বাংলাদেশে নারীবাদ বা ফেমিনিজম নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই একে পুরুষ বিদ্বেষ বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু নারীবাদ মানে কি আসলেই পুরুষ বিদ্বেষ? নাকি আমরা নিজেরাই নারীবাদের প্রকৃত অর্থ ভুলে গেছি?
“নারীবাদ” শব্দটা আজকাল যতটা আলোচনার, ততটাই বিতর্কের। কেউ এটাকে মুক্তির ডাক মনে করেন, কেউ আবার এই শব্দ শুনলেই কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়েন। । কেউ বলেন, “এরা তো পুরুষদের ঘৃণা করে!”, আবার কেউ বলেন, “নারীবাদীদের আসল উদ্দেশ্য নাকি পরিবার ধ্বংস করা!” ,কেউ বা বলেন, “এরা তো ছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরবে, ছোট চুল রাখবে, সিগারেট খাবে”। সত্যিটা কী?
আমরা কি আদৌ জানি, নারীবাদ আসলে কেন এসেছিল, কী চেয়েছিল, আর আজ কেন এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে? চলুন একটু গভীরে যাই, প্রশ্ন তুলি—আমরা কি সত্যিই নারীবাদের প্রকৃত অর্থ জানি?
নারীবাদ (Feminism) হলো এমন একটি চিন্তাধারা এবং আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য ছিল নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমতা আনা। অর্থাৎ নারীবাদের গোড়ার কথা ছিল—নারীও মানুষ। নারীবাদ চেয়েছিল এমন এক সমাজ, যেখানে নারীদের কোনো বৈষম্য ছাড়াই নিজেদের মতামত প্রকাশ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং স্বপ্নপূরণের স্বাধীনতা থাকবে।
নারীবাদ কখনোই বলেনি, নারীকে পুরুষের ওপরে রাখতে হবে। বরং বলেছে—পুরুষ আর নারীর মধ্যে মর্যাদা, সুযোগ আর অধিকার সমান হওয়া উচিত।
অনেকে বলে নারীবাদ মানে নাকি পুরুষদেরকে আবর্জনা মনে করা!! কিন্তু আসলে সত্যিটা হল, নারীবাদ পুরুষদের আবর্জনার মতো বিবেচনা করে না, বরং সমাজের কিছু পুরুষের এমন ‘আবর্জনার মতো কাজগুলো’ তুলে ধরে যা নারীর অবমাননা বাড়ায়। নারীবাদ চায় সমাজে যে ভুল নিয়মগুলো নারীদের পিছিয়ে রাখে, সেগুলো পরিবর্তন হোক, কারো উপরে অন্যায় ভাবে যেন শাসন করা না হয়, বরং সবাই যেন সমান সুযোগ পায় ।
নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাস বাংলাদেশে
বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় উপমহাদেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের ভেতরে। তবে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রতিবাদের মাধ্যমে নয়, বরং প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে। ব্রিটিশ আমলের সময় থেকেই নারীর অধিকার ও শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে বেগম রোকেয়ার নামটি এই আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি ছিলেন প্রথম নারী যিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাই তাকেই বলা যায় নারীবাদী আন্দোলনের গোড়ার ধাপ। এরপর পাকিস্তান আমলে সুফিয়া কামাল, হালিমা খাতুন, কাজী আফসারুন্নেসা প্রমুখ সমাজে নারী অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেন।
তবে স্বাধীনতার পরেই বাংলাদেশের নারীবাদী আন্দোলন নতুন রূপ নেয়। সেই ৮০’র দশকে যখন নারী নির্যাতনের বিচার হতো না, তখন “মহিলা পরিষদ” কিংবা “নারীপক্ষ” দাঁড়িয়েছিল ধর্ষণের বিরুদ্ধে। যে সময় নারীদেরকে বলা হতো, “তোমার কাজ শুধু স্বামীর পেছনে ছায়ার মতো থাকা,” তখনই তারা বলেছিলেন “নারীর নিজেরও একটি পরিচয় আছে।”
মূলত এই আন্দোলনের ফলে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন। যেমন- যৌতুকবিরোধী আইন, নারী নির্যাতন দমন আইন, কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা।
আধুনিক নারীবাদ ও বাস্তবতা
আজকের যুগে নারীবাদ অনেক বেশি উচ্চারিত হচ্ছে; বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে। নারীবাদ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা। এটি বিশ্বজুড়ে একটি সংবেদনশীল বিষয়। কারণ অতীতে ধর্ষণের ধারণা ছিল প্রায় অস্তিত্বহীন। ধর্ষণকে ধর্ষণ মনে করা হতো না। ধর্ষণ মানে ছিল, একজন নারী ‘চেয়েছিল’ বলেই তার সাথে এমনটা হয়েছে। এটা ছিল লজ্জার বিষয় এবং নির্যাতিত নারীদেরই দোষারোপ করা হতো। তখন ধর্ষণের বিষয়টি আলোচনা করার মতো কোনো বিষয় ছিল না।
সম্প্রতি, #MeToo-এর মতো আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ তাদের যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। যার ফলে এখন এটি আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ্যে আলোচিত একটি বিষয়।
অনেক নারী মুখ খুলেছেন এবং অভিযোগ করেছেন। কিন্তু খুব আশ্চর্যজনক ভাবে এর প্রতিক্রিয়ায় এমন মন্তব্য এসেছে যে- “সে মিথ্যা বলছে”, “এতদিন পর কেন এখন বলছে?”, “সে একজন নিরীহ পুরুষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে”, “সে কী পরেছিল?”, “সে মাতাল ছিল ঠিকই, কিন্তু সে সম্মতি দিয়েছে তাই এটা ধর্ষণ নয়”। এই তালিকা চলতেই থাকে।
অনেকে আবার অভিযোগ করেন, আজকের নারীবাদ কেন যেন কেবল শহুরের মধ্যবিত্ত মেয়েদের নিয়েই ব্যস্ত। যেসব নারীরা রিকশা টানেন, যারা গার্মেন্টসে কাজ করে সংসার চালান, তাদের কণ্ঠ কি শোনা যাচ্ছে এই নারীবাদে?
আরেকদিকে কিছু চরমপন্থী কণ্ঠ নারীবাদের নামে এমন কথাবার্তা বলেন, যেন পুরুষ মানেই শত্রু। অথচ নারীবাদ কখনোই এমনটা বলেনি। সত্যিকারের নারীবাদ তো বলে—পুরুষও এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একধরনের ‘বন্দি’। তাকেও শিখানো হয়,“তুমি কাঁদতে পারবে না, দুর্বল হতে পারবে না।” এটা কি মানবিক? তাহলে কেন বারবার নারীবাদের কথায় পুরুষদেরকে ছোট করে দেখা হয়?
এই সমাজে যেমন নারীরা নিজেদের স্বপ্ন, স্বাধীনতা ও মত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি পুরুষের মানবিক দিককেও আটকে রাখা হয় “মাচো” সংস্কৃতির চাপে। তাই নারীবাদ শুধু নারীর মুক্তির কথা নয়, এটি একটি সামগ্রিক মানবিক মুক্তির ধারণা বহন করে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, অনেক সময় নারীবাদের ভাষ্যে পুরুষদেরকে ছোট করে দেখানো হয় কিংবা নারীবাদকে পুরুষ-বিরোধী একটি তকমা দেওয়া হয়। এর ফলে সমাজে নারীবাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়, এবং প্রকৃত পরিবর্তনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
নারীবাদ কীভাবে সমাজ বদলাতে চেয়েছিল
নারীবাদ কখনোই শুধু আইনি সংস্কার চায়নি; এটি চেয়েছিল সমাজকে ভিতর থেকে তার চেতনা, মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে বদলাতে। এটি চেয়েছিল, যেন একজন নারীকে কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যের দিক থেকে মূল্যায়ণ না করে, বরং মানুষ হিসেবে তার চিন্তা, অনুভব, শ্রম ও সিদ্ধান্তকে সম্মান দেওয়া হোক।
নারীবাদ বলতে চেয়েছিল, নারী যেন পুতুল নয়, মানুষ হয়। সে যেন নিজের জীবনের কর্তৃত্ব নিজেই নিতে পারে। তার পছন্দ-অপছন্দ, শিক্ষা, পেশা, পরিবার—সবকিছুতে যেন তার মতামত গুরুত্ব পায়। গৃহকর্ম, যা এতদিন নারীসুলভ দায়িত্ব হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে, সেটাকে যেন সম্মানজনক শ্রম হিসেবে দেখা হয়। কারণ এই ঘরের কাজ না থাকলে সমাজ-অর্থনীতি কিছুই টিকবে না।
নারীবাদ আরও বলেছে, মেয়ে শিশু যেন পরিবারের বোঝা না হয়ে ওঠে। তাকে যেন জন্ম থেকেই “কম দামে বিয়ে দিতে হবে” এই মনোভাব দিয়ে বিচার না করা হয়। মেয়েরাও যে স্বপ্ন দেখতে পারে, বড় হতে পারে, সমাজে নেতৃত্ব দিতে পারে।
একজন নারী বসে আছে আর চার পাশে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্যের ছবি
এই চাওয়াগুলো কি অন্যায়? না, বরং এই চাওয়াগুলো একটি মানবিক সমাজের ভিত্তি। যেখানে মানুষ তার জন্ম নয়, তার গুণ, মেধা ও মর্যাদায় বিচার পাবে। নারীবাদ মানে পুরুষদের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়, বরং এমন একটি সমাজ গঠন করা, যেখানে পুরুষ ও নারী উভয়েই আবেগ, স্বাধীনতা ও সম্ভাবনার জায়গা থেকে বাঁচতে পারে।
তাহলে কেন এখন নারীবাদকে নিয়ে এত নেতিবাচক ধারণা?
প্রথমত, কিছু চরমপন্থী কণ্ঠ নারীবাদকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন এটি পুরুষদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধমূলক আন্দোলন। তারা নারীর স্বাধীনতাকে শুধুমাত্র পুরুষদের দোষারোপ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন, অথচ এটি আসল নারীবাদের লক্ষ্য নয়।
আবার, অনেকেই নারীবাদের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিষ্কার নন। তাদের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে যে নারীবাদ মানেই বিয়ের বিরোধিতা, পরিবার ভাঙন, কিংবা ধর্মবিরোধিতা—যা সম্পূর্ণ ভুল এবং ভ্রান্ত একটি দৃষ্টিভঙ্গি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায়ই কিছু অতিরঞ্জিত বা একপাক্ষিক নারীবাদী বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে নারীবাদ সম্পর্কে নেতিবাচক ও বিভ্রান্তিকর ধারণা তৈরি করে। তার উপর, আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বললেই অনেক সময় তা “বিদ্রোহ” বা “অপরাধ” হিসেবে বিবেচিত হয়।
সত্যি বলতে গেলে, কিছু জায়গায় হয়তো নারীবাদ তার মূল উদ্দেশ্য থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বা অপব্যবহারের কারণে কি গোটা আন্দোলনকেই বাতিল করে দেওয়া উচিত? আমরা যেমন ধর্মের নামে কট্টরপন্থা দেখলেই ধর্মকে অস্বীকার করি না, তেমনি নারীবাদকেও কিছু চরমপন্থীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করা উচিত নয়।
আজকের সমাজে নারীবাদ কতটা প্রয়োজনীয়?
আমি যদি চোখ বুজে সত্যিটা মেনে নিই; তবে বলতে বাধ্য হতে হয়, নারীবাদ আজও প্রয়োজনীয়। বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। কারণ, আজও মেয়েদের প্রায় শুনতে হয়; “তুমি তো মেয়ে, বেশি উচ্চস্বরে কথা বলো না।” “তুমি তো মেয়ে, এত রাতে বাইরে যাও কেন?”। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার আগে মেধা তালিকায় থাকা মেয়েটিকেও পরিবার মনে করিয়ে দেয়; “এখন তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এবার পড়াশোনা কমাও।” কর্মক্ষেত্রে একজন নারী যখন পুরুষ সহকর্মীদের চেয়েও বেশি দক্ষতা দেখান, তখনও তাকে প্রমাণ করতে হয়; সে ‘পুরুষের মতোই’ যোগ্য।
নারীবাদের পুরুষবিরোধী ভাবার চর্চা হঠাৎ করেই হয়তো চলে যাবে না। কারণ, পুরুষের মতো সমান অধিকার পেতে হলে সমাজে পিতৃতান্ত্রিকতার ভিতে যেভাবে আঘাত করা দরকার, যেভাবে লড়াই করা দরকার সেটি খুব শিগগিরই আসবে না। সেজন্যই এসব প্রচলিত ধারণাগুলো থাকবে।
তবে শেষ কথাটাও বেশ সোজা—নারীবাদ মানে নারীকে মানুষ ভাবা। এটা পুরুষবিরোধিতা নয়, পরিবারবিরোধিতা নয়, কিংবা ধর্মবিরোধিতা নয়। নারীবাদ মানে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, ন্যায়ের পাশে থাকা। আজ আমরা যখন বলি— “নারীবাদীরা তো শুধু শোরগোল করে!” তখন আমাদের একবার ইতিহাসের দিকে তাকানো উচিত। এই ‘শোরগোল’ করার সাহসটুকুই তো আমাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছে। এই ‘নারীবাদ’ই তো নারীকে ঘরের বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চে জায়গা করে দিয়েছে।
তথ্যসূত্র
- https://www.girlsglobe.org/2018/12/06/have-we-forgotten-what-feminism-really-means/
- https://bn.quora.com/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%A7%E0%A7%80-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF
- https://anannya.com.bd/article/27611