Image default
প্রযুক্তি

ইউটিউব এবার কঠোর! মনিটাইজেশনে নতুন নিয়ম, ডি-মনিটাইজ হবে যেসব চ্যানেল!

এবার কঠোর হচ্ছে ইউটিউব! AI বা কপি-পেস্ট কনটেন্ট দিয়ে ইউটিউব থেকে আয় করছেন? নতুন নিয়মে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আপনার চ্যানেলের ইনকাম। তাই ইউটিউব থেকে আয় করতে হলে জানতে হবে নতুন ইউটিউব পলিসির খুঁটিনাটি।

ইউটিউব, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম এবং কোটি কোটি কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস, তার মনিটাইজেশন নীতিমালায় একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ২০২৫ সালের ১৫ই জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া এই নতুন নিয়মকে ইউটিউবের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপগুলোর একটি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই আপডেটের মূল লক্ষ্য হলো প্ল্যাটফর্মকে আরও উন্নত, মানসম্মত এবং নির্ভরযোগ্য করে তোলা, যা হবে বিজ্ঞাপনদাতা এবং দর্শক উভয়ের জন্যই ইতিবাচক।

তবে এই পরিবর্তনের ফলে বহু ইউটিউব চ্যানেলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বিশেষ করে যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে বা স্বল্প পরিশ্রমে কনটেন্ট তৈরি করে আয় করছিলেন, তাদের চ্যানেল ডি-মনিটাইজ হওয়ার বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। 

কেন ইউটিউব এতটা কঠোর হলো?

বিগত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) অভাবনীয় উন্নতির ফলে কনটেন্ট তৈরির প্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। এর সুযোগ নিয়ে বহু ক্রিয়েটর অল্প সময় ও পরিশ্রম ছাড়াই ভিডিও তৈরি করা শুরু করেন, যা প্রায়শই একই ধরনের, সৃজনশীলতাহীন এবং নিম্নমানের হতো। AI ভয়েস দিয়ে আর্টিকেল পড়া, স্টক ফুটেজের উপর একই ধরনের টেক্সট বসানো, বা টেমপ্লেট ব্যবহার করে শত শত প্রায় একই রকম ভিডিও তৈরি করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল।

এ আই দিয়ে এক ক্লিকে অনেক ভিডিও বানানো হচ্ছে

এই “AI Slop” বা নিম্নমানের কনটেন্ট ইউটিউবের সামগ্রিক ইকোসিস্টেমের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারন – 

  • দর্শকরা একই ধরনের অরুচিকর কনটেন্ট দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন।
  • বড় ব্র্যান্ডগুলো তাদের বিজ্ঞাপন নিম্নমানের বা স্প্যামি ভিডিওর পাশে দেখাতে চায় না।
  • যারা সময় এবং মেধা দিয়ে আসল এবং মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করেন, তারা এই বিপুল পরিমাণ “অ্যাসেম্বলি লাইন” কনটেন্টের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছিলেন।

এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতেই ইউটিউব তার মনিটাইজেশন নীতি আরও কঠোর করতে বাধ্য হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো “অথেনটিক” বা আসল কনটেন্টকে পুরস্কৃত করা এবং “ইনঅথেনটিক” বা নকল কনটেন্টকে নিরুৎসাহিত করা।

নতুন ইউটিউব মনিটাইজেশন পলিসিতে কী কী পরিবর্তন এলো?

১৫ জুলাই, ২০২৫ থেকে কার্যকর হওয়া নতুন পলিসির মূল বিষয়বস্তু হলো “ইনঅথেনটিক কনটেন্ট” (Inauthentic Content) এর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা। পূর্বে এই নীতিটি “রিপিটিটিয়াস কনটেন্ট” (Repetitious Content) বা পুনরাবৃত্তিমূলক কনটেন্ট নামে পরিচিত ছিল। নাম পরিবর্তন এবং নতুন ব্যাখ্যা যোগ করে ইউটিউব স্পষ্ট করে দিয়েছে কোন ধরনের কনটেন্ট থেকে আর আয় করা যাবে না।

মনিটাইজেশনের যোগ্যতা (Eligibility Criteria) আগের মতোই, কিন্তু…

চ্যানেল মনিটাইজ করার জন্য প্রাথমিক যোগ্যতা আগের মতোই রয়েছে। আপনাকে গত ১২ মাসে ১০০০ সাবস্ক্রাইবার এবং ৪০০০ ঘণ্টা পাবলিক ওয়াচ আওয়ার পূরণ করতে হবে, অথবা গত ৯০ দিনে ১০ মিলিয়ন শর্টস ভিউ থাকতে হবে।

ইউটিউব মনিটাইজেশন যোগ্যতা

কিন্তু বড় পরিবর্তনটি হলো রিভিউ প্রক্রিয়ায়। এখন থেকে এই সংখ্যাগুলো পূরণ করাই যথেষ্ট নয়। ইউটিউবের রিভিউ টিম প্রতিটি চ্যানেলকে আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখবে এবং নিশ্চিত করবে যে আপনার কনটেন্টগুলো আসল, মানসম্মত এবং তাতে আপনার নিজস্ব সৃজনশীলতার ছোঁয়া আছে।

ডি-মনিটাইজ হবে যেসব চ্যানেল: ঝুঁকিতে কারা?

ইউটিউবের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ধরনের কনটেন্ট তৈরি করলে আপনার চ্যানেল ডি-মনিটাইজ বা মনিটাইজেশন বাতিল হয়ে যেতে পারে:

  • ব্যাপকহারে তৈরি বা Mass-produced কনটেন্ট: AI বা অন্য কোনো টুল ব্যবহার করে অল্প সময়ে শত শত ভিডিও তৈরি করা, যেগুলোর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। যেমন ধরুন টেমপ্লেট ব্যবহার করে বানানো জন্মদিনের শুভেচ্ছা ভিডিও বা রাশিফলের ভিডিও।
  • পুনরাবৃত্তিমূলক বা Repetitious কনটেন্ট: একই ধরনের ফরম্যাট বা আইডিয়া ব্যবহার করে বারবার ভিডিও বানানো, যেখানে নতুনত্ব বা সৃজনশীলতার অভাব রয়েছে। যেমন শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক পরিবর্তন করে একই স্লাইডশো বারবার আপলোড করা।
  • নকল বা Inauthentic কনটেন্ট: যে কনটেন্টে নির্মাতার নিজস্ব ইনপুট প্রায় নেই বললেই চলে। এর মধ্যে রয়েছে:
    • অন্য ওয়েবসাইট বা ব্লগ থেকে লেখা কপি করে AI ভয়েস দিয়ে পড়িয়ে শোনানো এবং তার সাথে স্টক ফুটেজ বা ছবি জুড়ে দেওয়া।
    • অন্য ক্রিয়েটরের ভিডিওর অংশবিশেষ নিয়ে সামান্য পরিবর্তন (যেমন ফিল্টার যোগ করা বা গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে দেওয়া) করে আপলোড করা।
    • কম্পাইলেশন বা প্রতিক্রিয়ামূলক (Reaction) ভিডিও, যেখানে আপনার নিজের মূল্যবান কোনো মন্তব্য, বিশ্লেষণ বা সৃজনশীল ইনপুট নেই।

গুরুত্বপূর্ণ নোট: ইউটিউব AI টুল ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করেনি। আপনি স্ক্রিপ্ট লিখতে, আইডিয়া জেনারেট করতে বা এডিটিং-এ সাহায্য নিতে AI ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু চূড়ান্ত ভিডিওতে অবশ্যই আপনার মানবীয় স্পর্শ (Human Touch) এবং সৃজনশীলতা  (Creative Value) যোগ করতে হবে।

ইউটিউব মনিটাইজেশন হারিয়ে গেলে করণীয়

যদি আপনার চ্যানেল নতুন নীতির কারণে ডি-মনিটাইজ হয়ে যায়, তবে আতঙ্কিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।

কারণ শনাক্ত করুন: ইউটিউব সাধারণত ইমেইলের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় কোন নীতি লঙ্ঘনের জন্য আপনার চ্যানেলের মনিটাইজেশন বাতিল করা হয়েছে। আপনার চ্যানেলের ভিডিওগুলো পুনরায় যাচাই বাছাই করে দেখুন কোনগুলো নতুন “ইনঅথেনটিক কনটেন্ট” নীতির আওতায় পড়ে।

ইউটিউব ডি মনিটাইজেশন মেইল

problematic ভিডিও সরিয়ে ফেলুন বা এডিট করুন: যেসব ভিডিও নতুন নীতি ভেঙ্গেছে, সেগুলোকে হয় ডিলিট করে দিন অথবা নতুন করে এডিট করে তাতে আপনার নিজস্ব ভয়েস, ধারাভাষ্য বা বিশ্লেষণ যোগ করুন।

পুনরায় আবেদন করুন: চ্যানেলকে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী পরিচ্ছন্ন করার পর, আপনি ৩০ দিন পর আবার মনিটাইজেশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে নিশ্চিত করুন যে, আবেদন করার আগে আপনার চ্যানেল যেন শতভাগ নীতিমালা মেনে চলে।

মনিটাইজড চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণে নতুন টিপস

২০২৫ সালের এই আপডেটের পর, চ্যানেলকে সুরক্ষিত রাখতে প্রত্যেক ক্রিয়েটরকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

এখন থেকে আপনার ভিডিওতে নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলুন। আপনি যদি ফেসক্যাম নাও করেন, আপনার ভয়েস, লেখার ধরন বা এডিটিং স্টাইল যেন আপনার নিজস্বতার পরিচয় বহন করে। পাশাপাশি যদি অন্য কারো কনটেন্ট (যেমন খেলার ক্লিপ, সিনেমার অংশ) ব্যবহার করতেই হয়, তবে নিশ্চিত করুন আপনি তাতে নতুন কোনো অর্থ বা মাত্রা যোগ করছেন। শিক্ষামূলক বিশ্লেষণ, মজাদার ধারাভাষ্য বা গঠনমূলক সমালোচনা যোগ করে কনটেন্টটিকে নিজের করে তুলুন। 

এছাড়াও, প্রতিদিন ১০টি নিম্নমানের ভিডিও আপলোড করার চেয়ে, সপ্তাহে ২টি মানসম্মত এবং আসল ভিডিও আপলোড করা অনেক বেশি কার্যকর ও নিরাপদ। ইউটিউব মনিটাইজেশন সরাসরি গুগল অ্যাডসেন্সের সাথে যুক্ত। তাই, অ্যাডসেন্সের নিয়মাবলী সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং সেগুলো মেনে চলুন।

ইউটিউবের নতুন মনিটাইজেশন পলিসি নিঃসন্দেহে বহু ক্রিয়েটরের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি পুরো প্ল্যাটফর্মের জন্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই পরিবর্তনের ফলে আসল এবং পরিশ্রমী ক্রিয়েটররা আরও বেশি গুরুত্ব পাবেন এবং দর্শকরাও মানসম্মত কনটেন্ট উপভোগ করতে পারবেন। তাই, যারা ইউটিউবকে একটি দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ার হিসেবে দেখতে চান, তাদের এখন থেকেই আরও বেশি সৃজনশীল, আসল এবং নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। দিনশেষে, ইউটিউব একটি কমিউনিটি, আর সেই কমিউনিটিকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

তথ্যসূত্র –

Related posts

কাজের চাপ কমাবে এই ১০টি এআই টুল

ইউটিউবে ভিউ পড়ে যাওয়ার কারণ

স্যাটেলাইটের আদ্যপ্রান্ত- ২০২৫ সালে মহাকাশে কত স্যাটেলাইট?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More