আপনি যদি কখনো “নারুটো” বা “ড্রাগন বল জি” দেখে থাকেন, তাহলে বুঝবেন, জাপান কি পরিমাণের কল্পনা শক্তি কাজে লাগিয়ে এগুলো তৈরি করেছে !!!!
পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়াকে হার মানিয়ে মাত্র ৭০ বছরে হিরোশিমা, নাগাসাকিতে সভ্যতার ফুল ফুটিয়েছিল যে দেশ সেটি হল জাপান। বোমার আঘাতে যখন দেশটি একেবারে ক্ষতবিক্ষত, যখন গবেষকরা ভবিষ্যৎবাণী করেই দিয়েছিল দেশটি আর কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না; ঠিক তখনই নাগরিকদের কঠোর পরিশ্রমে জাপান আজ পৃথিবীর অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র। আর হয়তো সে কারণেই সূর্য সবার আগে উঁকি দেয় দেশটিতে।
এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর অন্যতম হলো জাপান। দেশটিকে সূর্যদয়ের দেশ বলা হয়। কারণ, জাপান ভৌগোলিক দিক থেকে পূর্ব দিকে অবস্থিত, তাই এই অঞ্চলে সূর্য সবার আগে ওঠে। জাপানিরা নিজেদেরকে “নিহোন” (Nihon) বা “নিপ্পন” (Nippon) বলে থাকে, যার অর্থ হলো “সূর্য উদয়ের স্থান” বা ‘’সূর্যের উৎস’’।
রাজধানীর নাম | টোকিও |
ভাষার নাম | জাপানি |
জনসংখ্যা | ১২ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ |
দেশের আয়তন | প্রায় ৩৭৭,৯৭৭ বর্গ কিলোমিটার (১৪,৫৭৩ বর্গ মাইল) |
মুদ্রার নাম | ইয়েন |
সময় অঞ্চল | ইউটিসি +৯ |
জাপানের ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন ও জনসংখ্যা
জাপান পূর্ব-এশিয়ায় অবস্থিত একটি দ্বীপ দেশ। এটি মূলত প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে, চীনের পূর্বে, এবং কোরিয়া উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
জাপান মূলত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র যার আয়তন মোট ৩, ৭৭, ৯৭৭ বর্গ কি.মি। আয়তনের দিক থেকে জাপান পৃথিবীর ৬৯ তম বৃহত্তম দেশ ।জেনে অবাক হবেন, জাপান মোট ৬৮৩৪টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত, তবে এর মধ্যে প্রধান ৪টি দ্বীপ হলো— হোনশু, হোক্কাইডো, কিউশু, এবং শিকোকু। দেশটির প্রায় ৯৮% ভূখণ্ড ধরে এই চারটি দ্বীপের অবস্থান।
২০২৩ সালের আনুমানিক হিসাবে, জাপানের জনসংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৫০ লক্ষ। তবে, দেশটির জনসংখ্যা নিয়ে একটি মজার বিষয় হলো, এর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। জাপানের জনসংখ্যার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, দিন দিন দেশটির জন্মহার কমে যাচ্ছে এবং গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাছাড়া, জাপান হলো উচ্চঘন বসতি সম্পন্ন দেশ। বিশেষ করে প্রধান শহরগুলো যেমন টোকিও, ওসাকা, এবং ইয়োকোহামাতে ঘনবসতি সবচেয়ে বেশি।
ম্যাপ
জাপানের ইতিহাস
জাপানের ইতিহাস হাজার বছরের পৌরাণিক। প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগের হাজার হাজার বছরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হলো আজকের জাপান।
প্রাচীন যুগে জাপান
জাপানের ইতিহাসের প্রমাণ পাওয়া শুরু হয় প্রাচীন প্যালিওলিথিক যুগ অর্থাৎ পাথরের যুগ থেকে। তবে, খ্রিষ্টপূর্ব ৮,০০০-৩০০ অব্দে জাপানের প্রথম পুরানো যে সভ্যতাটি গড়ে ওঠে তার নাম হলো জোমোন সংস্কৃতি। পরবর্তিকালে, জাপানে ইয়ায়োই সভ্যতা এবং কফুন সভ্যতার আবাসভূমি হয়ে ওঠে।
রাজতন্ত্র ও শোগুনতন্ত্র (Feudal Era and Shogunate)
জাপান তার রাজতন্ত্রের জন্য অনেক বেশি পরিচিত ছিল। ৭ম শতকের দিকে জাপানে রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। তাঙ্কা যুগ এবং হেইয়ান যুগ (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) এর মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতির এই মহাযাত্রার শুরু। এখান থেকেই জাপানে সাহিত্য ও চিত্রকলা প্রসারিত হওয়া শুরু করে।
এরপর আসে ফিউডাল যুগ, যেখানে শোগুন (মিলিটারি শাসক) এর নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়। প্রথম প্রতিষ্ঠিত শোগুনতন্ত্র ছিলো কামাকুরা শোগুনেট(১১৮৫-১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)।
এডো যুগ (1603-18)
জাপানে দীর্ঘ সময়ের জন্য শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছিল এডো শোগুনেট । এই সময়ে, দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়, তবে বিদেশি সম্পর্ক ঘটে বিপত্তি, তার প্রধান কারণ ছিল সীমিত বৈদেশিক সম্পর্ক।
মেইজি যুগ ও আধুনিককরণ (Meiji Era, 1868-1912)
এরপর শুরু হয় মেইজি যুগ। ১৮৬৮ সালে, যখন শোগুনতন্ত্রের অবসান ঘটে, তখন সম্রাট মেইজি (মুট্সুহিতো) আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য সংস্কার ও উন্নয়ন শুরু করেন। বিদেশি প্রযুক্তি এবং পশ্চিমা কৌশল অনুসরণ করে জাপান দ্রুত আধুনিকায়ন এবং শিল্পায়নে এগিয়ে যায়।
বিশ্বযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছিল জাপান ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান জার্মানির পক্ষে অবস্থান নেয়, যার কারণে জাপানকে সাক্ষী হতে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক পরমাণু বোমা হামলার। এই হামলার পরেই জাপান আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটায়।
আধুনিক যুগ
প্রচলিত একটি কথা আছে যে, শেষ থেকে শুরু। জাপান সেই প্রচলিত কথাটির বাস্তব প্রমাণ। ১৯৫০ দশকের পর থেকেই মূলত আধুনিক জাপানের যাত্রা শুরু। আমেরিকান সাহায্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের মাধ্যমে জাপান তার অর্থনীতি শক্তিশালী করতে পেরেছিল।
জাপানের জন্য ১৯৬০-৮০ সাল ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এ সময় সনি, টোকিও টেলিভিশন, টয়োটা, হোন্ডা, নিন্টেনডো, এবং মিতসুবিশি-এর মতো কোম্পানির উত্থান হওয়া পর আধুনিকীকরণ শুরু হয়। যদিও ১৯৮০-এর শেষ দিকে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। তবে, ২০০০ সালের মধ্যে জাপানিরা তাদের কঠোর পরিশ্রম ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে আজকের অনেক জাপানের সূচনা করেছে।
জাপানের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি
জাপান একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রিক দেশ। জাপানের প্রধানমন্ত্রী সকল রাজনৈতিক কাজ পরিচালনা করেন যদিও জাপানে রয়েছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। তবে, সম্রাট কোন রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করেন না, শুধু আনুষ্ঠানিক কাজগুলোতে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
তাই জাপানের শাসনব্যবস্থায় একদিকে যেমন রয়েছে গণতন্ত্রের ছোঁয়া সেই সাথে রয়েছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের মিশ্রণ। যা অন্য দেশের চেয়ে অনেকটা উন্নত ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো। জাপানের শাসন ব্যবস্থায় সম্রাট একটি প্রতীকী ভূমিকা পালন করেন এবং মূল শাসন ক্ষমতা থাকে সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
জাপানের জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট।
- প্রতিনিধি পরিষদ (House of Representatives)
- উপদেষ্টা পরিষদ (House of Councillors)
তাছাড়া জাপানে বহুদলীয় ব্যবস্থা রয়েছে তবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (LDP) দীর্ঘ সময় ধরে জাপানে রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রেখেছে ।
জাপানের বর্তমান সম্রাট হলেন নারুহিতো, যিনি ২০১৯ সালে সিংহাসনে বসেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হলেন ফুমিও কিশিদা (২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী)।
জাপানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
জাপান এক অদ্ভুত মজার জায়গা, যেখানে আপনি একদিকে দেখতে পাবেন শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য, আর অন্যদিকে দেখতে পাবেন পুরো আধুনিকতার ঝলক।
জাপানের “চা” অনুষ্ঠান
আর এর মধ্যে যদি জাপানের চা-অনুষ্ঠানের কথা বলি, তাহলে বলতে হয় যে, এটা একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা। চা অনুষ্ঠানটি মূলত জাপানি সংস্কৃতি একটি অংশ, যা অতিথির প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা দেখাতে করা হয়। এই অনুষ্ঠানে চা তৈরি করতে তারা মাচা, বাঁশের ঘুঁটনি এবং বিশেষ বাটি ব্যবহার করে। এরপর, অতিথিরা চা গ্রহণ করার সময় একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় বাটি গ্রহণ ও ফিরিয়ে দেন, যা একে অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ।
চা জাপানের শুধু পানীয় নয়, এটা কে একটা পুরো আধ্যাত্মিক যাত্রা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়! জাপানিরা চা কে “চাদো” বলে— যার অর্থ হলো চায়ের পথ। এখানে চা খাওয়ার প্রতিটি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ।
জাপানের ওবন ফেস্টিভ্যাল
জাপানিদের গ্রীষ্মকালীন উৎসব এর নাম “ওবন ফেস্টিভ্যাল”। এটি জাপানের প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব। জাপানিরা বিশ্বাস করেন যে, এই উৎসবে মৃতব্যক্তির আত্মা পুনরায় ফিরে আসে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটায় এবং উৎসব শেষে তাদের আত্মা আবার পরকালে ফিরে যায়।
জাপানিজ মাঙ্গা এবং অ্যানিমে
আর জাপানের মাঙ্গা আর অ্যানিমে—এগুলো তো একেবারে দুনিয়াজোড়া বিখ্যাত! শুধু দেশজুড়ে না, বিশ্বজুড়ে তরুণরা ঝুঁকেছে এই সংস্কৃতিতে। আপনি যদি কখনো “নারুটো” বা “ড্রাগন বল জি” দেখে থাকেন, তাহলে বুঝবেন, জাপান কি পরিমাণের কল্পনা শক্তি কাজে লাগিয়ে এগুলো তৈরি করেছে!
আর স্টুডিও ঘিবলি(Studio Ghibli) সিনেমার কথা তো না বললেই নয়। এর অ্যানিমেশনের স্টাইল যেমন অসাধারণ, তেমন থাকে মনোমুগ্ধকর ব্যাকগ্রাউন্ড শিল্প। “স্পিরিটেড অ্যাওয়ে” (2001), “মাই নেবার টোটোরো” (1988), “কিরিকিরি কিহো” (2004) এবং “প্রিন্সেস মনোনোকি” (1997) এর মতো চলচ্চিত্রগুলি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে জিতে, নিয়েছে অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার।
জাপানের মার্শাল আর্টস
এছাড়া, জাপানের মার্শাল আর্টস— এর কথা তো বলতেই হয়! জাপানের একটি বিখ্যাত নাট্য শিল্প হল, “কাবুকি” । যখন ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে তারা এই নৃত্য দেখা যায়, তখন আপনি থাকতে পারবেন জাপানিরা তাদের সংস্কৃতির সাথে কতটা যুক্ত । আর “জুডো” , “ক্যারাতে” দেখলে আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন যে এই লোকগুলো কি আসলেই মানুষ, নাকি সুপারহিরো?
জাপানিদের প্রকৃতি প্রেম
জাপানিদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল প্রকৃতির প্রতি তাদের যে অসম্ভব শ্রদ্ধা রয়েছে। জাপানে যখন সাকুরা ফুল ফোটে বা শরতের সময় পাতা রঙ বদলায়, তখন তারা পুরোপুরি সেই সৌন্দর্যের সঙ্গে এক হয়ে যায়। শুধু যে উপভোগ করে তা না, প্রকৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখায়। আর যখন শীতকাল আসে, তখন বরফ আর স্নো ফলের মাঝে সব কিছু যেন আরেকটা জগত হয়ে ওঠে—পৃথিবীর এক কোণে চুপচাপ হয়ে পড়ে থাকা, এক শান্তির সুর!
জাপানের চেরি ফুল উৎসব
আমরা সবাই নিশ্চয়ই চেরি ফুল (Sakura) এর কথা শুনেছি!! যা জাপানের জাতীয় ফুলের পাশাপাশি জাপানেরও সংস্কৃতির অংশ। প্রতিবার বসন্তে যখন চেরি গাছের ফুল ফুটে, তখন জাপানিরা একটি বিশেষ ধরনের উৎসব পালন করে যা “হানামি” নামে পরিচিত। এই উৎসব মূলত চেরি ফুলকে স্বাগতম জানানোর জন্য করা হয় । তারা বিশ্বাস করে, যদি আপনি সাকুরা (চেরি) গাছের নিচে বসে থাকেন, তাহলে আপনার জীবনের সব ক্লান্তির কথা ভুলে যাবেন ।
জাপানের বিখ্যাত খাবার
জাপানিজ সুশি
সুশি, আপনি জানেন তো, এটা শুধু খাবারই নয়, এক ধরনের শিল্প বলা চলে! এটি ভাত, সামুদ্রিক খাবার (মাছ, শেলফিশ ইত্যাদি) এবং শাকসবজি দিয়ে তৈরি হয়। সুশি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন নিগিরি (মাছ ভাতের উপর), মাকি (রোল সুশি), এবং সাশিমি (কাঁচা মাছ ছিঁড়ে কাটা)।
রামেন
আমরা সবাই তো কোরিয়ান রামেনের কথা শুনেছি। কিন্তু শুধু কোরিয়াতেই নয় এশিয়ার মধ্যে জাপানেও রামেন সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হিসেবে ধরা হয়। এটি বিশেষ প্রকারের নুডল, সয়া সস, মাংস (সাধারণত শুকনো মুরগি বা শুয়োরের মাংস), সবজি এবং ডিম দিয়ে তৈরি করা হয়।
মোচি
জাপানিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টি হল মোচি, যা গম বা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় এবং ভেতরে বিভিন্ন ধরনের ফল, ক্রিম বা লাল মার্সমেলো দেওয়া থাকে। এটি উৎসব বা বিশেষ দিনগুলোতে খাওয়ার জন্য তৈরি হয়।
বেন্টো বক্স
অনেক রেস্টুরেন্টে বর্তমানে একটি নতুন খাবার দেখা যাচ্ছে যার নাম ‘বেন্টো বক্স’। এটি একটি জাপানিজ খাবার বক্স, যা এক বা একাধিক খাবার দিয়ে পূর্ণ হয় এবং সাধারণত বিভিন্ন ধরনের নুডল, মাংস, সবজি, এবং মিষ্টান্ন দিয়ে সাজানো হয়। এটি বিশেষত কাজের মাঝে বা স্কুলে খাবারের জন্য জনপ্রিয় জাপানে।
জাপানের খাবারের ছবিগুলো একসাথে
জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা
জাপান এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসনীয় তার শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই হয়েছে। দেশেটি শিক্ষার্থীদের শুধু উচ্চ মানের শিক্ষাই নিশ্চিত করে না, সেই সাথে নৈতিক মূল্যবোধের দিকটিও তারা সু-নিশ্চিত করে।
জাপান প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের মোট ৯ বছর শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। মজার বিষয় হলো, শিক্ষার্থীদের এই ৯ বছর সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়াশোনা করানো হয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তর বাধ্যতামূলক না হলেও প্রায় ৯৭% শিক্ষার্থী এই স্তরে শিক্ষা গ্রহণ করে।
জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় মত বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জাপানেই অবস্থিত। জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের শুধু একাডেমিক জ্ঞান নয়, পাশাপাশি নৈতিকতা এবং সামাজিক দক্ষতায়ও পারদর্শী করে গড়ে তোলে। এটাই তাদের সাফল্যের মূল কারণ ধরা হয়ে থাকে।
তবে জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু নেতিবাচক দিকে রয়েছে। যেমন- পড়াশোনার চাপ বা প্রবেশিকা পরীক্ষার চাপ, অতিরিক্ত কাজ ও দীর্ঘ সময়ের শিক্ষা সূচী। যার দরুন অনেক শিক্ষার্থী বেছে নিচ্ছে আত্মহণনের পথ। তবে, তার জন্য জাপানের সরকার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এবং দেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
জাপানের পর্যটন আকর্ষণ
জাপানের অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হলো এখানে প্রাচীন স্থাপত্যের পাশাপাশি রয়েছে আধুনিক সব স্থাপনা।এছাড়া এখানকার শিল্প নিদর্শনগুলো পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। জাপানের পর্যটক শিল্পকে আরো উন্নত করেছে জাপানি নাগরিকদের পর্যটকদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ । জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় কয়েকটি পর্যটন আকর্ষণ হলো-
গোল্ডেন প্যাভিলিয়ন
গোল্ডেন প্যাভিলিয়ান (Golden Pavilion) বা কিনকাকুজি (Kinkaku-ji) হল জাপানের বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির যা জাপানের কিয়োটো শহরে অবস্থিত। এই স্থাপত্যটি তার সোনালী রঙের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। ১৪২২ সালে এটি বিনোদনমূলক প্যাভিলিয়ন হিসেবে তৈরি করা হলেও, পরবর্তীতে এটিকে বৌদ্ধমন্দির হিসেবে রূপান্তর করা হয়।
ওসাকার ক্যাসেল
ওসাকা ক্যাসেল জাপানে অবস্থিত একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক দুর্গ। দুর্গের ভিতর রয়েছে একটি মিউজিয়াম যেখানে দুর্গের ইতিহাস, নির্মাণ এবং টয়োটোমি(এই দুর্গের নির্মাণকারী) পরিবার সম্পর্কে বলা হয়েছে। এছাড়া দুর্গের বাহিরে রয়েছে একটি বাগান ও পার্ক, যা দর্শনার্থীদের আরো বেশি আকর্ষণ করে।
হিরোশিমার পিস মেমোরিয়াল পার্ক
এই পার্কটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি বহনকারী একটি স্থান। এই জায়গা শুধু আপনাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিবে তা না, সেই সাথে আপনাকে জাপানিদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও বলবে। এখানেই অবস্থিত রয়েছে জেনবুক গম্বুজ ও পিস মিউজিয়াম।
ওকিনাওয়ার বিচ
জাপানে ঘুরতে আসলে আপনার একবার হলেও যে জায়গা দেখা উচিত তা হল ওকিনাওয়া বিচ। এই বিচ তার ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ পানি এবং প্রাকৃতিক দ্বীপের জন্য বিখ্যাত। স্নরকেলিং, ডাইভিং, এবং রিলাক্সেশনের জন্য এই দ্বীপ অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণ।
মাউন্ট ফুজি
মাউন্ট ফুজি (Mount Fuji) জাপানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্বতগুলোর মধ্যে একটি। এটি যদিও সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, তবে শেষবার ১৭০৭ সালে এর থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। এর পর থেকে এটি সুপ্ত অবস্থায় আছে।
মাউন্ট ফুজিতে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। তবে গ্রীষ্মের সময়ে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) আরোহণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তাই এই সময় জাপান ভ্রমণ করলে মাউন্ট ফুজি অবশ্যই দেখে আসা উচিত ।
টোকিও টাওয়ার
টোকিও টাওয়ার (Tokyo) হল একটি বিখ্যাত টেলিভিশন ও রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্র, যা ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। এখানে উপরে দুটি দর্শন গ্যালারি রয়েছে— একটি ১৫০ মিটার উচ্চতায় এবং অন্যটি ২৫০ মিটার উচ্চতায়। এগুলি থেকে টোকিও শহরের বিস্তৃত দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। মেঘমুক্ত দিনগুলিতে, দর্শনার্থীরা মাউন্ট ফুজি পর্যন্ত দেখতে পারবেন। বিশেষ করে, রাতের বেলাতে এটি একটি আলোকিত স্তম্ভের মতো দেখা যায়।
আসাকুসার সেন্সোজি মন্দির
সেন্সজি মন্দির (Senso-ji Temple) জাপানের অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক বৌদ্ধ মন্দির, যা পর্যটক এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য একটি প্রধান আকর্ষণ। এই স্থান তার বিশাল লণ্ঠন এবং ঐতিহ্যবাহী মার্কেট এলাকার জন্যও পরিচিত। পর্যটকরা এখান থেকে স্মারক ও ঐতিহ্যবাহী খাবার কিনতে পারেন।
জাপানের অর্থনীতি
জাপানের অর্থনীতি একটি বিস্ময়কর গল্পের মতো। এই অর্থনীতি সংগ্রাম, পরিশ্রম এবং সৃজনশীলতার শক্তিতে গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পরও জাপান এর অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তা সত্যিই সকলের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। আজ জাপান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিল্প ও প্রযুক্তির শক্তি
জাপানকে বলা হয়ে থাকে “টেকনোলজির স্বর্গরাজ্য।” সনি, টয়োটা, নিশান, প্যানাসনিকের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো জাপানের নাম উজ্জ্বল করেছে। গাড়ি এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী উৎপাদনে জাপান এককথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু গাড়িই নয়, হাইব্রিড ইঞ্জিন এবং পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তিতেও জাপানের কোম্পানিগুলো সবার থেকে এগিয়ে আছে।
জাপানের রোবটিক্স শিল্পও বলার মতো। কারখানা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষায় এবং বাড়ির কাজেও রোবট ব্যবহার শুরু করেছে তারা। আপনি যদি একবার জাপানের কোনো আধুনিক শহরে যান, দেখতে পাবেন প্রযুক্তির ছোয়ায় জীবনযাপনের প্রতিটি দিক সহজ হয়েছে।
রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতি
জাপানিরা “মেড ইন জাপান” ব্র্যান্ডকে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস, গাড়ি এবং শিল্প-উপকরণ রপ্তানি করে দেশটি তার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে, টয়োটা ও হোন্ডার মতো কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত গাড়ি বিশ্ববাজারে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে।
কৃষি ও স্থানীয় উৎপাদন
অর্থনীতি শুধু প্রযুক্তি বা রপ্তানিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থানীয় কৃষি এবং মাছ ধরার শিল্পও জাপানের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদিও এই ক্ষেত্রটি আয়তনে ছোট, তবে উন্নত চাষাবাদ কৌশল এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাপান নিজেকে খাদ্যে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছে।
বিনিয়োগ ও বৈশ্বিক সংযোগ
জাপান বৈশ্বিক বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান এ রয়েছে। জাপানি কোম্পানিগুলো শুধু দেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজেদের কারখানা স্থাপন করেছে। পাশাপাশি, জাপান বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে থাকে যার মাধ্যমে উক্ত দেশ গুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, জাপান শুধুমাত্র একটি দেশ নয়, বরং একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত, যেখানে অতীত এবং ভবিষ্যত এক হয়েছে । সাকুরার সৌন্দর্য, মাঙ্গার কল্পনাজগৎ , এবং তাদের সংস্কৃতির গভীরতা আমাদের উপলব্ধি করায় যে, কীভাবে একটি জাতি স্বকীয়তা বজায় রেখে উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। জাপান তাই শুধুমাত্র ভূগোলের মানচিত্রে জায়গা করেনি, মানুষের হৃদয়েও জায়গা করে নিয়েছে।
জাপান নিয়ে বেশ কিছু মজার তথ্য
ভেন্ডিং মেশিন: আমাদের দেশে ভেন্ডিং মেশিনের প্রচলন খুব নতুন হলেও জাপানে প্রায় সর্বত্র ভেন্ডিং মেশিন দেখা যায়। সেখানে শুধু পানীয় নয়, বরং ডিম, চাল, এমনকি গরম খাবারও পাওয়া যায়।
জাপানে ট্রেন দেরি করানো রীতিমতো অপরাধ: জাপানের ট্রেনগুলি তাদের সময়ানুবর্তিতার জন্য বিখ্যাত। যদি একটি ট্রেন মাত্র ১ মিনিট দেরি করে, তবে চালক ও স্টাফদের শাস্তি ভোগ করতে হয় ।
ছাত্র-শিক্ষক ক্লাস পরিষ্কার করে: আমাদের দেশে কি কখনো এটা ভাবা যায় যে একসাথে এবং শিক্ষক ক্লাস পরিষ্কার করবে!! কিন্তু জাপানে ছাত্র-শিক্ষক একই সঙ্গে ক্লাসরুম পরিষ্কার করে।
অফিসে ঘুমানোঃ আমাদের প্রায় সময় কাজ করার মধ্যে মনে হয় যদি একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেত! কিন্তু মজার বিষয় হল জাপানে এটি খুবই স্বাভাবিক। কোন ব্যক্তি যদি অফিসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে সেটি জাপানে ইতিবাচক ভাবে দেখা হয় কারণ, তখন মনে করা হয় ব্যক্তির উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ রয়েছে ।
দীর্ঘায়ুর দেশ: জাপানিরা গড়ে ৮৫ বছর বেঁচে থাকেন, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মূলত তাদের স্বাস্থ্যকর খাবার ও জীবনযাত্রার কারণে এটি সম্ভব হয়।
রেফারেন্সঃ
- https://en.wikipedia.org/wiki/Japan
- https://www.teachers.gov.bd/blog/details/632830?page=4165&japan-smprke-kichu-ojana-tthz&fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTAAAR0j0I_WgP17-YkwSCwho9cH29xiBYyw_TCkEqEGzJIbMf5GN_fd1xLf0tw_aem_q-npLlpPbUimNx6lPghZPg
- https://bn.wikivoyage.org/wiki/%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8
- https://www.britannica.com/topic/history-of-Japan