‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’- বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী এক বিশেষ অভিযান। সম্প্রতি, গাজীপুরসহ সারা দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর থেকে, সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর আগেও বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন সরকার বিশেষ সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশন চালিয়েছেন।
এই লেখায় আমরা জানবো এই অপারেশন ডেভিল হান্ট কী, এই অপারেশনের ফলে কী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে এবং পূর্ববর্তী অপারেশনগুলোর সম্পর্কে নানা জানা অজানা তথ্য।
অপারেশন ডেভিল হান্ট
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তা যেন এক গভীর সংকটের দিকে এগোচ্ছে। বিশেষ করে যখন দেশজুড়ে চলছে সহিংসতা, তখন ইউনুস সরকারের কাছেও এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে । এবং এসব সহিংসতার ঘটনাগুলো যেন থামছেই না।
ডেভিল হান্টের প্রেক্ষাপট- ধানমণ্ডি ৩২ ভাঙচুর ও শেখ হাসিনার ভাষণ
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে, ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা হওয়ার পর থেকেই, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে। শেখ হাসিনার ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই বিক্ষোভে ছাত্ররা বিভিন্ন সরকারি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি এবং স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর পরপরই এটি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, এবং বিশাল এক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনার আগেই ছাত্র নেতা হাসনাত ফেবসুকে একটি উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়েছিলেন। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ফ্যাসিবাদীদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে বাংলাদেশ’। এই উস্কানির ফলেই মূলত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
দুই দিন ধরে চলা এসব সহিংসতায় আক্রমণ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ফলে সরকারের নিস্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল ‘বিএনপি’ উদ্বেগ প্রকাশ করে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে পড়লে, গাজীপুরে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটার পর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সমন্বয়ে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।
অপারেশন ডেভিল হান্ট
অপারেশন ডেভিল হান্টের আওতায় যৌথ বাহিনী, সেনাবাহিনী, র্যাব এবং পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন এলাকা টহল শুরু করেন এবং হামলাকারীদের ধরতে তৎপর হন। অপারেশন ডেভিল হান্ট চলাকালীন বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসীদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে গাজীপুরে ১৫ জনকে আটক করা হয় এবং ফার্মগেটে তিনটি ককটেল উদ্ধার করা হয়, যা মূলত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া, বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ির সামনের সুরক্ষা বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
চলমান, অপারেশন ডেভিল হান্টের ফলাফল এখন পর্যন্ত বোঝা মুশকিল। কিছু এলাকায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও অন্যান্য স্থানে সহিংসতা এখনো থামেনি। এই সব হামলার পিছনে কারা আছে? ইউনুস সরকার কি ইচ্ছে করেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনছে না? এখন এই সব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে।
বাংলাদেশে এমন সেনা অভিযান নতুন নয়। এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান সম্পন্ন করেছে। দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অভিযানগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ পর্যায়ে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, এই সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানগুলো কেমন ছিল।
অপারেশন ক্লিন হার্ট
বাংলাদেশের এক অন্যতম বিতর্কিত ও গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান ছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’। ২০০২ সালের কথা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের উদ্যোগে শুরু হয় এই যৌথ অভিযান।
এই সময়ে, ৫০,০০০ এরও বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য দেশজুড়ে অভিযান চালিয়েছিলেন। অভিযানে ১১,২৪৫ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং শত শত মানুষ আহত হয়, এর মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি মারা যান। ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল একটি ক্ষতিপূরণমূলক আইন পাস করে, যা অভিযানে অংশগ্রহণকারী নিরাপত্তা কর্মীদের আইনি সুরক্ষা প্রদান করেছিল। তবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট এই আইনটিকে অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করে দেয়।
অপারেশন থান্ডারবোল্ট- হলি আর্টিজানে জিম্মি উদ্ধার
২০১৬ সালের পহেলা জুলাই গুলশান-২ এর হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ঘটে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জিম্মি সংকট। দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ব্যর্থ হলে, প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করতে নির্দেশ দেন।
রাতে সেনাবাহিনী, প্যারা-কমান্ডো বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান শুরু করে। ২রা জুলাই শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয় অপারেশন। ১৩ মিনিটের মধ্যে ৬ জঙ্গি নিহত হয় এবং সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ১৫ ঘণ্টার জিম্মি সংকট সফলভাবে শেষ হয়।
অপারেশন টোয়াইলাইট
তারই ঠিক এক বছর পর, ২০১৭ সালে পরিচালিত হয় আরেকটি জঙ্গি অভিযান ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’। সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গি আস্তানার বিরুদ্ধে পরিচালিত অপারেশন টোয়াইলাইট ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান। আতিয়া মহলটি ছিল একটি ৭ তলা ভবন, যেখানে বেশ কয়েকজন জঙ্গি আশ্রয় নিয়েছিল এবং তারা দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল।
অপারেশনটি শুরু হয় ২৫ মার্চ, যখন সেনাবাহিনী, র্যাব এবং পুলিশের যৌথ দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। অভিযানের শুরুতে জঙ্গিরা সেনা বাহিনীর উপর হামলা চালায়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরোধ করে। অভিযানে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো বাহিনী বিশেষভাবে অংশ নেয়। ভবনের ভিতরে সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি ও অবস্থান সনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রযুক্তি ও বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। অভিযানে ৬ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়, এবং ২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও আহত হন। এই অভিযানটি ছিল সম্পূর্ণ সফল এবং এরই মাধ্যমে ২৫ মার্চের মধ্যে পুরো এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নির্মূল করা হয়।
এই সন্ত্রাস বিরোধী অপারেশনগুলো সফল হলেও, বর্তমান পরিস্থিতি, অপারেশন ডেভিল হান্টের কার্যকারিতা এবং উদ্দেশ্য, সবকিছুই একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার কি সহিংসতা থামানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে, নাকি এটি আরও একটি রাজনৈতিক কৌশল? এটাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের ইতিহাসে পূর্ববর্তী সেনাবাহিনী অভিযানের মতো, এবারের অপারেশন ডেভিল হান্টও সফল হোক। দেশের অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা থেকে মুক্ত হয়ে শান্তি ও সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক।
সোর্স
https://www.kalerkantho.com/online/national/2025/02/08/1478367