Image default
নগর পরিচিতি

অ্যানিমের শহর- টোকিও

একসময়ের ছোটো একটি মৎস্য গ্রাম থেকে আজকের আধুনিক টোকিও!! 

জাপানের অ্যানিমে বা মাঙ্গার কথা কে না জানে? নারুটো, অ্যাটাক অন টাইটা্‌ন, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে মাই হিরো, একাডেমিয়া এর মত অ্যানিমে নাম  নিশ্চয়ই একবার হলেও শুনেছেন? কিন্তু এগুলোর উৎপত্তি কোন শহরে সেটা সম্পর্কে কি আপনি জানি?  বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অ্যানিমে উৎপাদন হয় জাপানের টোকিও শহরে। টোকিও জাপানের এমন একটি শহর যেখানে আধুনিকতা ও ঐতিহ্য পাশাপাশি বেঁচে আছে। 

চলুন, আজ সেই শহরের গল্পই জানা যাক । 

দেশ জাপান
অঞ্চল/রাজ্য কানতো (Kanto)
আয়তন ২,১৮৭.০৮ বর্গকিমি (৮৪৪.৪৪ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা  ১,৩০,১০,২৭৯ ( ২০১০ সালের আদমশুমারি)
সরকারি ভাষা জাপানি
প্রধান মুদ্রা ইয়েন
সময় অঞ্চল ইউটিসি +৯
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হানেদা বিমানবন্দর (Haneda Airport)

ম্যাপ

টোকিও আয়তন ও জনসংখ্যা

টোকিও বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। শহরটির আয়তন প্রায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার। এটি ২৩টি বিশেষ ওয়ার্ড (Special Wards), ২৬টি শহর, ৫টি উপশহর এবং বিভিন্ন দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে মেট্রোপলিটন এলাকার কেন্দ্রীয় অংশে জনবসতি সবচেয়ে বেশি।

২০২৪ সালের আনুমানিক তথ্য অনুযায়ী, টোকিওর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ, যা জাপানের মোট জনসংখ্যার এক দশমাংশ। টোকিও থেকে ইয়োকোহামা পর্যন্ত অঞ্চলটিকে টোকিও মেট্রোপলিটন অঞ্চল (Tokyo Metropolitan Area) বলা হয়। যার জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ।

টোকিওর অবস্থান ও আবহাওয়া 

টোকিও এর ভৌগলিক অবস্থান জাপানের হোনশু দ্বীপের পূর্ব উপকূলে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। শহরটি জাপানের বৃহত্তম সমভূমি অঞ্চল কানতো সমভূমির দক্ষিণাংশের দাঁড়িয়ে আছে। 

টোকিওর জলবায়ু উপক্রান্তীয়। অর্থাৎ এখানে মূলত চারটি ঋতু দেখা যায়। গ্রীষ্মে আবহাওয়া হয় অনেক গরম ও আর্দ্র হয়, এ সময় তাপমাত্রা থাকে প্রায় ২৫-৩০°C। শীতে এখানকার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা আর শুষ্ক হয়, আর তাপমাত্রা থাকে প্রায় ২-১০°C এর মধ্যে। 

তাই টোকিও ভ্রমণের জন্য বসন্ত আর শরৎকালই ভালো। কারণ, এই সময় শহরটিতে আবহাওয়া সবচেয়ে আরামদায়ক থাকে। মজার বিষয় হলো, জাপানে সারা বছরই বৃষ্টিপাত হয়। তবে জুন থেকে বর্ষাকাল শুরু হয়।  

টোকিও ভূমিকম্পপ্রবণ একটি শহর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় তেমন কোনো বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটেনি। তবে প্রায় সময় শহরটিতে টাইফুন হানা দেয়। 

টোকিওর ইতিহাস

টোকিওর গল্পটা আসলে বেশ পুরনো। এক সময় এটাকে এদো (Edo) নামে একটা ছোট মাছধরা গ্রাম হিসেবে চিনত সবাই। কিন্তু ১৬০৩ সালে তোকুগাওয়া শোগুনাতে এখানে শাসনকেন্দ্র গড়ে তোলেন। আর তারপর থেকেই এদো গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে শহরে পরিণত হতে থাকে।

তোকুগাওয়া শোগুনাতে

এদো যুগ

পরবর্তী ২৬৫ বছর ধরে, জাপানে এদো যুগ (১৬০৩-১৮৬৮) চলে। সে সময় জাপানের আনুষ্ঠানিক রাজধানী ছিল কিয়োটো। সেখানে সম্রাটরা বসবাস করলেও, সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এদো। 

শোগুনাতের পতন

১৮৬৮ সালে শোগুনাতের পতন ঘটে এবং সম্রাট মেইজি পুনরায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন। একই বছর সম্রাট মেইজি কিয়োটো ছেড়ে এদোতে চলে আসেন। আর তখনই শহরটির নতুন নাম রাখা হয় “টোকিও”, যার অর্থ “পূর্বের রাজধানী”। এই পরিবর্তনের পর থেকেই টোকিও দ্রুত আধুনিকায়নের দিকে যাত্রা শুরু করে।

কিন্তু এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। ১৯২৩ সালে এক বিশাল ভূমিকম্প (গ্রেট কান্তো ভূমিকম্প) শহরটিকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। শহরের বহু ভবন ধসে পড়ে, অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে, এবং হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। এতো বড় বিপর্যয়ের পরও টোকিও একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান

আর ঠিক তখনই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪৫ সালে মিত্রবাহিনী টোকিওর ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালায়।বিশেষভাবে ১০ মার্চের টোকিও ফায়ারবম্বিং ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বোমা হামলা। এক রাতের আগুনে প্রায় ১ লাখ মানুষ পুড়ে মারা যায় এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপ, ধোঁয়া এবং পোড়া মানুষের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টোকিও এর উপর ফায়ারবম্বিং

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী টোকিও

১৫ আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের শেষের দিকে টোকিও প্রায় এক বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। টোকিও আবার উঠে দাঁড়ায় এবং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, ধীরে ধীরে টোকিও পুনর্গঠিত হয় ।এবং এটি বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ও সমৃদ্ধ শহরে পরিণত হয়।

টোকিও এর অর্থনীতি ও শিল্প 

টোকিও, শুধু জাপানের রাজধানী হিসেবে নয়। বরং তার শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ব্যবসার জন্যও পরিচিত। টোকিও মূলত বিশ্ব প্রযুক্তি, আর্থিক সেবা, ট্রেড, এবং শিল্পের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। 

টোকিও প্রযুক্তি ও অর্থনীতি

টোকিও শহরের কেন্দ্রে বহু দেশী ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংস্থা রয়েছে। হোন্ডা, সনি, ক্যানন, টয়োটা, এনটিটি সহ বহুবৃহৎ আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত। 

২০১১ সালের ফরচুন গ্লোবাল এর জরিপে উঠে আসে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫১ টিই টোকিও তে অবস্থিত। বিশ্বের আর কোন দেশে এতগুলো আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। 

বিশেষ করে আকিহাবারা (Akihabara) জায়গাটিকে বলা হয় “ইলেকট্রনিক টাউন”।  এখানে সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য সহজেই পাওয়া যায়। 

এছাড়াও, নতুন নতুন প্রযুক্তির পণ্য এবং অ্যান্ড্রয়েড বা আইওএস অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কিত সামগ্রীও এইখানে পাওয়া যায়।

আকিহাবারা

ব্যবসা ও শেয়ারবাজার

টোকিও বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনৈতিক কেন্দ্র, যা অনেক দেশের অর্থনীতির সঙ্গেও তুলনা করা হয়। ২০২৩ সালে শহরটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কানাডা বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশের সমান।

টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ (Tokyo Stock Exchange – TSE) বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শেয়ারবাজার। যেখানে প্রতিদিন শত শত কোটি ডলারের লেনদেন হয়। আন্তর্জাতিক দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। শহরটি জাপানের প্রধান পাইকারি বাজার কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে। দেশজুড়ে এবং বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন পণ্য প্রথমে টোকিওতে পৌঁছায়। তারপর সেগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।

টোকিও শেয়ার বাজার

২০১১ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি সূচকে (Global Economic Power Index) টোকিও প্রথম স্থান অর্জন করে।যা শহরটির অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আরও দৃঢ় করে। 

বিনোদন ও  পর্যটন শিল্প 

বিনোদন খাত টোকিওর অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। সিনেমা, অ্যানিমেশন, সংগীত, থিয়েটার, এবং ভিডিও গেম শিল্প থেকে প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আসে। 

টোকিও ডিজনিল্যান্ড ও ইউনিভার্সাল স্টুডিওসের মতো বিনোদন পার্ক পর্যটকদের আকর্ষণ করে, যা শহরের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করেছে। 

এছাড়াও জাপানের বিখ্যাত অ্যানিমেশন  স্টুডিও যেমন স্টুডিও ঘিবলি (Studio Ghibli), টোই  অ্যানিমেশন (Toei Animation) টোকিওতেই অবস্থিত।

টোকিওর পর্যটন আকর্ষণ 

টোকিও টাওয়ার 

টোকিও টাওয়ার হল একটি বিখ্যাত টেলিভিশন ও রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্র, যা ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। এখানে উপরে দুটি দর্শন গ্যালারি রয়েছে— একটি ১৫০ মিটার উচ্চতায় এবং অন্যটি ২৫০ মিটার উচ্চতায়। 

এগুলি থেকে টোকিও শহরের বিস্তৃত দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। মেঘমুক্ত দিনগুলিতে, দর্শনার্থীরা মাউন্ট ফুজি পর্যন্ত দেখতে পারবেন। বিশেষ করে, রাতের বেলাতে এটি একটি আলোকিত স্তম্ভের মতো দেখা যায়।

টোকিও টাওয়ার

শিনজুকু গয়েন

এটি টোকিওর অন্যতম একটি সুন্দর ও বৃহৎ উদ্যান। এইখানে শহরের কোলাহলের মাঝেও নির্জনতা ও প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। বিশাল এই উদ্যানের তিনটা আলাদা ভাগ রয়েছে – জাপানি বাগান, ফরাসি উদ্যান, আর ইংলিশ ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন। 

বসন্তকালে এখানে চেরি ফুল দেখা যায়, যা স্থানীয় ও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। আবার, শরৎকালে গাছগুলো লাল-সোনালি রঙে ভরে ওঠে। 

শিনজুকু গয়েন

অকিহাবারা 

অকিহাবারা সাধারণত প্রযুক্তি, গেমিং, মাঙ্গা ও অ্যানিমে প্রেমীদের জন্য এক স্বপ্নের জগৎ। এখানে আধুনিক গ্যাজেট, রেট্রো ও নতুন ভিডিও গেম, মাঙ্গা বই এবং অ্যানিমে মেমোরাবিলিয়া পাওয়া যায়। 

এখানকার দোকানগুলোতে মিলবে বিশাল কালেকশনের গেম ও অ্যানিমে, লিমিটেড এডিশন ফিগার এবং গেমিং অ্যাক্সেসরিজ; যা সত্যিকারের গেমার ও অ্যানিমে ভক্তদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয়। 

টোকিও ডিজনি ল্যান্ড

টোকিও ডিজনি ল্যান্ড একটা ম্যাজিকাল থিম পার্ক। যা যেকোনো বয়সের মানষের জন্য উপভোগ্য। এখানে মিকি, মিনিসহ আপনি প্রিয় সকল ডিজনি চরিত্রদের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ পাবেন।  

এছাড়া বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইড, থ্রিলিং অ্যাডভেঞ্চার, এবং চমৎকার লাইভ শো পার্কটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। বিশেষ করে রাতের আতশবাজি এবং প্যারেড, একে অন্য যেকোনো থিম পার্কের থেকে আলাদা এবং রোমাঞ্চকর করে তোলে।

টোকিও ডিজনিল্যান্ড

সেন্সোজি মন্দির 

সেন্সজি মন্দির টোকিওর সবচেয়ে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, যা পর্যটক এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। এই স্থান তার বিশাল লণ্ঠন এবং ঐতিহ্যবাহী মার্কেট এলাকার জন্যও পরিচিত। পর্যটকরা এখান থেকে স্মারক ও ঐতিহ্যবাহী খাবার কিনতে পারেন। 

সেন্সোজি মন্দির

শিবুয়া ক্রসিং 

শিবুয়া ক্রসিং বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত এবং আইকনিক পথচারী ক্রসিংগুলোর মধ্যে একটি। এটি টোকিওর শিবুয়া স্টেশনের সামনে অবস্থিত। প্রতিবার ট্রাফিক সিগন্যাল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে এখানে হাজার হাজার মানুষ একযোগে রাস্তা পার হন।

এই রাস্তা জাপানের দ্রুতগতির জীবনধারার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। চারপাশের বিশাল স্ক্রিন, আলোকসজ্জা, এবং জনস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতি যেন,কোনো চলচ্চিত্রের দৃশ্যের মতো। তাই প্রতিদিনই এখানে প্রচুর পর্যটক ভিড় জমান। বিশেষ করে, সন্ধ্যার পর আলোকিত বিলবোর্ডগুলোর কারনেই জায়গাটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

শিবুয়া ক্রসিং

ওদাইবা দ্বীপ

ওদাইবা (Odaiba) টোকিও উপসাগরের উপর নির্মিত একটি কৃত্রিম দ্বীপ, যা তার আধুনিক স্থাপত্য ও প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনের জন্য জনপ্রিয়। 

এখানে অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো গুন্ডাম স্ট্যাচু (Gundam Statue) , teamLab Borderless (ডিজিটাল আর্ট মিউজিয়াম) এবং রেইনবো ব্রিজ (Rainbow Bridge)।

এছাড়াও এই দ্বীপে শপিং, বিনোদন ও প্রকৃতির ছোঁয়া একসঙ্গে পাওয়া যায়।

ওদাইবা দ্বীপ

টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম

টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম জাপানের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় জাদুঘর, যা উএনো পার্কে অবস্থিত। এটি জাপানের শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা।

এখানে সামুরাইদের অস্ত্র, ঐতিহ্যবাহী কিমোনো, বুদ্ধ মূর্তি, চিত্রকলা এবং চীন ও কোরিয়ার প্রাচীন শিল্পকর্মগুলো রয়েছে। মিউজিয়ামটি ছয়টি ভবনে বিভক্ত। যার মধ্যে হোনকান (Honkan) জাপানি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে এবং তোয়েইকান (Tōyōkan) এশিয়ার অন্যান্য দেশের শিল্প সংরক্ষণ করে।

টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম

টোকিও সংস্কৃতি ও জীবনধারা

টোকিওর সংস্কৃতি ও জীবনধারা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং ডাইনামিক। এখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা একসাথে মিশে রয়েছে। চলুন, টোকিওর সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানা যাক-

পোশাক ও ফ্যাশন

টোকিওর শহরের বেশ কিছু এলাকা যেমন হারাজুকু (Harajuku) এবং শিবুইয়া (Shibuya) তরুণদের জন্য ফ্যাশনের স্বর্গরাজ্য। 

এখানকার ফ্যাশন এর মধ্যে স্ট্রিট ফ্যাশন, কাওয়াই (Kawaii) ফ্যাশন, এবং লোলিটা স্টাইল অন্যতম ।

লোলিতা ফ্যাশন

স্ট্রিট ফ্যাশন

তরুনদের মধ্যে এই স্টাইল অধিক জনপ্রিয়। উজ্জ্বল রঙ, ওভারসাইজ পোশাক, কার্টুন-প্রভাবিত ডিজাইন, এবং অনন্য অ্যাক্সেসরিজ এই স্টাইল এর মূল বিষয়।

টোকিও খাবার

জাপানিজ সুশি 

সুশি, শুধু একটি খাবারই নয়, এক ধরনের শিল্প বলা চলে! এটি ভাত, সামুদ্রিক খাবার (মাছ, শেলফিশ ইত্যাদি) এবং শাকসবজি দিয়ে তৈরি হয়। সুশি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন নিগিরি (মাছ ভাতের উপর), মাকি (রোল সুশি), এবং সাশিমি (কাঁচা মাছ ছিঁড়ে কাটা)। 

জাপানিজ সুশি

মোচি

জাপানিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি হল মোচি, যা গম বা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় এবং ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ফল, ক্রিম বা লাল মার্শমেলো দেওয়া থাকে। এটি  উৎসব বা বিশেষ দিনগুলোতে খাওয়ার জন্য তৈরি হয়।

বেন্টো বক্স

অনেক রেস্টুরেন্টে বর্তমানে একটি নতুন খাবার দেখা যাচ্ছে যার নাম ‘বেন্টো বক্স’। এটি একটি জাপানিজ খাবার বক্স, যা এক বা একাধিক খাবার দিয়ে পূর্ণ হয় এবং সাধারণত বিভিন্ন ধরনের নুডল, মাংস, সবজি, এবং মিষ্টান্ন দিয়ে সাজানো হয়। এটি বিশেষত কাজের মাঝে বা স্কুলে খাবারের জন্য জনপ্রিয় জাপানে।

রামেন

আমরা সবাই তো কোরিয়ান রামেনের কথা শুনেছি। কিন্তু শুধু কোরিয়াতেই নয়, এশিয়ার মধ্যে জাপানেও রামেন সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হিসেবে ধরা হয়। এটি বিশেষ প্রকারের নুডল, সয়া সস, মাংস (সাধারণত শুকনো মুরগি বা শুয়োরের মাংস), সবজি এবং ডিম দিয়ে তৈরি করা হয়। 

জাপানিজ রামেন

টোকিওর উৎসব 

হানামি (Hanami)

এটি হলো জাপানের একটি বসন্তকালীন উৎসব। এসময় সাকুরা (চেরি ব্লসম) ফুল দেখা যায়। সাধারণত মার্চ ও এপ্রিল মাসে যখন সাকুরা ফুল ফোটে তখন মানুষ পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে গিয়ে পিকনিক করে।

হানামি উৎসব

সানজা মাতসুরি (Sanja Matsuri) 

এটি হলো টোকিওর অন্যতম বৃহত্তম এবং জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব। প্রতি বছর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহান্তে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ হলো মিকোশি (মন্দিরের ছোট মডেল বা পালকি) স্থানীয়রা কাঁধে নিয়ে স্থানীয়রা শহরের রাস্তায় শোভাযাত্রা  ।

কমিকেট (Comiket) 

কমিকেট হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাঙ্গা ও অ্যানিমে মেলা। যেখানে স্বাধীন শিল্পীরা তাদের নিজের তৈরি কমিক, গল্পের বই, অ্যানিমে আঁকা ও অন্যান্য কাজ বিক্রি করেন। এটি প্রতি বছর দু’বার টোকিওতে হয় এবং হাজার হাজার ভক্ত এখানে জড়ো হয়। কসপ্লে, বিশেষ বই ও ফ্যানদের তৈরি সামগ্রীর জন্য এটি দারুণ জনপ্রিয়!

চা অনুষ্ঠান  

জাপানে অন্যতম একটি প্রাচীন অনুষ্ঠান হল চা অনুষ্ঠান পালন করা হয়। চা অনুষ্ঠানটি মূলত জাপানি সংস্কৃতি একটি অংশ, যা অতিথির প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা দেখাতে করা হয়। এই অনুষ্ঠানে চা তৈরি করতে তারা মাচা, বাঁশের ঘুঁটনি এবং বিশেষ বাটি ব্যবহার করে। এরপর, অতিথিরা চা গ্রহণ করার সময় একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বাটি গ্রহণ ও ফিরিয়ে দেন, যা একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।

চা জাপানের শুধু পানীয় নয়, এটা কে একটা পুরো আধ্যাত্মিক যাত্রা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়! জাপানিরা চা কে “চাদো” বলে— যার অর্থ হলো চায়ের পথ। এখানে চা খাওয়ার প্রতিটি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ।      

ঐতিহ্যবাহী জাপানি চা অনুষ্ঠান

টোকিওকে কেন অ্যানিমের শহর বলা হয়?

টোকিওকে “অ্যানিমে শহর” বা “অ্যানিমে ক্যাপিটাল” বলা হয়। তার কারণ এটি জাপান এবং বিশ্বের বৃহত্তম অ্যানিমে উৎপাদন কেন্দ্র। শহরটিতে অ্যানিমে, মাঙ্গা, এবং গেমিং ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় স্টুডিও এবং অফিসগুলো অবস্থিত। এখানে অ্যানিমে এতটাই ফেমাস যে, অনেক দোকান, ক্যাফে, এবং থিম পার্ক, পুরোপুরি অ্যানিমে এবং মাঙ্গার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়।

জাপানিজ অ্যানিমে মুভি

টোকিওর আকিহাবারা এমন একটি স্থান যেখানে আপনি অ্যানিমে বা মাঙ্গার যেকোনো পণ্য সহজেই পাবেন।এছাড়া বিভিন্ন অ্যানিমে সম্পর্কিত ইভেন্টও এখানে অনুষ্ঠিত হয়।

টোকিওতেই অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম অ্যানিমে স্টুডিওগুলো, যেমন “স্টুডিও ঘিবলি” এবং “ম্যাপা”। এই স্টুডিওগুলোর তৈরি অ্যানিমে সিরিজ এবং চলচ্চিত্র বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।স্পিরিটেড অ্যাওয়ে” (2001), “মাই নেবার টোটোরো” (1988), “কিরিকিরি কিহো” (2004) এবং “প্রিন্সেস মনোনোকি” (1997) এর মতো চলচ্চিত্রগুলি শুধু জাপানে নয়। বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমাদৃত হয়েছে।

টোকিও বিশ্ববাজারে নিজেদের জায়গা এতটাই শক্তিশালী করে নিয়েছে যে,যখনই কেউ অ্যানিমের কথা চিন্তা করে তখনই তাদের মাথায় আসে জাপানের কথা। 

টোকিওর যোগাযোগ ব্যবস্থা 

টোকিও সাবওয়ে

টোকিওর যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ সহজ ও উন্নত। এখানে মূলত ট্রেন, সাবওয়ে, বাস এবং ট্যাক্সির মাধ্যমে যাতায়াত করা হয়। 

বেশিরভাগ মানুষ যাতায়াতের জন্য মেট্রো ও জেআর ট্রেন ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে যেমন র‍্যাপিড পাস  ব্যবহৃত হয়, তেমনি জাপানে মেট্রো ব্যবহারের জন্য সুইকা ও পাসমো কার্ড ব্যবহার করা হয়।

টোকিওতে বাস পরিষেবা থাকলেও, তা ট্রেনের তুলনায় কিছুটা ধীরগতির। তবে বাসের সুবিধা হলো, এটি এমন কিছু এলাকায় চলে যেখানে ট্রেন পৌঁছাতে পারে না। 

এছাড়া আপনি চাইলে উবার অথবা গো এর মত ট্যাক্সি অ্যাপ এর মাধ্যমে ট্যাক্সি  ডাকতে পারেন।তবে সেখানে ট্যাক্সি বেশ ব্যয়বহুল ।

টোকিওর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

টোকিও তার শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে বেশ প্রশংসনীয়। কারণ, জাপানে শিক্ষার্থীদের শুধু উচ্চ মানের শিক্ষাই দেওয়া হয় না, সাথে নৈতিক মূল্যবোধের দিকটিও নিশ্চিত করা হয়।

শহরটিতে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের মোট ৯ বছর শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, শিক্ষার্থীদের এই ৯ বছর সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়াশোনা করানো হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর বাধ্যতামূলক না হলেও প্রায় ৯৭% শিক্ষার্থী এই স্তরে শিক্ষা গ্রহণ করে ।

টোকিওতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সংখ্যা অনেক বেশি। জাপানের অন্যতম বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন টোকিও ইউনিভার্সিটি, কিয়োট ইউনিভার্সিটি ও ওসাকা ইউনিভার্সিটি এই শহরেই অবস্থিত। টোকিওর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখানে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসে। 

টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা 

টোকিওতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক উন্নত ও আধুনিক। এখানে সরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে, সাথে বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকও রয়েছে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, জাপানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে পরিচালিত হয়।

টোকিওর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিশেষ দিক হলো প্রিভেন্টিভ কেয়ার (preventive care)। এখানে স্বাস্থ্য সচেতনতা আর রোগ প্রতিরোধে বেশি মনোযোগ দেয়া হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।  

টোকিও, আধুনিকতার ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ এক মহানগরী । এখানে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। এই শহরের প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে নতুন নতুন গল্প, যা বিশ্বকে প্রতিনিয়ত বিস্মিত করছে। প্রতিবার এখানে এলে আপনি নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পারবেন । 

টোকিও নিয়ে মজার কিছু তথ্য 

টোকিওর ইউনিক ক্যাপসুল হোটেল-

একমাত্র জাপানের টোকিওতেই ক্যাপসুল হোটেল দেখা যায়। এটি মূলত ছোট, পডের মতো ঘর । যেখানে রাতে মানুষ থাকতে পারে।

ভেন্ডিং মেশিন

আমাদের দেশে ভেন্ডিং মেশিনের প্রচলন খুব বেশি না হলেও, টোকিও তে প্রায় সর্বত্র ভেন্ডিং মেশিন দেখা যায়। সেখানে শুধু পানীয় নয়, বরং নিত্য প্রয়োজনীয়  বিভিন্ন জিনিস, এমনকি গরম খাবারও পাওয়া যায় ।

অ্যান্টি-সুইসাইড লাইট

টোকিওর মেট্রো স্টেশনে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে নীল রঙের অ্যান্টি-সুইসাইড লাইট লাগানো হয়েছে। এই লাইটগুলো মানুষকে মানসিক শান্তি দেয় এবং আত্মহত্যার চেষ্টা রোধ করতে সাহায্য করে। 

টোকিও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাছের বাজারের বাড়ি-

টোকিওর সুকিজি ফিশ মার্কেট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাইকারি মাছ ও সী ফুডের বাজার। এখানকার সীফুড নিলাম, বিশেষ করে টুনা নিলাম, বিশ্ব বিখ্যাত। অনেক পর্যটক এই নিলাম দেখতে আসে এখানে। 

সবচেয়ে বড় অ্যানিমে কনভেনশন-

টোকিও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অ্যানিমে কনভেনশনের আয়োজন করে।এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অ্যানিমে ও মাঙ্গা প্রেমীরা একত্রিত হয়।

রেফারেন্স-

Related posts

আমস্টারডাম – ইউরোপের পর্যটন নগরী

রোমান্সের শহর-প্যারিস

মুম্বাই – মেরি জান

আবু সালেহ পিয়ার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More