Image default
ইউরোপএশিয়াদেশ পরিচিতি

তুরষ্ক – ইউরোপ নাকি এশিয়ার দেশ?

 মজার ব্যাপার হলো, তুরষ্ক দেশটি এশিয়া ও ইউরোপ, দুই মহাদেশেই অবস্থিত।

বর্তমান বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র তুরষ্ক। গৌরবময় অতীতের সাথে উত্তর আধুনিকতার ছোঁয়া দেশটিকে করেছে সমৃদ্ধ, সেই সাথে করেছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মজার ব্যাপার হলো, তুরষ্ক দেশটি এশিয়া ও ইউরোপ, দুই মহাদেশেই অবস্থিত। তাই তো এশিয়া ও ইউরোপের স্বাদ একসাথে নিতে পর্যটকেরা ভিড় করেন তুরষ্কে। দেশটির আলো ঝলমলে শহর ইস্তানবুল নিয়ে যেমন মানুষের আগ্রহের কমতি নেই, তেমনি অটোমান সাম্রাজ্যের অলিগলি ঘুরে তুরষ্ককে জানতেও সবাই উদগ্রীব। 

তুরষ্কের অবস্থান, আয়তন ও জনসংখ্যা

তুরষ্ক মূলত পর্বতে ঘেরা উচ্চ মালভূমি। দেশটির মোট আয়তন প্রায় ৭ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার। আর এই আয়তনের ৯৭ শতাংশ এশিয়া মহাদেশে এবং বাকী ৩ শতাংশ ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত। দেশটির পশ্চিম ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত অংশটিকে ‘ইউরোপীয় তুরস্ক’ বা ‘ইস্টার্ন থ্রেস’ বলা হয়। আর অন্যদিকে যে বৃহত্তর অংশটি এশিয়া মহাদেশে পড়েছে তাকে ‘আনাতোলিয়া’ বা ‘এশিয়ান তুরস্ক’ বলা হয়।

ম্যাপ 

তুরষ্কের দুই অংশ 

তুরস্কের এই দুই অংশকে আলাদা ‘করার জন্য দায়ী মূলত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। এগুলো হলো বসফরাস প্রণালী, মারমারা সাগর ও দার্দানেলস প্রণালী। এদের মধ্যে বসফরাস প্রণালী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মাঝে সরাসরি সীমানা তৈরি করেছে। মজার ব্যাপার হলো, তুরষ্কের ইস্তানবুল শহরের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে এই বসফরাস প্রণালি। যার ফলে ইস্তানবুল শহরটি হলো পৃথিবীর একমাত্র শহর যার এক অংশ ইউরোপে, আরেক অংশ এশিয়ায়। 

বসফরাস প্রণালী, মারমারা সাগর ও দার্দানেলস প্রণালী তুরস্কের দুই অংশকে আলাদা করেছে

আরেকটি অবাক করার মত বিষয় হলো, তুরষ্কের একেক জায়গায় একেক রকম আবহাওয়ার স্বাদ পাওয়া যায়। কারণ, দেশটির বৈচিত্রপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান এর জলবায়ুতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। যেমন- তুরস্কের দক্ষিণ এবং পশ্চিম উপকূলের গ্রীষ্মকাল হয় যথেষ্ট উষ্ম এবং শুষ্ক প্রকৃতির অন্যদিকে শীতকালে প্রচন্ড শীত পড়ার বদলে আবহাওয়া সহনীয় হয়ে থাকে।

এদিকে, দেশটির উত্তরাঞ্চল সারা বছরই থাকে বৃষ্টিমুখর। তবে, সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলের জলবায়ু। এই অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা খুব বেশি আবার শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ে, সাথে তুষারপাতও দেখা যায়। তুরস্ক ঘুরতে চাইলে বসন্তকাল এবং শরতকাল হবে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে তুরষ্কের আবহাওয়া মনোরম থাকে যা ঘোরাঘুরির জন্য একদম পারফেক্ট।

তুরষ্কের পর্যটনস্থান

তুরস্ক ভ্রমণ মানেই শুরুটা হবে ইস্তানবুল শহর দিয়ে! এটি এমন এক শহর যা কিনা ইতিহাসের হাজারো উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে আছে। একসময় অটোমান আর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই শহর। ইস্তানবুল শহরটি উঁচু-নিচু টিলাবেষ্টিত, অনেকটা মক্কা নগরীর মতো; যে শহরের পথে পথে ছড়িয়ে আছে তুরষ্কের গৌরবময় ইতিহাস। 

সুলতান আহমদ মসজিদ

 

ইস্তাম্বুলের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সুলতান আহমদ মসজিদ অন্যতম। এই মসজিদে একসঙ্গে দশ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। এর মূল গম্বুজের পাশাপাশি রয়েছে আরও আটটি ছোট-বড় গম্বুজ। গম্বুজ ও মিনারগুলো নীল ও সাদা সীসার গাঁথুনিতে তৈরি। মসজিদের ওপরের অংশে রয়েছে সোনালী রঙের নকশা। মসজিদের ভেতরের দেয়ালগুলোতে রয়েছে বাহারি কারুকাজ, সাথে আছে পবিত্র কোরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি, যা যেকোনো পর্যটকের চোখ জুড়িয়ে দিতে বাধ্য। 

তুরষ্কের সুলতান আহমেদ মসজিদ

তুরষ্কের গ্র্যান্ড বাজার

সুলতান আহমেদ মসজিদ থেকে বের হয়ে কিছু দূর গেলেই দেখা মিলবে ইস্তানবুলের আরেক বিখ্যাত স্থান, গ্র্যান্ড বাজারের। জেনে অবাক হবেন, মোট ৬০টি গলি নিয়ে বিস্তৃত এই বাজারে রয়েছে প্রায় চার হাজার দোকান! এসব দোকানে পাওয়া যায় সুলতানি যুগে ব্যবহৃত আকর্ষণীয় তৈজসপত্র, বিভিন্ন আকৃতি ও নকশার দৃষ্টিনন্দন লাইট, ফুলদানি ও ঝাড়বাতিসহ সব ধরনের পণ্য।

ইস্তানবুলের বিখ্যাত স্থান, গ্র্যান্ড বাজার
ইস্তানবুলের বিখ্যাত স্থান গ্র্যান্ড বাজার

 

 

হাজিয়া সোফিয়া মিউজিয়াম

ইস্তানবুল শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো হাজিয়া সোফিয়া মিউজিয়াম। কথিত আছে, ৯১৬ সাল পর্যন্ত ভবনটি ছিল একটি ক্যথলিক চার্চ। সুলতান ফাতেহ কর্তৃক কনস্টান্টিনাপোল বিজয়ের পর এই গির্জার উপর সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করে একে পরিণত করা হয় মসজিদে। 

পরবর্তীতে, ১৯৩৪ সালে কামাল আতাতুর্ক এটিকে পরিণত করেন জাদুঘরে। হাজিয়া সুফিয়া মিউজিয়ামে রয়েছে সুলতানি আমলের অনেক নিদর্শন। এখানেই রয়েছে, অটোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট সুলতান সোলেমানের বাসভবন। এই বাসভবনের অভ্যন্তরে স্থাপিত সংগ্রহশালায় রয়েছে মহানবী হজরত মোহাম্মদের (স.) এর দন্ত মোবারক, পায়ের ছাপ এবং হজরত ফাতিমা (রা.) ও হজরত হুসাইনের (রা.) ব্যবহৃত জামা ও বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহৃত সাহাবিদের তরবারি।

 

আনিতকাবির

অনেকে মনে করেন, ইস্তানবুল তুরষ্কের রাজধানী। কিন্তু দেশটির রাজধানী আসলে আঙ্কারা যা তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এই শহরে আধুনিকতার সঙ্গে মিশে আছে ঐতিহ্য। আঙ্কারার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আনিতকাবির এটি মূলত তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের স্মৃতিস্তম্ভ ও সমাধি। আনিতকাবিরের স্থাপত্যকলা রোমান ও তুর্কি শিল্পের অনুকরণে নির্মিত। এখানে রয়েছে বিশাল সমাধি হল, যেখানে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের কবর সংরক্ষিত, এবং এর চারপাশে রয়েছে প্রদর্শনী হল। 

মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের কবর আনিতকাবির

 

আনাতোলিয়ান সিভিলাইজেশন মিউজিয়াম

আনাতোলিয়ান সিভিলাইজেশন মিউজিয়াম প্রাচীন তুর্কি সভ্যতার এক নিদর্শন। এখানে ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, প্রাচীন মৃৎশিল্প এবং স্বর্ণালংকার প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। এই জাদুঘরের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো প্রাচীন কফিন ও মৃতদেহের সাথে দাফন করা সমাধি সামগ্রী। এই সমাধি সামগ্রী থেকে তৎকালীন মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। 

কোকােটেপ্পে

মিউজিয়াম ও স্মৃতিস্তম্ভের পাশাপাশি আঙ্কারায় ঐতিহ্যবাহী মসজিদেরও কমতি নেই। আঙ্কারার সবচেয়ে বড় মসজিদ হলো কোকােটেেপ্পে। মজার বিষয় হলো এই মসজিদ শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে সহজেই চোখে পড়ে। আর এর কারণ হলো, সুবিশাল গম্বুজ এবং চারটি সুউচ্চ মিনার। এই গম্বুজটি প্রায় ৪৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং এর অভ্যন্তরে রয়েছে চমৎকার কারুকাজ। এই মসজিদে প্রায় ২৪ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে।

 

বদ্রুম শহর

তুরষ্কে সমুদ্রের স্বাদ নিতে চাইলে চলে যান বদ্রুম শহরে। তুরস্কের বদ্রুম এমন এক জায়গা, যেখানে গেলে মনে হবে আপনি চলে গেছেন কোন রূপকথার শহরে। নীল সমুদ্র, সাদা রঙের ছোট ছোট বাড়ি, উঁচুনিচু পাহাড় ঘেরা শান্ত পরিবেশ—সব মিলিয়ে বদরুম যেন স্বপ্নপুরী। এই শহরটি তুরস্কের এজিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত এক সুন্দর পর্যটন নগরী। গ্রীষ্মকালে বদরুম শহরটি ছেয়ে যায় দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটক দিয়ে। এখানকার খাবারও অনেক মজার—তাজা সি ফুড, সুস্বাদু তুর্কিশ কাবাব আর বাদামের মিষ্টি। এখানে বেড়াতে আসার পর কেউ নৌভ্রমণে যায়, কেউ পাহাড়ে হাইকিং করে, আবার কেউ রিসোর্টে বসে শান্তিতে সূর্যাস্ত উপভোগ করে থাকে। 

ক্রুসেডারদের তৈরি বদরুম ক্যাসেল

বদ্রুমের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো ১৫ শতকে ক্রুসেডারদের দ্বারা তৈরি বদরুম ক্যাসেল। এই দুর্গটি তৈরি হয়েছিলো জল দস্যুদের আক্রমণ থেকে শহরকে রক্ষা করার জন্য। এই দূর্গেই রয়েছে ‘আন্ডারওয়াটার আর্কিওলজি মিউজিয়াম’, যেখানে প্রাচীন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ, কলকব্জা আর ডুবে যাওয়ার রহস্যময় গল্প ঘুরে দেখা যায়। 

 

বদ্রুম মেরিনা বা ইয়ট ক্লাব এই শহরের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে এখানকার বিলাসবহুল নৌকা এবং ইয়টগুলো নোঙর করা থাকে। বিশাল সমুদ্রের বুকে ভেসে ভেসে অভিজাত ইয়টে থাকার অভিজ্ঞতা নিতেও অনেকে এখানে আসেন। ওয়াইফাই থেকে শুরু করে প্রযুক্তির আধুনিক সব সুবিধাই বদ্রুমের বিলাসবহুল ইয়টগুলোতে পাওয়া যায়৷ 

ক্যাপাডোসিয়ার হট এয়ার বেলুন

তুরষ্কের বেলুনের শহর নামে পরিচিত ক্যাপাডোসিয়ায় ঢুকলেই চারপাশে নানা রঙের হট এয়ার বেলুন চোখে পড়বে। এই অভিজ্ঞতা যেন রূপকথার মতো। রোমান্টিক রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের জন্য ক্যাপাডোসিয়া হতে পারে আদর্শ স্থান। সূর্যোদয়ের সময় প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে হট এয়ার বেলুনে আকাশ থেকে ক্যাপাডোসিয়ার অপূর্ব সৌন্দর্য দেখা জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকে দর্শনার্থীদের। 

ক্যাপাডোসিয়ার হট এয়ার বেলুন
ক্যাপাডোসিয়ার হট এয়ার বেলুন

হট এয়ার বেলুন রাইড, বিলাসবহুল ইয়টে রাত্রিযাপন- অতি আধুনিকতার সব উপাদান যেমন তুরষ্কে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি দেশটির পথে পথে আছে সমৃদ্ধ ইতিহাসের হাতছানি। আর সেই ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে আছে অটোমান সাম্রাজ্য, যারা কিনা বিশ্বে ৬০০ বছর নিজেদের রাজত্ব ধরে রেখেছিল৷ 

 

তুরষ্কের ইতিহাস

অটোমান সাম্রাজ্যের গল্পটা শুরু হয় ১২৯৯ সালে, এক স্বপ্নবাজ শাসক ওসমান গাজীর হাত ধরে। তুরস্কের একটি ছোট অঞ্চল থেকে যাত্রা শুরু করে এই সাম্রাজ্য ক্রমে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা; তিনটি মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শুধু একটি সাম্রাজ্য নয়, অটোমান যুগ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়। 

অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবময় সময় ছিল সুলতান সুলাইমান এর শাসনামলে। তাঁর শাসনামলে অটোমান সাম্রাজ্য শুধু সাম্রাজ্য বিস্তারে নয়, শিল্প- সংস্কৃতি, জ্ঞান- বিজ্ঞানেও দারুণ উন্নতি লাভ করে। তুর্কি জাতি তাদের এই গৌরবময় অতীতকে অত্যন্ত ভালবাসার সাথে স্মরণ করে থাকে। 

সুলতান সুলাইমান 

তুরষ্কের সংস্কৃতি

এছাড়া, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং আন্তরিকতার জন্য তুর্কি জাতির বেশ খ্যাতিও আছে পৃথিবী জুড়ে। অতিথিকে সাদরে গ্রহণ করার রীতি তাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ঘরে অতিথি আসলে তারা চা না খাইয়ে ছাড়বেই না।

এছাড়া তুর্কি খাবারের বৈচিত্র্য ও স্বাদ বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। তুর্কি কাবাব, পিলাফ, ডোলমা, এবং লাহমাজুন তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। ডেজার্টের মধ্যে বকলাভা এবং কুনাফা বিশেষভাবে বিখ্যাত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তুর্কিরা বেশিরভাগ মিষ্টি খাবারেই বাদাম ব্যবহার করে থাকে, এতে তাদের খাবারের স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। 

তুরষ্কের বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম। তবে তাদের জীবনে ধর্মের প্রভাব খুব একটা দেখা যায় না। জানলে অবাক হবেন, অনেক ঐতিহ্যবাহী মসজিদ থাকা সত্ত্বেও খুব কম মানুষই মসজিদে নামাজ আদায় করে থাকে।  

তুরষ্কের নারী ও পুরুষের পোষাক

ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত হওয়ায় তুর্কীদের জীবনযাপনে বেশ ছাপ ফেলেছে পশ্চিমা রীতিনীতি৷ দেশটির শহুরে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ  আধুনিক পোশাক পরে, তবে গ্রামীণ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী পোশাকের চল এখনও প্রবল। প্রাচীনকালে তুর্কী পুরুষরা সাধারণত লম্বা জামা এবং এর নিচে ঢোলা পায়জামা পরত। জামার ওপরে জ্যাকেট বা কোটের মতো একটি পোশাক পরা হতো, যা “কাফতান” নামে পরিচিত। নারীরা লম্বা গাউন, সিল্কের শাল এবং এমব্রয়ডারি করা জ্যাকেট পরত। মাথায় স্কার্ফ বা অলংকৃত টুপি ছিল নারীদের পোশাকের অংশ। আজও তুরস্কের গ্রামীণ এলাকায় উৎসব বা বিশেষ দিনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা হয়।

তুরস্কের উৎসবগুলোও তাদের জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পবিত্র রমজান মাস এবং ঈদ উদযাপন এখানে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। এছাড়া বসন্ত ও নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে একধরনের উৎসব পালন করে তুরষ্কের কুর্দি ও আজারি জনগোষ্ঠীর মানুষ৷ এই উৎসবের নাম নওরোজ উৎসব। জেনে অবাক হবেন, উৎসবের সময় আগুন জ্বালানো ও তার ওপর দিয়ে লাফ দেওয়ার মাধ্যমে তারা পুরনো কষ্টকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনের সূচনা করছে বলে মনে করে। এছাড়া ইউরোপের অনুকরণে ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটিকেও বেশ জাকজমকভাবে পালন করে তুর্কিরা।

তুরষ্কের উৎসব নওরোজ পালন

 

তুরষ্কের বর্তমান অবস্থা

তবে এই আলো ঝলমলে উৎসবমুখর দেশটিকে ঘিরেও আছে অগণিত সমস্যা,আছে সমালোচনা ও বিতর্ক। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে তুরস্ক বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী আশ্রয়দাতা। প্রায় ৩৫ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী এখানে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান এবং শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করা তুরস্ক সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা দেশটিতে শুধু মানবিক সংকটই সৃষ্টি করছে না, সাথে তুরস্কের অর্থনীতি এবং রাজনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। 

এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থান এবং সামরিক শক্তি বিবেচনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তুরস্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। তুরষ্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের শাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচুর বিতর্ক থাকার পরেও; কুটনৈতিক কারণে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তুরষ্কের সাথে সমঝোতার নীতি মেনে চলে। 

তবে সব সমস্যাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের তালিকায় নিজেদের নাম আরও পাকাপোক্ত করছে দেশটি। কারণ,তুরস্ক শুধু একটি দেশ নয় বরং এই দেশ পৃথিবীর এক জীবন্ত ইতিহাস। তুরস্ক সেই রহস্যময় দেশ, যার প্রতিটি ইট-পাথর, প্রতিটি দালান আর প্রতিটি মানুষ বলে যায় এক গৌরবময় ইতিহাসের গল্প, যে গল্পে উপস্থিত ছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরাও৷ এই বিশ্বে তুরষ্ক আবারও নিজেদের শক্তিশালী করে তুলুক তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর ভালবাসা দিয়ে, এই কামনায় শেষ করছি বিশ্ব প্রান্তরের আজকের পর্ব। 

তুরষ্ক নিয়ে আরও কিছু মজার তথ্য

দুই মহাদেশে বিস্তৃত দেশ – তুরস্ক একমাত্র দেশ যা একসাথে ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশে বিস্তৃত। ইস্তানবুল শহরটি দুই মহাদেশের মাঝে অবস্থান করছে, যার একপাশ ইউরোপে, আরেকপাশ এশিয়ায়।

ট্রয় নগরীর জন্মভূমি – বিখ্যাত গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াডের ট্রয় যুদ্ধের শহর “ট্রয়” তুরস্কে অবস্থিত। এখানে এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখা যায়।

বিশ্বের প্রাচীনতম মন্দির – তুরস্কের গোবেকলি তেপে (Göbekli Tepe) বিশ্বের প্রাচীনতম মন্দির হিসেবে পরিচিত, যা খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০০ সালেরও পুরনো।

তুর্কি কফির বিশেষত্ব – তুরস্কে কফি সংস্কৃতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে ২০১৩ সালে ইউনেস্কো “Turkish Coffee Culture and Tradition”কে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর একটি – ইস্তানবুলের “গ্র্যান্ড বাজার” (Kapalıçarşı) বিশ্বের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম বাজারগুলোর একটি, যেখানে ৪,০০০-এরও বেশি দোকান রয়েছে।

তথ্যসূত্র-

https://en.wikipedia.org/wiki/Turkey

https://www.bbc.com/news/world-europe-17988453

https://www.tripadvisor.com/Tourism-g293969-Turkiye-Vacations.html

https://www.insightvacations.com/blog/facts-about-turkey/

https://www.ktb.gov.tr/?_Dil=2

Related posts

লেবানন – পৃথিবীর প্রাচীনতম সংস্কৃতির দেশ

শেখ আহাদ আহসান

দক্ষিণ কোরিয়ার জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার জগৎ!

মালয়েশিয়া: এক দেশ দুই ভূখণ্ড

আশা রহমান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More