গয়া জেলার বোধগয়ার মহাবোধি মন্দির কমপ্লেক্স – এ। এটি দেখতে এক বিশাল পিরামিডের মতো, আর এর চারপাশে খোদাই করা আছে বুদ্ধের জীবনচিত্র। এখানেই গৌতম বুদ্ধ জ্ঞানলাভ করেছিলেন, তাই সারা বিশ্বের বৌদ্ধ ভক্তরা এখানে ভিড় জমায়। মন্দিরের পাশে রয়েছে বোধিবৃক্ষ, সবুজ পাতায় ঢাকা শান্ত বাতাসে দুলতে থাকা এই বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয় ইতিহাস যেন আপনাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

গ্রেট বুদ্ধা স্ট্যাচু

এখানকার আরেক আকর্ষণ হলো গ্রেট বুদ্ধা স্ট্যাচু। ৮০ ফুট উঁচু এই ভাস্কর্যটি লাল গ্রানাইট ও সাদা পাথরে তৈরি। তৎকালীন ১৪তম দালাই লামা এই মূর্তির উন্মোচন করেন। এই মূর্তির ভেতরে মোট ১০টি ছোট ছোট বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। যখন সূর্যের আলো এর গায়ে পড়ে, তখন মনে হয় যেন বুদ্ধ স্বয়ং শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

রয়েল ভুটানি মঠ 

এছাড়া রয়েছে রয়েল ভুটানি মঠ, যেখানে ভুটানি স্থাপত্যের ছোঁয়া চোখে পড়ে। এটি মূলত ভুটান সরকারের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বোধগয়ায় ভুটানি বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটানো এবং ভুটানি ভিক্ষু ও ভক্তদের জন্য ধ্যান-চর্চার একটি কেন্দ্র তৈরি করা। যেহেতু গৌতম বুদ্ধ এখানে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, তাই এই স্থানকে ভুটানি বৌদ্ধরা অত্যন্ত পবিত্র মনে করেন। কাঠ ও পাথরের সূক্ষ্ম কারুকাজ, দোতলা গঠন এবং দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ প্রতীক এই মঠটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। এর ভেতরে বিশাল এক ধ্যানকক্ষ রয়েছে, যেখানে সোনালী বুদ্ধমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। এই মঠের দেয়ালজুড়ে রঙিন ফ্রেস্কো পেইন্টিং বা ভুটানি চিত্রশিল্প দেখা যায়, যেখানে বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনী ও ধর্মচক্রের উপাখ্যান ফুটে উঠেছে।

রয়েল ভুটানি মঠ

নালন্দা মহাবিহার

বৌদ্ধ ঐতিহ্যের পর এবার জ্ঞানের অমূল্য ভাণ্ডার নালন্দা মহাবিহারে আসা যাক। আজ এটি ধ্বংসাবশেষ হলেও একসময় এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্ডিতরা পড়তে আসতেন। বিশাল এক কমপ্লেক্সে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১০টি মঠ  এবং ৬টি বড় মন্দির  ছিল নালন্দা মহাবিহারের মূল অংশ। চারপাশে উঁচু ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা এই মহাবিহারের ভেতরে ছিল শিক্ষার্থীদের থাকার কক্ষ, ধ্যানকক্ষ, প্রার্থনাগৃহ, পাঠাগার ও বাগান। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল বিশাল পাঠাগার “ধর্মগঞ্জ”। তিনতলা বিশিষ্ট এই গ্রন্থাগারে অসংখ্য পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল, যা নালন্দাকে জ্ঞানচর্চার এক অনন্য কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়।

আর এর পাশে রয়েছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর, যেখানে পাওয়া যায় বুদ্ধমূর্তি, মাটির ফলক আর প্রাচীন পান্ডুলিপি। এই জাদুঘরে প্রায় ১৩,০০০ এরও বেশি প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত আছে। যারা নালন্দা ভ্রমণ করেন, তাদের কাছে এই জাদুঘর একটি বিশেষ আকর্ষণ।

নালন্দা মহাবিহার

মহাবীর মন্দির

বিহারের ধর্মীয় বৈচিত্র্য সত্যিই বিস্ময়কর। আর তাই পাটনা শহরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে মহাবীর মন্দির। এই মন্দিরের ভেতরে ঢুকলেই দেখা যায় ভক্তদের ভিড়, ঘণ্টাধ্বনি আর ধূপের গন্ধ। এখানে রামভক্ত হনুমানকে দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই মন্দিরে আন্তরিক মনে প্রার্থনা করলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। তাই হিন্দু ভক্তদের কাছে এটি শুধু মন্দির নয়, বরং এক পবিত্র আশ্রয়স্থল।

শ্রী হরমন্দির জি পাটনা

আবার, সোনালি গম্বুজ আর সাদা মার্বেলের দেয়ালে মোড়ানো তখত শ্রী হরমন্দির জি পাটনা সাহিব যেন বিহারের প্রশান্তির এক প্রতীক। এটি শিখদের দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং-এর জন্মস্থান। এই গুরুদুয়ারার ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় ধর্মীয় শোভাযাত্রা, ভজন আর সেবার পরিবেশ। এখানে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শিখ ধর্মাবলম্বীরা আসেন প্রার্থনা করতে। শুধু শিখদের জন্য নয়, শান্তি আর সমতার প্রতীক হিসেবে এ স্থান সবার কাছেই সমান আকর্ষণীয়।

শ্রী মহাবীরস্বামী জৈন জল মন্দির

আর যারা জৈন ধর্মের অনুসারী আছেন, তারা অবশ্যই ঘুরে যাবেন শ্রী মহাবীরস্বামী জৈন জল মন্দির। রাজগির শহরে অবস্থিত এই মন্দির যেন প্রকৃতির কোলে সাজানো এক রত্ন। চারপাশে জলে ঘেরা সাদা মার্বেলের মন্দিরটিকে দূর থেকে দেখলেই মনে হয় ভাসছে।  জৈন অনুসারীদের কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান। 

শেরশাহ সুরি সমাধি

বিহারের আরেক বড় আকর্ষণ শেরশাহ সুরি সমাধি। শেরশাহ সুরি ছিলেন দিল্লির সিংহাসনের অধিকারী এবং গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নির্মাতা। লাল বেলেপাথরে তৈরি এই সমাধিটি পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এটি দেখলে মনে হয় যেন এক ভাসমান প্রাসাদ। মুঘল স্থাপত্যের অনন্য উদাহরণ এই সমাধির দরজায় আর দেয়ালের সূক্ষ্ম খোদাই আর নকশা চোখে পড়ার মতো। তাই এই সমাধি শুধু স্থাপত্য নয়, বরং ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। 

শেরশাহ সুরি সমাধি

বারাবর গুহা

যারা প্রকৃতিপ্রেমী, তাদের জন্য রয়েছে গয়া জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত বারাবর গুহা। অবাক করা বিষয় হলো, পাহাড় কেটে তৈরি এই গুহার দেয়াল এত মসৃণ যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। ধারণা করা হয়, মৌর্য সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য এগুলো খোদাই করিয়েছিলেন। ভেতরে ঢুকলেই এর শীতল পরিবেশ আর অদ্ভুত নীরবতা আপনাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যাবে।

বাল্মীকি টাইগার রিজার্ভ

একই ভাবে বিহারের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত বাল্মীকি টাইগার রিজার্ভ হলো প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য আরেকটি স্বর্গ। সবুজ অরণ্য, বয়ে যাওয়া নদীর ধারা আর পাখির কলতান পুরো জায়গাটিকে এক প্রাণবন্ত চিত্রকর্মে পরিণত করে। এখানে বাঘ, হাতি, হরিণ, চিতা আর শতাধিক প্রজাতির পাখি বাস করে। সকালে সূর্যের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়লে জঙ্গলের ভেতর তৈরি হয় স্বপ্নময় পরিবেশ।

বিহার রাজ্য কেন আজ বিতর্কিত

তবে, ইতিহাস ঐতিহ্য দর্শনীয় স্থানে সমৃদ্ধ এই বিহার রাজ্য কেন আজ বিতর্কিত? খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি বা যেকোনো ধরনের সহিংসতায় এই রাজ্য ভারতের শীর্ষে রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, আজও যখন কোনো ট্রেন বিহারের মধ্য দিয়ে যায়, ডাকাতি হয়ে যায় ভেবে যাত্রীরা আতঙ্কিত থাকে। যেখানে ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলো প্রযুক্তি, শিক্ষা ও বিভিন্ন সেক্টরের দিকে এগোচ্ছে, সেখানে বিহার কেন ক্রমশ কাস্ট, অপরাধ এবং নোংরা রাজনীতির জালে আটকে পড়ছে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো,বিহারের এই পতনের জন্য আসলে দায়ী কে?

বিহারের রাজনীতি

বিহারের লোকসংস্কৃতি যেমন ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ, তেমনই এর রাজনীতিও এর দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। স্বাধীনতার পর, প্রথম দিকে কংগ্রেস পার্টি রাজ্যের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিল। জওহরলাল নেহরু ও অন্যান্য নেতা শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যখাত উন্নয়ন এবং অবকাঠামো নির্মাণে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে গ্রামীণ জনসংখ্যার বড় অংশ তখনও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে ছিল। 

রাজনীতিও বিহারের পতনের অন্যতম আরেকটি কারণ। স্বাধীনতার পর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জাত প্রথার ফলে রাজনীতিতে উচ্চ জাতির প্রভাব প্রাধান্য বিস্তার কারণে, নিম্নবর্গের মানুষরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। 

বর্তমানে বিহারের রাজনীতি মূলত বিজেপি, আরজেডি, জেডিইউ এবং কংগ্রেসকে ঘিরেই আবর্তিত। জাতীয় রাজনীতিতেও বিহারের গুরুত্ব অনেক, কারণ এখানকার ভোটসংখ্যা দেশের নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখে। বিজেপি এখানে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে, অন্যদিকে নীতীশ কুমারের জেডিইউ বারবার জোট পরিবর্তনের কারণে রাজনৈতিকভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ২০২৫ সালের নির্বাচন বিহারের জন্য শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বিজেপি, আরজেডি, কংগ্রেস সব দলই এই রাজ্যকে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া।

বিহার মানে শুধুই একটি রাজ্য নয়, এটি ভারতের আত্মপরিচয়ের অংশ। গঙ্গার পাড়ের প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক রাজনীতির কূটকৌশল সবই এখানে আছে। বিহার একদিকে দরিদ্রতা, অশিক্ষা ও অভিবাসনের গল্প বলে, অন্যদিকে জ্ঞান, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। আসন্ন নির্বাচনেও তাই সবার দৃষ্টি বিহারের দিকে। বিজেপির জন্য এটি শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির দিক নির্ধারণের এক বড় পরীক্ষা। বিহার তার দৈন্যতা কাটিয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাক।

রেফারেন্সঃ

Related posts

কায়রো – প্রাচীন কোলাহলের শহর

ডাবলিন: ভালোবাসা ও তারুণ্যের এক শহর

লাহোর – পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More