‘হাসি মুখে শ্বাসরোধ’ কথাটা হয়তো আগে অনেকেই শুনেছেন। আজকের ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেন একদম সেই কথাটার বাস্তব রূপ। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক একসময় ছিলো ‘বন্ধুত্বের রোল মডেল’। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের মনে প্রশ্ন তুলছে ভারত কি আদোতে আমাদের বন্ধু, নাকি কৌশলী প্রতিদ্বন্দ্বী?
বাংলাদেশের ক্ষমতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর থেকেই একে একে সামনে আসছে ভারতের এমন সব কৌশলী পদক্ষেপ যেগুলো শুনলে মনে প্রশ্ন জাগবেই যে, প্রতিবেশী দেশটি কি আসলেই আমাদের মঙ্গল চায় নাকি তাদের চাহিদা অন্যকিছু?
এরই মধ্যে ভারত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাঁর মধ্যে আলোচিত হলো ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, সীমান্তে প্রতিরক্ষা জোরদার, বিশেষ করে চিকেন নেক এলাকায় রাশিয়ান S-400 মোতায়েন, সেভেন সিস্টার্স রুটের রেল প্রকল্প স্থগিত, এবং তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তা। এমন নানারকম সিদ্ধান্ত মিলে স্পষ্ট হচ্ছে, ভারত তাদের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলে বড় রকমের পরিবর্তন এনেছে।
তবে, এই পরিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশও বসে নেই। পাল্টাপাল্টি অবস্থান এখন চোখে পড়ছে দুই দেশের নীতিতেই। এ থেকেই ভারত-বাংলাদেশ কি আসলেই বাণিজ্য যুদ্ধ চালাচ্ছে? এতে উপকার আসলে কার? ক্ষতিই বা কার বেশি?—এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে নানা বিশ্লেষণে। কীভাবে একের পর এক পাল্টাপাল্টি সিদ্ধান্ত বদলে দিচ্ছে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের চেহারা?
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা
প্রথমত, ভারত বাংলাদেশকে দেয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এই ট্রান্সশিপমেন্ট ছিলো বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুবিধা, কিন্তু এখন সেই পথ বন্ধ। এতোদিন বাংলাদেশী পণ্য ভারতীয় বন্দরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, নেপাল ও ভুটানের মতো তৃতীয় কোন দেশে পাঠানো হতো। কিন্তু হঠাৎ করে ভারত জানিয়েছে, তাদের বন্দরে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে, তাই তারা বাংলাদেশকে আর এই সুবিধা আর দেবে না।
২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাটি চালু ছিল এবং তা বাংলাদেশের গার্মেন্টস, ঔষধ, আইটি পণ্যসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ব্যবসা ও বাণিজ্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, কারণ ভারতীয় বন্দর ব্যবহার না করার কারণে অনেক পণ্যের জন্য নতুন রুট খুঁজতে হবে। এর ফলে সময় এবং খরচ উভয় দিক থেকেই বৃদ্ধি পাবে।
ভারতের উদ্দেশ্য এখানে একেবারে স্পষ্ট, বাংলাদেশের রপ্তানিকে ব্যাহত করে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলা। ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার ফলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বড় ধরনের আর্থিক ধাক্কায় পড়তে চলেছে। প্রাথমিক হিসাব বলছে, এই সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ব্যয় হতে পারে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা।
শুধু তাই নয়, পণ্য পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের উপর আস্থার জায়গা কমে যেতে পারে। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পরিচিতি ও পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাহত হবে। উদ্দেশ্য একটাই বাংলাদেশকে চাপে রাখা, এবং রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেওয়া।
গার্মেন্টস খাতে ভারতীয় আগ্রাসন
ভারতের বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে ধাপে ধাপে। একটা সময় ভারত কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। বিশেষ করে, গার্মেন্টস খাতকে টার্গেট করে তারা বাংলাদেশের চাল, সুতা ও কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
’সুতা’ বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের প্রাণ। আর এই সুতার একটি বড় অংশ বাংলাদেশ ভারত থেকেই আমদানি করে। এদিকে এখন ভারত সস্তায় সুতা পাঠাতে শুরু করেছে, যাতে বাংলাদেশের স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে। যার ফলাফল বাংলাদেশের প্রায় ৪৫০০টি টেক্সটাইল মিলের মধ্যে অন্তত ৩০% মিল তাদের উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবেই দেশের স্থানীয় শিল্প ধ্বংস করে ভারতীয় সুতা নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশের। তবে এই চালকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলাদেশ এখন ভারতের থেকে সূতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে এবং দেশীয় তৈরি সূতার উপর নির্ভরতা বাড়ানোর দিকে মনযোগ দিয়েছে।
তিস্তা ও রেল প্রকল্প
ভারত এখানেই থেমে থাকেনি। তিস্তা নদী নিয়ে বছরের পর বছর ধরে তারা চালিয়ে যাচ্ছে এক ‘কূটনৈতিক নাটক’। বারবার আলোচনা, প্রতিশ্রুতি, সম্মেলন কিন্তু বাস্তবতা শূন্য। তারপর, আরেক নতুন কৌশল ধর্মীয় ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা। ভারতীয় মিডিয়া সরব হয়ে প্রচার করতে থাকে, বাংলাদেশ নাকি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব রেল সংযোগ প্রকল্প নিয়ে কাজ চলছিল, তার অনেকগুলোই এখন স্থগিত হয়ে গেছে। ভারত প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপির রেল প্রকল্পের অর্থায়ন ও নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়াও, বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় অর্থায়নে যেসব রেল প্রকল্প চলছিল, তার অনেকগুলোরই অগ্রগতি খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। যেমন, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্পটি বেশ কয়েক বছর আগে শুরু হলেও এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
চিকেন নেক নিয়ে নতুন কৌশল
এদিকে, চিকেনস নেক নিয়ে ভারত চাল দিয়েছে নতুন কৌশলে। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা এই কৌশলগত এলাকা দিয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো যুক্ত। আর তাই এবার ভারত সেখানে মোতায়েন করেছে রাশিয়া থেকে আনা আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা S-400। শুধু এই এলাকাই নয়, সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলও এসেছে প্রতিরক্ষার আওতায়।
এই পদক্ষেপ ঘিরেও উঠছে নানা প্রশ্ন। অনেকেই মনে করছেন, চীনের উপদেষ্টারা সম্প্রতি সেভেন সিস্টার্স নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা থেকে ভারত ধারণা করছে বাংলাদেশ হয়তো চীনের সহায়তায় ওই অঞ্চলে কোনো সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের দিকে যাচ্ছে। এমন সম্ভাবনার কথা ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোও তুলছে। ফলে বিষয়টি কেবল প্রতিরক্ষা নয়, বরং গভীর কূটনৈতিক সন্দেহ ও ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই সব ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, একদিকে ভারত বাংলাদেশে তাদের রেল প্রকল্প স্থগিত করেছে, অন্যদিকে সীমান্তে প্রতিরক্ষা বাড়াচ্ছে। এর পাশাপাশি ভারত এখন নেপাল ও ভুটান হয়ে নতুন রেলপথ তৈরির কথা ভাবছে। সব মিলে এটা স্পষ্ট, ভারত এখন বাংলাদেশকে ঘিরে তাদের পরিকল্পনায় কিছু বড় পরিবর্তন আনছে। এতে দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা চাপের মধ্যে পড়তে পারে।
এখানেই শেষ নয়। কাস্টমস ও বন্দর ব্যবস্থায় পরিকল্পিতভাবে জটলা তৈরি করে বাংলাদেশের পণ্য আটকে রাখা; আবার হঠাৎ করেই পেঁয়াজ, ডাল, চিনি রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে ভারত বাংলাদেশের উপর এক ধরনের ‘রিমোট কন্ট্রোল বাণিজ্যনীতি’ চালানোর পাইতারা করে যাচ্ছে বহু বছর ধরে।
বাংলাদেশ-ভারত: কে কতটা লাভবান
তবে, এসব সিদ্ধান্তের ফলে ভারত ঠিক কতটা লাভবান হচ্ছে এটিও একটি দেখার বিষয়। কারণ, ভারতের দিক থেকে আসা এসব সিদ্ধান্ত যে একতরফাভাবে লাভজনক হচ্ছে, এ কথাও বলা যায় না। বাংলাদেশের বিকল্প পথ খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেলে ভারত তাদের বন্দর রাজস্ব হারাবে। এর পাশাপাশি এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বাণিজ্যিক অংশীদারও হারাতে পারে।
ভূরাজনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলেও, বাংলাদেশ আজ এককেন্দ্রিক নীতিতে আবদ্ধ নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের ইঙ্গিত, চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সমন্বয় এবং সৌদি বিনিয়োগ প্রবাহ সব মিলিয়ে ভারতকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ এখন আর কারো মুখাপেক্ষী নয়।
সোজা কথা হচ্ছে, ভারত এখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত নিছক কোনও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে সুস্পষ্ট ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। ভারত বুঝে গেছে, বাংলাদেশের বাজার এখন আর তাদের একচেটিয়া খামারবাড়ি নেই। তবে, শেষমেশ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায়, সেটা এখন সময়ই বলে দেবে। ভারতের নেওয়া এই সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের জন্য শুধু বড় ধাক্কা নয়, বরং হতে পারে এক নতুন বাস্তবতার সূচনা।
রেফারেন্স
- https://www.youtube.com/watch?v=6lwDNnyAP5k
- https://youtu.be/KpavIPVscKs?si=eJX4L-wKmBxJp_QH
- https://www.bbc.com/bengali/articles/c793342yz0ro
- https://www.deltatimes24.com/news/147928
- https://www.deshrupantor.com/587473/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B8-%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B2-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%97%E0%A6%BF%E0%A6%A4