এমনকি এই অঞ্চলটির আছে নিজস্ব মুদ্রা, পাসপোর্ট, সেনাবাহিনী ও সরকার। এই স্থানটি হলো একটি স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ড।
সোমালিয়া নামটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে জলদস্যু, দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের গল্প। বছরের পর বছর ধরে ব্যর্থ দেশের তালিকার শীর্ষে থাকা এই দেশটি যেন শুধু ধ্বংস আর অরাজকতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের কাছে। অথচ এই একই সোমালিয়ার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আরেক ভিন্ন চিত্র।
এই দেশের মধ্যেই রয়েছে এমন এক অঞ্চল, যেখানে টানা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে শান্তি, নিয়মিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও নারীর নিরাপত্তা। এমনকি এই অঞ্চলটির আছে নিজস্ব মুদ্রা, পাসপোর্ট, সেনাবাহিনী ও সরকার। এই স্থানটি হলো একটি স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ড।
যদিও বাস্তবে সোমালিল্যান্ড কার্যত একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মতোই কাজ করছে, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে অন্য দেশগুলো এটাকে এখনো ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে মেনে নেয়নি।
তাহলে, কাগজে-কলমে স্বাধীন না হয়েও দেশটির বাস্তবে স্বাধীনতার স্বাদ কেমন? কেমনই বা সোমালিল্যান্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর বর্তমান?
স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ড
সোমালিল্যান্ডের অবস্থান
সোমালিল্যান্ড আফ্রিকার পূর্বাংশের শৃঙ্গ বা Horn of Africa অঞ্চলে অবস্থিত। মানচিত্রে লক্ষ করলে দেখা যায়, এর উত্তরে রয়েছে বিস্তৃত লোহিত সাগর, পশ্চিমে জিবুতি, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে সোমালিয়া, আর পূর্বদিকে আছে পুন্টল্যান্ড, যা সোমালিয়ার একটি স্বশাসিত অঞ্চল।
সোমালিল্যান্ডের আয়তন ও জনসংখ্যা
দেশটির আয়তন প্রায় ১ লক্ষ্ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে কিছুটা বেশি। এই আয়তনের ভেতর বসবাস করে প্রায় ৬২ লক্ষ মানুষ। দেশটির রাজধানী হলো হারগেইসা শহর।

সোমালিল্যান্ডের ভৌগলিক গুরুত্ব
ভৌগলিক দিক থেকেও সোমালিল্যান্ডের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। দেশটি লোহিত সাগরের উপকূল ধরে চলা সামুদ্রিক পথের মাধ্যমে সুয়েজ খালের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত হয়। আর এই সুয়েজ খাল হলো বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক নৌপথ।
ঠিক এই কারণে সোমালিল্যান্ডের বার্বেরা বন্দর, কেবল অর্থনীতির জন্য নয়, সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ঐতিহাসিক দিক থেকেও এই অঞ্চলটির গুরুত্ব রয়েছে।
সোমালিল্যান্ডের ইতিহাস
সোমালিল্যান্ডের ইতিহাস শুরু হয় ঔপনিবেশিক যুগে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো আফ্রিকার বিশাল ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিতে যখন ব্যস্ত, তখন ব্রিটিশরা হর্ন অব আফ্রিকার এই অংশে তাদের প্রভাব বিস্তার করে।
১৮৮৪ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হয় ‘ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড প্রোটেক্টরেট’ নামে। আফ্রিকার এই ‘দখল দৌড়’কে ইতিহাসে বলা হয় স্ক্র্যাম্বল অফ আফ্রিকা (Scramble for Africa), যেখানে মাত্র কয়েক দশকে পুরো মহাদেশ মানচিত্রে ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
এরপর ১৯৬০ সালের ২৬ জুন ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এই স্বাধীনতা স্থায়ী হয়নি। মাত্র পাঁচ দিন পর, ১ জুলাই ১৯৬০ সালে এটি ইতালীয় সোমালিয়ার সঙ্গে একীভূত হয়ে গড়ে ওঠে নতুন রাষ্ট্র ‘সোমালি রিপাবলিক’।
শুরুতে এই মিলনকে অনেকেই জাতিগত ঐক্যের বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন। জেনে অবাক হবেন, তখন সোমালিল্যান্ড ছিল আফ্রিকার একমাত্র রাষ্ট্র, যা মাত্র ৫ দিনের জন্যই স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসংঘে জায়গা করে নিয়েছিল। তবে, তারা কোন অধিবেশনে যোগদান করতে পারেনি।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তরের জনগণ অর্থাৎ সোমালিল্যান্ডবাসী অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। সরকারের পদে তাদের অংশগ্রহণ কম, উন্নয়ন প্রকল্পেও তারা পিছিয়ে। ১৯৮০-এর দশকে এই অসন্তোষ চরমে ওঠে।

এসময় তৎকালীন স্বৈরশাসক সিয়াদ বারে উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক দমন চালান। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়, গ্রাম ধ্বংস করা হয়, এবং অসংখ্য মানুষ শরণার্থী হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। আর একারণেই, সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসাকে আক্ষরিক অর্থেই “আফ্রিকার ড্রেসডেন” বলা হয়েছিল, কারণ শহরের অধিকাংশ অংশ বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়।
১৯৯১ সালে সিয়াদ বারের সরকার পতনের পর পুরো সোমালি রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে। দেশে আইন-শৃঙ্খলার অভাব, গৃহযুদ্ধ আর বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তখনই সোমালিল্যান্ডের জনগণ নিজেদের আলাদা পরিচয় ঘোষণা করে।
তারা নিজেদের সীমানা, সরকার ও প্রশাসন গঠন করে—একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কার্যত পথচলা শুরু করে। সোমালিল্যান্ডে পতাকা তোলার প্রথম অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৮ মে, যা আজও স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
সোমালিল্যান্ডের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা
যদিও সোমালিল্যান্ড এখনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়, তবুও তাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো অন্য যেকোনো স্বীকৃত দেশের মতোই শক্তিশালী। এখানে সংসদ, বিচারব্যবস্থা, নিজস্ব সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবকিছুই কার্যকরভাবে কাজ করে।
তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ২০০১ সালে স্থানীয় জনগণের গণভোটের মাধ্যমে একটি সংবিধান অনুমোদিত হয়। এই সংবিধান শুধু আইনের কাঠামো নয়, বরং রাষ্ট্রের নীতি, নাগরিকদের অধিকার এবং দায়িত্বও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সোমালিল্যান্ডের এই গণভোটে প্রায় ৯৭% মানুষ নতুন সংবিধানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল, যা আফ্রিকার ইতিহাসে অন্যতম উচ্চ সমর্থনপ্রাপ্ত গণভোট হিসেবে বিবেচিত। এর মাধ্যমে সোমালিল্যান্ড প্রমাণ করেছে যে তারা শুধু ইতিহাসের শিকার নয়, বরং ইতিহাস গড়ার ক্ষমতাও রাখে।
সোমালিল্যান্ড স্বাধীনতার পর থেকে নিজস্ব রাষ্ট্র হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করেছে। তাদের নিজস্ব পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, সরকার, সেনাবাহিনী এবং মুদ্রা রয়েছে, যা প্রমাণ করে তারা কার্যত একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। তাছাড়া প্রশাসনিক কাঠামোতে সোমালিল্যান্ডে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার রয়েছে।

সোমালিল্যান্ডের বিচারব্যবস্থাও বিশেষ গোছানো। এখানে আধুনিক আইন এবং ঐতিহ্যবাহী ‘গু’ ব্যবস্থা একত্রে কাজ করে। ‘গু’ হলো সোমালিল্যান্ডের ক্ল্যানভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী বিচার ব্যবস্থা, যা স্থানীয় দ্বন্দ্ব সমাধানে ব্যবহৃত হয়। এই সিস্টেমের মাধ্যমে ছোটখাটো বিরোধ দ্রুত ও শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়, যা স্থানীয় জনগণের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করেছে।
সোমালিল্যান্ডের পর্যটন
যদিও সোমালিল্যান্ড এখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পায় নি, তবুও এর প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি আর পর্যটনস্থানগুলো পর্যটকদের কাছে যেন এক গুপ্তধনের ভাণ্ডার। এখানে আছে প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকলা, সবুজ পাহাড়, মেঘে মোড়া অরণ্য আর অনাবিল নীল সমুদ্রতট।
লাস গিলতে
প্রথমেই যাওয়া যাক, লাস গিলতে। হারগেইসা শহরের কাছাকাছি পাথুরে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এই জায়গাটি, আফ্রিকার সবচেয়ে সংরক্ষিত প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের ভাণ্ডার। এই গুহার ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে লাল, বাদামি আর সাদা রঙে আঁকা গরু, পশুপালকের জীবনযাত্রা আর ধর্মীয় আচার ব্যবস্থার রঙিন চিত্রকলা। ধারণা করা হয়, এগুলোর বয়স প্রায় ৫,০০০ বছর। এই চিত্রগুলো শুধু শিল্প নয়, সোমালি উপকূলীয় সভ্যতার জীবন্ত দলিল। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, প্রাচীন পশুপালকেরা এখানে বৃষ্টি আর সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করত।
কালা মাদো পাহাড়ি রেঞ্জ
এই দেশটির কিছুটা উত্তরে গেলে দেখা যাবে প্রকৃতির অপার বিষ্ময় কালা মাদো পাহাড়ি রেঞ্জ। যেহেতু দূর থেকে পাহাড়গুলোকে কালো রঙের দেখায়, তাই এর নাম রাখা হয় ‘কালো পাহাড়’।
এর পাহাড়চূড়াগুলো অনেকটা ঢেউ খেলানো, কোথাও খাড়া দেয়ালের মতো আবার কোথাও মসৃণ ঢাল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, পুরোটা যেন কালো আগ্নেয়লাভার স্তূপ। আশপাশের সবুজ বন বা অন্য রঙের পাথর এর জন্য কালো পাহাড়টি আলাদা করে স্পষ্ট চোখে পড়ে। অনেক সময় কুয়াশা বা মেঘে ঢেকে গেলে পাহাড়টা আরও রহস্যময় মনে হয়।

দালো পাহাড়
এই কাল মাদোর ধারাবাহিকতায় উঠে আসে দালো পাহাড়। এটি সোমালিল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পাহাড়। বর্ষাকালে পাহাড়টির গা ভিজে চকচকে হয়ে যায়, তখন সবুজ আর বাদামি শিলার মিশ্রণে পাহাড়টা অসাধারণ লাগে। এই পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেলেই চোখে পড়বে আঁকাবাঁকা সরু পথ, চারপাশে গভীর জঙ্গল আর বাঁশঝাড় দেখা যায়।
এই পাহাড়ের চূড়া থেকে চারপাশের অন্য পাহাড়, নদী আর গ্রাম দেখতে পান। আর পাহাড়ের নিচেই রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ছোট ছোট গ্রাম, আর সেখানে গ্রামবাসীদের ঝুপড়িঘর আর ধানখেত পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।দালো পাহাড়ের ইতিহাসও বেশ উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন সময়ে যোদ্ধারা এই পাহাড়কে আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করত। এমনকি এখনও স্থানীয়রা এটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে দেখে।
বাটালালে বিচ
পাহাড়ি ভ্রমণ শেষে এবার আসি সমুদ্রতটে। সোমালিল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ হলো বাটালালে বিচ। এর সৈকতের বালু সোনালি রঙের, নরম ও বিস্তৃত। এখানে সূর্যের আলো পড়লে পুরো বালুময় অংশ ঝলমল করে ওঠে। সমুদ্রের পানি স্বচ্ছ নীলচে, কখনো আবার সবুজাভ দেখায়। ঢেউ তুলনামূলক শান্ত হওয়ায় সাঁতার কাটা, হাঁটা কিংবা আরাম করে বসে থাকার জন্য দারুণ উপযোগী।
আশপাশে আধুনিক কোলাহল নেই, তাই একেবারেই নিরিবিলি পরিবেশে প্রকৃতির স্বাদ পাওয়া যায়। এখানকার সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা হলো সূর্যাস্ত। এসময় আকাশ ধীরে ধীরে লাল, কমলা আর বেগুনি রঙে রাঙিয়ে ওঠে, আর সমুদ্রের ঢেউ যেন গান গেয়ে চলে।
বেরবেরা
সোমালিল্যান্ডের উপকূলীয় সৌন্দর্যের এক অন্যতম রত্ন হলো বেরবেরা। লাল সাগরের তীরে অবস্থিত এই বন্দরনগরী শুধু অর্থনৈতিক গুরুত্বই রাখে না, বরং ভ্রমণকারীদের জন্যে একটি চমৎকার প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। এখানকার সৈকতগুলো সাদা এবং সূক্ষ্ম বালি দিয়ে ঢাকা, যেখানে নীল জলরাশির সঙ্গে রঙিন মাছের ছটা চোখে পড়ে। প্রাচীন এই বন্দরঘাট আজও সক্রিয় এবং স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় ইতিহাস ও আধুনিকতার এক অনন্য সংমিশ্রণ।

সারিয়ান মিউজিয়াম
দেশটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থান হলো সারিয়ান মিউজিয়াম। ছোট হলেও এটি এক অমূল্য ভাণ্ডার, যেখানে সোমালিল্যান্ডের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে। জাদুঘরের প্রদর্শনী ঘরগুলোতে চোখে পড়ে স্থানীয়দের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, প্রাচীন সরঞ্জাম এবং ইতিহাসের নথিপত্র। প্রতিটি নিদর্শন যেন অতীতের গল্প বলছে, যেখানে ফুটে উঠেছে সোমালিল্যান্ডের সমাজ, মানুষের জীবনযাত্রা এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরিবর্তনের ছাপ।
জিগ জিগা ইয়ার মসজিদ
এছাড়াও, রাজধানী শহর হারগেইসার এর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জিগ জিগা ইয়ার মসজিদ ,স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় কেন্দ্র। মসজিদটি সাদা বা হালকা ক্রিম রঙের দেওয়াল দিয়ে গঠিত, যেখানে মাঝারি আকারের মিনার এবং অর্ধবৃত্তাকার দরজা ও জানালা আছে। ছোট হলেও এর ঐতিহ্য এবং সামাজিক প্রভাব অনন্য।
মসজিদটি শহরের ব্যস্ত বাজারের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে চারপাশে মানুষের কোলাহল, বিক্রেতাদের ডাকধ্বনি এবং রাস্তার রঙিন জীবনধারা প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। আর তাই ভ্রমণকারীরা এখানে এসে কেবল ধর্মীয় স্থাপনা দেখেন না, বরং স্থানীয় জীবনের ছোঁয়া, মানুষের বিশ্বাস এবং প্রতিদিনের রুটিনের সঙ্গে মসজিদের সংযোগও অনুভব করেন।
সোমালিল্যান্ডের সংস্কৃতি
সোমালিল্যান্ডে ধর্মের দিক থেকে এখানকার প্রায় সমস্ত মানুষই মুসলমান। আর তাদের মধ্যে সুন্নি ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ধর্মিক চর্চা এখানে শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাস নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও গভীরভাবে মিশে আছে। ধর্ম শিক্ষার সঙ্গে জীবনযাত্রার নিয়মকানুন, সামাজিক আচরণ এবং পরিবারিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।
সোমালিল্যান্ডের মানুষের পোশাক ও খাবারের ধরণেও তাদের ধর্ম এবং ইতিহাসের প্রতিফলন পাওয়া যায়। এখানে পোশাকে যেমন ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। পোশাকের দিক থেকে পুরুষরা সাধারণত “মাকাওয়িস” নামে পরিচিত একটি পোশাক পরে। এটি দেখতে অনেকটা লুঙ্গির মতো, তবে হালকা কাপড়ে তৈরি বলে মরুভূমির গরম আবহাওয়ায় আরাম দেয়। এর সঙ্গে তারা লম্বা জামা পরে এবং মাথায় “কুফি” বা ছোট টুপি ব্যবহার করে, যা তাদের কাছে একদিকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ।
অন্যদিকে নারীদের পোশাকে রঙ এবং বৈচিত্র্যের সমাহার দেখা যায়। তারা সাধারণত ঢিলেঢালা, রঙিন পোশাক পরে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে “গুন্টিনো” বলা হয়। এর সঙ্গে হিজাব বা ওড়না ব্যবহার করে, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়।

এদিকে, ভাষাও সোমালিল্যান্ডে বসবাসকারী মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের অংশ। তাদের মূল ভাষা হলো সোমালি, যা দেশের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। তবে, আরবি ভাষাকেও তারা শিক্ষা, ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করে। এই দুই ভাষার সমন্বয় সোমালিল্যান্ডকে বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
সোমালিল্যান্ড সাহিত্য ও শিল্প বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। মৌখিক সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা ও গান, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সোমালি কবিতাকে আফ্রিকান সাহিত্যে “গান্ধারী ধারা” হিসেবে অভিহিত করা হয়। এখানে কবিতা শুধুমাত্র শিল্প নয়; এটি তাদের সমাজের ভাব, ইতিহাস এবং ক্ল্যানভিত্তিক সংঘর্ষ ও ঐক্যের গল্প বহন করে। অনুষ্ঠান, উৎসব ও সামাজিক সমাবেশে এই কবিতার মাধ্যমে মানুষদের মধ্যে সংহতি, ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক গর্ব বজায় থাকে।
সোমালিল্যান্ডের ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠান ও উৎসবও তাদের সমাজের মূল আকর্ষণ। জন্ম, বিবাহ, ধর্মীয় উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে গান, নৃত্য এবং কবিতা সবসময় অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু, সোমালিল্যান্ডের অর্থনীতি মূলত গবাদিপশুর ওপর নির্ভরশীল, তাই পশুপালন মেলাও তাদের সাংস্কৃতিক জীবনের অংশ। বিশেষ করে উট সোমালি সংস্কৃতিতে মর্যাদার প্রতীক, অনেক সময় লোকজ উৎসবে উট দৌড় প্রতিযোগিতা বা প্রদর্শনীও হয়।
এবার আসি খাবারের কথায়। সোমালিল্যান্ডের খাবার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় হলেও কয়েকটি সাধারণ উপাদান সবখানেই পাওয়া যায়। ভাত, রুটি, উটের মাংস, ছাগলের মাংস এবং মাছ এখানে সবচেয়ে প্রচলিত। বিশেষ করে ভাতের সঙ্গে মাংস রান্না সোমালিল্যান্ডবাসীর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার অংশ। তবে, চায়ের সংস্কৃতি এখানকার মানুষের জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক কাপ চা ছাড়া তাদের দিন যেন অসম্পূর্ণ। এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ মিশিয়ে দুধ-চা বানানো হয়, যা অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে বন্ধুদের আড্ডা সব ক্ষেত্রেই অপরিহার্য। মজার বিষয় হলো, সোমালিল্যান্ডের রান্নায় অতিরিক্ত ঝালের ব্যবহার নেই।
সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনতায় বাঁধা কোথায়?
আফ্রিকান ইউনিয়নের স্বীকৃতি
এত সুন্দর একটি দেশ, তবে তাদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো, আফ্রিকান ইউনিয়নের স্বীকৃতির অভাব। তারা মনে করে, যদি সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি পায়, তবে আফ্রিকার অন্য অনেক জাতিগোষ্ঠীও আলাদা রাষ্ট্রের দাবি তুলবে, যা মহাদেশজুড়ে সীমান্ত বিভাজনের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। ফলে আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্যরা সোমালিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
জাতিসংঘ ও পশ্চিমা শক্তি
অন্যদিকে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা শক্তিগুলোও মূলত সোমালিয়ার ঐক্য ধরে রাখার নীতি অনুসরণ করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে, স্বীকৃতির প্রশ্নটি নতুন করে আঞ্চলিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে সোমালিল্যান্ডকে এখনো “ডি ফ্যাক্টো” রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করতে হলেও কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক দিক থেকে বৈধ রাষ্ট্রের সুবিধা ভোগ করতে পারছে না।
ফলে বড় ধরনের বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সোমালিল্যান্ডের সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। যদিও ইথিওপিয়া, জিবুতি বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তবুও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া তা পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
সোমালিল্যান্ড এর চিত্র আফ্রিকার অন্য অংশের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে ভিন্ন এবং বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। এখানকার মানুষ মূলত সোমালি জাতিগোষ্ঠীর অংশ, তবে তারা নিজেদের আলাদা পরিচয় এবং ঐতিহ্যের প্রতি অত্যন্ত গর্বিত। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ছাড়াই কিভাবে একটি ভূখণ্ড কার্যত রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারে, তার বাস্তব নিদর্শন হলো এ দেশ।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায় এই বাস্তবতা কি কোনোদিন “আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্র” হিসেবে আন্তর্জাতিক মানচিত্রে স্থান পাবে? নাকি এটি চিরকালই “অঘোষিত স্বাধীন দেশ” হয়েই টিকে থাকবে? এই অঞ্চলটি তার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠুক এই কামনা করে শেষ করছি বিশ্ব প্রান্তরের আজকের পর্ব।

