Image default
প্রযুক্তি

ভবিষ্যতে প্রোগ্রাম নয়, কম্পিউটারকে কুকুরের মতো ট্রেইন করা হবে- নতুন AI যুগের দৃষ্টান্ত

প্রোগ্রামারদের যুগ কি শেষ? AI এখন শিখছে মানুষের মতো, লক্ষ লক্ষ উদাহরণ দেখে এবং সঠিক কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়ে। জানুন ভবিষ্যতের সেই প্রযুক্তির কথা, যা কম্পিউটারকে নিয়ম শেখানোর বদলে ধীরে ধীরে বুদ্ধিমান করে তুলছে।

যখন আমরা ‘প্রোগ্রামার’ শব্দটি শুনি, তখন আমাদের চোখে কী ভাসে? সম্ভবত, অন্ধকার ঘরে বসা একদল মেধাবী মানুষ, যারা কফি খেতে খেতে কিবোর্ডে ঝড় তুলছেন এবং হাজার হাজার লাইনের জটিল কোড লিখছেন। এই কোডই হলো সেই জাদুর কাঠি, যা কম্পিউটারকে বলে দেয় ঠিক কী করতে হবে, কখন করতে হবে এবং কীভাবে করতে হবে। কয়েক দশক ধরে, এই চিত্রটিই ছিল প্রযুক্তির অগ্রগতির মূল ভিত্তি। আমরা কম্পিউটারকে নিয়ম শিখিয়েছি, আর কম্পিউটার সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।

কিন্তু ২০২৫ সালে এসে, এই চিত্রটি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI-এর যে অভাবনীয় উত্থান আমরা দেখছি, তার পেছনে কাজ করছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দর্শন। এই নতুন দর্শনের মূল কথাটি বিখ্যাত প্রযুক্তি ম্যাগাজিন Wired-এর একটি প্রবন্ধে দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছিল: “ভবিষ্যতে আমরা কম্পিউটারকে প্রোগ্রাম করব না, আমরা তাদের কুকুরের মতো ট্রেইন করাব।”

এই উক্তিটি শুনতে যতই অদ্ভুত বা আপত্তিকর মনে হোক না কেন, এর গভীরে লুকিয়ে আছে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মূল ধারণা। আমরা ধীরে ধীরে এমন এক যুগে প্রবেশ করছি, যেখানে কম্পিউটারকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশ দেওয়ার পরিবর্তে, আমরা তাকে উদাহরণ, অভিজ্ঞতা এবং পুরস্কারের মাধ্যমে শেখাব; ঠিক যেভাবে আমরা একটি বুদ্ধিমান প্রাণীকে নতুন কিছু শেখাই।

প্রোগ্রামিং-এর যুগ: নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা কম্পিউটার

এই নতুন পরিবর্তনটি বোঝার আগে, আমাদের চিরাচরিত প্রোগ্রামিং-এর পদ্ধতিটি বুঝতে হবে। ক্লাসিক্যাল প্রোগ্রামিং হলো কম্পিউটারকে একটি অত্যন্ত বিস্তারিত এবং সুনির্দিষ্ট ‘রেসিপি’ বা নিয়মাবলী দেওয়ার মতো।

ধরুন, আপনি একটি কম্পিউটারকে দুটি সংখ্যা যোগ করার জন্য প্রোগ্রাম করতে চান। আপনাকে কোডের মাধ্যমে ধাপে ধাপে বলে দিতে হবে: “প্রথমে প্রথম সংখ্যাটি নাও, তারপর দ্বিতীয় সংখ্যাটি নাও, তাদের মধ্যে যোগ চিহ্ন বসাও, এবং ফলাফলটি স্ক্রিনে দেখাও।” কম্পিউটার এই নিয়মের বাইরে একচুলও নড়তে পারবে না। যদি আপনি তাকে বিয়োগ করতে বলেন, সে পারবে না, কারণ তাকে সেই নিয়ম শেখানো হয়নি।

প্রোগ্রামিং করছে একজন প্রোগ্রামার

এই পদ্ধতিটি সেইসব কাজের জন্য অসাধারণ, যেগুলো যুক্তিনির্ভর এবং যার একটি নির্দিষ্ট এবং অনুমেয় আউটপুট আছে। যেমন ক্যালকুলেটর, ওয়ার্ড প্রসেসর বা একটি ওয়েবসাইটের মেন্যু। এই সব ক্ষেত্রেই “যদি এটা হয়, তবে ওটা করো” (If-Then) লজিক ব্যবহার করা হয়।

প্রোগ্রামিং-এর সীমাবদ্ধতা:

সমস্যাটা তখনই শুরু হয়, যখন আমরা কম্পিউটারকে এমন কিছু করতে বলি, যার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যেমন:

  • একটি ছবি থেকে বিড়াল চেনা: আপনি কম্পিউটারকে কীভাবে প্রোগ্রাম করে বোঝাবেন যে, একটি বিড়াল দেখতে কেমন? তার চারটি পা, দুটি কান, একটি লেজ আছে। এই নিয়মগুলো দিয়ে শুরু করলেও, হাজারো ব্যতিক্রম থাকবে। বসা অবস্থায়, শোয়া অবস্থায়, সাদা, কালো, ডোরাকাটা কত রকমের বিড়াল হতে পারে! এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়মাবলী লেখা প্রায় অসম্ভব।
  • ভাষা অনুবাদ: একটি বাক্যকে অন্য ভাষায় অনুবাদ করা শুধু শব্দের প্রতিশব্দ বসানো নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে ভাব, সংস্কৃতি এবং প্রেক্ষাপট। কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম দিয়ে এই জটিল কাজটি করা যায় না।

এই ধরনের জটিল এবং পরিবর্তনশীল কাজের ক্ষেত্রেই চিরাচরিত প্রোগ্রামিং অসহায় হয়ে পড়ে। আর এখানেই জন্ম হয়েছে নতুন এক পদ্ধতির – মেশিন লার্নিং বা AI ট্রেনিং।

নতুন দিগন্ত: কম্পিউটারকে যেভাবে ‘কুকুরের মতো’ ট্রেইন করা হয়

“Train them like dogs” বা “কুকুরের মতো ট্রেইন করানো” এই উপমাটিই মেশিন লার্নিং-এর মূল দর্শনকে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে। 

১. লক্ষ্য নির্ধারণ (The Goal):

আপনি যখন একটি কুকুরকে “বসতে” শেখান, তখন আপনি তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে প্রোগ্রাম করেন না। আপনি শুধু একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেন “আমি যখন ‘বস’ বলব, তখন তুমি বসবে।” একইভাবে, মেশিন লার্নিং-এ আমরা কম্পিউটারকে একটি লক্ষ্য দিই। যেমন এই লক্ষ লক্ষ ছবির মধ্যে থেকে যেগুলো বিড়ালের ছবি, সেগুলোকে শনাক্ত করো।” আমরা তাকে বিড়ালের সংজ্ঞা বা নিয়ম বলে দিই না, শুধু লক্ষ্যটা বলে দিই।

প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে বিড়াল ডিটেক্ট করা হচ্ছে

২. ডেটা প্রদান (The Experience):

কুকুরটি বারবার আপনাকে দেখে এবং আপনার নির্দেশ শুনে শেখে। আপনি তাকে হয়তো হাত দিয়ে বসিয়ে দেন, অথবা অন্য কুকুরকে বসতে দেখেন। এটাই তার অভিজ্ঞতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে, এই অভিজ্ঞতা হলো ডেটা। বিড়াল শনাক্ত করার জন্য, আমরা AI মডেলটিকে লক্ষ লক্ষ ছবি দেখাই, যার কিছুতে বিড়ালের ছবি থাকে (এবং “বিড়াল” হিসেবে লেবেল করা থাকে) এবং কিছুতে থাকে না। এই বিশাল ডেটাসেটই হলো তার শেখার প্রধান উপকরণ।

৩. পুরস্কার ও শাস্তি (Reinforcement):

কুকুরটি যখন সঠিকভাবে বসে, তখন আপনি তাকে একটি বিস্কুট দেন বা প্রশংসা করেন। এটি হলো পজিটিভ রিইনফোর্সমেন্ট বা ইতিবাচক পুরস্কার। আর যখন সে ভুল করে, তখন আপনি হয়তো তাকে উপেক্ষা করেন বা আবার চেষ্টা করতে বলেন। AI ট্রেনিং-এর ক্ষেত্রেও ঠিক একই রকম একটি ব্যবস্থা আছে, যার নাম রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং (Reinforcement Learning)।

AI মডেলটি যখন একটি ছবিতে সঠিকভাবে বিড়াল শনাক্ত করে, তখন তার ভেতরের গাণিতিক মডেলের প্যারামিটারগুলোকে এমনভাবে সামান্য পরিবর্তন করা হয়, যাতে সে ভবিষ্যতে একই ধরনের সঠিক কাজ করার জন্য উৎসাহিত হয়। আর যখন সে ভুল করে (যেমন একটি কুকুরকে বিড়াল বলে), তখন তার প্যারামিটারগুলোকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যাতে সেই ভুল পথের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এই লক্ষ লক্ষ বার সঠিক কাজের জন্য পুরস্কৃত হওয়া এবং ভুল কাজের জন্য শাস্তি পাওয়ার মাধ্যমেই AI ধীরে ধীরে শেখে।

. প্যাটার্ন শনাক্তকরণ (The Learning):

শেষ পর্যন্ত, কুকুরটি “বস” শব্দটি এবং বসার ভঙ্গির মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করতে শেখে। সে পুরস্কার পাওয়ার জন্য এই কাজটি করে। একইভাবে, AI মডেলটিও লক্ষ লক্ষ ছবির পিক্সেলগুলোর মধ্যে এমন কিছু প্যাটার্ন (যেমন চোখের আকৃতি, কানের গঠন, গোঁফের বিন্যাস) খুঁজে বের করে, যা “বিড়াল” লেবেলের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত। সে আসলে “বিড়াল” কী, তা বোঝে না; সে শুধু গাণিতিকভাবে প্যাটার্ন শনাক্ত করতে শেখে।

এভাবেই, কোনো আলাদ কোড বা নিয়ম ছাড়াই, শুধুমাত্র ডেটা এবং রিইনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে একটি কম্পিউটার এমন কিছু শিখতে পারে, যা তাকে প্রোগ্রাম করে শেখানো প্রায় অসম্ভব ছিল।

প্রোগ্রাম বনাম প্রশিক্ষণ: মূল পার্থক্যগুলো কী কী?

  • পদ্ধতি: প্রোগ্রামিং হলো নিয়ম-ভিত্তিক (Rule-based)। প্রশিক্ষণ হলো উদাহরণ-ভিত্তিক (Example-based)।
  • যুক্তি: প্রোগ্রামিং হলো ডিটারমিনিস্টিক (Deterministic), অর্থাৎ একই ইনপুট দিলে সবসময় একই আউটপুট আসবে। মেশিন লার্নিং হলো প্রোবাবিলিস্টিক (Probabilistic), অর্থাৎ এটি ডেটার উপর ভিত্তি করে সবচেয়ে সম্ভাব্য একটি উত্তর দেয়, যা সবসময় শতভাগ সঠিক নাও হতে পারে।
  • স্বচ্ছতা: একটি প্রোগ্রাম হলো ‘হোয়াইট বক্স’। একজন মানুষ কোড পড়ে বুঝতে পারে, কম্পিউটার কেন একটি নির্দিষ্ট কাজ করল। কিন্তু একটি আধুনিক নিউরাল নেটওয়ার্ক হলো ‘ব্ল্যাক বক্স’। এটি হয়তো সঠিকভাবে বিড়াল শনাক্ত করতে পারে, কিন্তু ঠিক কোন গাণিতিক গণনার মাধ্যমে সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, তা তার নির্মাতাদের পক্ষেও পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয় না।
  • দক্ষতা: প্রোগ্রামিং সেইসব কাজের জন্য সেরা, যেখানে নিয়মগুলো স্পষ্ট। প্রশিক্ষণ সেইসব কাজের জন্য সেরা, যেখানে নিয়মগুলো অস্পষ্ট কিন্তু প্রচুর উদাহরণ বা ডেটা রয়েছে।

এর প্রভাব কী? চাকরি থেকে সৃষ্টিশীলতা পর্যন্ত

এই প্যারাডাইম শিফট বা ধারণাগত পরিবর্তন আমাদের ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে চলেছে।

  • প্রোগ্রামিং-এর ভবিষ্যৎ: তাহলে কি প্রোগ্রামারদের যুগ শেষ হয়ে যাবে? উত্তর হলো – না। কিন্তু তাদের কাজের ধরণ আমূল বদলে যাবে। ভবিষ্যতের প্রোগ্রামাররা হয়তো প্রতিটি লাইনের কোড লিখবেন না। তাদের কাজ হবে:
    • এআই আর্কিটেক্ট: শক্তিশালী এবং কার্যকর লার্নিং মডেল বা নিউরাল নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা।
    • এআই ট্রেইনার: মডেলটিকে সঠিক ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তার ভুলগুলো সংশোধন করা।
    • এআই এথিসিস্ট: মডেলটি যেন কোনো অনৈতিক বা পক্ষপাতমূলক আচরণ না করে, তা নিশ্চিত করা।
      অর্থাৎ, প্রোগ্রামাররা হয়ে উঠবেন ‘এআই-এর শিক্ষক’ বা ‘এআই-এর মেন্টর’।
  • নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন: এই নতুন পদ্ধতিতে আমরা এমন সব সমস্যার সমাধান করতে পারছি, যা আগে অকল্পনীয় ছিল। যেমন নতুন ঔষধ আবিষ্কারের জন্য প্রোটিনের গঠন বোঝা, জলবায়ু পরিবর্তনের মডেল তৈরি করা, অথবা মানুষের কণ্ঠস্বরকে অনুকরণ করে কথা বলা।
  • সৃজনশীলতার নতুন রূপ: সৃজনশীল জগতেও এই পরিবর্তন আসছে। একজন শিল্পী এখন আর শুধু তুলি দিয়ে ছবি আঁকেন না। তিনি এআই-কে ‘প্রম্পট’ বা নির্দেশনা দিয়ে সহ-শিল্পী হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি এআই-কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তার নিজস্ব স্টাইল অনুকরণ করার জন্য।

উপসংহার:

চিরাচরিত প্রোগ্রামিং-এর যুগ হয়তো শেষ হবে না, কারণ নিয়ম-ভিত্তিক কাজের প্রয়োজনীয়তা সবসময়ই থাকবে। কিন্তু প্রযুক্তির সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং যুগান্তকারী উদ্ভাবনগুলো এখন আসবে মেশিন লার্নিং এবং AI ট্রেনিং-এর পথ ধরেই।

এই নতুন যুগে সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় দক্ষতা কোডিং নয়, বরং শেখানোর ক্ষমতা, সঠিক প্রশ্ন করার ক্ষমতা এবং একটি বুদ্ধিমান সিস্টেমের সাথে কার্যকরভাবে কাজ করার ক্ষমতা। ভবিষ্যৎ তাদেরই, যারা যন্ত্রকে শুধু নির্দেশ দিতেই জানে না, বরং তাকে শিখতেও সাহায্য করতে পারে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

আইফোন, পিক্সেল না স্যামসাং? ২০২৫ সালে কোন ফোনে বাজিমাত!

iPhone 17 Air-এর সব নতুন ফিচার: পাতলা ডিজাইন থেকে উন্নত ক্যামেরা পর্যন্ত

কিভাবে ফেসবুক থেকে আয় করতে পারেন?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More