গ্রামে ঢোকার পথেই নীল রঙের সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা Welcome to the God’s Own Twins Village অর্থাৎ, “ঈশ্বরের নিজের যমজ গ্রামে আপনাকে স্বাগতম।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এই গ্রামে যমজ সন্তান জন্ম নেওয়া যেন একেবারেই সাধারণ ঘটনা। বরং যমজ সন্তান না জন্মানো ব্যপারটাকে এখানে অস্বাভাবিকভাবে দেখা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, কী আছে এই গ্রামে? কী সেই অদ্ভুত রহস্য, যার কারণে এখানে যমজ সন্তানের জন্মহার পৃথিবীর গড় সংখ্যার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি?
চলুন শুরু করা যাক এই রহস্য সমাধানের যাত্রা।
পানি বেষ্টিত যমজ গ্রাম
আমাদের বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য রহস্য। বিজ্ঞান মানুষকে যতই এগিয়ে নিয়ে যাক না কেন, কিছু ঘটনা সবসময় অজানার অন্ধকারেই থেকে যায়। তেমনই একটি গ্রাম হলো কেরালার মালাপ্পুরম জেলার কোদিনহি। মালাপ্পুরম জেলার সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একই গ্রামে চারদিকে পানি বেষ্টিত এবং এর সাথে বাইরের যোগাযোগের একমাত্র পথ হলো নিকটবর্তী তিরুরাঙ্গাদি শহর। আর ছোট্ট এই গ্রামটিই পৃথিবীজুড়েই পরিচিত “যমজদের গ্রাম” নামে।
কোদিনহি গ্রামে গেলে মনে হবে আর পাঁচটা দক্ষিণ ভারতীয় গ্রামের মতো। নারকেল গাছ, সবুজ মাঠ, শান্ত পরিবেশ সবই যেন চিরচেনা ভারতের গ্রামের সৌন্দর্যের মতই। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করলেই মনটা কেন যেন এক অদ্ভুত ধাঁধায় আটকে যায়।
যমজ গ্রামের অদ্ভুত জনসংখ্যা
এখানে দুই হাজারের কিছু বেশি পরিবারের বসবাস, সবমিলিয়ে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ মুসলিম এবং বাকিরা হিন্দু। তবে গ্রামের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, এখানে বসবাসরত দুই হাজার পরিবারের মধ্যে যমজের সংখ্যা প্রায় ৪৫০ জোড়া! অর্থাৎ, প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এক জোড়া যমজ রয়েছে। আর এমন ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোথাও এত ঘন ঘন দেখা যায় না।
আরো অবাক করা বিষয়, শুধু যমজই নয়, কোনও কোনও পরিবারে ত্রয়ী ভাইবোনও রয়েছে। তাই বলে ভাববেন না গ্রামের পুরুষদের ক্ষেত্রেই এমন হয়, গ্রামে মেয়েরা যদি বাইরে কোথায় বিয়ে করেন তাহলেও তাঁদের যমজ বা একসঙ্গে তিনটি সন্তান প্রসব করার ইতিহাস রয়েছে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতে প্রতি হাজারে যমজের সংখ্যা ৯ জন৷ গোটা পৃথিবীতে সেই সংখ্যাটা প্রতি হাজারে ৬জন। আর সেই অনুযায়ী কোদিনহিতে প্রতি হাজারে যমজের সংখ্যা ৪৫ জন। অর্থাৎ, কোদিনহি গ্রামে যমজ সন্তানের জন্ম হওয়ার হার, বৈশ্বিক গড়ের প্রায় আট গুণ বেশি। আর তাই তো এই গ্রামের মাঠে, ঘাটে, স্কুলে, বাড়িতে চোখে পড়বে একই চেহারা দু’টি করে মানুষ। প্রতিটি স্কুলেও রয়েছে ১৫-২০ জোড়া যমজ ছাত্রছাত্রী৷
যমজ সন্তানের শুরু
যাঁরা জুড়বা, রাম অর শ্যাম, সীতা অর গীতা, ভ্রান্তিবিলাস বা লুকোচুরি ছবি দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই একই চেহারার দুজন মানুষে নিয়ে সমস্যাটা বুঝতে পারছেন? কিন্তু গ্রামের এই যমজ সন্তানের শুরু কবে থেকে হল?
গ্রামের মানুষদের কথায়, অতীতে নাকি এই গ্রামেও স্বাভাবিক হারে যমজ সন্তান জন্মাত। ধারণা করা হয়, প্রায় ৬০-৭০ বছর আগে থেকেই এখানে যমজ জন্মের হার হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ হার আরও বেড়েছে। ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, কোদিনহিতে যমজের সংখ্যা ছিল ২৬৪ জোড়া। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ জোড়ায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিকভাবে হিসাব করলে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। হতে পারে পাঁচ শতাধিক যমজ ভাইবোন রয়েছে এই ছোট্ট গ্রামে।

শোনা যায়, ২০০৮ সাল নাগাদ কোদিনহা গ্রামের একটি স্কুলের ক্লাস এইটের দুই যমজ বোন সামিরা এবং ফামিনা খেয়াল করে যে ক্লাসে তারা ছাড়াও আরও আট জোড়া যমজ ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। খুঁজতে গিয়ে তারা দেখে যে স্কুলের অন্যান্য ক্লাসেও অনেক যমজ ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করছে। সব মিলিয়ে তাদের স্কুলেই ছিল ২৪ জোড়া যমজ ছাত্র-ছাত্রী। দুই বোনের সেই মজাদার আবিষ্কারের পরই বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ কৌতূহল তৈরি হয়।
এত বেশি যমজ হওয়ার কারণ
কিন্তু এত বেশি যমজ হওয়ার কারণ কি? এটি কি শুধুই জিনগত নাকি এটি আবহাওয়ার খেলা? অনেকের বিশ্বাস, গ্রামের পানিতে নাকি এক ধরনের বিশেষ প্রাকৃতিক রাসায়নিক রয়েছে, আর সেটির প্রভাবেই এত যমজ সন্তান জন্ম নেয়। তবে এই ধারণাকে অনেকেই কেবল মুখে মুখে প্রচলিত কথা বা কুসংস্কার হিসেবেই দেখেন। বৈজ্ঞানিকভাবে এখনও এ দাবির কোনো প্রমাণ মেলেনি।
তবে কোদিনহির এই রহস্যের সঠিক উত্তর জানতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এখানে জৈবিক নমুনা সংগ্রহ করেছেন। নমুনা সংগ্রহের তালিকায় আছে সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি, ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন, হায়দরাবাদ, কেরালা ইউনিভার্সিটি অফ ফিশারিজ অ্যান্ড ওশান স্টাডিজের মতো নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো। গবেষকরা যমজদের লালা ও চুলের নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করেছেন। তবে এখনও সঠিক ব্যাখ্যা মেলেনি।
পৃথিবীর আরও কিছু যময গ্রাম
পৃথিবীর যমজ রহস্যকে এভাবেই বাড়িয়ে তুলেছে ব্রাজিলের ক্যানডিডো গোডোই, নাইজেরিয়ার ইগবো-ওরা এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের হাং হিয়েপ এর মতো গ্রামগুলি৷ এই গ্রামগুলিতেও যমজ সন্তানের জন্মের হার অত্যাধিক।
আফ্রিকার নাইজেরিয়ার ইগবো গ্রামকে বলা হয় “দ্য টুইন ক্যাপিটাল অব দ্য ওয়ার্ল্ড”। এখানেও প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অন্তত একটি করে যমজ আছে। ধারণা করা হয়, এখানে যমজ জন্মের হার প্রতি হাজারে প্রায় ৫০–৬০ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এর পেছনে প্রধান কারণ তাদের খাদ্যাভ্যাস , বিশেষ করে ইয়াম নামের এক ধরনের মূলজাতীয় খাবার। গবেষকেরা বলেন, ইয়ামের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক হরমোন থাকে, যা ডিম্বাণুর বিভাজনকে প্রভাবিত করে। ফলে এখানে যমজ সন্তানের জন্ম অনেক বেশি।

ভারত ও নাইজেরিয়া ছাড়াও ব্রাজিলের ক্যান্ডিডো গদয় গ্রামও একই কারণে বিখ্যাত। সেখানে গত কয়েক দশকে অস্বাভাবিক সংখ্যক যমজ জন্ম হয়েছে। গবেষকেরা ধারণা করেন, এই গ্রামের জেনেটিক প্যাটার্ন ও স্থানীয় পানির উপাদান এর পেছনে ভূমিকা রাখছে।
কোদিনহি কেবল একটি গ্রাম নয়, এটি মানুষের জিন, প্রকৃতি আর সমাজের এক বিস্ময়কর মিলন। এখানে জন্ম নেওয়া প্রতিটি যমজ শিশু বিজ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে কোদিনহির মতো গ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ যতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর হোক, প্রকৃতির ভেতরে এখনো অসংখ্য রহস্য লুকিয়ে আছে।
তথ্যসূত্র-
- https://www.orbitnews.in/kodinhi-twin-village-of-india/
- https://en.wikipedia.org/wiki/Kodinhi
- https://archive.roar.media/bangla/main/world/mysterious-twin-village-of-india
- https://www.facebook.com/ummotivation/posts/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%87-%E0%A6%97%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%98%E0%A6%B0%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AF%E0%A6%AE%E0%A6%9C-%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%81-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9C%E0%A7%87-%E0%A6%B6%E0%A7%9F-%E0%A6%B6%E0%A7%9F-%E0%A6%AF%E0%A6%AE%E0%A6%9C-%E0%A6%8F%E0%A6%87-%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE/865699748753311/

