Image default
সভ্যতা

নক্ষত্রেই ছিল নাবাতিয়ানদের ঈশ্বর? পেত্রার পাথরে লেখা মহাকাশের ধর্মকথা

নাবাতিয়ানরা যখন রাতের আকাশে তাকাত, তারা শুধু আলোর বিন্দু দেখত না; তারা দেখত এক মহাজাগতিক নিয়ম, এক ঐশ্বরিক নকশা, আর তার মধ্যে তাদের নিজেদের ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। তাদের ধর্ম ছিল বিজ্ঞানময়, আর বিজ্ঞান ছিল ধর্মপ্রাণ।

বিশাল মরুভূমির বুকে পাথরে খোদাই করা গোলাপী শহর পেত্রা। দিনের আলোয় এর সৌন্দর্য যেমন মনোমুগ্ধকর, রাতের অন্ধকারে তা হয়ে ওঠে আরও রহস্যময়। এই সেই বিস্ময়কর শহর ছিলো নাবাতিয়ান সভ্যতার রাজধানী, যারা ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যবসায়ী আর প্রকৌশলী। তবে, তাদের পরিচয় শুধু এইটুকুই নয়। তাদের ধর্মবিশ্বাস আর জীবনযাত্রার গভীরে লুকিয়ে ছিল মহাকাশের এক আশ্চর্য রহস্য। একদিকে গভীর ধর্মবিশ্বাস, অন্যদিকে নিখুঁত প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান।

আজকের প্রশ্নটি ঠিক এখানেই। নাবাতিয়ানদের প্রধান দেবতা ‘দুশারা’ বা অন্য দেব-দেবীরা কি কেবলই অদৃশ্য কোনো সত্তা ছিলেন, নাকি তাদের অস্তিত্ব ছিল কোন নক্ষত্র হিসেবে? তাদের উপাসনা কি নিছকই ধর্মবিশ্বাস ছিল, নাকি তা ছিল এক উন্নত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের আধ্যাত্মিক রূপ?

কারা ছিলেন এই বিস্ময়কর নাবাতিয়ান?

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে ১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বুকে দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেছিল এই আরব জাতি। মূলত আরব উপদ্বীপের যাযাবর হিসেবে জীবন শুরু করলেও, সময়ের সাথে সাথে তারা মশলা, সুগন্ধি আর ধূপের মতো মূল্যবান সামগ্রীর বাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ করে এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তাদের রাজধানী পেত্রা ছিল বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনস্থল। 

মিশর, মেসোপটেমিয়া, গ্রিস ও রোমের বণিকরা এখানে আসত, যা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলাকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। তারা যেমন দক্ষ ব্যবসায়ী ছিল, তেমনি ছিল অসাধারণ জল প্রকৌশলী। পাথরের বুক চিরে মরুভূমির মাঝে পানির ব্যবস্থা করার যে কৌশল তারা আয়ত্ত করেছিল, তা আজও আধুনিক প্রকৌশলীদের বিস্মিত করে। আর এই জ্ঞানের ভিত্তি ছিল প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে,  বিশেষ করে আকাশকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা।

নেবুতিয়ান

দুশারা: পাহাড়ের দেবতা থেকে মহাকাশের অধিপতি

নাবাতিয়ানদের প্রধান দেবতা ছিলেন দুশারা। তার নামের আক্ষরিক অর্থ “শারা’র প্রভু”, যা পেত্রার চারপাশের শারা পর্বতমালাকে নির্দেশ করে। প্রাথমিকভাবে তাকে পাহাড়ের রক্ষাকর্তা, উর্বরতা আর প্রকৃতির দেবতা মনে করা হলেও, সময়ের সাথে সাথে তার পরিচয় আরও ব্যাপক ও রহস্যময় হয়ে ওঠে।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, নাবাতিয়ানরা দুশারার কোনো মানব মূর্তি তৈরি করত না। তার প্রতীক ছিল একটি অমসৃণ, কালো রঙের চৌকোণা পাথর বা শিলাখণ্ড। এই ধরনের উপাসনা প্রাক-ইসলামিক আরবের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা মক্কার কাবার কালো পাথরের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই মানব আকৃতিহীন প্রতীকই তাকে আরও রহস্যময় করে তোলে এবং আধুনিক গবেষকদের মনে এই প্রশ্ন জাগায়, তবে কি এই পাথরটি কোনো জাগতিক বস্তুর প্রতীক ছিল না? তবে কি এটি ছিল আকাশের অসীমতা বা কোনো নির্দিষ্ট মহাজাগতিক সত্তার প্রতীক?

দেবতা দুশারা

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দুশারা ছিলেন একজন সৌরদেবতা। রোমানরা যখন এই অঞ্চল দখল করে, তখন তারা দুশারার পরিচয় দেয় তাদের নিজস্ব প্রধান দেবতা জুপিটারের সঙ্গে। এই তুলনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জুপিটার যেমন দেবতাদের রাজা এবং রোমান প্যান্থিয়নের প্রধান, তেমনি আকাশে গ্রহরাজ হিসেবেও পরিচিত। এই সংযোগ থেকে ধারণা করা হয়, দুশারার পরিচয় হয়তো কোনো একটি নির্দিষ্ট উজ্জ্বল নাক্ষত্রিক বস্তু বা গ্রহের সঙ্গে বাঁধা ছিল, যা রাতের আকাশে রাজত্ব করত।

শুধু দুশারা নন, তাদের দেবীত্রয়ী আল-উজ্জা, আল-লাত এবং মানাত-এরও মহাকাশীয় সংযোগ ছিল। এর মধ্যে আল-উজ্জাকে প্রায়শই শুক্র গ্রহের (Venus) সঙ্গে যুক্ত করা হয়। শুক্র গ্রহের দ্বৈত রূপ। কখনও ভোরের আকাশে শুকতারা, কখনও সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা। তাকে প্রেম ও উর্বরতার দেবী এবং কখনও যুদ্ধের দেবী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এই জটিল মহাজাগতিক পরিচয়গুলো প্রমাণ করে যে, নাবাতিয়ানদের ধর্ম ছিল আকাশের গতিবিধির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

পেত্রার স্থাপত্য: পাথরের ক্যালেন্ডার ও মহাকাশের মানচিত্র

নাবাতিয়ানদের জ্যোতির্বিজ্ঞানিক জ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রমাণ কোনো বই বা পুঁথিতে নয়, বরং তাদের তৈরি স্থাপত্যে, বিশেষ করে পেত্রার পাথুরে দালানগুলোতে খোদাই করা আছে। এই দালানগুলো যেন একেকটি পাথরের ক্যালেন্ডার।

আদ-দেইর (মঠ) 

পেত্রার সবচেয়ে উঁচু এবং বিশাল স্থাপত্য হলো আদ-দেইর। এর মূল দরজাটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বছরের সবচেয়ে ছোট দিন, অর্থাৎ শীতকালীন অয়নান্তের (Winter Solstice) দিন সূর্য ডোবার সময় তার আলো সরাসরি দরজার ভেতর দিয়ে পেছনের একটি পবিত্র বেদিতে গিয়ে পড়ে। 

এই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। কল্পনা করুন, হাজার হাজার উপাসক সমবেত হয়েছেন, আর ঠিক নির্দিষ্ট মুহূর্তে সূর্যের শেষ রশ্মি এসে যখন দেবতার প্রতীককে আলোকিত করছে, তখন তা এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত তৈরি করত। সম্ভবত এই দিনটি ছিল দুশারার জন্ম বা পুনরুত্থান উপলক্ষে সবচেয়ে বড় উৎসব।

আদ-দেইর

দ্য ট্রেজারি (আল-খাজনেহ) 

পেত্রার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য হলো ‘দ্য ট্রেজারি’। এর অবস্থানটিও জ্যোতির্বিজ্ঞানিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সংকীর্ণ গিরিপথ ‘সিক’ (Siq) দিয়ে হাঁটার পর হঠাৎ করেই এই বিশাল স্থাপত্য দৃশ্যমান হয়। বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিনে সূর্যের আলো এমনভাবে এর ওপর পড়ে যে, পুরো কাঠামোটি এক ঐশ্বরিক আভায় জ্বলে ওঠে।

নদীর দেবতা ও সিংহের মন্দির (Temple of the Winged Lions) 

এই মন্দিরের ভেতরে এমন সব নিদর্শন পাওয়া গেছে যা চন্দ্র, সূর্য এবং বিভিন্ন গ্রহের প্রতীক বহন করে। মন্দিরের স্তম্ভ এবং অলঙ্করণে রাশিচক্রের চিহ্নও পাওয়া যায়, যা মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়। এটি প্রমাণ করে যে, তাদের বিভিন্ন দেবতার উপাসনার সঙ্গে মহাকাশীয় পর্যবেক্ষণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। 

এই স্থাপত্যগুলো কোনোভাবেই দুর্ঘটনাবশত এমনভাবে তৈরি হয়নি। এগুলো ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আকাশ পর্যবেক্ষণের ফলে অর্জিত জ্ঞানের ফল। নাবাতিয়ানরা জানত, বছরের কোন দিনে সূর্য কোন কোণে উদয় হবে বা অস্ত যাবে। আর সেই জ্ঞানকে ব্যবহার করেই তারা তাদের সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোকে নির্মাণ করেছিল, যেন প্রকৃতির শক্তি তাদের উপাসনার অংশ হতে পারে।

ধর্মবিশ্বাস না প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞান? একটি আধুনিক দ্বিধা

আজকের দিনে আমরা ধর্ম এবং বিজ্ঞানকে দুটি ভিন্ন চোখে দেখি। কিন্তু প্রাচীন মানুষদের কাছে এই বিভাজন ছিল না। তাদের জন্য, যা কিছু বিজ্ঞান, তাই ছিল ধর্মের অংশ। আর যা ধর্ম, তাই ছিল বিজ্ঞানের অনুপ্রেরণা।

নাবাতিয়ানদের জন্য আকাশ পর্যবেক্ষণ নিছক কোনো বৈজ্ঞানিক কৌতূহল ছিল না, এটি ছিল একটি পবিত্র দায়িত্ব। আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের সুশৃঙ্খল চলাচল ছিল তাদের কাছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং মহাবিশ্বের ঐশ্বরিক নিয়মের প্রমাণ। তাদের জ্যোতির্বিজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যবহারিক উদ্দেশ্যও ছিল:

পথপ্রদর্শক হিসেবে

রাতের অন্ধকারে মরুভূমির বুকে বাণিজ্য কাফেলা পরিচালনা করার জন্য ধ্রুবতারা এবং অন্যান্য নক্ষত্রপুঞ্জই ছিল তাদের একমাত্র জিপিএস। যে তারাগুলো তাদের নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনত, সেগুলোকে তারা ঐশ্বরিক রক্ষাকর্তা হিসেবেই দেখত।

ক্যালেন্ডার হিসেবে

চাঁদের দশা এবং সূর্যের অবস্থান দেখেই তারা তাদের মাস ও বছর গণনা করত। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ীই তাদের ধর্মীয় উৎসব, কৃষি কাজ এবং সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালিত হতো।

ভবিষ্যৎ গণনার জন্য

অনেক প্রাচীন সভ্যতার মতো তারাও বিশ্বাস করত যে, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্যকে প্রভাবিত করে। নাবাতিয়ানরা যেহেতু মিশর ও মেসোপটেমিয়ার মতো উন্নত জ্যোতিষচর্চার কেন্দ্রগুলোর মাঝে অবস্থিত ছিল, তাই তাদের উপর এই প্রভাব থাকাটাই স্বাভাবিক।

সুতরাং, তাদের ধর্মবিশ্বাস আর জ্যোতির্বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক ছিল। বিজ্ঞান তাদের দিয়েছে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা, আর ধর্ম সেই পর্যবেক্ষণকে দিয়েছে আধ্যাত্মিক অর্থ। তারা নক্ষত্রে দেবতার সন্ধান করত, কারণ তারা বিশ্বাস করত, ঈশ্বর তার সৃষ্টির মাধ্যমেই কথা বলেন। তাদের পুরোহিত শ্রেণীই সম্ভবত ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যারা মহাকাশের ভাষা পড়তে পারত এবং সাধারণ মানুষের কাছে তা ব্যাখ্যা করত।

আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দেখে সামনের দিকে এগুচ্ছে নাবাতিয়ানদের কাফেলা

“নক্ষত্রেই কি নাবাতিয়ানদের ঈশ্বর ছিল?” – এই প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। উত্তরটি হলো হ্যাঁ এবং না। তাদের দেবতা দুশারা হয়তো আক্ষরিক অর্থে কোনো নক্ষত্র ছিলেন না, কিন্তু তার শক্তি, উপস্থিতি এবং মহিমাকে তারা আকাশে দৃশ্যমান গ্রহ, সূর্য বা নক্ষত্রপুঞ্জের মাধ্যমেই অনুভব করত। তাদের কাছে আকাশ ছিল একটি জীবন্ত মন্দির, যার প্রতিটি তারা ছিল এক একটি ঐশ্বরিক বার্তা।

পেত্রার ধ্বংসাবশেষ আজ আমাদের এটাই শেখায় যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা আর আধ্যাত্মিকতার সাধনা একসঙ্গে চলতে পারে। আধুনিকতার বিভাজনে আমরা হয়তো এই দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু পেত্রার পাথরের ভাঁজে ভাঁজে এবং মরুভূমির রাতের আকাশে সেই মহাকাশীয় ধর্মবিশ্বাস আজও নিঃশব্দে কথা বলে যায়।

তথ্যসূত্র –

Related posts

সাত সতীর ছায়ায় মহেঞ্জোদারো: এক রহস্যময় অধ্যায়ের উন্মোচন

যে খেলা মায়া সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো!

মায়ানদের শেষ রাত: অন্ধকারে লুকানো উত্তর

আবু সালেহ পিয়ার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More