Image default
এশিয়াদেশ পরিচিতি

মরুভূমি থেকে বিশ্ব রাজনীতির ময়দান ইরাক

মাঝ রাতের অন্ধকারে বোমার ধোঁয়া আর বন্দুকের শব্দে ভারী হয়ে উঠেছে বাগদাদের রাস্তাগুলো। হাজার বছরের সভ্যতার শহর এখন আগুন আর ধ্বংসের ময়দান। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর তীরে জন্ম নেওয়া দেশটি এখনো গর্জে ওঠে। নতুন করে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য লড়াই করছে। হ্যাঁ, এটাই আজকের ইরাক। সভ্যতার সূতিকাগার, আর যুদ্ধ-নিপীড়নের চিরচেনা প্রতিচ্ছবি। 

ইরাকের আয়তন, জনসংখ্যা ও অবস্থান  

ইরাক নামটা শুনলেই অনেকের মনে ভেসে ওঠে যুদ্ধ, ধ্বংস আর কষ্টের ছবি। কিন্তু এক সময় এখানেই রচিত হয়েছিলো পৃথিবীর প্রথম লিখিত আইন, প্রথম শহর এবং সভ্যতার ভিত্তি। ইরাকের অবস্থান যেন এক কৌশলগত দাবার চাল। পশ্চিমে সিরিয়া, পূর্বে ইরান, উত্তরে তুরস্ক আর দক্ষিণে সৌদি আরব আর কুয়েত। প্রায় চার লক্ষ আটত্রিশ হাজার তিন শত সতেরো বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির জনসংখ্যা প্রায় চার কোটি ত্রিশ লাখের মতো।  কিন্তু আজ, সন্ত্রাস আর স্থানীয় বিদ্রোহের মধ্যেই টিকে আছে দেশটি। সব মিলিয়ে ইরাক, মধ্যপ্রাচ্যের ঠিক মাঝখানে বসে থাকা এক পুরনো বইয়ের পাতা। 

ম্যাপ

ইরাকের জলবায়ু বৈচিত্র্য

ভৌগোলিকভাবে ইরাককে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। প্রথমত, উত্তরের কুর্দিস্তান অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা। এখানকার জাগরোস পর্বতমালার চূড়াগুলো শীতকালে বরফে ঢেকে যায়, আর গ্রীষ্মে সবুজে ছেয়ে ওঠে। শুনে অবাক লাগলেও, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এখানকার তাপমাত্রা ০°C পর্যন্ত নেমে যেতে পারে! এর পাশাপাশি, রয়েছে মধ্য ও দক্ষিণ ইরাকের নদী অববাহিকা। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর প্রবাহ এখানে গড়ে তুলেছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম কৃষি সভ্যতা। আজও দেশের প্রায় ৭০% কৃষিজমি এই অঞ্চলেই অবস্থিত। অন্যদিকে, পশ্চিম ও দক্ষিণ ইরাক জুড়ে রয়েছে বিস্তৃত মরুভূমি। রুব আল-খালি মরুভূমির একটি অংশ এখানেও ছড়িয়ে আছে। গ্রীষ্মকালে এখানকার তাপমাত্রা ৫০°C ছাড়িয়ে যায়, আর সেই সঙ্গে শুরু হয় ভয়ানক বালুঝড় “শামাল”, যা আকাশকে লালচে ধুলোর চাদরে ঢেকে দেয়! আশ্চর্য হলেও সত্যি, দেশের প্রায় ৪০% এলাকা মরুভূমি, কিন্তু সেখানে বাস করে মাত্র ২% মানুষ।

এই ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল ইরাকের জলবায়ুকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। ইরাকের জলবায়ু যেন “আগুন” আর “বরফের” খেলা। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণের মরুভূমিতে রোদের তীব্রতায় রাস্তার পিচ পর্যন্ত গলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। বাতাসে আর্দ্রতা থাকে প্রায় শূন্যের কোঠায়, আর ধুলিঝড়ের দিনে দৃশ্যমানতা নেমে আসে ১০ মিটারের নিচে। শীতকালে উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে তুষারপাত হয়। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, ইরাকে বরফ পড়ে! অথচ এর মাত্র ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে বসরায় তখনো গরমে রাস্তায় চলা দায়! বসন্ত ও শরৎ এখানে খুবই স্বল্পস্থায়ী। কিন্তু ওই সময়টুকুতেই প্রকৃতি যেন নদী তীরের ধূসর ভূমিকে সবুজ গালিচায় ঢেকে দেয়। ইরাকে বছরে গড়ে মাত্র ১০-১৫ দিন বৃষ্টি হয়। 

কিন্তু আজকের বাস্তবতা আরও কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইরাক মারাত্মক সংকটে পড়েছে। দক্ষিণের মরুভূমি প্রতি বছর ১% হারে বিস্তৃত হচ্ছে, আর উত্তরের বরফ গলছে আশঙ্কাজনক হারে। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পানির প্রবাহ গত ৫০ বছরে ৪০% কমে গেছে। 

ইরাকের ইতিহাস

কিউনিফর্ম লিপির পাথরের ফলক

আর এই দুই নদীর মাঝের উর্বর উপত্যকাকেই বলা হয় একও সময়ের ‘মেসোপটেমিয়া’। মেসোপটেমিয়া শব্দটির অর্থ “দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি”। আজকের মানচিত্রে এই মেসোপটেমিয়ার প্রধান অংশটাই পড়ে ইরাকের মধ্যে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের কাছাকাছি সময়েই এখানে জন্ম নেয় পৃথিবীর প্রথম প্রামাণ্য সভ্যতা, “সুমেরীয় সভ্যতা।” তারাই গড়ে তোলে ‘উরুক’ নামে প্রথম শহর, তৈরি করে কিউনিফর্ম নামের লিখনপদ্ধতি, আর নিয়ে আসে ধর্ম, আইন, চাকা, গণনা ও ক্যালেন্ডারের ধারণা।

আক্কাদীয় সাম্রাজ্য- পৃথিবীর প্রথম আইন

এর কিছু শতাব্দী পর, খ্রিস্টপূর্ব ২৩শ শতকে উঠে আসে আক্কাদীয় সাম্রাজ্য। এটি ছিল বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম কেন্দ্রীয় শাসিত সাম্রাজ্য। সুমের ও আক্কাদের মিলিত ঐতিহ্য থেকেই আসে ব্যাবিলোনীয় ও আসিরীয় সংস্কৃতি। খ্রিস্টপূর্ব ১৮শ শতকে ব্যাবিলোনের রাজা হাম্মুরাবি রচনা করেন “হাম্মুরাবির বিধি”। মানব ইতিহাসের প্রথম লিখিত আইন। খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ শতক থেকে শুরু করে প্রায় সাতশ বছর ধরে আসিরীয়রা গড়ে তুলেছিল এক দুর্ধর্ষ সাম্রাজ্য। এরা যুদ্ধ, শাসনব্যবস্থা ও নির্মাণশিল্পে প্রভাব রেখে গেছে।

সময় গড়াতে গড়াতে, এই অঞ্চল চলে আসে পারস্যের আচেমেনিদদের হাত ধরে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এরপর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়, সেলেউকিড শাসন, পার্থিয়ান ও সাসানীয় পারসিক রাজবংশের পালাবদল ঘটে। এই দীর্ঘ সময়ে মেসোপটেমিয়া হয়ে ওঠে এক অনন্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

ইরাকে মুসলিম শাসন

৬৩৭ সালে মুসলিম বাহিনী পারসিকদের পরাজিত করে অঞ্চলটির দখল নেয়। একশ বছরের মাথায়, ৭৬১ সালে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর তিগরিস নদীর তীরে প্রতিষ্ঠা করেন বাগদাদ। অচিরেই  বাগদাদ হয়ে ওঠে সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। এখানেই গড়ে ওঠে ‘’বাইতুল হিকমাহ” বা হিকমতের ঘর। যেখানে গ্রিক দার্শনিক, ভারতীয় গণিতবিদ ও ফারসি চিকিৎসাবিদদের লেখা অনুবাদ করা হত। গণিতবিদ আল-খোয়ারিজমি এখান থেকেই “অ্যালগরিদম”-এর ধারণা দেন। বাগদাদ হয়ে ওঠে চিকিৎসা, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের এক তীর্থ। ১২৫৮ সালে হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল বাহিনী বাগদাদে হামলা চালায়। এই হামলায় পুরো শহর ধ্বংস হয়ে যায়। পুড়িয়ে ফেলা হয় হিকমতের ঘর। এই শহরের ধ্বংসস্তূপের নিচে অগণিত পাণ্ডুলিপি আর হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে যায়।

ইরাকের স্বাধীনতা

১৯৩২ সালে ইরাকের স্বাধীনতার সময়কাল

পরে আসে তুর্কি ও স্থানীয় শাসকদের অস্থির শাসন। ১৫৩৪ সালে ওসমানীয়রা ইরাক দখল করে এবং প্রায় ৪০০ বছর শাসন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় পতনের পর ব্রিটিশরা ইরাক দখল করে।  এবং ১৯৩২ সালে ইরাক স্বাধীনতা পায়। এরপর ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থান, ১৯৬৮-তে বাথ পার্টির উত্থান ও সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতা গ্রহণ করে। তার শাসনে ইরান-ইরাক যুদ্ধ ও কুয়েত আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটে। ২০০৩ সালে আমেরিকা ও তার মিত্রবাহিনী ইরাক আক্রমণ করে, সাদ্দাম হোসেনকে অপসারণ করে। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা, গৃহযুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবাদের উত্থান।

সদ্দাম হোসেইনের পতনের পর ইরাকে একটি গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার সূচনা হয়। বর্তমানে দেশটি একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র।  সংবিধান অনুযায়ী, রাস্ত্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি হলেও প্রকৃত ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

ইরাকের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজন। শিয়া, সুন্নি এবং কুর্দিদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে সংঘাত চলতেই থাকে। ইরাকের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে শিয়া-সমর্থিত ‘দাওয়া পার্টি’, কুর্দি নেতৃত্বাধীন ‘কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (KDP)’, এবং সুন্নিদের বিভিন্ন ছোট দল। রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন ও বিদেশি হস্তক্ষেপ দেশটির ভবিষ্যৎকে ধোঁয়াটে করে রেখেছে।

ইরাকের অর্থনীতি

এই রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি প্রভাব ফেলে দেশের অর্থনীতির ওপর। ইরাক, তেলনির্ভর অর্থনীতির এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ইরাকের প্রায় ১৪৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের রিজার্ভ রয়েছে! দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ৯০% আসে তেল রপ্তানি থেকে। এই বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থা বরাবরই টালমাটাল। অন্যদিকে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, এবং নিরাপত্তার কারণে কৃষি ও শিল্প খাতে ইরাক অনেক পিছিয়ে রয়েছে। 

বর্তমানে ইরাকের অনেক মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসই আমদানি করা লাগে। এইসব আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে খাদ্যদ্রব্য, যন্ত্রাংশ, ও ওষুধ। বর্তমানে চীন ইরাকের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার; বিশেষ করে তেল খাতে। এছাড়াও পর্যটন খাত থেকে আসে মোট জিডিপির ২%।  কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে পর্যটনের অবস্থাও খারাপ। 

ইরাকের পর্যটন স্থান

নাজাফ ও কারবালা

তবুও, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক নাজাফ ও কারবালায় আসেন। আরবাঈন উপলক্ষে কারবালায় জমে ওঠে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। শিয়া মুসলিমদের জন্য এই দুটি শহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র। কারবালার ইমাম হুসেইনের মাজার এবং নাজাফের ইমাম আলীর মাজার এই অঞ্চলকে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের জন্য পবিত্র ভূমিতে পরিণত করেছে। আরবাঈনের সময়, যা আশুরার ৪০ দিন পর পালিত হয়, কারবালায় অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ—যেখানে কোটি মানুষ হেঁটে আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। এই সময়কার বিশাল পদযাত্রা, সেবা কার্যক্রম এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশ এই স্থানকে শুধু ধর্মীয়ভাবে নয়, সাংস্কৃতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

নাজাফ ও কারবালা

উরের জিগগুরাট

এছাড়াও ইরাকে ছড়িয়ে রয়েছে সুমেরীয়, বাবেলীয়, আক্কাদীয় আর আসিরীয় সভ্যতার অনেক নিদর্শন। দক্ষিণ ইরাকে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘উরের জিগগুরাট।’ প্রায় ৪০০০ বছর আগে নির্মিত হয় পিরামিড-আকৃতির এই মন্দির। এখানে সুমেরীয়রা পূজা করত চন্দ্রদেব নান্নার।

উরের জিগগুরাট

আল-মুস্তানসিরিয়া মাদ্রাসা

এর থেকে সামনে গেলেই বাগদাদ। এখানেই আছে আল-মুস্তানসিরিয়া মাদ্রাসা। ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসা ছিল ইসলামী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র। এর কারুকাজ, প্রাচীন লাইব্রেরি ও প্রশস্ত আঙিনা এক নিঃশব্দ ঐতিহাসিক ঘ্রাণ ছড়ায়। তারপর চোখে পড়েবে সামারার বিস্ময়, ‘মালউইয়া মিনার’। ৯ম শতকে নির্মিত এই প্যাঁচানো মিনারটি  ৫২ মিটার উঁচু। 

এরবিল সিটাডেল

উত্তর ইরাকে গেলে চোখে পড়বে এরবিল সিটাডেল। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম বাসযোগ্য দুর্গগুলোর একটি। আজও এর প্রাচীন দেয়াল ও গলি বয়ে নিয়ে চলে কুর্দিস্তানের হাজার বছরের ইতিহাস। পাশেই সুলাইমানিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে রয়েছে আহমাদ আওয়া ঝরনা। এছাড়াও এখানকার দারবন্দিখান ও দুকান লেক দুটি সমুদ্র না হয়েও সী-বিচের আনন্দ এনে দেয়। আবার গালি আলি বাগ ক্যানিয়ন-এ গেলে পাওয়া যায় অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ। বিশাল ঝরনা, পাথরের খাঁদ আর প্রাকৃতিক শিলার গঠন বাস্তবে দাঁড়িয়ে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। 

এরবিল সিটাডেল

ইরাক ন্যাশনাল মিউজিয়াম

সবশেষে ইরাকের সংস্কৃতি দেখতে হলে যেতে হবে বাগদাদের ‘ইরাক ন্যাশনাল মিউজিয়াম’-এ। সুমেরীয়, বাবেলীয়, আক্কাদীয় ও আসিরীয় সভ্যতার হাজারো নিদর্শন রয়েছে এখানে। একটা দেশকে চেনার সহজ উপায় হচ্ছে তার খাবার, মানুষের পোশাক, আর সংস্কৃতি দেখা। 

ইরাকের সংস্কৃতি

আশুরা উপলক্ষে কারবালার মাতম ও মিছিল

এ কথা সত্য যে, ইরাক আরব বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্যাবিলন, সুমের, এবং আসিরিয়ানদের এই মাটি যুগে যুগে নানা জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনস্থল হয়ে উঠেছে। ফলে, আজকের ইরাকি সমাজেও সেই বহুস্তর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতিফলন স্পষ্ট দেখা যায়।

ইরাকের সংস্কৃতি অনেকটাই ইসলাম ধর্মকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তবে এর গভীরে রয়েছে মেসোপটেমিয়ান, পারস্যীয় ও অটোমান প্রভাব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব হলো আশুরা। কারবালায় ইমাম হুসাইনের শাহাদতের স্মরণে ইরাকজুড়ে লাখ লাখ মানুষ মিছিল, মাতম এবং নীরব প্রার্থনায় অংশ নেন। এই আশুরা উৎসব ইরাকের জাতীয় চেতনার অংশ হয়ে উঠেছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইরাকি উৎসব হলো নওরোজ। ইরানিদের মতোই, ইরাকেও পালিত হয় এই বসন্ত উৎসব। এটি মূলত কুর্দিস্তান অঞ্চলে উদযাপিত হয়। এই সময় মানুষ নতুন জামা পরে, ঘরবাড়ি সাজায় এবং পরিবারসহ আনন্দে মেতে ওঠে।

ইরাকি খাবার দেশটির সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইরাকি রান্নায় আরব, পারস্য, তুর্কি ও লেভান্ত অঞ্চলগুলোর প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়।মাসগূফকে ইরাকের জাতীয় খাবার বলা যেতে পারে। এটি টাইগ্রিস বা ইউফ্রেটিস নদীর মাছ গ্রিল করে লেবু ও বিভিন্ন মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। অন্যান্য জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে কুব্বা, ডলমা, ফালাফেল, তাব্বুলে এবং হরিসা। ইরাকি রান্নায় ব্যবহৃত হয় নানা ধরনের মসলা যেমন দারুচিনি, এলাচ, কিশমিশ, বাদাম ও খেজুর। এগুলো খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। 

সঙ্গীত ও সাহিত্যও ইরাকিদের সাংস্কৃতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইরাকের ঐতিহ্যবাহী তারযন্ত্র উড দিয়ে পরিবেশিত সঙ্গীত আজও জনপ্রিয়। পাশাপাশি, তরুণ প্রজন্ম ধীরে ধীরে আধুনিক কবিতা, নাটক ও সিনেমার প্রতিও আগ্রহ দেখাচ্ছে।

ইরাকের সাহিত্যিক ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল বিশ্বের প্রথম লিখিত ভাষা—সুমেরীয় কিউনিফর্ম লিপিতে। এখানেই জন্ম নেয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন মহাকাব্য “গিলগামেশের মহাকাব্য।” আব্বাসীয় যুগে বাগদাদ হয়ে ওঠে জ্ঞান ও সাহিত্যের কেন্দ্র। সে সময় গড়ে ওঠে বায়তুল হিকমা। এখানে গ্রিক, ফারসি ও হিন্দি ভাষার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ করা হতো। এই সময়েই আবির্ভাব ঘটে বিখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ আল-মুতানাব্বি, আল-জাহিজ প্রমুখের।

বিংশ শতকে, ইরাকে আধুনিক আরবি কবিতার বিকাশ ঘটে। নাজিক আল-মালাইকা ছিলেন প্রথম দিককার মুক্তকবিদের একজন। তিনি গদ্যধর্মী ছন্দে লেখালেখি শুরু করেন। আজকের দিনে, সিনান আন্তুন-এর মতো লেখকরা শরণার্থী জীবন, স্মৃতি, এবং যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে সাহিত্য রচনা করে যাচ্ছেন।

আজকের ইরাক

আজকের ইরাক এক যুদ্ধবিধ্বস্ত, কিন্তু প্রতিশ্রুতিশীল দেশ। ২০০৩ সালের যুদ্ধ, আইএস-এর উত্থান, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত হলেও দেশটি এখন ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতিগত বিভাজন এখনো স্পষ্ট। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নাগরিক আন্দোলন ও তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নতুন আশা জাগাচ্ছে।

তবুও নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যুদ্ধের মধ্যে জন্ম নেওয়া মানুষগুলো এখন পরিবর্তন চায়, চায় শান্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার। ইরাক এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে একদিকে দীর্ঘ ছায়ার মতো অতীত, অন্যদিকে অনিশ্চিত কিন্তু সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। 

Related posts

লেবানন – পৃথিবীর প্রাচীনতম সংস্কৃতির দেশ

শেখ আহাদ আহসান

ফিনল্যান্ড – সুখী দেশের মানুষ কেন আত্মহত্যা করে?

দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদের দেশ- আলজেরিয়া

ইসরাত জাহান ইরা

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More