Image default
ইতিহাস ১০১

টুপির পেছনের গল্প- ইসলাম, ইহুদি, খ্রিস্টান ধর্মে টুপির রহস্যময় ব্যবহার

অনেক সংস্কৃতিতে মাথাকে শরীরের পবিত্রতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, ফলে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সম্মান রক্ষার্থে মাথা ঢাকার প্রথা চালু হয়।

টুপির ইতিহাস শুধুমাত্র ফ্যাশনের গল্প নয়; এটি ধর্মীয় আচার, আত্মপরিচয় এবং আধ্যাত্মিক সম্মানের প্রতিচ্ছবি। বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাথাকে শরীরের সবচেয়ে পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে গণ্য করেছে। এই বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছে মাথা ঢাকার নানা রীতি, যার মধ্যে টুপি অন্যতম। ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্ম—তিনটি ধর্মেই টুপির রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও ব্যবহারের ঐতিহ্য। কখনো এটি নম্রতার প্রতীক, কখনো সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যম, আবার কখনো পরিচয়ের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

টুপির উৎপত্তি

টুপি শব্দটির বাংলা অর্থ হলো মস্তকাবরণবিশেষ বা শিরস্ত্রাণ। এটি মূলত সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে। টুপির বহুল পরিচিত আরবি শব্দ ‘কালানসুওয়া’। ‘কালানসুওয়া’ অর্থ শিরোভূষণ। এটি ‘কালসুন’ থেকে উদগত, এর বহুবচন হলো ‘কালানিস’।

মাথা ঢাকার প্রথা আদিকাল থেকেই মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গোড়ার দিকে মানুষ পাতা, পশুর চামড়া কিংবা পাখির পালক দিয়ে মাথা ঢাকত মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা যেমন সূর্যের তাপ, বৃষ্টি, ঠান্ডা ও ধুলাবালি থেকে সুরক্ষার প্রয়োজনেই মাথা ঢাকার অভ্যাস গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, এটি আত্মপরিচয় প্রকাশ এবং সামাজিক বা গোত্রীয় অবস্থান বোঝানোর একটি মাধ্যম ছিল। তৃতীয়ত, অনেক সংস্কৃতিতে মাথাকে শরীরের পবিত্রতম অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, ফলে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় সম্মান রক্ষার্থে মাথা ঢাকার প্রথা চালু হয়।  

বিভিন্ন রকমের টুপি

এদিকে ধর্মীয় অঙ্গনের বাইরে বা ধর্মীয় বিশেষ ঘরানায় আলাদা আলাদা টুপি ব্যবহারের রীতি চালু আছে। এগুলোর ব্যবহার ও ধরন হিসেবে বিভিন্ন নামও আছে। যেমন—গোল টুপি, লম্বা টুপি বা কিস্তি টুপি, পাঁচকল্লি টুপি, চারকল্লি টুপি, জিন্নাহ টুপি, গান্ধী টুপি, নেহরু টুপি, নেপালি টুপি, মালয়েশিয়ান টুপি, শামি টুপি, তুর্কি টুপি, রুমি টুপি, পাকিস্তানি টুপি, সৌদি টুপি, আরবি টুপি, জালি টুপি, তালি টুপি, বেতের টুপি, খানকা টুপি, দরবারি টুপি, পিরালি টুপি, মুরিদি টুপি, কংগ্রেসি টুপি, বিয়ের টুপি ও ঈদের টুপি।

বিভিন্ন রকমের টুপি

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে টুপি

পারস্য 

পারস্যের টুপির বয়স প্রায় ছয় হাজার বছর। অনেকে বলেন, পারস্যেই এর যাত্রা শুরু। প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামে পারস্যের এক দেবীমূর্তি রাখা আছে। মূর্তিটির বয়স পাঁচ হাজার বছর, দেবীর মাথায় একটি মোচাকৃতির মুকুট দেখা যায়। জরথুস্ট্র ধর্মের দেবতা আহুর মাজদার মাথায়ও টুপি বা মুকুট দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায়, টুপির বয়স হাজার হাজার বছর।

গ্রিস ও রোম  

গ্রিসে টুপির ব্যবহার দেখা যায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিনোয়ান সমাজে। মিনোয়ান সভ্যতার নারী-পুরুষ সবাই বড় চুল রাখত আর পাতা বা ধাতু দিয়ে মুকুট বানিয়ে নিত। তবে শাসক ও ধর্মগুরুরা কাপড়ের টুপি ব্যবহার করতেন। আফগানদের পাকল নামের টুপি আর গ্রিকদের কাউসিয়া প্রায় একই রকম দেখতে। ধারণা করা হয়, গ্রিকরা এটি আফগানিস্তানের নুরিস্তানে নিয়ে আসে। গ্রিকরা পশ্চিম এশিয়ার (কুর্দিস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি) দেশেও টুপির প্রসার ঘটিয়েছে। 

চীন  

খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের আগে থেকে চীনের রাজারা সিল্কের টুপি ব্যবহার করতেন। তাঁদের টুপিতেই প্রথম রোদ থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি অংশের ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণ লোকজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠদের টুপি পরার অধিকার ছিল।

আফ্রিকা 

আফ্রিকায় মুকুট বা টুপিের চল বহু পুরনো। তবে কাপড়ের টুপির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে নতুন। ইসলাম ধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকায় কাপড়ের টুপির ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আরবরা টুপি ও পাগড়ি ইসলাম আসার আগে থেকেই ব্যবহার করত। 

ইসলামে টুপি পরার ইতিহাস ও তাৎপর্য

হাজার বছরের মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক টুপি। ইসলামের সূচনাকাল থেকেই টুপি পরিধানের চল রয়েছে। ফিকহের দৃষ্টিকোণে টুপি পরা সুন্নত। মহানবী (সা.) সর্বদা টুপি পরিধান করতেন। নামাজের সময় টুপি পরা বা মাথা ঢেকে রাখা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তিন বা ততোধিক টুপি ছিল। মহানবী (সা.) পাগড়ি ছাড়াও টুপি পরতেন, কিন্তু টুপি ছাড়া পাগড়ি পরতেন না।

টুপি মুসলিম উম্মাহর জাতীয় নিদর্শন। রাসুলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবেতাবেইন, আইম্মায়ে মুজতাহিদগণসহ সব যুগে টুপি পরিধান করার প্রচলন মুসলিম সমাজে ছিল, এখনো আছে। শালীনতা ও সৌন্দর্যের আবরণ টুপি মুসলমানদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং সুন্নাহসম্মত ইসলামি পোশাকের অন্তর্ভুক্ত।

জাতীয় ঐক্যের প্রতীক

টুপি মুসলমানদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। রাসুলের যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত, সব যুগেই মুসলমানদের মধ্যে টুপির ব্যাপক প্রচলন ছিল। মুসলিমরা ইউরোপীয় সংস্কৃতির পোশাক-আশাক গ্রহণ করতে শুরু করলেও টুপি পরা বন্ধ করেননি। 

উসমানি আমলে সেনাবাহিনীর জন্যও বিশেষ ‘লাল টুপি’র বাধ্যবাধকতা ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে ভৌগোলিক ও ঐতিহ্যগত কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের টুপির আকার-আকৃতি বিভিন্ন ধরনের দেখা যায়। উপমহাদেশেও বিভিন্ন ধারার চিন্তা ও প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ডিজাইনের টুপির ব্যবহার লক্ষ করা যায়

উসমানি আমলে সেনাবাহিনীর বিশেষ টুপি

ইহুদিরা যে কারণে ‘কিপ্পা’ বা ইয়ামাকা পরে

ইহুদি ধর্মানুসারীরা টুপি পরিধান করে থাকেন। তাদের মাথার তালুতে পরার এ কিপ্পা, মাথার তুলনায় অনেক ছোট। আর তা মাথার ঠিক উপরে পেছনের দিকে পরা হয়। আর তা চুলের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে রাখতে হয়। যাতে কোনো রকম মাথার তালুর পেছনের অংশ ঢেকে থাকে। এ কিপ্পা পরার পেছনে ইয়াহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থ তালমুদে এক বিশেষ কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হলো- 

‘তুমি তোমার মাথা ঢেকে রাখো,যেন আসমানের কোনো ক্রোধ ও গজব তোমার উপর পতিত না হয়।’

ধর্মীয় প্রার্থনার সময় এ কিপ্পা পরা তাদের ধর্মের আবশ্যকীয় নিয়ম। তবে অন্যান্য সময় এটা পরায় তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

কিপ্পার রঙ ও শ্রেণি বিভেদ
তবে ইয়াহুদিদের সবাই এক রঙের কিপ্পা পরতে পারে না। শ্রেণি বিশেষের মর্যাদার সঙ্গে মিল রেখেই নির্ধারিত রঙের কিপ্পা পরতে হয়। মান-মর্যাদা, মতবাদ ও স্তরের তারতম্য বিবেচনায় ব্যবহৃত হয় কিপ্পা। আর তাহলো-

সাদা রঙের কিপ্পা: রক্ষণশীল ও সংস্কারক মর্যাদা ও স্তরের ইয়াহুদিরা সাদা রঙের কিপ্পা পরে।

কালো রঙের কিপ্পা: কট্টর ইয়াহুদি ধর্মাবলম্বীরাই কালো রঙের কিপ্পা পরে। তবে যারা বিশেষভাবে ইয়াহুদি ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা কিংবা গবেষণা করে, তারও কালো রঙের কিপ্পা পরে।

অন্যান্য সব রঙের কিপ্পা: অন্যান্য সব সাধারণ ইয়াহুদিরা সাদা ও কালো রঙ ব্যতিত যে কোনো রঙের কিপ্পা পরতে পারে।

কিপ্পা পরা অবস্থায় ইহুদিরা

খ্রিষ্টধর্মে পোপ কেন বিশেষ ধরণের টুপি পরে?

খ্রিস্টধর্মে টুপির ব্যবহার তেমন একটা দেখা যায় না। তবে পোপকে বিশেষ এক ধরনের টুপি ব্যবহার করতে দেখা যায়।

পোপ যে বিশেষ ধরণের টুপি পরেন, সেটি হলো “জুক্কাত্তো” (Zucchetto) এবং এটি আসলে ক্যাথলিক চার্চের সকল বিশপদের জন্য একটি সাধারণ টুপি। তবে পোপের জুক্কাত্তো সাদা রঙের হয়ে থাকে, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। এটি মূলত গির্জার আনুষ্ঠানিক পোশাকে একটি অংশ এবং এটি মণ্ডলীর প্রধান হিসেবে তার পরিচয় বহন করে। 

পোপ যে টুপি পরেন, তার কয়েকটি বিশেষত্ব হলো- এটি একটি ছোট, গোলাকার টুপি যা সাধারণত চামড়া বা কাপড়ের তৈরি এবং ক্যাথলিক যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিধান করা হয়। পোপের জুক্কাত্তো সাদা রঙের হয়ে থাকে। জুক্কাত্তো পরিধানের ঐতিহ্য অনেক পুরনো এবং এটি সম্ভবত ঠান্ডা আবহাওয়ায় মাথা গরম রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো। পোপের সাদা জুক্কাত্তো তার পদমর্যাদা এবং চার্চের প্রধান হিসেবে তার প্রতীক। পোপের মুকুট (Tiara) “রাজাদের পিতা”, “বিশ্বের শাসক” এবং “খ্রিস্টের প্রতিনিধি” হিসেবে তার ত্রিবিধ ক্ষমতার প্রতীক।

তথ্যসূত্রঃ 

Related posts

গালি’র ইতিহাস : ভাষা ও সংস্কৃতির অংশ এবং আবেগ প্রকাশের মাধ্যম

কীভাবে আপনার হাতে এলো ‘শপিং ব্যাগ’

বিড়ালের হারানো অতীত: যুদ্ধক্ষেত্রে বিড়াল

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More