মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই নেনেট শিশুরা দায়িত্ব নিতে শেখে এবং পরিবারের কাজে সাহায্য করে।
কখনো কি ভেবেছেন মাত্র মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বসবাস করা সম্ভব! বাংলাদেশে যখন ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই কাঁপুনি ধরে…তাহলে কেমন হবে সেই জায়গায় জীবনযাপন করা, যেখানে নিঃশ্বাসেও বরফ জমে!
শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, পৃথিবীতে এমনও এক জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা এই তীব্র ঠান্ডা মোকাবেলা করে জীবন যাপন করে চলেছে বছরের পর বছর। এই তীব্র বরফের যাযাবর জাতিটির নাম হচ্ছে ‘নেনেট সম্প্রদায়’।
কিভাবে তারা এই তীব্র ঠান্ডায় চরম পরিস্থিতির মাঝেও বেঁচে থাকে? কেমনই বা তাদের জীবনযাত্রা ?
নেনেটদের বাসস্থান
নেনেটরা প্রাচীন যাযাবর সম্প্রদায়। এরা মূলত রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের আদিবাসী। তবে তারা অনেক কয়টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পৃথক পৃথক অঞ্চলে বসবাস করে। এর মধ্যে ইয়ামালো-নেনেটরা ওক্রগ এর দক্ষিণ-পূর্বে এবং খান্তি-মানসিয়া পুর এবং তাজ নদীর অববাহিকায় বাস করে।
২০২১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, রাশিয়ান ফেডারেশনে ৪৯,৬৪৬ জন নেনেট ছিল। নেনেটদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং বসবাসের স্থান আলাদা হলেও, তাদের মধ্যে একটি গভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে।
হারিয়ে যাচ্ছে নেনেট ভাষা
নেনেটদের ভাষা ইউরালিক ভাষা পরিবারের অন্তর্গত এবং এটি সামোয়েদিক শাখার একটি ভাষা। এই ভাষার দু’টি প্রধান উপভাষা হচ্ছে টুন্ড্রা নেনেট এবং ফরেস্ট নেনেট। তবে, দুর্ভাগ্যবশত, ইউনেস্কো নেনেট ভাষাকে একটি বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সাইবেরিয়ার বেশিরভাগ তরুণ এখনও নেনেট ভাষায় সাবলীল হলেও, ইউরোপীয় রাশিয়ায় বসবাসকারী নেনেট তরুণরা, রাশিয়ান ভাষায় কথা বলতেই বেশি পছন্দ করেন। ফলে, নেনেট ভাষা বর্তমানে মূলত বয়স্ক প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
নেনেটদের অদ্ভুত জীবন-যাপন
বরফ যুগের শেষ
নেনেট গোত্রের জীবন যাপন নিয়ে অনেক অদ্ভুত গল্প রয়েছে। সেই গল্প জানতে হলে, আমাদের যেতে হবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে। সে সময় পৃথিবীতে ধীরে ধীরে বরফ যুগের প্রভাব কমে আসছিলো এবং জমাট বরফ গলে অনেক এলাকা আবার মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠছিল।
এই পরিবর্তনের সুযোগে উত্তর-পূর্ব ইউরোপের কিছু গোত্র নতুন বসতি খুঁজতে বের হয়। তারা চলে আসে ইউরোপ ও এশিয়ার উত্তরের তুন্দ্রা অঞ্চলে, বিশেষ করে অব ও ইয়েনেসি নদীর পাশে। এইসব এলাকায় যারা বসতি গড়েছিল, তারাই পরে পরিচিত হয় নেনেট নামে।
নেনেট গোত্রের জীবনযাত্রা নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে রয়েছে নানা কৌতুহল। এদের প্রধান বাসস্থান এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ইয়ামাল উপদ্বীপ। ইয়ামাল শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “পৃথিবীর শেষ প্রান্ত” এবং এই অঞ্চলটি রাশিয়ার সবচেয়ে উত্তরের অঞ্চলগুলোর একটি। এখানে বসবাসরত নেনেটরা কঠিন শীতকাল, বরফ ঢাকা তুন্দ্রা, এবং সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে জীবনযাপন করে।
স্ব-ভক্ষক থেকে নেনেট
এই নেনেট সম্প্রদায়কে একসময় “সামোয়েড” নামে ডাকা হতো। রুশ ভাষার এ শব্দের অর্থ ‘সেল্ফ ইটার’ বা “স্ব-ভক্ষক”। কিন্তু এটি একটি অপমানজনক শব্দ হিসেবে গণ্য হতো। বর্তমান সময়ে, নেনেটরা তাদের নিজেদেরকে তাদের ভাষায় নেনেটস হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে, যার অর্থ হলো “মানুষ”।
অর্থনীতির ভিত্তি-বলগা হরিণ
এই জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা যেমন কঠিন, তেমনি চমকপ্রদ ও ঐতিহ্যে ভরপুর। নেনেটরা সাধারণত বলগা হরিণ পালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের জীবনে বলগা হরিণ শুধুই পশু নয়, যেন সবকিছু।
মজার বিষয় হলো, তাদের সমাজে যার কাছে যত বেশি হরিণ রয়েছে, তাকে তত ধনী মনে করা হয়। এমনকি বিবাহের ক্ষেত্রেও হরিণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেনে অবাক হবেন, একজন পুরুষকে যদি বিয়ে করতে হয়, তাহলে তাকে পাত্রীর পরিবারকে যৌতুক হিসেবে অনেক বলগা হরিণ দিতে হয়।
নেনেটদের কুকুর
নেনেটদের সংস্কৃতির আরও একটি মজার বিষয় হলো কুকুর। কুকুর তাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং এরা ঠান্ডা সহনশীল, শক্তিশালী আর শিকারি প্রকৃতির। বরফে ঢাকা কঠিন পথে চলতে, কিংবা শিকারি প্রাণী থেকে রক্ষা পেতে এই কুকুররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছারাও তুষার ঘেরা তুন্দ্রা অঞ্চলে মূল যানবাহন হলো কুকুর এবং বলগা হরিণ-টানা স্লেজ। নেনেটরা এই গাড়িকে “নাটটা” বলে থাকে। এই স্লেজগুলো কাঠ দিয়ে তৈরি এবং বরফের ওপর চলার জন্য একেবারে আদর্শ। নেনেট সংস্কৃতিতে কুকুরগুলোকে শুধু কাজের জন্যই নয়, বরং, তারা পরিবারের সদস্য হিসেবেই গণ্য হয়।
নেনেটদের ঘরবাড়ি ও পোশাক
নেনেটদের বসবাসের ঘরবাড়ি গুলোকে বলা হয় “চুম”। এই চুমের গম্বুজ আকৃতির তাঁবু রিয়েছে। সেই তাঁবুগুলো বলগা হরিণের চামড়া ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। এই চুম সহজে খুলে ফেলা যায়, সহজে বহনযোগ্য এবং বরফে ঢাকা পরিবেশে শরীরকে গরম রাখতে বেশ উপযোগী।
এদিকে নেনেটদের খাবারের কথা বলতে গেলে, এখানেও বলগা হরিণই তাদের খাবারের প্রধান উৎস। তারা মূলত এই হরিণের মাংস খায়, এছাড়াও বলগা হরিণের দুধ থেকে দই ও বিশেষভাবে সংরক্ষিত খাবার তৈরি করা হয়, যা তাদের পুষ্টির বড় উৎস।
নেনেটদের যাযাবর জীবন
নেনেটদের জীবনধারা ঐতিহ্যগতভাবে নোমাডিক অর্থাৎ যাযাবর। তারা তাদের হরিণের পাল নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যায়। এর প্রধান কারণ হলো হরিণের খাবার। বলগা হরিণ বিশেষ করে লাইকেন নামে এক ধরনের শৈবাল খেয়ে থাকে। যখন একটি এলাকার লাইকেন শেষ হয়ে যায়, তখন তারা নতুন অঞ্চলের খোঁজে রওনা দেয়।
প্রতিবছর তারা শুধু এই খাবারের খোঁজে আর্কটিক সাগর থেকে শুরু করে উত্তর উরাল পর্বতের বনাঞ্চল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। কয়েক দিন পরপরই তাদের তাঁবু এবং অন্য জিনিসপত্র স্লেজে তুলে নিয়ে নতুন জায়গায় চলে যেতে হয়।
তীব্র ঠাণ্ডায় নেনেট
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব অঞ্চলে প্রায় ৮ মাস ধরে জমি তুষারে ঢাকা থাকে। শীতকালে তাপমাত্রা নেমে যায় -৩০ থেকে -৫০°C পর্যন্ত, যা সত্যিই ভয়ংকর ঠান্ডা। এই চরম পরিবেশে টিকে থাকতে, নেনেট মহিলারা হরিণের চামড়া দিয়ে গরম পোশাক, জুতা আর তাঁবুর কভার তৈরি করেন।
অবাক করা বিষয় হলো, মাত্র ৫ বছর বয়স থেকেই নেনেট শিশুরা দায়িত্ব নিতে শেখে এবং পরিবারের কাজে সাহায্য করে। এদিকে নেনেটদের মধ্যে অনেকেই যাযাবর জীবনযাপন করলেও, যাদের বলগা হরিণ নেই, তারা গ্রামে বসবাস করে এবং মূলত মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে।
নেনেটদের বর্তমান জীবনের চ্যালেঞ্জ
তবে দিন দিন এই দুই ধরনের জীবনই কঠিন হয়ে উঠছে। এর একটি বড় কারণ হলো, বলগা হরিণ এর চারণভূমিটি এখন রাশিয়ার ধনী তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের উপর পড়েছে। ফলে, নেনেটদের ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনকে অনেক সময় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে দেখা হয়। আবার অন্যদিকে, গ্যাস পাইপলাইন নদীর ভেতর দিয়ে যাওয়ায় অনেক মাছও মারা যাচ্ছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে মৎস্যজীবী নেনেটদের ওপর।
এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন তাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যেমন, ২০১৩ সালে, ডিসেম্বরের অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিতে এতোটাই দ্রুত তাপমাত্রা কমে যায় যে, বরফের উপর একটি পুরু স্তর তৈরি হয়। বলগা হরিণরা সেই শক্ত বরফ ভেদ করে আর লাইকেন খুঁজে পায় না, আর খাবারের অভাবে হাজার হাজার হরিণ মারা যায়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এ সময় অনেক নেনেট পরিবার তাদের সব হরিণ হারিয়ে বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে আসে। ফলে, তাদের প্রাচীন যাযাবর জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়ে।
এদিকে, গ্রামাঞ্চলে নেনেটদের বেকারত্ব, মদ্যপান এবং আত্মহত্যা খুবই সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণরা ভবিষ্যতের জন্য কোনও আশা ছাড়া বড় হয়। এদিকে যারা তুন্দ্রা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, তাদের হরিণ পালনের বাইরে অন্য জীবিকা নির্বাহের উপায় এবং নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখার জন্য নতুন পথ খুঁজতে হচ্ছে।
তবে একটি ইতিবাচক বিষয় হলো, যে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখেও, তারা চেষ্টা করছে নিজেদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করতে। যদিও অনেক কিছুই হারানোর পথে, তবুও নেনেট জাতি গোষ্ঠীর টিকে থাকার অদম্য লড়াই তাদের বিচিত্র ঐতিহ্যকে জীবিত রেখেছে। ব্যতিক্রমধর্মী এই জাতি এবং তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য টিকে থাকুক।