কানাডার স্পটেড লেক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর রহস্যময়তা যেখানে মিলেমিশে একাকার। এই হ্রদের পানির দিকে তাকালে দেখা যাবে, শত শত রঙিন দাগের ঝলকানি, যা দেখলে অতি সংবেদনশীল পর্যটকদের গা শিউরেও উঠতে পারে। পানির মধ্যে এত রঙিন আঁকিবুঁকি এঁকে দিলো কে? এর পেছনে থাকা রহস্যটা-ই বা কী?
আয়তনে বিশাল এক দেশ কানাডা, যেটি তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। দেশটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য এতটাই মনোমুগ্ধকর যে দেখলে মনে হবে প্রকৃতি যেন এই দেশটিকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে দেশটিতে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত রহস্যময় স্থান, যাকে বলে ভয়ংকর সুন্দর৷ আর সেই স্থানটি হলো কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের স্পটেড লেক।
গ্রীষ্মকালে এই হ্রদের বুকে ফুটে ওঠা অজস্র রঙিন দাগ বা ‘স্পট’ এটিকে এক অদ্ভুত বিচিত্র এক রূপ দেয়। এটি কি শুধুই একটি দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক ঘটনা নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের জটিল কোন ব্যাখ্যা? আসুন, আমরা এই রহস্যময় হ্রদের গভীরে ডুব দিই এবং কানাডার এই রহস্যময় স্থানটিকে ঘিরে থাকা রহস্যগুলো বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করি।
ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ
স্পটেড লেক কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত। এটি ওসায়ুস (Osoyoos) শহরের প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, সিমিলকামিন উপত্যকার (Similkameen Valley) শুষ্ক ও উষ্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি কানাডার একমাত্র উষ্ণ মরুভূমি অঞ্চলের অংশ, যা ওকানাগান ভ্যালির দক্ষিণে বিস্তৃত। এখানকার জলবায়ু অত্যন্ত শুষ্ক, গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশ উচ্চ থাকে এবং বৃষ্টিপাত খুব কম হয়।
মূলত ভৌগোলিক অবস্থান এবং এর জলবায়ু স্পটেড লেকের অনন্য বৈশিষ্ট্য গঠনের অন্যতম প্রধান কারণ। এই লেকটি তুলনামূলকভাবে ছোট, প্রায় ০.১৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। মজার ব্যাপার হলো, স্পটেড লেকটি একটি এন্ডোরহেইক বেসিন (Endorheic Basin) – অর্থাৎ, এই হ্রদের পানি কোনো নদী বা সাগরের সাথে মিলিত হয় না। এর পানি শুধুমাত্র বাষ্পীভবনের মাধ্যমেই এই হ্রদ থেকে বেরিয়ে যায়, যার ফলে পানির গভীরে থাকা খনিজ পদার্থগুলো এখানেই জমা থাকে।
স্পটেড লেকের জন্মকথা: ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস
স্পটেড লেকের গঠন প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে এই অঞ্চলের জটিল ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, এর উৎপত্তি হয়েছে সর্বশেষ বরফ যুগের (Last Ice Age) শেষের দিকে। হাজার হাজার বছর আগে, এই অঞ্চলটি বিশাল বরফের চাদরে ঢাকা ছিল। কিন্তু কালের অববাহিকায়, ধীরে ধীরে জলবায়ু যত উষ্ণ হতে শুরু করে, এই হিমবাহগুলো তত বেশি গলতে শুরু করে। হিমবাহ গলার সময় প্রচুর পরিমাণে মাটি, পাথর এবং খনিজ পদার্থ বয়ে নিয়ে আসে।
এছাড়া হিমবাহ সরে যাওয়ার পর এই অঞ্চলে একটি নিচু অববাহিকা বা বেসিনও তৈরি হয়। আশেপাশের পাহাড় এবং উঁচু ভূমি থেকে বৃষ্টির পানি এবং ছোট ছোট ঝর্ণা বয়ে এসে এই অববাহিকায় জমা হতে থাকে। এই পানি আসার পথে শিলাস্তর থেকে প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ ধুয়ে নিয়ে আসে। যেহেতু এই হ্রদের পানি বাইরে যাওয়ার কোনো পথ নেই, তাই হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে আসা এই খনিজগুলো এখানেই জমা হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে বাষ্পীভবনের কারণে পানির পরিমাণ কমতে থাকে এবং খনিজগুলোর ঘনত্ব বাড়তে থাকে, যা আজকের স্পটেড লেকের ভিত্তি তৈরি করেছে।
স্পটেড লেকের রহস্যময় দাগ: বিজ্ঞানের চোখে ব্যাখ্যা
স্পটেড লেকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং রহস্যময় দিক হলো এর গায়ে ফুটে ওঠা অসংখ্য রঙিন দাগ। এই দাগগুলোর উৎস নিয়ে নানান ধরনের লোকগাথা বা জনশ্রুতি থাকলেও বিজ্ঞান বলছে, এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, বরং এর পিছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক কারণ। কারণগুলো হলো-
খনিজ উপাদানের প্রাচুর্য
এই হ্রদের পানিতে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের খনিজ লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এটি বিশ্বের অন্যতম খনিজ সমৃদ্ধ হ্রদগুলোর মধ্যে একটি।
স্পটেড লেকের পানিতে প্রধানত ম্যাগনেসিয়াম সালফেট,ক্যালসিয়াম সালফেট এবং সোডিয়াম সালফেট উচ্চ মাত্রায় পাওয়া যায়। এছাড়াও, এখানে রূপা, টাইটানিয়ামসহ আরও প্রায় দশ ধরনের খনিজ পদার্থের উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়েছে। যার ফলে এই খনিজগুলোই জমাটবদ্ধ হয়ে পানিতে ভেসে থাকে।
বাষ্পীভবনের ভূমিকা
গ্রীষ্মকালে, যখন এই অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হয়, তখন হ্রদের পানি দ্রুত বাষ্পীভূত হতে শুরু করে। পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে পানিতে দ্রবীভূত খনিজগুলোর ঘনত্ব বাড়তে থাকে।
ক্রিস্টালাইজেশন ও রঙের খেলা
যখন খনিজগুলোর ঘনত্ব একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছায়, তখন সেগুলো কঠিন স্ফটিকে (Crystal) রূপান্তরিত হয়। এই স্ফটিকগুলোই হ্রদের তলদেশে জমা হয়ে গোলাকার দাগ তৈরি করে। খনিজগুলোর ধরণ এবং ঘনত্বের উপর নির্ভর করে এই দাগগুলোর রঙও ভিন্ন ভিন্ন হয়। ম্যাগনেসিয়াম সালফেট সাধারণত সাদা বা হলুদাভ রঙ তৈরি করে। অন্যান্য খনিজ এবং শৈবালের উপস্থিতির কারণে সবুজ, নীল এবং বাদামী রঙের দাগও দেখা যায়।
গ্রীষ্মকালে যত বেশি গরম পড়তে থাকে, তার সাথে সাথে পানির স্তর আরও কমতে থাকে। যার ফলে, এই খনিজ স্ফটিকগুলো আরও শক্ত হয়ে ওঠে এবং দাগগুলোর মাঝে সাদা রঙের ‘ওয়াকওয়ে’ বা হাঁটার পথ তৈরি হয়, যা পুরো দৃশ্যটিকে আরও অদ্ভুত করে তোলে।
স্পটেড লেকের সাথে জড়িয়ে থাকা জনশ্রুতি ও বিশ্বাস
স্পটেড লেক কেবল একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, এটি কানাডার আদিবাসী ওকানাগান (Syilx) জনগোষ্ঠীর কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি স্থান। তাদের ভাষায় এই হ্রদের নাম ‘ক্লিলুক’ (Khiluk), যার অর্থ ‘পবিত্র জল’। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওকানাগান জনগোষ্ঠী এই হ্রদের পানিকে একটি শক্তিশালী নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
তারা বিশ্বাস করে যে, এই হ্রদের পানিতে এবং এর খনিজ দাগগুলোতে এক ঐশ্বরিক নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, হ্রদের বিভিন্ন দাগ বিভিন্ন ধরনের রোগ, যেমন – চর্মরোগ, বাত, এবং শরীরের নানা ব্যথা নিরাময়ে সক্ষম। তারা এই হ্রদের পানি ও কাদা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে পবিত্র পানি হিসেবে ব্যবহার করে। এমনকি রোগ নিরাময়ের ওষুধ হিসেবেও এই পানির ব্যবহার রয়েছে।
এছাড়া, ক্লিলুক বা স্পটেড লেক ওকানাগানদের কিংবদন্তী এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা বিশ্বাস করে, এই হ্রদেই তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা ও প্রাকৃতিক শক্তি মিলিত হয়েছে, যা তাদের জন্য এই লেকটি আশীর্বাদ স্বরূপ। একেক ঋতুতে লেকের পানি একেক রঙ ও রূপ ধারণ করে। ওকানাগানরা মনে করে, এই রঙের মাধ্যমে প্রকৃতি তাদের বার্তা দেয়। অর্থাৎ কানাডার স্পটেড লেকটি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করছে বলে বিশ্বাস করে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা।
কানাডার স্পটেড লেকটি যে ওকানাগান জনগোষ্ঠীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার প্রমাণ পাবেন এক ঘটনার মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই হ্রদটি ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে যায় এবং লেকটিকে একটি স্পা হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ওকানাগান জনগোষ্ঠী তাদের এই পবিত্র স্থানকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে। তাদের প্রাণপণ প্রচেষ্টার কাছে হার মানতে হয় কর্তৃপক্ষকে। স্থানীয়দের আন্দোলন এবং কানাডিয়ান সরকারের সহায়তায়, ২০০১ সালে প্রায় ২১ হেক্টর এলাকাসহ এই হ্রদটি কিনে নেওয়া হয়। লেকের সুরক্ষা ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ওকানাগান নেশন অ্যালায়েন্সের হাতে। এই লেক সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত আদিবাসী অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন ইতিহাসবিদরা।
কাছে যাওয়া বারণ
কানাডার স্পটেড লেকের অনন্য সৌন্দর্য এবং রহস্যময়তা সারা বিশ্বের পর্যটকদের দারুণ আকর্ষণ করে। আপনি হয়ত ভাবছেন, লেকের পানি একটু হাতে ছুঁয়ে দেখবেন কিংবা ঐতিহাসিক এই লেকটির সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সেলফি তুলবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
হ্রদটির কাছে যাওয়া এবং এর পানি ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। লেকটির সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং এটির পানিতে থাকা খনিজের কেমিক্যাল রিয়্যাকশনের কারণে এই লেকটিকে সব ধরনের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা হয়েছে।
পর্যটকরা যাতে দূর থেকে দেখতে পারে, সে কারণে হাইওয়ে ৩-এর পাশে একটি নির্দিষ্ট ভিউপয়েন্ট তৈরি করা হয়েছে এবং সেখানে একটি বেড়া দিয়ে তথ্যমূলক সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, যেখানে হ্রদের বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা। পর্যটকরা তাই বাধ্য হয়ে এই ভিউপয়েন্ট থেকেই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
বর্তমানে ওকানাগান নেশন অ্যালায়েন্স এবং কানাডিয়ান সরকার যৌথভাবে এই হ্রদ এবং এর আশেপাশের এলাকা সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য হলো এই প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা।
তথ্যসূত্র –
- https://bartamanpatrika.com/news/-spotted-lake
- https://www.tripadvisor.com/Attraction_Review-g181723-d1194040-Reviews-Spotted_Lake-Osoyoos_Okanagan_Valley_British_Columbia.html
- https://timesofindia.indiatimes.com/travel/destinations/exploring-the-magical-spotted-lake-of-british-columbia/articleshow/107167053.cms