আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।
কাক দেখতে কালো এবং কর্কশ স্বরের অধিকারী হওয়ায় অধিকাংশ মানুষের পছন্দের পাখির তালিকায় জায়গা পায়নি। স্বাদের দিক থেকেও কাকের মাংস তিতকুটে হওয়ায় শিকারি পাখি কিংবা প্রাণীরাও এর প্রতি আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু কাককে নিয়ে কবি জীবনানন্দ দাশের ভাবনা ছিল ভিন্ন—তিনি চেয়েছিলেন “ভোরের কাক” হয়ে আবার এই বাংলায় ফিরে আসতে।
কিন্তু আপনি কি আজকাল এই পাখিটিকে দেখতে পান?
নগরজীবনে কাক: অবহেলার পাখি হলেও নৈকট্যের অংশ
ঢাকা কাকেরই শহর। কাক ছাড়া ঢাকার কথা যে চিন্তা করা যায় না, তার প্রমাণ রনবীর (শিল্পী রফিকুন নবী) টোকাই কার্টুন। রনবীরের টোকাই চরিত্রটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে বিচিত্রার পাতায় এবং নব্বই দশকের শেষ পর্যন্ত পাঠকদের ভাবিয়েছে। সে সময় ঢাকার সড়কে সিমেন্ট বাঁধানো ডাস্টবিন ছিল, যেখানে টোকাই খাবার কুড়াতো কিংবা বিশ্রাম নিত। তার পাশেই থাকত এক বা একাধিক কাক—খাদ্যের খোঁজে। কখনো কখনো টোকাই আর কাকের মধ্যে যেন নিঃশব্দে ভাবনার আদান-প্রদান হতো, হয়তো সেই আলোচনা ছিল খাবারের সংকট বা উচ্ছিষ্টের মান নিয়ে।
কাক শুধু উপস্থিতিতেই নয়, স্বভাবেও ব্যতিক্রম। তারা সামাজিক প্রাণী—একজন কাক বিপদে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসে, মৃত্যুর সময় শোক প্রকাশ করে। স্ত্রী ও পুরুষ কাক পরস্পরের প্রতি যত্নশীল; কাছাকাছি থাকে, একে অপরকে আগলে রাখে। একাকী কাক দেখা যায় খুব কমই। ঢাকার প্রতীক হিসেবে কাককে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও, শহরজুড়ে তাদের পদচারণা ছিল অবিস্মরণীয়।
এক সময় শহরে ভোরবেলা নগরবাসীর ঘুম ভাঙত কাকের সম্মিলিত কোরাসে। ভোরের আলো ফোটার আগেই পাড়া-মহল্লার আঁস্তাকুড়ে শুরু হতো কাকের ‘আড্ডা’। কখনো দেখা যেতো একদল কাক খাবার নিয়ে কোলাহল করছে, আবার কেউ কেউ সড়কের পাশে বিদ্যুতের খুঁটি বা টেলিফোনের তারে সারি বেঁধে বসে কা-কা শব্দে মুখর করে তুলছে চারপাশ। কখনো আবার খাবারের সন্ধানে কাক চুপিচুপি ঢুকে পড়তো মানুষের রান্নাঘরেও।
কাকের সঙ্গে মানুষের এই নিত্যকার, সরাসরি সম্পর্কের কারণেই বাংলা সাহিত্য এবং আধুনিক সাহিত্যে এই পাখিটির উপস্থিতি এত বেশি। অন্য কোনো পাখির এমন বিস্তৃত সাহিত্যে পদচারণা নেই, যা কাকের রয়েছে। অবহেলার পাখি হয়েও কাক আমাদের শহরজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ছিল।
কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—ঢাকায় কি সত্যিই কাকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে? এক সময়ের সেই চেনা কোলাহল, সকালের কোরাস, আর বিদ্যুতের তারে ভিড়—সবই কি আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে? পরিবেশ, জলবায়ু ও নগর ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের প্রভাবেই হয়তো আজ কাকবিহীন ঢাকা আমাদের শূন্যতা অনুভব করাচ্ছে।
পরিবেশে কাকের গুরুত্ব
কাক আমাদের পরিবেশের এক অপরিহার্য অংশ। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাকের ভূমিকা অনন্য। এ পাখিটি পচা-নোংরা আবর্জনা খেয়ে আমাদের আশেপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। তাই কাককে ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ বলা হয়ে থাকে। পরিবেশ সচেতন মানুষের কাছে কাকের গুরুত্ব অনেক, কারণ এটি আমাদের জৈবিক সার্কেলেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী।
তবে সম্প্রতি শহরাঞ্চলে কাকের সংখ্যা দৃশ্যমানভাবে হ্রাস পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পাখিদের আচরণে যেমন পরিবর্তন এনেছে, কাকের ক্ষেত্রেও তেমনটি দেখা যাচ্ছে। এক সময় ঢাকা শহরে প্রচুর গাছপালা থাকায় কাকেরা সহজেই বাসা বাঁধতে পারতো। কিন্তু নগরায়নের ফলে গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে, যার ফলে কাকের আবাস সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি শহরের ডাম্পিং জোন বা ময়লার স্তূপ স্থানান্তরিত হওয়ায় কাকেরা খাদ্যের উৎস হারিয়ে শহর ত্যাগ করছে। এই পরিস্থিতি শুধু কাকের জন্য নয়, বরং আমাদের পরিবেশের জন্যও এক অশনিসংকেত।
রাজধানীর ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাকের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। তবে রাস্তার পাশে কিংবা ময়লার ভাগাড়ের আশপাশে কাকের সংখ্যা কিছুটা বেশি। ঢাকা শহরে আগে কী পরিমাণ কাক ছিল বা কাক কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কোনও গবেষণা বা গণনা না থাকলেও পাখিপ্রেমী এবং পরিবেশ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা সবাই বলছেন, গত দশ বছরে কাকের সংখ্যা যে কমেছে তা খালি চোখেই বোঝা যায়।
কাক কমে যাচ্ছে কেন
কাকের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা গেছে—বাসস্থান ও খাদ্যের সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো প্রযুক্তিগত স্থাপনার অতিরিক্ত বিস্তার। এই কারণগুলোর ফলে কাক তার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশের সঙ্গে কাকের স্বাভাবিক ভারসাম্য দিন দিন ব্যাহত হচ্ছে।
গাছ কাটা ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের ফলে কাকেক্র বাসস্থান সীমিত হয়ে আসছে, কাকের খাদ্যতালিকা বিশাল—উচ্ছিষ্ট খাবার, পোকামাকড়, ফলমূল, ডিম, ছোট সরীসৃপ থেকে শুরু করে ব্যাঙ ও ফুলের মধুও খায়। কিন্তু উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে বিষাক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার এবং খাদ্য উৎসের সংকটে তারা সহজে খাদ্য পাচ্ছে না। পলিথিন, প্লাস্টিক ও বিষাক্ত বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কাক বিষক্রিয়ায়ও আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া কাকের পানিপান ও গোসলের প্রয়োজন থাকলেও জলাধারের অভাব এবং পানির দূষণ তাদের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলছে।
ঢাকায় কাক কমে যাওয়ার আরেকটি বড়ো কারণ হিসেবে বলা হয় মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে বের হওয়া তেজস্ক্রিয়া। পাখিরা তেজস্ক্রিয়া থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থানে চলে যায়।
কাকের মতো উপকারী পাখিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের নগরায়ণ হতে হবে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধব। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে তাদের নিরাপদ বাসস্থান, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা। তা না হলে পরিবেশচক্র ও বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে, যা পরবর্তীতে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।