Image default
সভ্যতা

একসময় বাংলাদেশ ছিল বৌদ্ধদের রাজ্য! জানুন সেই গৌরবের ইতিহাস

মুসলিমপ্রধান এই দেশটিতে একসময় ছিল বৌদ্ধ ধর্মের জয়জয়কার। তাই তো বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে এদেশের আনাচে কানাচে গড়ে উঠছে অনেক বৌদ্ধ বিহার। শুধু বাংলায় নয়, পুরো পৃথিবীর বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশে এই বৌদ্ধবিহারগুলো অবদান রেখেছে। কিন্তু কিভাবে?

বাংলাদেশের পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাস। যুগে যুগে এখানে পা রেখেছেন নানান ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ, তাদের মধ্যে অনেকেই এখানে রাজত্ব করেছেন, ছড়িয়ে গেছেন নিজের বিশ্বাস আর দর্শনের আলোকবার্তা। বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহারগুলো তেমনই এক ঐতিহাসিক সময়ের চিহ্ন বহন করে আজও টিকে আছে এদেশের বুকে। 

বাংলাদেশের মাটি একসময় ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির উর্বর ভূমি। তখনকার সময়ের শাসক, সমাজ ও জনগণ এই ধর্মকে লালন করেছে আন্তরিকভাবে। তাই বাংলার আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার হোক সেটা প্রত্যন্ত কোন গ্রাম, নগর আর কিংবা পাহাড়ের সুউচ্চ ঢালে। 

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন শুধু ধর্ম নয়, এই বিহারগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন। 

প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ও প্রসার 

বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা হয়েছিল ভারতবর্ষে, গৌতম বুদ্ধের হাত ধরে খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ থেকে ৫ম শতকে। কিন্তু বাংলায় এই ধর্ম ঠিক কখন এল?  

ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রথম প্রবেশ ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে। এ সময় মৌর্য সম্রাট মহামতি অশোক উত্তর বাংলা দখল করে একটি প্রদেশে বা ভুক্তিতে পরিণত করেন। এই পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর, যা আজকের মহাস্থানগড়। এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে সে যুগের বৌদ্ধ নিদর্শন পাওয়া গেছে। 

তবে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রবলভাবে বিকাশ লাভ করে তারও অনেক পরে, খ্রিষ্টীয় আট শতক থেকে। এ সময় বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ছাড়া বাকি অঞ্চল পাল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১১ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছিল এ দেশে। 

একই যুগপর্বে দেবপর্বতকে ঘিরে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় দেব, চন্দ্র, খড়গ প্রভৃতি রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজারাও ছিলেন বৌদ্ধধর্মাশ্রয়ী। ফলে বলা যায়, আট শতক থেকে এগারো শতক পর্যন্ত পুরো বাংলায় বৌদ্ধ সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

প্রাচীন বাংলায় শিক্ষা ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ঐতিহ্য সবচেয়ে উজ্জ্বল। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো সোমপুর মহাবিহার, যা বর্তমানে নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত। এটি একসময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র।

বৌদ্ধ সাধক

সেসময়ে কুমিল্লার শালবন বিহার, মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুর বিহার, নওগাঁর জগদ্দল বিহার এবং মহাস্থানগড়ের আশেপাশেও অনেক বৌদ্ধ বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠে। এখানে শুধুমাত্র ধর্মীয় সাধনা হতো এমন না, বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যসহ নানা বিষয়ে বিদ্যা অর্জনের পাঠ দেওয়া হতো।

মূলত, পাল যুগেই বাংলাদেশে বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তি গড়ে দেয়। এর আগেও হয়তো ছোটখাটো বিহার ছিল, কিন্তু এই সময়েই বিহারগুলো হয়ে ওঠে সাংগঠনিক ও সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী।

প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের এই বিস্তার শুধু ধর্ম নয়, বরং সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও শিক্ষার চেতনা ছড়িয়ে দেয় সমাজে। পাল রাজারা এমন এক ঐতিহ্য তৈরি করে যান, যা আজও আমাদের গর্বের জায়গা হয়ে আছে।

এই ধারাই পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে, যেখানে বাংলাদেশের অন্যতম মনোমুগ্ধকর বৌদ্ধ বিহারগুলোর দেখা পাওয়া যায়। 

বিখ্যাত প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারসমূহ 

সোমপুর মহাবিহার

বাংলাদেশে অবস্থিত বৌদ্ধ বিহারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম সোমপুর বা পাহাড়পুর মহাবিহার। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত এই বিহারটি একসময় ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। 

১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। পাহাড়পুরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার বলা যেতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্মচর্চা কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার ( তদানীন্তন ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন।

সোমপুর মহাবিহার

সারা পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত জ্যামিতিক নকশার পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়পুর তার মধ্যে সেরা। কারো কারো মতে এখানে একটি জৈন মন্দির ছিল। আর সেই মন্দিরের উপরেই গড়ে তোলা হয়েছে এ বিহার। এ বিহারে মোট ১৭৭টি ঘর রয়েছে। ঘরগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতেন। বিহারের ঠিক মাঝ খানে রয়েছে একটি মন্দির। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৪০০ ফুট, প্রস্থে প্রায় ৩৫০ ফুট ওউচ্চতায় ৭০ ফুট। 

কালের বিবর্তনে মন্দিরের সবচেয়ে উপরের অংশ ধসে গেছে। বাইরের দেয়ালে বুদ্ধমূর্তি, হিন্দুদের দেবী মূর্তি ও প্রচুর পোড়া মাটির ফলকচিত্র রয়েছে। এসব চিত্রে সাধারণ মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা চিত্রিত হয়েছে। বিহারের মূল বেষ্টনীর দেয়াল প্রায় ২০ ফুট চওড়া। বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে আরেকটি মন্দির। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই বিহারটি দেখতে প্রতিদিন এখানে ভিড় করেন দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক। 

শালবন বিহার 

শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার কোটবাড়িতে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় এ বিহারটির অবস্থান। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। 

শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। আকারে চৌকো শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে। এই বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। ধারণা করা হয় যে এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন এবং ধর্মচর্চ্চা করতেন। নানা সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে।

শালবন বিহার

মহাস্থানগড়

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুন্ড্রবর্ধন বা পুন্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল। এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৬ সালে এটিকে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন শাসকদের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণের ধারা বিবরণীতে লেখেন, বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় চীন ও তিব্বত থেকে ভিক্ষুরা তখন মহাস্থানগড়ে আসতেন লেখাপড়া করতে। এরপর তারা বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সেখানে গিয়ে তারা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতেন। 

বর্তমানে মহাস্থানগড়ের ভেতরে কয়েকটি ঢিবি ও নির্মাণ নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে জিয়ত কুন্ডু (একটি কূপ যাতে জীবন প্রদানের শক্তি আছে বলে বিশ্বাস করা হয়), মানকালীর ধাপ (মানকালীর পবিত্র স্থান),পরশুরামের বাসগৃহ (রাজা পরশুরামের প্রাসাদ), বৈরাগীর ভিটা (সন্ন্যাসিনীদের আখড়া), খোদার পাথর ভিটা (ঈশ্বরকে অর্পিত প্রস্তর খন্ড), মুনির ঘোন প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি প্রবেশদ্বার রয়েছে যেমন কাঁটা দুয়ার, দোরাব শাহ তোরণ, বুড়ির ফটক, তাম্র দরজা ইত্যাদি।  

মহাস্থানগড়

এদিকে বিক্রমপুর বিহার (মুন্সিগঞ্জ) ও জগদ্দল বিহার (নওগাঁ) ছিল পাল যুগের বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র। এইসব বিহারে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, দর্শন, চিকিৎসা ও সাহিত্যের চর্চা হতো। তবে সময়ের সাথে আরও অনেক বিহারের চিহ্ন মিলেছে, যেগুলো প্রমাণ করে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ও শক্তিশালী ভিত্তি।

চট্টগ্রামে বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠার পেছনের কারণ

চট্টগ্রাম আজকের দিনে যেমন বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম বন্দরনগরী, অতীতেও এই শহরটি ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।  

চট্টগ্রাম ছিল সেই সময়ে বাংলার বাণিজ্য ও সংস্কৃতির মিলনস্থল। মূলত এই স্থানটিতেই  লুকিয়ে আছে বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠার মূল কারণ। 

প্রথমত, সমুদ্রপথে বাণিজ্য, চট্টগ্রাম ছিল প্রাচীন সময় থেকেই ভারত, আরাকান (বর্তমান মিয়ানমার), চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। এই পথ ধরেই নানান দেশ থেকে বণিক, ভিক্ষু ও সাধকের আগমন ঘটে প্রাচীন বাংলায়। এই সংযোগের মাধ্যমেই বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি, ও ভাবধারার আদান-প্রদান ঘটত বাংলায়। 

দ্বিতীয়ত, চট্টগ্রামে আরাকান রাজ্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব। ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চল কিছু সময় আরাকান শাসকদের অধীনে ছিল। আর আরাকান ছিল একটি বৌদ্ধপ্রধান এলাকা। মূলত সেই সময় থেকেই এই অঞ্চলে বৌদ্ধ বিহার, প্যাগোডা ও মঠ গড়ে ওঠে।

এই স্থানে বৌদ্ধ বিহার গড়ে উঠার তৃতীয় কারণটি ছিল স্থানীয় জনগণের সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতা চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও সমতলের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে বহু ধর্মে বিশ্বাসী ও সহনশীল। তাই অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে বিশ্বাসী চট্টগ্রামের মানুষ খুব সহজেই বৌদ্ধ ধর্মকে আপন করে নেয় এবং যে কারণে এই ধর্ম খুব সহজেই অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে পড়ে। 

ইতিহাসবিদদের মতে, বারো আউলিয়ার আগমনের আগেই চট্টগ্রামে বেশ কিছু বিহার স্থাপিত হয়েছিল। বিশেষ করে পটিয়া, রাঙ্গুনিয়া, কক্সবাজারের কিছু অংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

আজও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চলে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন ও মারমা সম্প্রদায়ের মধ্যে, প্রাচীন বিহার সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য টিকে আছে। এই বিহারগুলো শুধু উপাসনার স্থান নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ বিহার ও ধর্মীয় ঐতিহ্য

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ বিহার কেবল একটি ধর্মীয় স্থান নয় এটা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, জীবনধারা ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এখানে বসবাসরত আদিবাসীগোষ্ঠী যেমন- চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বমসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এই বিহারগুলো।

বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় ছড়িয়ে আছে শত শত ছোট-বড় বিহার। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির।  বান্দরবানের উপশহর বালাঘাটার পুল পাড়া নামক স্থানে স্বর্ণমন্দির এর অবস্থান যা মহাসুখ মন্দির বা বৌদ্ধ ধাতু জাদী নামে পরিচিত। নাম স্বর্ণমন্দির হলেও এখানে স্বর্ণ দিয়ে তৈরি কোন দেব-দেবীও নেই। এটি তার সোনালি রঙের জন্য বর্তমানে স্বর্ণমন্দির নামে খ্যাত। সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়ার তৈরী এই মন্দিরটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। এটির নির্মাণশৈলী মায়ানমার, চীন ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ টেম্পল গুলোর আদলে তৈরী করা হয়।

মহাসুখ মন্দির বা বৌদ্ধ ধাতু জাদী

দেশ বিদেশ থেকে অনেক বুদ্ধ ধর্মালম্বী এই মন্দিরটি একবার স্বচক্ষে দেখতে এবং প্রার্থনা করতে আসেন। গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক কালে নির্মিত বিশ্বের সেরা কয়েকটি বুদ্ধ মুর্তির মধ্যে একটি এখানে রয়েছে। প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয়। 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিহার হলো রাঙামাটির রাজবিহার। এটি চাকমা রাজ পরিবারের ঐতিহ্য বহনকারী এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। রাজবিহার কেবল উপাসনার স্থান নয়, বরং পাহাড়ি সংস্কৃতি, শিক্ষা, ও সমাজবোধের কেন্দ্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। চাকমা ভাষায় বিহার বা মন্দিরকে ‘কিয়াং’ বলা হয়ে থাকে। রাজবন বিহার বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধবিহার হিসেবে পরিচিত। প্রায় ৩৩ দশমিক ৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত বিহার এলাকায় ৪টি মন্দির, ভিক্ষুদের ভাবনা কেন্দ্র, বেইনঘর, তাবতিংশ স্বর্গ, বিশ্রামাগার ও হাসপাতাল রয়েছে।

বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবগুলোতে এই বিহারগুলো হয়ে ওঠে প্রাণের মেলা। প্রবারণা পূর্ণিমা, চীবর দান, কঠিন চীবর দান এইসব উৎসবে পাহাড়ি জনগণ দলবেঁধে বিহারে আসেন, দান করেন, প্রার্থনায় অংশ নেন। পাহাড়ি এই বিহারগুলোতে আজও চলে শিক্ষা, সাধনা ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড। ছোট ছোট ভিক্ষুরা এখানে থেকে ধর্মচর্চা শেখে, বিভিন্ন সামাজিক নিয়ম-কানুনে অভ্যস্ত হয়। এছাড়া এই বিহারগুলো পাহাড়ি জনগণের সভ্যতা ও ভাষার সংরক্ষক হিসেবেও কাজ করে।

বাংলাদেশে বৌদ্ধ বিহার হলো ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির এক বিস্ময়কর মেলবন্ধন যার সূচনা পাল যুগে হলেও ধারা আজও বহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে। বৌদ্ধবিহারগুলো আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি তৈরি করেছে সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত৷ এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে চাই যথাযথ সংরক্ষণ, কর্তৃপক্ষের মনোযোগ এবং সর্বোপরি, সবার মাঝে সচেতনতা তাহলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছাবে এই মহামূল্যবান সম্পদ।

তথ্যসূত্র –

Related posts

ব্রোঞ্জ যুগের পতন: প্রাচীন বিশ্বের রহস্যময় ধ্বংসযাত্রা

ব্রত: বাংলার নারীদের শক্তি, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের এক বিস্ময়কর ইতিহাস

ইন্দুস ভ্যালির ভাষা রহস্য: হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার নিঃশব্দ কণ্ঠস্বর

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More