Image default
কী ও কেন

পোপ নির্বাচনের রহস্যময় পদ্ধতি- পোপ ফ্রান্সিসের পর যেভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন পোপ

“পোপ সাড়া না পেলে একটি রূপার হাতুড়ি দিয়ে তাঁর কপালে আলতো করে ঠোকা দেওয়া হয় “

২০১৩ সালে যখন আর্জেন্টিনার এক জেসুইট পাদ্রী হঠাৎ করে ভ্যাটিকান সিটির পোপ হয়ে গেলেন, পৃথিবী তখন থমকে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেই ৮৮ বছর বয়সী পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে যেন আবার পৃথিবী কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছে। কারণ, এই মৃত্যু শুধুই একজন মানুষের বিদায় নয়, এটা ১.৩ বিলিয়ন ক্যাথলিক বিশ্বাসীর জন্য এক নতুন ইতিহাসের শুরু!

ভ্যাটিকান এখন নিঃশব্দ—.কিন্তু বিশ্বের প্রতিটি কোণায় কানে কানে ঘুরছে একটাই প্রশ্ন—“কে হবেন পরবর্তী পোপ? কিভাবেই বা নির্বাচিত হবে নতুন পোপ, আর কেন পোপ নির্বাচন হওয়ার বিষয়টি এমন গোপন? 

পোপের মৃত্যু নিশ্চিত হয় যেভাবে

পোপের মৃত্যু ক্যাথলিক চার্চের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক মুহূর্ত। পোপ মারা গেলে প্রথম যে কাজটি হয়, তা হলো তার মৃত্যু নিশ্চিত করা। আর এই দায়িত্ব থাকে ক্যামেরলেঙ্গো এর হাতে। ক্যামেরালেঙ্গো হলো এমন একজন ব্যক্তি যিনি পোপের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে পোপ দ্বারাই নিযুক্ত হন। তিনি প্রথমে পোপের কক্ষে গিয়ে পোপের নাম তিনবার উচ্চারণ করে ডাকেন। সাড়া না পেলে একটি রূপার হাতুড়ি দিয়ে পোপের কপালে আলতো করে ঠোকা দেন। 

আর তখনও যদি কোন সাড়া না পাওয়া যায় তবে তাঁকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করেন ক্যামেরলেঙ্গো। মৃত্যু নিশ্চিত করার পর ক্যামেরলেঙ্গো “সেডে ভ্যাকান্তে” (Sede Vacante) বা “সিংহাসন খালি” অবস্থা ঘোষণা করেন। এরপর শুরু হয় সেই রহস্যময়, ঐতিহ্যবাহী, প্রায় সিনেমার মতো নাটকীয় প্রক্রিয়া, প্যাপাল কনক্লেভ। 

পোপের মৃত্যু নিশ্চিত করতে যে রুপোর হাতুড়ি ব্যবহৃত হয়

কনক্লেভ হলো কার্ডিনাল বা বিশপদের একটি গোপন সভা। এই সভায় পোপ নির্বাচন করা হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য কার্ডিনালদের বয়স ৮০ বছরের নিচে হতে হবে। বর্তমানে ১৩৫ জন কার্ডিনাল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আর, এই ১৩৫ জনের মধ্যে ১০৯ জনকেই পোপ ফ্রান্সিস নিজে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

এখন কী হবে? 

কার্ডিনালরা পোপ নির্বাচনের জন্য সিক্রেট ব্যালটে ভোট প্রদান করেন। পোপ নির্বাচিত হতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেতে হয়। এই পুরো কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় ভ্যাটিকানের সিস্টিন চ্যাপেলে। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে দুইবার করে ভোট হয়। কেউ যদি দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পান, তবেই তিনি পোপ হন। 

পোপ নির্বাচনের জন্য বিশপদের মিটিং

কিন্তু ১৯৯৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল এই নিয়ম বদলে ফেলেন। নতুন নিয়মে সর্বোচ্চ ৩৪ রাউন্ডে ভোট গ্রহণের পরেও যদি ফল না আসে, তাহলে সরাসরি অর্ধেকের একটি ভোট যিনি বেশি পাবে, তিনিই হবেন পরবর্তী নির্বাচিত পোপ। আর এই নিয়মেই, ২০১৩ সালে ৫ রাউন্ড ভোটের পর নির্বাচিত হয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। 

কালো ধোঁয়া, সাদা ধোঁয়া: পোপ নির্বাচনের নাটক

তবে, এখানেই ঘটনা শেষ নয়। এই ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে বোঝাতে ঘটে আরেক অদ্ভুত ঘটনা। আর তা হলো চিমনির ধোঁয়া। এই চিমনির ধোঁয়া হলো আসলে একটি সংকেত। প্রতিবার ভোটের পর ব্যালট পুড়িয়ে চিমনিতে ধোঁয়া তোলা হয়। কালো ধোঁয়া মানে এখনও কেউ নির্বাচিত হননি। সাদা ধোঁয়া মানে, নতুন পোপ এসে গেছেন। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে ১৯৫৮ সালে ধোঁয়া ‘সাদা’ হওয়ার পরও, কার্ডিনালরা নতুন পোপের নাম ৪ দিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন । 

ভ্যাটিকান সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে সাদা ধোয়া  বের হচ্ছে

পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর নতুন পোপকেও নির্বাচিত হতে হবে ঠিক এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই। পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন উদারনৈতিক, তিনি পুরনো নিয়ম ভাঙতে কখনও ভয় পাননি। তবে, তার উত্তরসূরি কি আরও রক্ষণশীল হবেন? তিনিও কি ফ্রান্সিসের মতো সাহসী হবেন? বিশ্বের অনেকেই চাইবেন এমন একজন পোপ, যিনি জলবায়ু পরিবর্তন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী অধিকার বা যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আরও কড়া অবস্থান নেবেন। তবে এর বিপরীতে কেউ কেউ আবার এটাও চাইবেন যে নতুন পোপের মাধ্যমে গির্জা যেন আবার তাঁর পুরোনো রক্ষণশীল রুপে ফিরে আসেন। 

পোপ নির্বাচন কি রাজনীতিমুক্ত?

পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। আর তা হলো পোপ নির্বাচন কি রাজনীতিমুক্ত?

এই প্রশ্নটি শুনতে খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার মতো হলেও পৃথিবীজুড়ে এই প্রশ্নের অস্তিত্ব রয়েছে। আর এর উত্তর হলো, প্যাপাল নির্বাচনও আসলে একটা “আধ্যাত্মিক রাজনীতি”। কার্ডিনালরা পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব পরিস্থিতি, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, এমনকি মিডিয়ার প্রতিক্রিয়াও বিবেচনা করেন। 

পোপ জন পল

উদাহরণস্বরূপ, স্নায়ু যুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধের প্রতীক হিসেবে পোপ জন পল নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর পোপ ফ্রান্সিস এসেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন গির্জা যৌন কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ছিল। তাই সবাই ধারণা করছেন, এই মুহূর্তে নির্বাচিত নতুন পোপ হবেন হয়তো “উন্নয়নশীল বিশ্বের কণ্ঠস্বর” কিংবা বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।

কেবল ধর্ম নয়, ক্ষমতারও প্রশ্ন

তবে পোপ নির্বাচন কিন্তু শুধু ধর্মের বিষয় নয়। এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে ক্ষমতা। কারণ, ভ্যাটিকান রাষ্ট্রের প্রধান হল পোপ। বিশ্বের প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ক্যাথলিক খ্রিস্টানের ধর্মীয় অভিভাবক হওয়ার পাশাপাশি, তিনি কূটনৈতিকভাবে ১৮০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে ভ্যাটিকানের সম্পর্ক পরিচালনা করেন। এছাড়াও, পোপের দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিমালা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলে। 

এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা ভ্যাটিকানের বক্তব্য ও অবস্থানের দিকে নজর রাখে। কারণ, পোপের বক্তব্য অনেক সময় কোটি কোটি মানুষের মত ও মনোভাবকে প্রভাবিত করে, যা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও প্রতিফলিত হয়।

পোপ ফ্রান্সিস এর উত্তরসূরি কে হবেন

পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন সাধারণ মানুষের পক্ষে কাজ করা, সমাজের সকল শ্রেণির প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারক-বাহক। আর পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক ধর্মে নানা পরিবর্তন আসছে, একজন নতুন পোপের ভূমিকা হবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এখন দেখার বিষয় তাঁর পরবর্তী পোপও কি সেই মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখবেন, নাকি গির্জার পুরনো ঐতিহ্যকেই অনুসরণ করবেন?

 রেফারেন্স লিঙ্কঃ 

 

Related posts

পিলের বোতল কেন কমলা রঙের হয়?

আবু সালেহ পিয়ার

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More