Image default
প্রযুক্তি

ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ: আইফোনের দাম কি আকাশছোঁয়া হবে?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের ওপর আরোপিত ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের প্রভাব পড়বে আইফোনের ভোক্তাদের ওপর। ভোক্তাদের থেকেই আদায় করা হবে এই টাকা। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনো মুখ খুলছে না কর্তৃপক্ষ। আইফোনের দাম কি তবে আকাশ ছোঁয়া হচ্ছে? সময় যত যাচ্ছে, দুশ্চিন্তা তত বাড়ছে বিশ্ববাজারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ৪২ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও নীতিমালার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ত্রাসের সঞ্চার করে চলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম সমালোচিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে বিভিন্ন দেশের উপর রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পালটা শুল্ক আরোপ করা। 

এর মধ্যে ব্যাপক গুঞ্জন উঠেছে যে, রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় আইফোনের দাম বেশ বাড়তে পারে। কারণ ট্রাম্পের নতুন শুল্কের কারণে বাড়তি ব্যয় অ্যাপল যদি ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে আইফোনের দাম ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প

তবে পালটা মতও দিচ্ছেন কেউ। ট্রাম্পের শুল্ক নীতি এবং এর কারণে আইফোনের দামে কতটা প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো আজকের লেখায়। 

ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শুল্ক নীতি

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি পুনরায় নির্বাচিত হলে বিশ্বব্যাপী মার্কিন আমদানির ওপর ন্যূনতম ১০% শুল্ক আরোপ করবেন। বিশেষভাবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে তিনি চীনা পণ্যের ওপর ৬০% বা তারও বেশি শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছেন। 

অ্যাপল বছরে প্রায় ২২ কোটি আইফোন বিক্রি করে, যার প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপ। অ্যাপলের বেশির ভাগ আইফোন এখনো চীনে তৈরি হয়। আর পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানিতে নতুন শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত।

ট্রাম্পের এই নীতির মূল লক্ষ্য আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো হলেও, এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে অ্যাপলের পণ্য দামে।

আমেরিকা-চীনের শুল্ক যুদ্ধ এবং এর প্রভাব  

চলতি মাসের শুরুতেই বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। পরে সেই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করলেও ফাঁড়া কাটেনি চীনের। দেশটির ওপর শুল্ক বাড়িয়ে বরং ১৪৫ শতাংশ করা হয়। তবে গত শুক্রবার চীনের ওপর আরোপ করা ওই শুল্ক থেকে কিছু প্রযুক্তিপণ্যকে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেয় হোয়াইট হাউস। লক্ষ্য – এই পণ্যগুলো ভোক্তাপর্যায়ে কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে পৌঁছানো।

চীন ও আমেরিকার পতাকা

যদিও তার ঠিক দু’দিন যেতে না যেতেই গত রোববার ট্রাম্প আবার বলেছেন, আগামী সপ্তাহে আমদানি করা সেমিকন্ডাক্টরের ওপর নতুন শুল্ক ঘোষণা করা হবে। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা থাকবে। এ ঘোষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, চীন থেকে আমদানি করা স্মার্টফোন ও কম্পিউটারের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়ার আগের সিদ্ধান্ত বেশি দিন টিকছে না। কারণ, এই প্রযুক্তিপণ্য তৈরির অন্যতম উপাদান সেমিকন্ডাক্টর।

এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমরা অন্যান্য কোম্পানি যারা প্রযুক্তিপণ্য তৈরি করে, তাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাই। কারণ, আমরা চাই আমাদের চিপ, সেমিকন্ডাক্টরসহ অন্যান্য প্রযুক্তিপণ্য দেশেই তৈরি হোক।’ স্মার্টফোনের মতো পণ্যগুলো আদৌ শুল্কমুক্ত থাকবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু এটুকু বলেছেন, ‘কেউ যেন অতিরিক্ত কঠোর না হয়, তাই একটু নমনীয়তা দেখাতে হয়।’ 

মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই কথায় ইতোমধ্যেই অনেকে আশার আলো দেখতে শুরু করলেও ট্রাম্পের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেছেন, চীনা প্রযুক্তিপণ্যের ওপর শুল্ক ছাড়ের বিষয়টি নতুনভাবে নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

তাই শুল্ক আরোপের কারণে আইফোনের দামে প্রভাব পড়বে কি-না তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে বিশ্লেষকরা। 

তবে বিশ্বজুড়ে এই অনিশ্চয়তার জন্য চীনকেই দায়ী করেছেন মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। সিবিএসের ‘ফেস দ্য নেশন’ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, চীনই পাল্টা শুল্ক আরোপ করে বাণিজ্য উত্তেজনা তৈরি করছে।

আইফোনের দামে সম্ভাব্য প্রভাব

অ্যাপল বছরে প্রায় ২২ কোটি আইফোন বিক্রি করে, যার প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপ। অ্যাপলের বেশির ভাগ আইফোন এখনো চীনে তৈরি হয়। আর পাল্টা শুল্ক আরোপের ফলে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য আমদানিতে নতুন শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত।

আইফোন

এই অতিরিক্ত খরচ অ্যাপল কীভাবে সমন্বয় করবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। অ্যাপল হয়তো খরচের কিছু অংশ নিজেরা বহন করতে পারে, কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, শুল্কের বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের উপরই চাপানো হবে।

 বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন ১৬ মডেলের সর্বনিম্ন দাম ৭৯৯ মার্কিন ডলার, যা নতুন শুল্কের কারণে ১ হাজার ১৪২ ডলারে পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া আইফোন ১৬ প্রো ম্যাক্সের দাম ১ হাজার ৫৯৯ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩০০ ডলার হতে পারে। অ্যাপল যদি ৪৩ শতাংশ শুল্ক ব্যয় ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে আইফোনের এই দাম হবে। 

রোজেনব্ল্যাট সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক বার্টন ক্রকেট বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, মার্কিন প্রতিষ্ঠান হিসেবে অ্যাপলকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে, কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। আমাদের হিসাব অনুসারে, ট্রাম্পের নতুন শুল্ক অ্যাপলের জন্য ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। 

আমদানি শুল্ক কি আইফোন বিক্রিতে প্রভাব ফেলবে? 

নতুন শুল্কের কারণে দাম বাড়বে কি না, সেটি নিয়ে অ্যাপল এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, অ্যাপলের পক্ষে ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি দাম বাড়ানো কঠিন হবে। 

তাদের মতে, অ্যাপল বড় কোনো মূল্যবৃদ্ধি করবে না অন্তত এই বছরের শরৎকাল পর্যন্ত, যখন আইফোন ১৭ বাজারে আসবে।

তবে পাল্টা মতামতও দিচ্ছেন অনেক গবেষক। কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের সহপ্রতিষ্ঠাতা নিল শাহের মতে, শুল্ক ক্ষতি পোষাতে অ্যাপলকে তাদের পণ্যের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে। এতে আইফোনের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে। সেই সুযোগে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যেতে পারে। তার কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর শুল্কের হার তুলনামূলক কম।

যা আইফোন উৎপাদক কোম্পানি ও ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অশনি সংকেত। 

আইফোনের দাম বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের উপর প্রভাব

ট্রাম্পের এই বিতর্কিত শুল্ক নীতি আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনতে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বাজারে যেখানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে সীমিত।

আন্তর্জাতিক বাজারে আইফোনের দাম বাড়লে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের আমদানিকারকদের বেশি দামে ফোন কিনতে হবে। এর সাথে যোগ হবে স্থানীয় শুল্ক ও কর। ফলে বাংলাদেশের বাজারেও আইফোনের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে। চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ কার্যকর হলে চীনে তৈরি ২৫৬ গিগাবাইট স্টোরেজের আইফোন ১৬ প্রো ম্যাক্সের দাম এক হাজার ১৯৯ ডলার থেকে বেড়ে এক হাজার ৯৯৯ ডলার হয়ে যেতে পারে।

অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় এই আইফোন মডেলের দাম হবে দুই লাখ ৪৩ হাজার টাকা, যা বাংলাদেশের যেকোনো উচ্চবিত্ত পরিবারের জন্যও রীতিমতো বড় অংকের টাকা। 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শুল্ক নীতি বাস্তবায়িত হলে তা আইফোনের দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা বাংলাদেশসহ বিশ্ব বাজারে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। 

ট্রাম্প প্রশাসনের স্বপ্ন অনুযায়ী, সামনে অ্যাপল যদি তাদের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের কারখানায় উৎপাদন করে, তাহলে দাম বহুগুণ বেড়ে যাবে। ‘মেইড ইন ইউএসএ’ আইফোনের দাম তিন হাজার ৫০০ ডলার বা চার লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো হতে পারে। 

তাই ভোক্তাদের সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে- হয় তাদেরকে উচ্চমূল্যের বিনিময়ে আইফোন কেনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে অথবা তাদেরকে বিকল্প ডিভাইসের দিকে মনযোগী হতে হবে। 

তথ্যসূত্র – 

Related posts

স্যাটেলাইটের আদ্যপ্রান্ত- ২০২৫ সালে মহাকাশে কত স্যাটেলাইট?

প্রতারকদের পছন্দ টেলিগ্রাম! কেন স্ক্যামাররা এই অ্যাপ ব্যবহার করে?

শেখ আহাদ আহসান

যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এআই(AI)

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More