এলোকেশি মামলা যেনো নারীর স্বাধীনতার চিরন্তন রুপ
সময় ১৮৭৩ সাল। হুগলী কোর্ট স্টেশন। বাইরে ভিড় থিক থিক করছে। গেটের দারোয়ান সবার টিকিট দেখে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। টিকিট মূল্য তৎকালীন সময়েই তিন টাকা। পাঠক এতোক্ষণে হয়তো বুঝে গেছেন কোনো সিনেমা বা নাটক দেখার জন্য সবাই টিকিট কেটেছে। না! কোনো নাটক বা সিনেমা দেখার জন্য কেউ টিকিট কাটেনি। বরং টিকিট কেটেছে মামলার শুনারি শোনার জন্য। কখনো শুনেছেন এমন কথা?
হ্যাঁ এমনটাই হয়েছিলো সে সময়ে। বৃটিশ ভারতের ইতিহাসে এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ ঘটনা, যেখানে মানুষ টিকিট কেটেছিলো মামলার শুনানি শোনার জন্য। এতো মানুষের ভিড় যখন টিকিটের ব্যবস্থা করেও সামলানো গেলো না তখন করা হলো অন্য ব্যবস্থা। বলা হলো যারা শুধু ইংরেজি জানে কেবল তারাই মামলার শুনানি শোনার জন্য ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে।
জানেন কি, কী এমন মামলা ছিলো যার জন্য মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট পর্যন্ত কিনতে রাজি ছিলো। একটি খুনের মামলার শুনানি। একটি অনার কিলিং মামলার শুনানি। যেখানে একজন স্ত্রী পরকীয়া করায় তার স্বামী তাকে মাছ বটি দিয়ে ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেছিলেন। স্বামী তার দোষ স্বীকার করা সত্ত্বেও তাকে বেকসুর খালাস করতে বাধ্য হয়েছিলো তৎকালীন বৃটিশ আদালত।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা ও অধিকার কতটা সংবেদনশীল ও রাজনীতিক ছিল, তা বুঝতে হলে এলোকেশি মামলার মতো ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি। “এলোকেশি মামলা” শুধু একটি আইনি ঘটনা ছিল না; এটি ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে নারীর স্বাধীনতা ও পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাখ্যান। ১৮৭৩ সালে সংঘটিত এই মামলায় নারীর শরীর, পছন্দ, এবং চরিত্রকে জনসম্মুখে টেনে আনা হয়। মামলা চলাকালীন “টিকিট কেটে” মানুষ শুনানি দেখতে যেতেন, যা আদালতের ঘটনাকে বিনোদনমূলক চেহারা দেয় এবং নারীর প্রতি সমাজের উৎকট কৌতূহলপ্রবণ দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্মোচিত করে।
এলোকেশি কেস: ঘটনা ও প্রেক্ষাপট
উনিশ শতকে ধর্ষণ তখনও এতটা জলভাত হয়ে যায়নি। রোজকার অভ্যাসের মধ্যেও এভাবে ঢুকে পড়েনি। উপরন্তু লজ্জা আর ভয়ে তখন মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিলে এলোকেশির এই ঘটনা। একদিকে তারকেশ্বরের মোহন্ত মাধবচন্দ্র গিরি, অন্যদিকে এলোকেশী নামের এক সাধারণ গৃহবধূ। আসলে ঘটেছিল কী, তারকেশ্বরের কাছে কুমরুল গ্রামেই এক গরিব ব্রাহ্মণের মেয়ে এলোকেশীর।
মা নেই। সৎমার কাছে খুব একটা আদর আহ্লাদের জীবন কাটেনি। তবে নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে বিয়ের পরে সে অবস্থা খানিক বদলায়। কুলীন প্রথার দৌলতে তখন বুড়ো বরের সঙ্গে বিয়ে হয় বালিকারও। তবে এলোকেশীর স্বামী নামের মতোই বয়সেও নবীন। কাজের সূত্রে দূরে থাকতে হয়, এই যা দুঃখ। আর এরই সুযোগ নিলেন এলোকেশীর সৎমা। তিনি মোহন্তের অনুগৃহীতা, মাঝে মাঝেই তারকেশ্বরে যান।
মোহন্তের নজর পুরনো প্রেম থেকে সরে গেল নতুন তরুণীর দিকে। টাকার লোভে এলোকেশীর বিমাতা তো বটেই, বাবাও রাজি। এদিকে বিয়ের অনেক দিন পার হয়ে গেলেও সন্তান হয় না এলোকেশির। তাই, সন্তান হওয়ার জন্য অলৌকিক ওষুধ দেবেন মোহন্ত, এই লোভ দেখিয়ে মেয়েকে মোহন্তের কাছে পাঠিয়েছিলেন তারা। তারপর মাদক খাইয়ে হোক বা যেভাবেই হোক, কাজ হাসিল করেন মোহন্ত।
সেই শুরু। একবার নয়, বারবার। এ কথা চাপা থাকে না। জানতে পারলেন এলোকেশীর স্বামী নবীনও। এলোকেশী সব কথা খুলে বলায় তিনি ঠিক করলেন, স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসবেন। সেখানেও মোহন্তের কাঁটা। পথে পথে পাহারা। রাগে ক্ষোভে অসহায় নবীন কোনও পথ পেলেন না। স্ত্রীর গলায় বসিয়ে দিলেন আঁশবঁটি। তারপর থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণও করলেন নিজেই। নবীনের এজাহার থেকেই গ্রেপ্তার হলেন মোহন্তও। এখান থেকেই শুরু এলোকেশি মামলার।
এলোকেশি মামলা এবং ঔপনিবেশিক সমাজের নারী ভাবনা
ঔপনিবেশিক ভারতে নারীকে একদিকে ‘বাড়ির লক্ষ্মী’ হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছিল, অন্যদিকে তাঁর সামাজিক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে এলোকেশির ঘটনা একটি ভাঙন সৃষ্টি করে। এলোকেশিকে হত্যার পরে তার স্বামী নিজেই আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। শুরু হয় মামলার ট্রায়াল। এই মামলাকে কেন্দ্র করে তখন দিনের পর দিন সরগরম থাকতো ভারতীয় এবং ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলি। একজন কুলীন গৃহস্থ কুলবধূর এমন কেচ্ছাকাহিনীতে শুনানির দিনগুলোতে ভেঙে পড়ত আদালত চত্বর।
আইনের ভাষায় এই মামলায় শিকার এলোকেশী এবং অপরাধী নবীন হলেও জনতা ততদিনে নবীনকে নির্দোষ আখ্যা দিয়েছে, যে স্বামী স্ত্রীর এতবড় অন্যায়ের পরেও তাকে পরিত্যাগ না করে নিয়ে পালাতে চেষ্টা করে সে জনতার চোখে মহান। এখান থেকেই আসলে বোঝা যায় তৎকালীন সময়ে সমাজে নারীর অবস্থান আসলে কেমন ছিলো। মোহন্তের পক্ষের উকিলের কথাতেও এর অনেকটা প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রসিকিউটার ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র বললেন, তবে তো নবীনের অভিযোগ ধোপেই টেকে না।
এলোকেশী আদতে একজন বারবণিতা ছিল, বেশ্যাকে আবার ধর্ষণের অভিযোগ কি করে হয়? মোহন্ত যা করেছে টাকার বিনিময়ে করেছে। এখানে নারীরই যত দোষ। নারীর শরীরে যেনো খুব সহজেই কলঙ্কের দাগ লেগে যায়। যাতে করে ‘অনার কিলিং’ হয় স্বামীল। সমাজে মাথা কাটা যায়। তাই হয়তো নবীন চন্দ্রও আঁশবটি দিয়ে ধর থেকে মাথা ছিন্ন করতে দুবার ভাবেন না।
পুরুষতন্ত্রের ছায়ায় পুরুষতন্ত্রেরই বলি এলোকেশি
ঔপনিবেশিক ভারতের সমাজব্যবস্থা ছিল দ্বিমুখী। একদিকে পশ্চিমা আদর্শ ও ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে সমাজে কিছু সংস্কারমূলক পরিবর্তন আসছিল (যেমন বিধবা বিবাহ আইন, সতীদাহ নিবারণ ইত্যাদি), কিন্তু অন্যদিকে ঐতিহ্যগত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো দৃঢ়ভাবেই অবস্থান করছিল।
এলোকেশি কাণ্ডে দেখা যায় এই দ্বৈত সমাজের দ্বিধা। তিনি যদি কোনো ভুল করে থাকেন, তবে তাঁর জন্য আইনগত ও সামাজিকভাবে সংশোধনের জায়গা রাখা যেত। কিন্তু তার বদলে তাকে “চরিত্রহীন”, “পাপী”, “লজ্জাহীন” হিসেবে দোষারোপ করে সমাজ। যার কারণে স্বামী নবীন চন্দ্র স্ত্রীকে হত্যার করার পরে নিজে মুখে স্বীকার করার পরেও তাকে শাস্তিুর রায় পাল্টাতে সমাজে মানুষের চাহিদার জন্য। কারণ সমাজের মানুষের চোখে এলোকেশি ছিলো কলঙ্কিত স্ত্রী। এমন কলঙ্কিত স্ত্রীকে নিয়েও যে নবীন পালাতে চেয়েছিলো এটাই নবীনকে মহৎ করে তোলে। এ যেনো পুরুষের ভালোবাসা পেয়ে পুরুষতন্ত্রেরই বলি এলোকেশি।
এলোকেশির বিমাতাকে আচরণে মনে হতে পারে এক স্বাধীন নারী। যে কিনা নিজের স্বামী জানা সত্ত্বেও পর পুরুষ মোহন্তের সঙ্গে রাত কাটায়। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়।তিনিও পুরুষতন্ত্র আর ক্ষমতার কাছে বন্দি। তিনি নিজেও আসলে পুরুষন্ত্রেরেই একটা অংশ। সে যদি পুরুষতন্ত্রের অংশই না হবেন তাহলে কেনো নিজের সতীনের মেয়েকে ওমন কাম লিপ্সু পুরুষের কাছে সপে দিয়ে আসবেন। এমনকি মেয়ের বাবাকে পর্যন্ত রাজি করিয়েছেন নিজের মেয়েকে স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরপুরুষের কাছে সপে দেওয়ার জন্য।
এলোকেশি মামলা: নারীর স্বাধীনতার চিরন্তন রুপ
প্রকৃতপক্ষে, এলোকেশি কেসের পুরো প্রক্রিয়া যেন সমাজের পক্ষ থেকে এক স্পষ্ট ঘোষণা, নারী যদি নিজের ইচ্ছায় চলতে চায়, তবে সমাজ তাকে ক্ষমা করবে না, পুরুষতন্ত্র তাকে ছাড়বে না। এই বিচার সামাজিক শৃঙ্খলার নামে নারীর আত্মপরিচয় ও ইচ্ছার শাস্তি।
নারীর চরিত্র এবং তার ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ তখন বিচার হয় তার পোশাক, চলাফেরা, এবং কার সঙ্গে কতটা সময় কাটায়, এইসব তথাকথিত প্রমাণের ভিত্তিতে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নারী স্বাধীনতার জন্য এক বিরাট বাধা। আজও, সমাজে নারীর প্রতি একই ধরনের মনোভাব দেখা যায়। বিশেষ করে মিডিয়া, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং আইনি প্রক্রিয়ায়। নারীর পোশাক, সম্পর্ক, বা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই চলে বিতর্ক। শুধু তাই নয়, বর্তমানে যে নারী আন্দোলনের সামনে থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তাকেই পরবর্তী সময়ে ছুড়ে ফেলতে এক মিনিটও সময় নেয় না পুরুষতন্ত্র।
আমরা জুলাই আন্দোলনে সময় দেখেছি তারা কীভাবে নিজেদের জীবন বাঁজি রেখে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে লড়াই করেছে। কিন্তু আন্দোলন পরবর্তী সময়ে মেয়েদেরকে সেরকমভাবে মূল্যায়ন করেনি। চলছে নারী অধিকার সংস্কার কমিশন নিয়ে বিতর্ক। একদল এই সংস্কার কমিশনকে বলছে ‘বেশ্যা সংস্কার কমিশন’। সুতরাং এলোকেশি কেস মনে করিয়ে দেয়, এই আচরণ শুধু ঐতিহাসিক নয়, বর্তমানেরও বাস্তবতা।
এলোকেশি মামলা শুধুমাত্র একটি দাম্পত্য বিচ্ছেদের ঘটনা নয়। এটি ছিল নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমাজ, বিচারব্যবস্থা এবং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর এক সম্মিলিত প্রয়াস। এটি নারীর স্বাধীনতা, ইচ্ছা এবং মর্যাদাকে অস্বীকার করার একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ। যা বর্তমান আধুনিক সমাজেও বিদ্যমান।
এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে নারীর অধিকার কেবল আইন করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, বিচারিক ন্যায়বোধ এবং মানবিকতা তাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এলোকেশি কেবল একজন নারী ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজের পুরুষতান্ত্রিক সীমার বাইরে যাওয়ার সাহস দেখানো একজন প্রতীক।
তথ্যসূত্র
- https://authordebarati.wordpress.com/2018/04/09/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A7%9C%E0%A6%B6%E0%A7%8B-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%96%E0%A7%81%E0%A6%A8-2/
- https://shono.sangbadpratidin.in/bengal-and-bengali/r-g-kar-incident-reminds-of-mohanta-and-elokeshi-case-of-19th-century-bengal/
- https://www.bongodorshon.com/home/story_detail/mohanto-elokeshi-of-tarakeshwar
- https://www.anandabazar.com/rabibashoriyo/%E0%A6%95-%E0%A6%9A-%E0%A6%9B-1.31892
- https://www.peepultree.world/livehistoryindia/story/art-history/elokeshi-murder-a-scandal-that-shook-colonial-calcutta
- https://sobbanglay.com/history/mohanto-elokeshi-case-tarakeshwar-murder-case1874/